Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গাপটিলেরও একটি গল্প আছে

হার্লি গাপটিল এখনো বোধহয় ‘মা’, ‘বাবা’ ডাকার বাইরে কথা বলতে শেখেননি। কিংবা আরও ছোট দু-একটি শব্দ বলা শিখলেও ‘আমায় একটি গল্প শোনাও বাবা!’ বলার মতো সক্ষমতা অর্জন করার কথা নয় এখনো। ‘বোধহয়’, ‘কথা নয়’ এসব শব্দের বারংবার ব্যবহারে পাঠকের বিরক্ত হওয়াই উচিৎ কিছুটা, ‘লিখবেন-ই যখন, তখন একটু জেনে নিলেই তো পারেন, শিশুরা কবে কথা বলতে শেখে!’

তা নিয়েছি বৈকি। এখন তো আর জানার জন্যে বই-পত্তর ঘাঁটাঘাঁটির দরকারও পড়ে না। শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিন, গুগল নামের সবজান্তার কাছে জানতে চান, উত্তর পেয়ে যাবেন। সেই আশ্চর্য প্রদীপ গুগলই জানাল, শিশুরা মা-বাবা জাতীয় শব্দ বলতে শুরু ছয় মাসের পর থেকেই। মাঝে আরও কিছু শব্দ শিখে নিয়ে দু-চার শব্দের বাক্য বলতে শুরু করে ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে। গুগলই জানালো, হার্লির বয়স ১৮ মাস হলো দিনকতক আগে।

হার্লি খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে শিখুক, অন্তত গল্প শোনানোর আবদারটুকু করতে শিখুক পিতার কাছে। তবেই যে এক বাস্তবের সুপারম্যানের গল্প বলে ফেলতে পারেন তার বাবা।

হার্লির বাবা মার্টিন গাপটিলেরও তো একটা গল্প আছে।

মার্টিন গাপটিল; Image credit: Gareth Copley/ Getty Images 

যেভাবে শুরু হয়েছিল

শুরুটা তো সেই ষাটের দশকে, গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলেন মিস্টার অ্যান্ড মিসেস গাপটিল। এতটুকু জেনে প্রতি ক্রিকেট দর্শকের মনে একটি নাম উঁকি দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। সেই সাথে থাকে আশঙ্কাও, এই বুঝি পাঠক ভ্রু কুঁচকে তাকালেন! পৃথিবীর বুকে মার্টিন গাপটিল অত আগে আসেন কীভাবে?

না না, মার্টিন আসেননি। তবে আর্থার এসেছিলেন, আর তাকে বিয়ে করে তার সঙ্গে এক ছাদের নিচে এসেছিলেন জয়েস। বিশ্ব তখন দুলছিল এক পরিবর্তনের দোলায়। কেউ দুলছিলেন বিটলসে কিংবা বব ডিলানে, কেউ দুলছিলেন জন এফ কেনেডি আর চে গুয়েভারাতে। নারীবাদ আর সমকামিতাকে কেন্দ্র করে বাকিরাও যখন পার করছিলেন উত্তাল এক সময়, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড শহরের এক কোণায় বসে পিটার-জয়েস দম্পতি দুলছিলেন অন্য চিন্তার দোলায়। কীভাবে আরেকটু ভালো থাকা যায়, কীভাবে উত্তর-প্রজন্মকে আরেকটু ভালো রাখা যায়!

অনেক ভেবে, বেশ কিছু কাজ করে দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিলেন পণ্য পরিবহনের ব্যবসা। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্বান্তই নিয়েছিলেন বলতে হবে। জিনিসপত্র পরিবহনের এ ব্যবসা আজ যতটা রমরমা দেখা যায়, ওই ষাটের দশকে তো তেমনটা ছিল না।

ব্যবসাটাকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতেই যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন দুজনে, তখনই হঠাৎ অন্যলোকে পাড়ি জমান আর্থার গাপটিল। জয়েসের ওপর রেখে যান চার সন্তানের ভার। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও তখন এমন, স্বামী শোকে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেললেও পরবর্তী বেলার আহার জোটা নিয়ে সংশয়। জয়েস গাপটিলের তাই ওই পণ্য পরিবহনের ব্যবসায় মন লাগানো ছাড়া উপায় ছিল না। আর ১৩ বছর বয়সী পিটারেরও সুযোগ ছিল না, মাকে সাহায্য না করে অন্য কিছু করার।

মা আর বড় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসাকে। এমনকি বিয়ের আগে পিটার গাপটিল নিজেই কিনে ফেলেছিলেন একটা শেভি ট্রাক। ইয়ান হেন্ডারসন তাই যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পিটার গাপটিলকে বিয়ে করবেন, সাথে সাথে নিশ্চিত করেই মেনে নিয়েছিলেন, বাকি জীবনটা জিনিসপত্র পরিবহনের ব্যবসাতেই কাটবে।

মার্টিন গাপটিল এলেন

১৯৮৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে পিটার-ইয়ান দম্পতির ঘর আলো করে এসেছিল তাদের দ্বিতীয় সন্তান। নিজের জীবনটা বদ্ধ খাঁচায় আটকে ছিল দেখেই বোধহয় পিটার চাননি, সন্তানগুলোর ভাগ্যেও তেমন পরিণতিই জুটুক। সন্তানকে ডানা মেলে ওড়ানোর বাসনাতেই বোধকরি, দ্বিতীয় সন্তানের নাম রেখেছিলেন পাখির নামে। মার্টিন, মার্টিন গাপটিল।

তা পাখির মতো তিনি উড়েছিলেনও। পিটার গাপটিল নিজেই জানাচ্ছেন, বড় ভাই বেনের সঙ্গে মিলে মার্টিন এমনসব দুষ্টুমিই করতেন যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে তার মা ইয়ান হেন্ডারসনের জীবন শুধু একটি কাজেই আটকে গিয়েছিল, সারাদিন যেন দু’ভাই চোখে চোখে থাকে।

মার্টিনও ক্রিকেট খেলবে

জীবনের প্রতি পদক্ষেপ কম্পাস দিয়ে মেপে মেপে চলাই যখন নিয়তি, তখন শখ-আহ্লাদ শব্দগুলো বিলাসিতার মতোই শোনায়। ১৩ বছর বয়স থেকেই তো, স্কুল আর কাজের বাইরে পিটার গাপটিলের ফুসরৎ মেলাই ঢের! সপ্তাহান্তে এরপরেও অবশ্য কিছুটা বিশ্রাম মিলতো, আর সারা সপ্তাহ নিজেকে চাঙা রাখতে পিটার গাপটিল ছুটে যেতেন পাশের ক্লাব মাঠে, ক্রিকেট খেলতে।

এরপরে কয়েক দশক পেরোলেও, দুই সন্তানের জনক হলেও পিটার গাপটিলের এই অভ্যাসটা বদলায়নি কখনোই, প্রতি শনিবারে নিউ লিনের ওই ক্লাবে যাওয়া।

জন্মের পরে মার্টিন গাপটিলেরও তাই ওই ক্লাবে পা ফেলাটা নিয়তিই ছিল। শুধু মার্টিন গাপটিলের বাবা ক্রিকেট খেলতেন বলেই নয়, ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার এই ধারাটা নিউজিল্যান্ডারদেরই বৈশিষ্ট্য। পিটার গাপটিল নিজেই জানাচ্ছেন:

আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের খুব ছোট বয়সেই খেলাধুলার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিই। এমন না যে পেশাদার খেলোয়াড় হবার চাপ ওর ওপর চাপিয়ে দিই, বরং এটা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। আমার মনে পড়ছে, ছোটবেলাতে মার্টিন ওর সামনে যা-ই খেলা হতো, ও তা-ই খেলতে চাইতো। হকি, রাগবি, ক্রিকেট থেকে শুরু করে সামোয়ান ক্রিকেট, মার্টিনের সবরকম খেলা খেলবার অভিজ্ঞতাই রয়েছে।

এমন ক্রীড়ামোদী আবহে বড় হতে থাকা মার্টিন গাপটিল ক্লাবে গিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন পাঁচ বছর বয়সেই। সাথে বাকি খেলায় অংশগ্রহণ তো ছিলোই। একবার স্কুলের হয়ে কিলিকিটি (সামোয়ান ক্রিকেট) টুর্নামেন্টে গিয়ে তো জিতে আসেন অকল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাই! কিছুটা অবাক হলেও মনে মনে পিটার গাপটিল কিছুটা আশাবাদী হয়ে ওঠেন ঠিক-ই, ‘ছেলে আমার জাত অ্যাথলেট!’

গাপটিল পরিবারের নিউ-লিনের ক্লাবে যাতায়াত তাই তখন আরও বেশি নিয়মিত ঘটনা হয়ে ওঠে এরপরে। ক্রিকেটের প্রেমে পড়ার সূচনাও তখন থেকেই, আরও নিরদিষ্ট করে বললে ব্যাটিংয়ের। ব্যাটিংয়ের প্রেমে গাপটিল মজে গিয়েছিলেন এতটাই যে তাকে বোলিং করতে করতে ক্লান্ত হয়ে লুকিয়ে পড়তেন ক্লাবের বোলারদের কেউ কেউ। তবে ক্রিকেটের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের কারণে ক্লাবের সকলেরই নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন গাপটিল।

দারুণ ব্যাটসম্যান, দারুণ ফিল্ডার; Image credit: Buddhika Weerasinghe/ Getty Images

ক্রিকেটের প্রতি গাপটিলের এই দারুণ আগ্রহ নজর কেড়েছিলো তার স্কুল কোচেরও। গাপটিলের স্কুল, অ্যাভোন্ডেল কলেজের তৎকালীন কোচ কিট পেরেরার ভাষ্যে,

তার মাঝে কিছু একটা ছিল, আমরা বোধহয় এমন কিছুকেই এক্স-ফ্যাক্টর বলি। ক্রিকেটের প্রতি ও ছিল অসম্ভব নিবেদিত। এমনও দিন গিয়েছে, টানা দুই-তিন ঘণ্টা ক্যাচিং প্র‍্যাকটিস করিয়ে আমার হাত প্রায় ভেঙে পড়বার দশা, বাসায় গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে, তখনো গাপটিল বলছে, ‘আরও দিন স্যার!’

স্কুল ক্রিকেটে গাপটিলের ব্যাটে রানের বন্যা তাই প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু, অপ্রত্যাশিত অনেক ব্যাপার ঘটে বলেই তো এর নাম জীবন। গাপটিলের পরিবারেও অপ্রত্যাশিত এক বিপর্যয় নেমে এসেছিল এর পরেই।

টু টোজ গাপটিল

জুনিয়র দলের হয়ে রানবন্যার পুরষ্কারস্বরূপ মার্টিন গাপটিল ডাক পেয়েছিলেন স্কুলের সিনিয়র দলে। পরের সপ্তাহেই অভিষেক হবার কথা ছিল তার। গাপটিল পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের বয়স তখন ১৩।

বেন গাপটিল তার বাবার দোকানের সামনে থেকে ট্রাক চালিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু সামনে থেকে আসা মার্টিনকে দেখতে পাননি তিনি। যতক্ষণে দেখতে পেলেন, ততক্ষণে সাড়ে সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে। মার্টিনের বাঁ পায়ের উপরে বেন তুলে দিয়েছিলেন তখন ট্রাকের চাকা।

মার্টিনকে সেখান থেকে উদ্ধার করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো হাসপাতালে। প্রথম-প্রথম ডাক্তাররা আশ্বস্ত করেছিলেন, তার পা আবার আগের অবস্থায় ফেরত যাবে। কিন্তু সপ্তাহ দুই পেরোতেই ডাক্তাররা বুঝে যান, আঙুলগুলো আগের অবস্থায় ফেরানো তো দূরে থাক, শরীরে রাখাই অসম্ভব। সিদ্ধান্ত হয়, বাঁ পায়ের তিনটি আঙুল কেটে ফেলার।

নিউ-লিনের উজ্জ্বলতম প্রতিভা থেকে হঠাৎ করেই গাপটিল চলে যান ঘোর অমানিশায়।

বাঁ পায়ে আঙুল মাত্র দুটি, তাতে কী! Image credit: Martin Guptill 

কিন্ত, ক্রিকেট তো ছাড়বো না

আমরা তো ভীষণ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। মার্টিনকে দেখে অবশ্য বোঝার উপায় ছিলো না, কী অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে ও যাচ্ছিলো। ভেতরে যা-ই চলুক, বাইরেতে ও ভীষণ শক্ত সেই ছোটবেলা থেকেই। আমরা বড়রাই বরং পড়ে যাচ্ছিলাম ভীষণ ভাবনায়, এই শক ও কীভাবে কাটিয়ে উঠবে। আর বেনের কথাও একবার ভাবুন। কিীভীষণ মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে ওকে যেতে হচ্ছিলো অতটুকুন বয়সে!

মার্টিনকে চাঙ্গা জন্যে তার বাবা তখন সবকিছুই করেছিলেন। নিউজিল্যান্ডের তৎকালীন ম্যানেজার ও বর্তমানে আইসিসির ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোকে দিয়ে রাজি করিয়েছিলেন স্টিভেন ফ্লেমিংকে মার্টিনের পাশে এসে বসতে। সবার ভালোবাসা আর সহানুভূতিতে তিনি সুস্থ হতে শুরুও করেন খুব দ্রুতই। তবে মাস দেড়েক না পেরোতেই তিনি বাবা-মায়ের কাছে চেয়ে বসেন এমন এক জিনিস, যা শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না পিটার কিংবা ইয়ান হেন্ডারসন। গাপটিল ক্রিকেট খেলতে চান, আবারও।

বেনকে কিছুটা স্বস্তির সুযোগ দিয়ে গাপটিল আবারও ক্রিকেটে ফেরেন দুই মাস পর। দুই মাসে অনেক কিছুই বদলে গেলেও স্থির ছিল কেবল একটিই জিনিস। ক্রিকেটের প্রতি তার সেই প্রেম, গাপটিলের সেই ব্যাটিং!

সাফল্যের বাঁকে বাঁকে

ওই দুর্ঘটনা যেন ক্রিকেটের প্রতি আরও বেশি নিবেদিত করে তুলেছিল গাপটিলকে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলেছিলেন এর পরপরই, মাত্র সপ্তম গ্রেডে। পড়াশোনা সাঙ্গ করলেও অবশ্য ভারী গাড়ি চালাবার লাইসেন্সটা যোগাড় করে রেখেছিলেন সে সময়টায়। ক্রিকেটটা যদি এ জীবনে একেবারেই না হয়, অন্তত খেয়ে-পরে বাঁচবার সংস্থানটা যেন হয়, সে ভাবনাতেই!

নাহ, মার্টিনকে তার বাবার পথের পথিক হতে হয়নি। বয়সভিত্তিক দলে যে রানবন্যার সূচনা করেছিলেন দুর্ঘটনার আগে, দুর্ঘটনার পরেও সেখানে পার্থক্য হয়নি তেমন। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত ২০০৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলেও জায়গা করে নিয়েছিলেন অনবদ্য পারফরম্যান্স দিয়েই। যদিও সে বিশ্বকাপে ছয় খেলায় ১৭ গড়ে রান করেছিলেন মোটে ১০৩, তবে দারুণ কিছু স্ট্রোকপ্লেতে ঠিকই চিনিয়েছিলেন নিজের জাত।

অনূর্ধ্ব-১৯ নিউজিল্যান্ড দল, ২০০৬ বিশ্বকাপে; Image credit: Lakruwan Wanniarachchi/ Getty Images

বিশ্বকাপ থেকে ফিরেই সুযোগ পেয়েছিলেন অকল্যান্ডের স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপের দলে। শুরুর ইনিংসটায় শূন্যতেই প্যাভিলিয়নে ফিরলেও নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ দেখিয়েছিলেন পরের ইনিংসেই। মার্ক গিলেস্পি, জিতান প্যাটেলদের নিয়ে গড়া ওয়েলিংটনের বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে তুলে নিয়েছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। সেখানেও অবশ্য আক্ষেপই সঙ্গী, আউট হয়েছিলেন যে ৯৯ রানে!

অভিষেক মৌসুমে খেলেছিলেন দুটি মাত্র ম্যাচ, তাতেই এক অর্ধশতক আর প্রায় এক শতকে নিশ্চিত করেছিলেন পরের মৌসুমে অকল্যান্ড দলে তার থাকাটা অবশ্যম্ভাবীই। তবে এমন নিশ্চিত সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি মোটেই। ১১ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে রান করেছিলেন মাত্র ১৭৪। তার দল অকল্যান্ডও সে মৌসুম শেষ করেছিল ছয় দলের মাঝে চতুর্থ হয়ে।

মার্টিন গাপটিলের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় বাঁকটা এসেছিল এরপরেই। ২০০৭-০৮ মৌসুমে স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যর্থ হলেও ঘরোয়া একদিনের টুর্নামেন্ট স্টেট শিল্ডে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। এমনকি সেবারের ফাইনালেও খেলেছিলেন দুর্দান্ত এক শতরানের ইনিংস, যদিও ব্রেন্ডন ম্যাককালামের কাছে হেরে যেতে হয়েছিল তার দল অকল্যান্ডকে। কিন্তু সেবারের আসরে তিনি করেছিলেন ৫৯৬ রান, যা তার সামনে খুলে দিয়েছিল নিউজিল্যান্ড ইমার্জিং দলের দরজা। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের উদীয়মানদের নিয়ে আয়োজিত এক টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৩৮০ রান করে নিশ্চিত করেছিলেন ‘এ’ দলে ডাক পাওয়া। ব্ল্যাক ক্যাপসদের হয়ে মাঠে নামাটা তখন কেবলই একসিঁড়ি অপেক্ষা।

অকল্যান্ডের জার্সি গায়ে, সময়টা ২০০৭; Image credit: Sandra Mu/ Getty Images

স্বপ্ন হলো সত্যি

‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে এসেছিলেন ২০০৮ সালের অক্টোবরে। অমিত মিশ্র-রবীন্দ্র জাদেজাদের স্পিন সামলে চেন্নাইয়ের স্পিন ধরা উইকেটে প্রথম সুযোগেই যে ৮০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, তাতেই বোধহয় নিউজিল্যান্ডের নির্বাচকেরা বুঝে গিয়েছিলেন, এবারে মার্টিন গাপটিলকে নেয়া যেতেই পারে।

অবশেষে ২০০৯ সালের শুরুতেই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জেমস হাউ পড়লেন বাজে ফর্মে। বদলে নির্বাচকেরা ডেকেছিলেন ২৮ লিস্ট-এ ম্যাচে ৩৮ ছাড়ানো গড়ে ৯৬৫ রান করা মার্টিন গাপটিলকে। রান-গড়ের চেয়ে স্ট্রাইক রেটটাই তো ছিল বেশি নজরকাড়া। সে মৌসুমে যে ব্যাট করছিলেন ১০৩ স্ট্রাইক রেটে!

নেপিয়ারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটা ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। তবে তার আগেই অভিষেক ইনিংস রাঙিয়ে দিয়েছিলেন গাপটিল, আট চার আর দুই ছক্কায় রান করেছিলেন অপরাজিত ১২২। নাম লিখিয়েছিলেন পাঁচজনের সেই ছোট্ট তালিকায়, যারা অভিষেকেই পূরণ করেছিলেন শতরানের কোটা। মাঠে অমন দারুণ চেয়েও গাপটিলকে বেশি তৃপ্তি দিয়েছিল সম্ভবত মাঠের বাইরের প্রশংসা। দলের ক্যাপ্টেন যখন স্যালুট ঠুকেন অভিষিক্ত ক্রিকেটারকে, তখন গর্ব তো হবেই। ভেট্টোরি অবশ্য সেদিন কুর্নিশ জানিয়েই থামেননি। শুনুন তার ভাষ্যেই,

আমার দেখা অন্যতম সেরা ওডিআই ইনিংস ছিলো এটি!

প্রথম ম্যাচেই বাজিমাতের পরে; Image credit: Phil Walter/ Getty Images

বৃষ্টির বাধায় প্রথম ম্যাচে না পারলেও দ্বিতীয় ম্যাচে ঠিকই জয় এনে দিয়েছিলেন দলকে। তার ৩৯ বলে ৪৩ রানের ইনিংসেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল জয়ের নাটাই। কিছুদিন বাদেই চ্যাপেল-হ্যাডলি ট্রফিতে দেখা দিয়েছিলেন আরও বিধ্বংসী হয়ে, মাত্র ৩৪ বলে ৬৪ রানের ইনিংস দেখে ভেট্টোরি আরও একবার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, ‘তার দেখা সেরা স্ট্রোকপ্লে বলে,’ আর জনপ্রিয় ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো তো ঘোষণার সুরেই বলে দিয়েছিল, ‘গাপটিল দেখিয়ে দিলেন, নিউজিল্যান্ডের ভবিষ্যত কী দারুণ উজ্জ্বল!’

১৮৯, ২৩৭, ১৮০

অমন বিধ্বংসী শুরু তিনি হরহামেশাই পাচ্ছিলেন। কিন্তু, ইনিংসটাই বড় করতে পারছিলেন না। নইলে, প্রথম সেই সেঞ্চুরির পরে পরবর্তী শতকের দেখা পেতে আরও ৫৩ ম্যাচ অপেক্ষা করতে হবে কেন! মাঝে বাংলাদেশের বিপক্ষে আউট হয়েছিলেন নড়বড়ে নব্বইতে। প্রথম বিশ্বকাপেও পৌঁছে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় সেঞ্চুরির খুব কাছাকাছি, কিন্তু আউট হয়ে গিয়েছিলেন চৌদ্দ রান দূরত্বে।

১২ বার পঞ্চাশের চৌকাঠ পেরিয়ে অবশেষে গেরো কেটেছিল ৫৪-তম ম্যাচে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই সেঞ্চুরিতেই যেন পেয়ে গিয়েছিলেন ইনিংস বড় করবার তরিকা। সেই তরিকা কাজে লাগিয়েই রোজ বোলে খেলেছিলেন ১৮৯ রানের ইনিংস। ১৯ চার আর ২ ছক্কার ইনিংস খেলার পথেই লু ভিনসেন্টকে পেরিয়ে বনে গিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের মালিক।

১৮৯ এর পরে; Image credit: Mike Hewitt/ Getty Images

নিজের সে রেকর্ডকে ছাড়িয়েছিলেন নিজেই। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে আবারও ঝলসে উঠেছিল তার ব্যাট। কেকটিন স্টেডিয়ামের দর্শকদের সাক্ষী রেখে খেলেছিলেন ১১ ছয়ের ২৩৭ রানের ইনিংস। ৩৯৩ রানের নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের ৬০.৩১ শতাংশ রানই সেদিন এসেছিল তার ব্যাটে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ইনিংস নেই একটিও, রোহিত শর্মার অতিমানবীয় ২৬৪ রানের ইনিংসকে যদি অস্পৃশ্য ধরেই নেয়া হয়, তবে ওয়ানডে ইতিহাসেই এটি সর্বোচ্চ।

২০১৯ বিশ্বকাপটাই ব্যতিক্রম, নইলে উইলো হাতে এমন বিনোদনভরা ইনিংস তিনি তো কম উপহার দেননি। একদিবসী ক্রিকেটে তার স্ট্রাইক রেট ছাড়িয়েছে ৮৭, এমন রান-বলের পাল্লা দিয়ে ১৮০-ঊর্ধ্ব তিনটি ইনিংস খেলেছেন বলে গড়টাও ৪২.২০। তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট নিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন, এমন ক্রিকেটারের সংখ্যাটা পঞ্চাশেরও বেশি। তার চেয়ে বেশি গড়ও আছে ৪২ জন ক্রিকেটারের। তবে দুটোকে এক করলে, মার্টিন গাপটিলের তুল্য কাউকে খুঁজে পেতে একটু কষ্টই হবে।

ওয়ানডে ফরম্যাটটা তো মার্টিন গাপটিলেরই!

বাকি দুটো ফরম্যাটে

ওয়ানডেতে অমন ঔজ্জ্বল্যে ভরা শুরুর পরে টেস্ট ক্যাপ পেতেও দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়নি। ভারতের বিপক্ষে ১৪ আর ৪৮ রানের দুটো ইনিংস খেলে শুরু করলেও উন্নতির ধারাটা ধরে রাখতে পারেননি তেমন করে। ওয়ানডের ফরম্যাটে যেমন নিরবচ্ছিন্নভাবে খেলে গিয়েছেন এবং এখনো যাচ্ছেন, বিপরীতে টেস্ট ক্রিকেটে বারেবারেই পেয়েছেন বাধা। ৪৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে শেষ টেস্ট খেলেছেন সেই ২০১৬ সালে। আশ্চর্যই বলতে হবে, ওয়ানডেতেই যার রয়েছে তিনটি ১৮০-উর্ধ্ব ইনিংস, সেখানে টেস্টেও তার শতক সংখ্যা আটকে গিয়েছে তিনটিতেই।

টেস্টে নাহয় না-ই হলো; Image credit: Hannah Peters/ Getty Images

সাদা বলেই যে তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ, তা প্রমাণ করেই টি-২০ ক্রিকেটেও রান করেছেন ২,৩৮৬। দুই ভারতীয় রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির পরে টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ।

গন্তব্য লরা

ডার্বিশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলতে গিয়েছিলেন একবারই, সেই ২০১১ সালে। যাওয়ার আগে ডাক পড়েছিল স্কাই টিভির ইন্টারভিউ টেবিলে। সে ডাকে সাড়া দিতে গিয়েই হলো সর্বনাশের চূড়ান্ত। প্রথম দেখেছিলেন লরা ম্যাকগোল্ডরিককে। এরপরে যা হবার ছিল, প্রথম দর্শনেই প্রেম!

ডার্বির দিনগুলোতে যেমন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়েছিলেন নিজে, তেমনি ওই ক্ষণিকের টিভি-শোতে জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন লরাকেও। ইংল্যান্ড থেকে ফেরত আসতেই চার চোখ এক হয়েছিল আবারও। এরপরে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়, যা পরিণতি পেয়েছিল ২০১৪ সালে।

শুধুই উপস্থাপক-ক্রিকেটার নন; Image credit: Kai Schwoerer/ Getty Images

২০১৮ সালে দুজনের ঘর আলো করে আসা রাজকন্যার কথা তো আগেই পড়েছেন, যার জন্যে মার্টিন গাপটিল ওই বাইশ গজে গল্প আর কাব্য লিখে চলেছেন।

হার্লিটা যে কবে গল্প শুনতে চাইবে! গাপটিল তো গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেই আছেন।

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘খেলাধুলা’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ

১) মাশরাফি
২) কাছের ক্রিকেট দূরের ক্রিকেট
৩) ক্রিকেট অভিধান

This article is in Bangla language. The incredible journey of Martin Guptill, an international cricket star is written here. Necessary hyperlinks are attached inside.

Featured image © Anthony Au-Yeung/ Getty Images

Related Articles