দলের ভারসাম্য রক্ষা কিংবা পারফর্মেন্স গ্রাফ উর্ধ্বমুখী করার জন্য দলবদলের বাজার বড় ভূমিকা পালন করে। দলবদলে ভালো কিছু সিদ্ধান্ত একটি ক্লাবের পারফর্মেন্সে বড়সড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আবার কিছু খারাপ সিদ্ধান্ত একটি ক্লাবের পুরো মৌসুমকেই এলোমেলো করে দিতে পারে। ২০১৮ সালের দলবলদলের বাজারের কথা যদি বলি, তাহলে সফল দলবদলের সংখ্যাই হয়তো বেশি হবে। অ্যালিসন কিংবা ভ্যান ডাইকের মতো খেলোয়াড়দের দলে ভিড়িয়ে লিভারপুলের সেই চিরচেনা ভাঙাচোরা রক্ষণভাগ যেন আমূল পাল্টে গেছে। এক লুকাস টোরেইরাকে কিনে আর্সেনালের পারফর্মেন্সে ব্যাপক উন্নতি এসেছে।
তবে এর বিপরীত চিত্রও আছে, বেশ কিছু ক্লাব মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করেও সাফল্য পায়নি। আবার কিছু দলবদলের ফলে কিছু খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারই হুট করে থমকে গেছে। আজ আমরা ২০১৮ সালে উল্লেখযোগ্য হতাশাজনক দলবদলগুলো নিয়েই আলোচনা করবো।
অ্যালেক্সিস সানচেজ (আর্সেনাল থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
এ বছরের জানুয়ারিতে শীতকালীন দলবদলে আর্সেনাল থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমান চিলিয়ান ফরোয়ার্ড অ্যালেক্সিজ সানচেজ, বিনিময়ে রেড ডেভিলদের আর্মেনিয়ান মিডফিল্ডার হেনরিখ মিখিতারিয়ান চলে যান আর্সেনালে। আর্সেনালের জার্সিতে সানচেজের পারফর্মেন্স বেশ ভালো ছিল। তাই সপ্তাহে চার লক্ষ পাউন্ড মোটা অঙ্কের বেতন দিয়েই সানচেজকে দলে ভিড়িয়েছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশার সিকিভাগও পূরণ করতে পারেননি তিনি।
এখন পর্যন্ত রেড ডেভিলদের হয়ে ২২ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন মোটে ৩টি। সানচেজের পারফর্মেন্স এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে রেড ডেভিলদের মূল একাদশেই তার জায়গা পাওয়াটা দুরূহ হয়ে গেছে। এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ১৭ ম্যাচের মধ্যে মাত্র পাঁচটি ম্যাচ মূল একাদশে থেকে শুরু করেছেন তিনি। এমন পারফর্মেন্সের পর তার মোটা অঙ্কের বেতন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকেরা।
দিয়েগো কস্তা (চেলসি থেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ)
চেলসির তৎকালীন কোচ অ্যান্টনিও কন্তের সাথে বিবাদে জড়ানোর পর থেকেই নিজের পুরনো ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ফেরার জন্য মুখিয়ে ছিলেন দিয়েগো কস্তা। এই স্প্যানিশ স্ট্রাইকার তার পুরনো ক্লাবে ফিরে যেতে এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে, ২০১৭ সালের শেষার্ধ পুরোটা বেঞ্চে কাটিয়েছেন, যাতে তিনি তার পুরনো ক্লাবে ফিরতে পারেন। শেষপর্যন্ত ২০১৮ সালের শীতকালীন দলবদলের শুরুতেই ৫৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসি থেকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে ফিরে আসেন দিয়েগো কস্তা।
ফিরে আসার পর প্রথমদিকে কস্তার পারফর্মেন্স ভালোই ছিল, কিন্তু এই মৌসুমে তার পারফর্মেন্স ভীষণ বিবর্ণ। এই মৌসুমে লিগে ১১ ম্যাচ মূল একাদশে শুরু করে গোল করেছেন মোটে একটি! আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তিনটি ম্যাচ খেলে সেখানেও গোল করেছেন একটি। সবমিলিয়ে যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে ৫৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে কস্তাকে ফিরিয়ে এনে ভুলই করে ফেলেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ।
ফ্রেড (শাখতার দোনেৎস্ক থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
এ বছরের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ইউক্রেনের ক্লাব শাখতার দোনেৎস্ক থেকে ৫২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার ফ্রেড। রক্ষণভাগে সাহায্য করার সাথে দারুণ টেকনিক্যাল দক্ষতা– সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো ফ্রেডের আগমন বুঝি রেড ডেভিলদের নাজুক মাঝমাঠকে কিছুটা হলেও শক্তিশালী করবে।
কিন্তু সেটা হয়নি, দলের সাথে মানিয়ে নিতে না পারায় এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র আটটি ম্যাচ খেলেছেন এই ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার। সানচেজ আর ফ্রেডের মতো বিগ সাইনিংগুলো ব্যর্থ হওয়ায় এই মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পারফর্মেন্সও ভীষণ ছন্নছাড়া।
ম্যালকম (বোর্দো থেকে বার্সেলোনা)
সানচেজ কিংবা ফ্রেড এই তালিকায় এসেছেন তাদের খারাপ পারফর্মেন্সের কারণে। তবে এই তালিকায় এমন একজনও আছেন যিনি নতুন ক্লাবে পারফর্ম করার সুযোগই পাচ্ছেন না। তিনি ব্রাজিলের উদীয়মান উইঙ্গার ম্যালকম। বোর্দোতে শেষ দুই মৌসুম অসাধারণ সময় পার করায় এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে ম্যালকমের প্রতি বেশ কয়েকটি ক্লাব আগ্রহী ছিল। একপর্যায়ে রোমা তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ম্যালকমকে দলে ভেড়ানোর কথা ঘোষণাও করে দিয়েছিলো।
কিন্তু তখনই নাটকীয় কিছু ঘটনায় রোমার বদলে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যালকম। এই দলবদলে বার্সেলোনাকে প্রায় ৪১ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হয়। তবে এত জল ঘোলা করে রোমার বদলে বার্সেলোনাকে বেছে নিয়ে হয়তো বড়সড় ভুলই করে ফেলেছেন এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি ম্যাচে মূল একাদশে থেকে শুরু করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। যদিও এই অল্প সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুই গোল করেছেন তিনি, কিন্তু এভাবে অধিকাংশ সময়ে সাইডবেঞ্চে কাটানোয় তার প্রতিভার কতটুকুই ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা নিয়ে সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। তাই অন্তত ম্যালকমের জন্য হলেও এই দলবদল ভীষণ হতাশাজনক।
মিচি বাতশুয়াই (চেলসি থেকে ভ্যালেন্সিয়া)
চেলসির তৎকালীন কোচ আন্তোনিও কন্তের পরিকল্পনায় না থাকায় মার্শেই থেকে চেলসিতে যাওয়ার পর তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না মিচি বাতশুয়াই। এই মৌসুমের শুরুতে কন্তে চেলসি ছাড়লেও বাতশুয়াইয়ের ভাগ্য অবশ্য খোলেনি, লন্ডনের ক্লাবটি মোরাতা ও জিরুডের উপরে আস্থা রাখায় তাকে ধারে ভ্যালেন্সিয়ায় পাঠানো হয়।
তবে সেখানে গিয়েই নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ এই বেলজিয়ান স্ট্রাইকার। এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে চারটি ম্যাচ মূল একাদশে থেকে শুরু করে গোল করেছেন মোটে একটি। লিগে তার অবস্থা তো আরো খারাপ, ষোল রাউন্ড শেষে মূল একাদশে থেকে ম্যাচ শুরু করার সুযোগই পেয়েছেন মাত্র চারবার! সব মিলিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তাতে বাতশুয়াইয়ের ভ্যালেন্সিয়া আগমনটাও ব্যর্থ হিসেবেই হয়তো পরিগণিত হতে যাচ্ছে।
হেনরিখ মিখিতারিয়ান (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে আর্সেনাল)
মিখিতারিয়ানকে এই তালিকায় কেন আনা হলো সেটা নিয়ে বলার আগে তার ক্যারিয়ারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া যাক। এই মিখিতারিয়ান ২০১৫-১৬ মৌসুমে বুন্দেসলিগার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ঐ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টও ছিল এই আর্মেনিয়ান মিডফিল্ডারের। এমন এক মৌসুম কাটিয়ে ২০১৬ সালে তিনি যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে ছিল।
কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, রেড ডেভিলদের জার্সিতে মিখিতারিয়ান সেই প্রত্যাশা পূরণে সমর্থ হননি। এ বছরের জানুয়ারিতে যখন সানচেজের বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায় আর্সেনাল, তখন অনেক বিশ্লেষক বলেছিলেন, এবার হয়তো সেই বুন্দেসলিগার মিখিতারিয়ানকে দেখতে পাওয়া যাবে। সেটা হয়নি, গানারদের হয়েও নিজের সেরাটা দিতে ব্যর্থ তিনি। এক ম্যাচ ভালো খেলেন তো পরের দুই ম্যাচে বিবর্ণ, এ কারণে নিয়মিত মূল একাদশেও সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি। যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে প্রিমিয়ার লিগে মিখিতারিয়ানের সেরাটা দেখার আশা দুরাশাই রয়ে যাবে।
ইয়েরি মিনা (বার্সেলোনা থেকে এভারটন)
সাম্প্রতিক সময়ে দলবদলের বাজারে বেশ কিছু খেলোয়াড় কিনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ইংলিশ ক্লাব এভারটন, তবে তাদের বেশ কিছু দলবদল আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ বলেই মনে হচ্ছে। বার্সেলোনার ইয়েরি মিনাকে দলে ভেড়ানোটাও সেই কাতারেই পড়বে। ডিফেন্ডার হয়েও বিশ্বকাপে তিন গোল করে আলোচনায় আসা মিনাকে ৩০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়ায় এভারটন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার যা পারফর্মেন্স তাতে মনে হচ্ছে তাকে ৩০ মিলিয়নে বিক্রি করে দিয়ে বার্সেলোনাই বেশ লাভবান হয়েছে।
সেঙ্ক টসুন (বেসিকতাস থেকে এভারটন)
এ বছরের জানুয়ারিতে ২৭ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে বেসিকতাস থেকে এভারটনে যোগ দেন সেঙ্ক টসুন। যোগদানের পর তৎকালীন কোচ স্যাম অ্যালাড্রাইসের অধীনে ভালোই খেলেছিলেন এই তিউনিসিয়ান ফরোয়ার্ড। কিন্তু নতুন কোচ মাউরো সিলভার পরিকল্পনায় না থাকায় এই মৌসুমে একদমই নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি।
লিগে এই মৌসুমে মাত্র ছয়টি ম্যাচ মূল একাদশে থেকে শুরু করতে পেরেছেন টসুন, গোল করেছেন মাত্র দুটি। কোচ বদলের কারণে নতুন কোচের আগমনের আগে হওয়া দলবদলগুলো ব্যর্থ হওয়াটা নতুন কিছু না, সেই তালিকায় হয়তো টসুনের দলবদলও পড়তে যাচ্ছে।
আলিরেজা জাহানবাখস (এজেড থেকে ব্রাইটন)
নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের রেকর্ড ট্রান্সফার ফি দিয়ে ইরানিয়ান ফরোয়ার্ড আলিরেজা জাহানবাখসকে ডাচ ক্লাব এজেড আল্কমার থেকে দলে ভিড়িয়েছিলো ব্রাইটন। স্বাভাবিকভাবেই আলিরেজার প্রতি তাদের প্রত্যাশাও বেশি ছিল, কিন্তু এই দলবদলও আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত লিগে মাত্র চারটি ম্যাচ মূল একাদশে শুরু করেছেন তিনি, সেখানেও তার পারফর্মেন্স আশাব্যঞ্জক নয়।
এছাড়াও এই বছরের আরো বেশকিছু দলবদল আছে যেগুলোকে এখন ব্যর্থ বা সফল– কোনো তালিকাতেই ফেলা যাচ্ছে না। সামনের বছরের পারফর্মেন্স হয়তো সেসব দলবদলের ভাগ্য ঠিক করে দেবে। আবার এই তালিকায় যাদের নাম বলা হলো তাদের সামনেও সুযোগ রয়েছে আগামী বছর ভালো পারফর্মেন্স করে এই তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার। যদি তা না হয় তবে এই তালিকার অধিকাংশ খেলোয়াড়কেই হয়তো অতি দ্রুত ক্লাব পরিবর্তন করতে হবে।