ব্রাজিলের ‘শাঁখের করাত’

২০২২ সালের পর থেকে ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে একটা কথা প্রায় সময়ই শোনা যায়। এই বিশ্বকাপ এখন নাকি একেবারেই ইউরোপিয়ানদের দখলে। যদিও এই কথার পেছনে মোক্ষম যুক্তি কিন্তু রয়েছে। ২০০৬ সালে ইতালি, ২০১০ সালে স্পেন, ২০১৮ সালে জার্মানি এবং ২০১৮ সালে ফ্রান্স – প্রত্যেক বিশ্বকাপই কিন্তু ইউরোপের কোনো না কোনো দেশই জিতেছে। এমনকি শেষ চার বিশ্বকাপের ফাইনালিস্টদের কথাও যদি ধরা যায়, তাহলে ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা ছাড়া অন্য কোনো লাতিন আমেরিকান দেশ ফাইনালের মঞ্চে উঠতেই পারেনি।

তাহলে বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানদের কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকান দেশগুলো? শেষ চার বিশ্বকাপে গল্পটা অনেকটা এমনই। হট ফেভারিট হয়েও আর্জেন্টিনা ২০০৬ এবং ২০১০ বিশ্বকাপে নত মুখে ফেরত এসেছিল। ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে ৭ গোল খেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতেতে পরে ব্রাজিলকে বিদায় নিতে হয়েছিল সেমি-ফাইনাল থেকে। ২০১৮ বিশ্বকাপে দারুণ একটা দল নিয়েও ব্রাজিল বেলজিয়াম বাধা পার হতে পারেনি।

কিন্তু এবার কাতারে ইউরোপিয়ান দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বকাপ জেতায় অন্যতম ফেভারিট দেশ ধরা হচ্ছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাকে। মেসি, লাউতারো এবং ডি মারিয়া ছাড়া আর্জেন্টিনায় তারকা ফুটবলার তেমন নেই। কিন্তু তারকা-তকমা ছাড়াই আর্জেন্টিনা যখন খেলতে নামে, তখন গোটা দলের আগ্রাসন ফুটবলে দলের ভাবমূর্তি ভোজবাজির মতো পালটে যায়। আর্জেন্টিনা এখন ‘এগারোজনে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ’ কথায় বিশ্বাসী। আসলে ফুটবলটা তো এমনই হওয়া উচিত।

বিপরীতে সেলেকাও দলে তারকা মুখ দিয়ে ভরা। গোলবারে অ্যালিসন ও এডারসন। মিডফিল্ডে ক্যাসেমিরো এবং ফ্যাবিনহো ছাড়াও নেইমার, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, জেসুস, অ্যান্টনি, রাফিনহা, মার্টিনেল্লি ও রদ্রিগো গোয়েস’রা তো আছেননি। ৩৮ বছর বয়সী দানি আলভেজ পর্যন্ত রয়েছেন দলে অভিজ্ঞতার ছোঁয়া এনে দিতে।

দলে অভিজ্ঞতার ছোঁয়া এনে দিতে আছেন দানি আলভেজ; Image Source: Getty Images

এত এত তারকা! তাহলে এটা কি ব্রাজিলের অন্যতম সেরা দল?

সেটা জানা যাবে বিশ্বকাপ শেষেই। কিন্তু সেরা দল থেকে বরং এই ব্রাজিলকে ‘তিতের দল’ বলাটাই বেশি মানানসই। রক্ষণ, মধ্যমাঠ এবং আক্রমণ – প্রত্যেক পজিশনে যেসব খেলোয়াড়কে তিনি ডেকেছেন, তারা এই ব্রাজিল দলে গত কয়েক বছরের নিয়মিত মুখ। এই দলের যেকোনো খেলোয়াড়ের সব থেকে বড় পরিচয়, তারা তিতের ফুটবল দর্শন বেশ ভালো বোঝেন। 

কিন্তু একটি পজিশনে তিতে যথাযথ খেলোয়াড় নিতে পারেননি। আসলে চাইলেও তিনি পারতেন না। এজন্য ফুলব্যাক পজিশনে এই ব্রাজিল আর সব দেশ থেকে কিছুটা পিছিয়ে।

রক্ষণে থিয়াগো সিলভা, এডার মিলিতাও ,ব্রেমার এবং মার্কিনোস রয়েছেন। এখানে কোনো চমক নেই। এই চারজনেরই দলে ডাক পাওয়ার কথা। কিন্তু রাইটব্যাক পজিশনে বর্ষীয়ান দানি আলভেজ এবং দানিলো কতটা ভরসাযোগ্য? অথবা লেফটব্যাকের কথাই যদি ধরি, অ্যালেক্স স্যান্দ্রো এবং অ্যালেক্স তেলেসকে আপনি কতটা ভরসা করতে পারেন?

দানি আলভেজকে আসলে দলে নিয়মিত খেলানোর জন্য রাখা হয়নি। ইউরোপের দুর্দান্ত গতিসম্পন্ন উইঙ্গারের সামনে ৩৮ বছর বয়সী আলভেজ যে বিপাকে পড়বেন, সেটা তো সবার জানা। কিন্তু দানিলোও কখনো ধারাবাহিকতার সাথে ফুটবলটা খেলতে পারেননি। বিশ্বকাপ তো ভুল করার জায়গা নয়। এমনকি ভুল করে ফেললেও ভুলের মাশুল দেওয়ারও সুযোগ নেই। 

রাইট-ব্যাক হিসেবে দেখা যেতে পারে মিলিতাওকে; Image Source: Getty Images

কিন্তু আলভেজ এবং দানিলো ছাড়া তিতের হাতে আর কোনো খেলোয়াড় ছিল কি? মোনাকোর কাইয়ো হেনরিক এবং ভেনডারসনের নাম আসতে পারে। কিন্তু তিতের পছন্দের তালিকায় তারা তখনও ছিলেন না। আগেই বলেছি, তিতে তাদেরই নিয়েছেন – যারা জানেন তিনি কী ঘরানার ফুটবলটা খেলাতে চান। তাই রাইটব্যাক পজিশনে অন্য কোনো খেলোয়াড়কে ডাকার সুযোগ নেই।

এজন্য প্রতিপক্ষ বুঝে তিতে এবার রাইটব্যাক পজিশনে মিলিতাওকে খেলাতে পারেন। বর্তমান ফুটবলে প্রায় সময়ই একজন সেন্টারব্যাকের পাসিং, এরিয়াল ডুয়েল এবং গতি দেখে তাকে মাঠের ডানপাশে (মেকশিফট ফুলব্যাক) হিসেবে খেলানোর চেষ্টা করানো হয়। সেন্টারব্যাক হয়েও রোনাল্ড আরাউহো বার্সেলোনা এবং উরুগুয়ের হয়ে রাইটব্যাকে খেলেছেন। মিকেল আরতেতা ৪-২-৩-১ মতান্তরে ৩-৫-২ ছকে বেন হোয়াইটকে ডানে খেলিয়ে থাকেন।

বামপাশে অ্যালেক্স স্যান্দ্রো আহামরি কোনো ফুলব্যাক না হলেও তার গতিটা বেশ ভালো। হুটহাট প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে যেতে পারেন। ক্রসটাও নেহায়েত মন্দ দেন না। কিন্তু আরেক ফুলব্যাক অ্যালেক্স তেলেস বহুদিন হলো নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ব্যর্থ সময় কাটিয়ে সেভিয়াতে গিয়েও নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছেন বেঞ্চে। তাই স্যান্দ্রোর সাথে যোগ্য সঙ্গীর অভাবটা এখানে থেকে গেল। কিন্তু তিতের কী দোষ বলুন! ব্রাজিল দলের লেফটব্যাকে খেলার মতো যে আর কেউ নেই।

এই ব্রাজিল আক্রমণকে থামাবে কে?; Image Source: Getty Images

তবে তিতের ফুটবল কৌশল ঠিক ফুলব্যাক ভিত্তিক না। তার মূল অস্ত্র হচ্ছে মাঝমাঠ এবং ফরোয়ার্ড। ব্রাজিল সবসময় প্রতিপক্ষের রক্ষণে আক্রমণ শানিয়েই তাদের ফুটবলটা খেলে গেছে। এবার নেইমার-রাফিনহা-ভিনিসিয়ুস-জেসুসদের নিয়ে গড়া আক্রমণও তার ব্যতিক্রম হবে না। আর মাঝমাঠ দখলে রাখার কাজটা ক্যাসেমিরো-ফ্রেড-পাকেতা-ব্রুনোরা বেশ ভালোই জানেন। এজন্যই হয়তো সেলেকাও ফুলব্যাক পজিশনে অতিরিক্ত চাপ থাকবে না। স্যান্দ্রো ও দানিলোরা বিশেষ কোনো ভুল না করলে এই ব্রাজিলকে তো গোল করা থেকে থামানোই অসম্ভব।

This article is in Bangla language. It is about the full-back problem in the Qatar World Cup 2022 for Brazil.

Featured Image: Getty Images

Related Articles

Exit mobile version