Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বুফন: পরিপূর্ণ এক মহানায়কের অপূর্ণ বিদায়

নভেম্বর, ২০১৭; ইতালির বিখ্যাত মাঠ সানসিরোতে ইতালি বনাম সুইডেনের মধ্যকার খেলা শুরুর প্রাক্কাল। আগের ম্যাচে ১-০ তে জিতে বিশ্বকাপ খেলার পথে এক পা দিয়ে রেখেছে সুইডেন। আর বাদ পড়ার শঙ্কায় ইতালি। সুইডেনের জাতীয় সঙ্গীত শুরু হতেই ইতালি সমর্থকরা দুয়ো দিতে লাগলো আর একজন ইতালিয়ান প্লেয়ার জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন পুরো সময়টা হাততালি দিয়ে গেলেন জোরে জোরে যেন নিজের সমর্থকদের এহেন কাজের প্রতিবাদস্বরূপই। তিনি সদ্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরে যাওয়া ইতালিয়ান অধিনায়ক জিয়ানলুইগি বুফন। খেলোয়াড়ি যোগ্যতা খেলোয়াড়কে প্রয়োজনীয় সব দিলেও তার আসল পূর্ণতা আসে মাঠে বা মাঠের বাইরে তার ব্যক্তিত্ব দিয়েই। ফুটবল জগতে তেমনই একজন পরিপূর্ণ লিজেন্ডের জীবনগাথা নিয়েই আজকের লেখাটি।

বুফনকে সর্বকালের সেরা গোলকিপারদের একজন ভাবা হলেও তার ক্যারিয়ারের শুরু কিন্তু একজন মিডফিল্ডার হিসেবে! যুব একাডেমিতে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর একজন মিডফিল্ডার। একদিন দেখা গেল, দলের সব গোলকিপার ইনজুরিতে। ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার অবস্থা, ভেবেচিন্তে যুবদলের সহকারী কোচ লম্বা থাকায় বুফনকে গোলকিপার হওয়ার কথা বলেন। প্রথমে হাসি-তামাশা করলেও গ্লাভস হাতে মাঠে নামেন বুফন। সেদিনই শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়ের। বিস্ময়ের সাথে কোচিং স্টাফরা দেখলো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার। তারপর থেকে তার আর গ্লাভস ছাড়া হয়নি, বনে যান পুরোদস্তুর গোলকিপার।

পারমার হয়ে কোপা ইতালিয়া জয়ের পর; Source: The Gentleman Ultra

নভেম্বর ১৯, ১৯৯৫; পারমার সাথে এসি মিলানের ম্যাচ। ব্যাজিও, উইয়াহদের মতো মাঠ কাঁপানো প্লেয়াররা তখন মিলানে খেলেন, তারা তখন ইতালির চ্যাম্পিয়ন দল। এদিকে পারমার কোনো মূল গোলকিপারই দলে নেই ইনজুরির জন্য। কোচ স্কেলিও যুব একাডেমির কিপার বুফনের কাছে গিয়ে বললেন, “কাল মিলানের সাথে নামালে পারবে তো?” বুফন জবাব দেন, “সমস্যা কি? খেলতে নেমেছি তো সবার সাথেই তো খেলতে হবে!” শক্তিশালী মিলানের সাথে অভিষেক হলো বুফনের। দারুণ কয়েকটি সেইভ করে ঠেকিয়ে দিলেন উইয়াহ, ব্যাজ্জিওদের মিলানকে। আর পেছনে তাকানো নয়। পারমার মূল দলের গোলবারের নিচের জায়গাটি পাকা করে নিলেন তিনি।

তার পারফর্মেন্স ক্রমশ উন্নতির দিকে যেতে থাকলো। ২৯ ম্যাচে মাত্র ১৭টি গোল হজম করে পারমাকে বানালেন সিরি আ’র রানার আপ। ডাক পেলেন ইতালির জাতীয় দলে। রাশিয়ার সাথে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়িং ম্যাচে সিজার মালদিনি মূল কিপার না থাকায় তাকেই নামিয়ে দেন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। দারুণ কিছু সেই করে ইতালিকে তুলে দেন বিশ্বকাপের মূলপর্বে। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে তিনি বাস্তবিক অর্থে সবার নজর কাড়েন। পারমাকে সেবার কোপা ইতালিয়া ও উয়েফা কাপ জেতান। বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, রোমার মতো ক্লাবগুলো হামলে পড়ে তাকে কিনে নিতে। শেষ পর্যন্ত সেই আমলের রেকর্ড ৩২ মিলিয়ন ইউরোতে যোগ দেন জুভেন্তাসে।

জুভেন্টাসের জার্সিতেই বুফনের অমরত্ব; Source: The Sun

সেই যুগে ৩২ মিলিয়ন ইউরো দামের দলবদল খুব আনকমন ছিল, গোলকিপারদের  বেলায় এমন অঙ্ক তো অভাবনীয়। মিডিয়া প্রেশার বেড়ে গেল, কেমন করবে এই ছোকড়া? কিন্তু বুফন যে পুরো অন্য ধাতুতে গড়া, এমনভাবে জুভেন্টাস ক্যারিয়ার শুরু করলেন যেন এখানেরই একজন ছিলেন তিনি। টানা পাঁচ বছরে চারটি লীগ জিতে নিলেন তিনি। ২০০৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে ওঠান জুভেন্টাসকে। সেখানে পেনাল্টিতে হেরে যায় জুভেন্টাস মিলানের কাছে। জুভেন্টাসকে হারানোর কেউ যে ছিলই না ইতালিতে। বুফন ছিলেন ধারাবাহিকতার চুড়ান্তরুপ। সেই ১৯ নভেম্বর, ১৯৯৫ থেকে তার আর থামতি নেই। ততদিনে ইতালি জাতীয় দলের মূল কিপার তিনি। কিন্তু ২০০৬ সালের পর তার অনেক হিসেবই অন্যরকম হয়ে যায়।

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে বুফন; Source: the gentlemen ultra

জার্মানির ওলিম্পিয়াস্টেডিয়ন স্টেডিয়ামটি বুফনের পূর্ণতা আর অপূর্ণতা দুটোরই সাক্ষী। জুলাই, ২০০৬; ফ্রান্সের সাথে বিশ্বকাপের ফাইনাল চলছে সেখানে। খেলা সমতায়, শেষ হয়ে আসছে সময়। তেমন সময় ভেসে আসা একটি ক্রসে প্রায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা জিদান দারুণ জোরে হেড নিলেন। ঠিক এমনই হেডে ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলকে শূন্য হাতে ফেরানো জিদানের হেডটি অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতার সাথে ঠেকিয়ে দিলেন। সাথে সাথেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে ইতালি। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে যেকোনো ফুটবলারের পরমারাধ্য ট্রফিটি জিতে নেন বুফন।

সেবার কি এতই সহজ ছিল ইতালির যাত্রা? না। ইতালি বিশ্বকাপে আসার আগে ইতালিয়ান ফুটবলকে কাঁপিয়ে দেয়া ম্যাচ পাতানো কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। মূল দোষী দল জুভেন্টাস। আর সেবার ইতালিয়ান দলের মূল ভিত্তিই ছিল জুভেন্টাসের প্লেয়াররা। ইতালি এল টুর্নামেন্টে সবচেয়ে কম ফেভারিটদের একজন হয়ে। মিডিয়া ভেবে নিয়েছিল দলের ঐক্য ঠিক থাকবে না আর আশু বিদায় নেবে ইতালি। যে দুজন গুমোট আবহাওয়াকে জেদে বদলে দিলেন তাদের একজন বুফন। ক্যানাভারো-বুফনরা শপথ নিয়েছিল দেশকে কিছু সু-সংবাদ দেবার। যার ফলাফল ছিল মিলান, তুরিনের রাস্তায় সোনালি ট্রফিসহ উদ্বাহু ইতালিয়ানদের। যখন যেখানে দরকার হয়েছে, ইতালি তাকে সেভাবেই পেয়েছে। গ্রুপ পর্ব বা নকআউটের প্রথমদিকে ইতালি যখন ধুঁকছিল, অনেক সময় গোলবার বাঁচিয়েছেন তিনি। ইতালিকে জয় এনে দিলেও তার জীবনে আসে দারুণ এক দোটানা।

একই ফ্রেমে দুই লিজেন্ড ক্যাসিয়াস ও বুফন; Source: Pulse.ng

স্ক্যান্ডালে নাম থাকায় জুভেন্টাসকে অবনমন করে দেয়া হয় দ্বিতীয় বিভাগে। এদিকে বুফনের ক্যারিয়ারের তখন সেরা সময়। তার মতো একজন গোলকিপার কি কখনো দ্বিতীয় বিভাগে খেলে? সবাই ভেবে নিলেন বুফন ক্লাব ছেড়ে চলে যাবে। সুযোগসন্ধানী ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো সময়ের সেরা রত্নটিকে পেতে মাঠে নেমে পড়লো। কিন্তু অনেক সময়ই লয়্যালটি টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তার সেই সময়কার বেতনের দ্বিগুণ বেতনের অফার ফিরিয়ে থেকে যান জুভেন্টাসেই। যে দল তাকে এত দিয়েছে, তাদের এত সহজে ছেড়ে গেলেন না বিপদের সময়। বিশ্বের সেরা গোলকিপার কেবল প্রতিদান আর অন্তরের কথা শুনে ইতালিয়ান দ্বিতীয় বিভাগে খেললেন কম বেতন নিয়েও। সেবার দ্বিতীয় বিভাগ থেকে দলকে তুলে আনেন আবার মূল লীগে। কিন্তু লীগে আর তখন জুভেন্টাস রাজত্ব নেই। রাজত্ব তখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলানের। আর সদ্য উঠে আসা জুভেন্টাসের অবস্থা ভঙ্গুর। ভালো ম্যানেজার নেই, বুড়িয়ে যাওয়া কিছু খেলোয়াড়, ভগ্ন আর্থিক দশা। সে সবের মাঝে একজনই ছিলেন অনন্য, তিনি বুফন। সমানে উচ্চ বেতনে অন্য বড় বড় ক্লাবগুলো থেকে অফার আসছিল। সবাই বোঝাচ্ছিল, জুভেন্টাসের তো ভবিষ্যৎ এত উজ্জ্বল না। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না।

কিছু মানুষের জন্য বানানো পথ প্রয়োজন হয় না, নিজেরাই পথ তৈরি করে নেয়। ৭ম অবস্থান বা ফুলহ্যামের মতো দলের কাছে হেরে ইউরোপা লীগ থেকে বাদ পড়া এমন হাজারো ঝামেলায় জর্জরিত জুভেন্টাসকে অনেকে মধ্যম সারির দলেই ফেলে দিয়েছিল। বাস্তব সত্য হলো, ট্রফি না থাকলে মানুষ ভালো পারফর্মেন্সকেও এত হাইলাইট করে না। অনেকেই ভেবে নিচ্ছিলেন, তার দিন শেষ। কন্তে ক্লাবে এলেন কোচ হয়ে। মিডিয়ায় এলো, নতুন কোচ নাকি তাকে বাদ দিতে পারেন। আসলে হলো উল্টোটা। কন্তে সাবেক জুভেন্টাস লিজেন্ড, হাল-হকিকত ভালই বোঝেন। বুফনকে শুধু অধিনায়কই না, দলের অবিসংবাদিত নেতার স্থানও দেয়া হয়। অনেকটা জাদুর মতো কাজ করলো কন্তে-বুফন জুটি। টানা অপরাজিত থেকে লীগ জিতে নেয় জুভেন্টাস। সেই শুরু। এরপর ঘরোয়া দাপট আবার ফিরে পায় জুভেন্টাস। গুনে গুনে টানা ছয়টি লীগ ট্রফি সহ ঘরোয়া আরো অনেক ট্রফি সাম্প্রতিক সময়ে জুভেন্টাসের ঘরে।

মাঠের বুফন সবসময়ই ছিলেন প্রেরণাদায়ী; Source: Pulse.ng

২০১২ সালে আবারো প্রায় সবার আশার বিপরীতে গিয়ে ইতালিকে তোলেন ইউরোর ফাইনালে। তিকিতাকার পূর্ণ ছন্দে থাকা স্পেনের সাথে এঁটে উঠেনি ইতালি। তবে যে অপূর্ণতা ঘোচেনি তা হলো একটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফি। ২০০৩ সালে বঞ্চিত হন পেনাল্টি শ্যুটআউটে। ৩৬ পেরোনো বুফন ২০১৫ সালে বেল-বেনজেমা-রোনালদোকে নিরস্ত রেখে যখন ফাইনালে উঠেন আবার, তখন ভাবা হচ্ছিল এবার বোধহয় হতে পারে। কিন্তু ফর্মের চূড়ান্ত শিখড়ে থাকা মেসি-নেইমারের কাছে আবারো স্বপ্নভঙ্গ হয় তার। জানেন কোন স্টেডিয়ামে? সেই ওলিম্পিয়াস্টেডিয়ন, যেখানে ২০০৬ সালে তিনি জিতে নেন বিশ্বকাপ ট্রফিটি। সর্বশেষ গতবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগে জুভেন্টাসকে ভাবা হচ্ছিল নিশ্ছিদ্র। সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার রেকর্ড নিয়ে ফাইনালে উঠে জুভেন্টাস। সেমিফাইনালে মেসি, ইনিয়েস্তাদের একের পর এক চেষ্টা ঠেকিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। বয়স ৩৯ বছর, অথচ একরত্তিও বোঝার জো নেই তার পারফর্মেন্স দেখে। অনবদ্য এক রোনালদোর কাছে আবারও তার স্বপ্ন ঠেকে যায় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ট্রফির স্বাদ নেয়ার।

সুইডেনের সাথে ম্যাচের পর বুফন; Source: Daily Mirror

সুইডেনের সাথে ড্র করে যখন ইতালি বাদ পড়ে যায়, তখন সাথে সাথে লিখিত হয়ে যায় তাদের এক মহানায়কের বিদায় আখ্যান। বুফনের ক্যারিয়ার ২২ বছরের, ক্লাব ক্যারিয়ার এখনো চলছে, ১,০০০ এর বেশী ম্যাচ তার খেলা হয়ে গিয়েছে। এই ২২ বছরে তার ফর্ম প্রায় একই রকম ছিল। সেই বেবি-ফেইসড পারমার বুফন কিংবা ৪০ এর কাছাকাছিতে থাকা জুভেন্টাসের বুফন- ধারাবাহিকতা একই লেভেলের। বিতর্ক তাকে ম্লান করেনি। তার সমসাময়িক গোলকিপাররা যখন অবসর নিয়ে স্যুট-ব্যুট পড়ে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন, তখনও সেই একই ক্ষিপ্রতায় দলের জন্য লড়ে যাচ্ছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে বিদায় নিলেও ক্লাবে তার অধরা সাফল্যের পেছনে এখনো ছুটছেন। যখন পুরোপুরিভাবে তিনি তার গ্লাভস-বুট তুলে রাখবেন, তার নাম উঠে যাবে ইতিহাসের সেরাদের একজনের মধ্যে।

অশ্রুতেই বিদায় বুফনের; Source: independent.co.uk

বুফন কেবল একজন গোলরক্ষক না, আরো বেশী কিছু। নতুনদের ডিফেন্ড করেছেন অভিভাবকের মতো, বিতর্ক থেকে দলকে রাখতে চেয়েছেন আড়াল করে। ২২ বছরের ক্যারিয়ারে তার কোনো কালিমা নেই, বরং আছে নানা সাফল্যের পালক। মাঠে দু’দলের বিবাদে তার উপস্থিতি থাকে সবার আগে মিটমাট করার জন্য, ৬০ হাজার মানুষ আরেক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের অপমান করলেও একা তিনি সন্মান দেখিয়ে যান। বুফনের মতো গোলকিপার হয়তো আরো আসবে, তবে আরেকজন বুফন? হয়তো আর আসবে না। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার বিদায় দুঃখের সাথে হলেও তার সুবিশাল ক্যারিয়ারে তা কিছুই না। ফুটবল ইতিহাসে বুফন অনন্য এক নাম, সেরাদের সেরা একজন।

ফিচার ইমেজ-  Ali Khateeb (Deviant Art)

Related Articles