ইতালির সিসিলি। সময়টা ১৯৪৩ সালের ১৯ জুলাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দান। মাথার ওপর ফাটছে মর্টার শেল। রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে জার্মান শিবির থেকে ছুটে আসা আর্টিলারি ফায়ারের বিস্ফোরণে। ফায়ারের শেলগুলো ধুলোমাখা মাটিতে মিশে করছে ধামাকা। এরই মাঝখানে এক শস্যক্ষেতে আটকা পড়েছে ব্রিটিশ আর্মির গোটা এক ব্যাটালিয়ন। ব্যাটালিয়নের নাম গ্রিন হাওয়ার্ডস। তুমুল গোলাবর্ষণে আগুন লেগে গেল শস্যক্ষেত আর গাছগুলোতে। বিপদ আরো বাড়লো। প্রতিপক্ষের কাছে একদম উন্মুক্ত হয়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যদের অবস্থান।
কিন্তু গ্রিন হাওয়ার্ডসের ফার্স্ট প্লাটুনের অধিনায়ক সাহস হারালেন না। পেছনে একটা ফার্মহাউজে ছিল ব্যাটালিয়নের এক প্লাটুন সৈন্য। তাদের কভারিং ফায়ারের আদেশ দিয়ে সামনে থাকা যোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে চললেন ৩৮ বছর বয়সী টগবগে অধিনায়ক। অ্যাটাকিং লাইনের একদম সামনে ছিলেন তিনি। ছুটছেন জার্মান শিবিরপানে। তখনই একটা শেল এসে বিঁধল বুকে, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। প্রচণ্ড জখম হলো শরীরে। তবুও তাকে দমায় কে? চিৎকার করে প্লাটুনের সৈন্যদের বললেন, ‘কিপ গোয়িং!’
অসম সাহসী সেই অধিনায়কের নাম হেডলি ভ্যারিটি। টানা ১২ দিন সেই জখমের সাথে লড়াই করে আর পেরে ওঠেননি, মারা যান ইতালির ক্যাসের্টায় এক হাসপাতালে। তার আছে এক করুন কাহিনি। সেটা জানতে পারবেন লেখার পরের অংশে। এই ফাঁকে তার পরিচয়টা দিয়ে নিই। ইংল্যান্ডের সেরা স্পিনারদের একজন তিনি, ইংলিশ ক্রিকেটের এক দারুণ চরিত্র। কাউন্টি মাতিয়েছেন ইয়র্কশায়ারের হয়ে; শুধু মাতিয়েছেন বললে ভুল হবে বোধহয়, বাঁহাতি স্পিনে রীতিমতো নাচিয়েছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। ঝুলিতে আছে প্রায় দুই হাজার উইকেট। এসব ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করছে অনন্য এক রেকর্ড।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বলা হয় যাকে। এত প্রভাবশালী এক ব্যাটসম্যানের উইকেট কতটা আরাধ্য ছিল বোলারদের কাছে, তার গুরুত্ব বোঝাতে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং রেকর্ডই যথেষ্ট। ক্রিকেটের সেই ডনকে গুনে গুনে আটবার আউট করেছেন ভ্যারিটি, সবচেয়ে বেশি। যেখানে ১৯৩১ সালে একবার ব্র্যাডম্যানের উইকেট পেয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হিরো হয়ে গেছিলেন হারম্যান গ্রিফিথ, সেখানে ইংল্যান্ডে ভ্যারিটিকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হতো, বলাই বাহুল্য।
দেশের ক্রিকেটকে দু’হাত ভরে দিয়েছেন, বিনিময়ে পেয়েছেনও অনেক কিছু। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে ছিলেন পুরোদস্তুর জেন্টলম্যান। শান্তশিষ্ট হলেও বুকে ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসার নদী। সেই নদীতে জোয়ার এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার পর। সবকিছু ফেলে জীবন বাজি রেখে ছুটলেন যুদ্ধের ময়দানে। ব্যাটের বদলে হাতে নিলেন বন্দুক, বলের জায়গায় হাতে তোলা বন্দুক থেকে ছুটে গেল বুলেট। মাঠে যেমন প্রতিপক্ষের উইকেট উপড়াতেন দারুণ কোনো টার্নিং ডেলিভারিতে, যুদ্ধের ময়দানে তেমনই প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করেছেন একেকটা মর্টারে। টানা চার বছর ছিলেন মর্টার-শেল-বুলেট-বন্দুকের সাথে। টিকে ছিলেন, টিকিয়ে রেখেছিলেন। সেই যাত্রাটা থেমেও গেল একটা সময়। ক্রিকেট মাঠ থেকে শুরু করে ইতালি পর্যন্ত ভ্যারিটির সেই যাত্রার গল্পটাই শোনাব আজ।
অ্যাশেজ, ব্র্যাডম্যান ও ভ্যারিটি
ইংলিশ ক্রিকেটের বিশাল ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সফল বাঁহাতি স্পিনারদের একজন ভ্যারিটি। ৪০ টেস্টে নিয়েছেন ১৪৪ উইকেট। আর কাউন্টিতে ৩৭৮ ম্যাচে ১,৯৫৬ উইকেট। গড়টাও চোখ কপালে তোলার মতো – ১৪.৯০! সেরা বোলিং ফিগারটা আরো চমকপ্রদ; ১৯৩২ মৌসুমে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে নটিংহ্যামকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন একাই, এক ইনিংসেই দশ রানে দশ উইকেট নিয়েছিলেন।
অভিষেক হয়েছিল ১৯৩১ সালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। আট বছরের জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে খেলেছেন চারটি অ্যাশেজ, যার মধ্যে আছে বহুল সমালোচিত বডিলাইন অ্যাশেজ সিরিজও। সেই সিরিজে চার ম্যাচে নেন ১১ উইকেট। তবে মঞ্চটা নিজের করে নিতে সময় নেন আরো এক বছর।
১৯৩৪ সালে ঘরের মাঠে ফিরতি অ্যাশেজে বাঁহাতি স্পিনে ভেলকি দেখান ভ্যারিটি। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ছিল লর্ডসে। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড করে ৪৪০। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ভ্যারিটির ঘূর্ণিজাদুতে ২৮৪’তে আটকে যায় অস্ট্রেলিয়া। ৬১ রানে নেন সাত উইকেট, একাই ধ্বসিয়ে দেন অজিদের।
অজিদের সেই ২৮৪’তে ব্র্যাডম্যানের অবদান ৩৬, যার বেশিরভাগই এসেছিল বাউন্ডারি থেকে। যেভাবে শুরু করেছিলেন ডন, সেটা ১৩৬ কিংবা ২৩৬ হওয়াটাও অসম্ভব ছিল না। ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগে তাকে বিদায় জানান ভ্যারিটি। ফলোঅনে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। একই দিনে আবার ব্যাট করতে নামে ব্র্যাডম্যানের দল। দ্বিতীয় ইনিংসে আরো ধ্বংসাত্মক বোলিং করেন ভ্যারিটি, ৪৩ রানে আট উইকেট। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অজিদের দ্বিতীয় ইনিংসেও ব্র্যাডম্যানের উইকেট নেন তিনি। একইদিনে ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানকে দুইবার আউট করার স্বপ্ন হয়তো দেখতো না তখনকার কোনো বোলার। অথচ ভ্যারিটি তা করে দেখিয়েছেন।
ম্যাচটা ইংল্যান্ড জিতে নেয় ইনিংস ও ৩৮ রানে। ম্যাচশেষে ভ্যারিটির বোলিং ফিগার ছিল ১০৪ রানে ১৫ উইকেট, যার মধ্যে ১৪টাই নিয়েছেন একদিনে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন কীর্তিতে এখন পর্যন্ত এক ও অদ্বিতীয় তিনি। কাউন্টি ক্রিকেটে অবশ্য একদিনে ১৭ উইকেটও নিয়েছেন তিনি। ১৯৩৩ সালে এসেক্সের বিপক্ষে এই বিধ্বংসী বোলিং করেন ভ্যারিটি। এমন কীর্তি আছে কেবল আর দু’জনের; কলিন ব্লাইথ ও টম গডার্ড।
ব্র্যাডম্যানের বিপক্ষে ১৭টি টেস্ট খেলেছেন ভ্যারিটি। সেই ১৭ টেস্টের আটবার তার কাছে উইকেট খুইয়েছেন ‘দ্য গ্রেট ব্র্যাডম্যান’। ব্র্যাডম্যানও তাকে সমীহ করতেন। কী, একটু অবাক লাগছে না? ব্র্যাডম্যানের মতো ক্রিকেটারও কাউকে সমীহ করতেন? চলুন, স্বয়ং ব্র্যাডম্যানের জবানিতেই শোনা যাক। ভ্যারিটির আত্মজীবনী লিখেছেন অ্যালান হিল। ‘হেডলি ভ্যারিটি: পোর্ট্রের্ট অফ আ ক্রিকেটার’ নামের বইটি প্রকাশ হয় ১৯৮৬ সালে।
সেই বইয়ে স্বয়ং ব্র্যাডম্যান লিখেছেন,
‘আমরা ছিলাম দুই শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও ক্রিকেটার আর পুরোদস্তুর ভদ্রলোক হিসেবে তার প্রতি আমার আলাদা একটা সম্মান ছিল। শারীরিক গঠন আর ধীরগতির আলসে রানআপের মিশেলে প্রতিটা ডেলিভারিতেই আলাদা সুবিধা পেতেন তিনি। সাথে লেন্থ আর বলের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্দান্ত। তবে ক্রিকেটিং স্কিলের চেয়ে বেশি ছিল তার স্পোর্টসম্যানশিপ। ছিল যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার দারুণ এক দক্ষতা। আমি তাকে কখনো অভিযোগ করতে দেখিনি।’
তিনি আরো বলেছেন,
‘ভ্যারিটির জীবনজুড়ে ক্রিকেটই ছিল। ক্রিকেটটাই ছিল তার জীবনের সেরা অংশ। ত্রিশের দশকের সেই সোনালী দিনগুলোতে তার সাথে একই মঞ্চে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি দারুণ সম্মানিতে বোধ করি।’
স্পিন-জাদুর কারিকুরি
বল করতেন প্রায় মিডিয়াম পেসারের গতিতে। যে রানআপ নিতেন, তা স্পিনারদের জন্য অনেক বড়ই ছিল। উচ্চতাও ছিল ভালো, ফিটনেসও দারুণ। প্রতিটা ডেলিভারিতেই তাই পেতেন আলাদা সুবিধা। সোজা কথায় একজন আদর্শ পেসারের যে ক’টা গুণ থাকা দরকার, সবই ছিল ভ্যারিটির। অথচ তিনি করতেন বাঁহাতি স্পিন।
ভ্যারিটির বোলিংয়ের বিশেষত্ব ছিল টানা এক জায়গায় বল করতে পারার সক্ষমতা। একই লেংথে সারাদিন ক্লান্তিহীনভাবে বল করে যাওয়ার মতো জীবনীশক্তি আর ধৈর্য্য ছিল তার। মাঝেমধ্যে দু-একটা ডেলিভারি এদিক-ওদিক হতো না, তা অবশ্য নয়।
বল করতেন জোরের ওপর। রিলিজ পয়েন্ট থেকে বাতাসে সুইং করে পপিং ক্রিজে যেত আড়াআড়িভাবে বাতাস কেটে। মাটিতে পিচ করার পর সেই ডেলিভারিৎ বেরিয়ে যেত টার্ন করে। ব্যাটসম্যানরা খাবি খেতেন ভেতরে পিচ করে বাইরে টার্ন করা সেসব ডেলিভারি খেলতে। মাঝেমাঝে ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের নাজহাল করতেন। ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে কিংবা ডাস্টে ভরা উইকেটে বল করতেন আলাদাভাবে। অমন সব উইকেটে ডেলিভারির গতি কমিয়ে দিয়ে মন দিতেন ফ্লাইট আর লুপে। লাইন-লেংথ থাকতো একদম মাপা। তার দর্শন ছিল একটাই, ব্যাটসম্যানকে খেলতে বাধ্য করা। আরো একটা গুণের জন্য অধিনায়ক তাকে ভরসা করতেন বেশি, টেলএন্ডারদের বিরক্তিকর ব্যাটিং থামাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ভ্যারিটি।
ইয়র্কশায়ারের জাদুকর
জন্ম ১৯০৫ সালে হেডিংলিতে। লিডসের পাশেই থাকতেন ভ্যারিটি। ছোট থেকেই ইয়র্কশায়ারের কিংবদন্তিদের খেলতে দেখে অভ্যস্ত ছিলেন, ক্রিকেটার হবার প্রেরণাটা তাদের থেকেই পেয়েছেন। তবে কাউন্টিতে ডাক পেয়েছেন ২৫ বছর বয়সে। তার একটা কারণও আছে। ইয়র্কশায়ারের বাঁহাতি স্পিনারের জায়গাটা বরাদ্দ ছিল কিংবদন্তি উইলেফ্রড রোডসের জন্য। তার মতো ক্রিকেটারকে সরিয়ে সেরা একাদশে জায়গা করে নেয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়!
ওদিকে ভ্যারিটি খেলে বেড়িয়েছেন ইয়র্কশায়ার কাউন্সিলের হয়ে। কখনো ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে, কখনো মিডলটনের সেন্ট্রাল লিগে। টানা পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন সেসব লিগে। তৈরি হয়েই ছিলেন, কখন ডাক আসে ইয়র্কশায়ার থেকে। অবশেষে শুনতে পেলেন সেই কাঙ্ক্ষিত ডাক। উইলফ্রেড রোডস অবসরের ঘোষণা দেন, আর সুযোগ পান এতদিন ইয়র্কশায়ারের রাডারে থাকা ভ্যারিটি।
চমক দেখান নিজের চতুর্থ ম্যাচেই। গ্ল্যামরগানের বিপক্ষে বৃষ্টিভেজা পিচে নেন নয় উইকেট। সেই তাক লাগানো বোলিং স্পেল দিয়েই দলে নিজের অবস্থান শক্ত করে নেন। পরের বছর অভিষেক হয় জাতীয় দলে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজে দুই টেস্টে নেন চার উইকেট। উইকেট কম হলেও বল হাতে ছিলেন দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত।
কাউন্টিতে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে মাত্র ১৩.৮৮ গড়ে নেন ১৬২ উইকেট। দুর্দান্ত সেই মৌসুমে দশ উইকেটও নেন এক ইনিংসে। নটিংহ্যামের বিপক্ষে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে মাত্র দশ রানে তাদের সবক’টি উইকেট তুলে নেন ভ্যারিটি, ভেঙে দেন জর্জ গিয়ারির রেকর্ড। লেস্টারশায়ারের হয়ে এক ইনিংসে ১৮ রানে দশ উইকেট নেন প্রয়াত এই মিডিয়াম পেসার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভ্যারিটির সেই রেকর্ড বোলিং ফিগার এখনো টিকে আছে।
এক ইনিংসে প্রতিপক্ষের দশ উইকেটের সবকটিই নেয়া বোলারদের তালিকাটা বেশ লম্বাই। তবে এই কীর্তি দুইবার করতে পেরেছেন একজন বোলারই। সেই বোলার হচ্ছেন ভ্যারিটি। প্রথমবার ইনিংসে দশ উইকেট নিয়েছিলেন ১৯৩১ সালে ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে। ঘরের মাঠে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তিনি নেন তিন উইকেটে। ওয়ারউইকশায়ার তার ভয়াল স্পিন দেখে তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে। ফলোঅনে পড়ে ব্যাট করতে নেমে ভ্যারিটির নিয়ন্ত্রিত লাইনলেংথের স্পিনে নাজেহাল হয় তারা, ৩৬ রানে দশ উইকেট নেন ভ্যারিটি।
ক্যারিয়ারের নানান রূপ
১৯৩৩ সালে ভারত সফরে যায় ইংল্যান্ড। বডিলাইন সিরিজে ইংল্যান্ড দলে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে কেবল অধিনায়ক ডগলাস জারডিন ও ভ্যারিটিরই জায়গা হয়েছিল সেই সফরে। ব্যাটে-বলে দারুণ ছন্দে ছিলেন ভারতের মাটিতে। কলকাতায় দ্বিতীয় টেস্টে করেন ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি, নেন আট উইকেট। মাদ্রাজে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে করেন ৪২ রান, উইকেট নেন ১১টি।
১৯৩৪ অ্যাশেজটা ভ্যারিটি কাটিয়েছেন স্বপ্নের মতো, ২৫ উইকেট নেন একাই। ১৯৩৫ সালে কাউন্টিতে ছাপিয়ে যান নিজের আগের মৌসুমকেও। ২১১ উইকেট নিয়ে ইয়র্কশায়ারকে কাউন্টি চ্যাম্পিয়ন করতে রাখেন অনব্দ্য ভূমিকা। তবে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখেন এর কিছুদিন পরই। পাঁচ টেস্টের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই সিরিজে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন ভ্যারিটি। চার টেস্টে মাত্র ১২ উইকে, তার নামের সাথে বড্ড বেমানান। প্রতিটি উইকেট পেতে তাকে করতে হয়েছে ৮৫ বল! সিরিজ চলাকালীন প্রস্তুতি ম্যাচেও ছন্দ হারিয়েছিলেন ভ্যারিটি। তার মতো দারুণ বোলারকে একহাত নিয়েছিলেন জক ক্যামেরন। ভ্যারিটির এক ওভারে ত্রিশ রান তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান এই ব্যাটসম্যান, ফলস্বরূপ বাদ পড়েন সিরিজের শেষ টেস্টের দল থেকে।
তিন ম্যাচের সিরিজ খেলতে ১৯৩৬ সালে জ্যামাইকা সফরে যায় ইয়র্কশায়ার। সিরিজের প্রথম ম্যাচেই জ্যামাইকানদের হারায় ইংলিশ এই কাউন্টি। ঘরের মাঠে দশ বছর পর ম্যাচ হেরেছিল সেবার জ্যামাইকা। সেই ম্যাচে ৫৭ ওভার বল করে ১০৬ রানে দশ উইকেট নেন। সিরিজের শেষ ম্যাচের নিষ্পত্তি হয় ড্র’তে। সেই ম্যাচের শেষদিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের প্রথম ও একমাত্র সেঞ্চুরি হাঁকান ভ্যারিটি। অলরাউন্ডিং পারফর্ম্যান্স দিয়ে আবারও জাতীয় দলে জায়গা করে নেন ভ্যারিটি।
সে বছরই ইংল্যান্ড সফরে যায় ভারত। সেখানে আবার দেখা মেলে অলরাউন্ডার ভ্যারিটির খোঁজ, পাঁচ টেস্টে শিকার করেন ১৫ উইকেট। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে খেলেন ৬৬ রানের ইনিংস, যা তার সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংস।
সে বছরের শেষদিকে অ্যাশেজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায় ইংল্যান্ড। অধিনায়ক গাবি অ্যালেনের দলে ছিলেন ভ্যারিটিও। স্পোর্টিং পিচে বল হাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। উইকেট পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে, মাত্র ১১ উইকেট পান সেই সিরিজে। সিডনিতে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ৭৯ রানে তিন উইকেট নেন। ফলোঅনে পড়ে ব্যাট করছিল অজিরা। ইংলিশ বোলারদের তখন সামলাচ্ছিলেন ব্র্যাডম্যান। তিনি যখন ৮২ রানে, তখনই ভ্যারিটির বলে বোল্ড হন তিনি। সেই ম্যাচটাও ইংল্যান্ড জিতে ইনিংস ব্যবধানে।
সিরিজের তৃতীয় টেস্টটা ইংল্যান্ড হারলেও ভ্যারিটির বোলিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং নেভিল কার্ডাস। মেলবোর্নে সেই টেস্টের দুই ইনিংসেই ভ্যারিটির বলে আউট হন ব্র্যাডম্যান। প্রথম ইনিংসে ব্র্যাডম্যানের উইকেট সহজে পেয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ইংলিশ বোলারদের সুযোগ দেননি, তুলোধুনা করে খেলেন ২৭০ রানের ইনিংস; অস্ট্রেলিয়া করে ৫৬৪ রান। সেই ইনিংসে ব্যাটিং পজিশন বদল করেছিলেন ব্র্যাডম্যান, সাধারণত টপ অর্ডারে ব্যাট করলেও সেই ইনিংসে সাত নম্বরে নেমেছিলেন তিনি। দারুণ ছন্দে থাকা ডনকে ভ্যারিটি থামান ৩৮ ওভার বল করে। তখন টেস্টে আট বলে এক ওভার হিসেব করা হতো। ৭৯ রানে তিন উইকেট নেন ভ্যারিটি।
অমন লম্বা বোলিং স্পেল দেখে নেভিল কার্ডাস ভ্যারিটির প্রশংসা করে লেখেন,
‘ভ্যারিটি ছিলেন দুর্দান্ত, চমৎকার। ভ্যারিটি না থাকলে ব্র্যাডম্যান হয়তো আরো ১০০ রান করে ফেলতেন। বিশেষ কিছুই না, শুধুমাত্র পরিপূর্ণ লেংথ আর মাপা ফ্লাইট দিয়েই ব্র্যাডম্যানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ভ্যারিটি। তিনি এমন একটা আবহ তৈরি করেছিলেন যে, ব্র্যাডম্যানকে প্রতিটা রান আদায় করে নিতে হয়েছে কষ্ট করে। অনিন্দ্য সুন্দর বোলিং ছিল, চোখের শান্তি যাকে বলে।’
সেবারের অ্যাশেজে ওপেনিং পেয়ার নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিল ইংল্যান্ড। কখনো আর্থার ফ্যাগ-কিম বার্নেট, কখনো বার্নেটের সঙ্গে স্ট্যান ওর্দিংটন। কিন্তু কোনো জুটিই ক্লিক করছিল না। সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অধিনায়ক অ্যালেন বার্নেটের সঙ্গে ওপেন করতে পাঠান ভ্যারিটিকে। সেই টোটকা কাজে লাগলো, অ্যাডিলেডে দুই ব্যাটসম্যান গড়লেন ৫৩ রানের জুটি; সেই সফরে উদ্বোধনী জুটিতে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ। ১১৯ বলে ১৯ রান করেন ভ্যারিটি। দ্বিতীয় ইনিংসেও দু’জন গড়েন ৪৫ রানের জুটি। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান না হলেও ব্যাটসম্যানশিপের কোনো কমতি ছিল না তার।
এর দুই বছর পরের কথা। ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডে ফিরতি অ্যাশেজ। সবক’টা ম্যাচ হলো ব্যাটিং উইকেটে। সেবার রীতিমতো রানের বন্যা হচ্ছিল অ্যাশেজে। অমন উইকেটে ভ্যারিটিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। অধিনায়ক ওয়ালি হ্যামন্ডও তাই তার কাঁধে ভরসার হাতটা রাখেননি ওভাবে।
বল হাতে জাদু দেখাতে না পারলেও সতীর্থদের দারুণ সমর্থন দিয়েছেন সেবার। ওভাল টেস্টে ৩৬৪ রানের বিশাল এক ইনিংস খেলেন লেন হাটন। ইয়র্কশায়ারে একসঙ্গেই খেলতেন ভ্যারিটি ও হাটন। ইনিংসের বিরতির সময় হাটনের সঙ্গে কথা বলেছেন ভ্যারিটি, তাকে সাহস দিয়েছেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সিরিজ চলাকালীন এক ছুটির দিনে ভ্যারিটি তাকে নিয়ে গেছিলেন সমুদ্র সৈকতে, ক্রিকেট থেকে দূরে রাখার জন্য।
ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ১৯৩৯ সালে লর্ডসে। প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আট উইকেটে জেতা সেই ম্যাচে ২০ রানে দুই উইকেট নেন। সেই মৌসুমেই বইতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাওয়া। বিশ্বযুদ্ধ বাগড়া দেয়ার আগে ১৩ গড়ে ১৯১ উইকেট নেন ভ্যারিটি। সে বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর সাসেক্সের বিপক্ষে খেলছিল ইয়র্কশায়ার। ভ্যারিটিও ছিলেন আগের মতোই ক্ষুরধার, সাসেক্সের ব্যাটসম্যানরা পাত্তাই পাচ্ছিলেন না। মাত্র ছয় ওভার বল করে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন সাসেক্সকে। ছয় ওভার বল করে মাত্র নয় রানে সাত উইকেট নেন। সাসেক্স থেমে যায় মাত্র ৩৩ রানে।
অমন দাপুটে পারফর্ম্যান্সের পর দর্শকরা ছুটে গিয়েছিল মাঠে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে অভিনন্দন জানাতে। উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত ভ্যারিটি তখন বলেন,
“I wonder if I’ll ever bowl here again.”
সত্যিই তো! ভ্যারিটি আর লিডসে খেলতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তখনই বন্ধ হয়ে যায় ক্রিকেট। সেই ম্যাচটাই সাক্ষী হয়ে রইল ইয়র্কশায়ারের জার্সিতে ভ্যারিটির শেষের।
সিসিলিতে সর্বনাশ
লেখার শুরুতেই বলেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটি ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন ছিলেন ভ্যারিটি। যুদ্ধ শুরু হবার আগে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। যদিও তিনি এর আগেই যেতে চেয়েছিলেন, ১৯৩৮ সালে মিউনিখ ক্রিসিসের চলাকালীন। যোগাযোগ করেছিলেন কর্নেল আর্নল্ড শ’র সাথে। সেই আগ্রহ থেকেই ১৯৩৩-৩৪ সালে ভারত সফরে গিয়ে অবসরে মিলিটারি সম্পর্ক কিছু বই পড়েছিলেন। ছিলেন বইয়ের পোকা। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও তাই করেছিলেন। ভ্যারিটির বইপ্রেম নিয়ে মজার তথ্য দিয়েছিলেন নেভিল কার্ডাস। অস্ট্রেলিয়া সফরে যাওয়ার সময় জাহাজে একই কেবিনে ছিলেন কিম বার্নেট ও ভ্যারিটি। তখন একজন আরেকজনকে ‘The Seven Pillars of Wisdom’ বইটি পড়ে শোনাচ্ছিলেন।
যুদ্ধের ময়দানে ফেরা যাক। যুদ্ধ শুরু হলো। আবারও কর্নেল শ’র শরণাপন্ন ভ্যারিটি। দুই বছর প্রশিক্ষণের পর পদোন্নতি হয় তার। ১৯৪১ সালে গ্রীন হাওয়ার্ডের ফার্স্ট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও কোম্পানি কমান্ডার নির্বাচিত হন। প্রথমে রাঁচিতে, এরপর পারস্য, সিরিয়ায় নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে ব্যাটালিয়ন নিয়ে পৌঁছান মিশরে। সেই মিশরেই জীবনের শেষ ম্যাচটা খেলেছিলেন, সেখান থেকে ইতালিতে যাওয়ার আগে।
১৯৪৩ সালের ১০ জুলাই ইতালির সিসিলির কাতানিয়ায় পৌঁছান ভ্যারিটি, যেখানে জার্মান শিবিরে আক্রমণ করার কথা ছিল ইংলিশদের। অবশেষে এলো সেই সময়, ১৯ জুলাই। সেই রাতেই শেলের আঘাতে আহত হয়েছিলেন ভ্যারিটি। বাজে একটা জখম হয়েছিল বুকে। ভ্যারিটির খোঁজ পায় না কেউ। তাকে খুঁজতে বের হন টম র্যানল্ডসন, যিনি ছিলেন ভ্যারিটির ব্যাটম্যান (কমিশন্ড অফিসারদের ব্যক্তিগত সহকারী)। অনেক খোঁজার পর শেষ পর্যন্ত ভ্যারিটিকে খুঁজে পান টম। তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যান ফিল্ড হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে ইতালির নেপলসে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য। টানা তিনদিনের ভ্রমণ শেষে ভ্যারিটির জায়গা হয় ক্যাসের্টার এক মিলিটারি হাসপাতালে।
সেখানে তাকে চিনতে পারেন ইয়র্কশায়ারের একজন, মেডিকেল আর্দারলি হেন্টি। স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন ভ্যারিটি। তাকে দেখে হেন্টি প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কি ইয়র্কশায়ারের সেই ক্রিকেটার?’ উত্তরে ভ্যারিটি বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন হেন্টিকে নিজের স্ত্রী আর দুই ছেলের ছবি বের করে দেখিয়েছিলেন ভ্যারিটি।
তিনদিন পর অপারেশনের টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয় ভ্যারিটিকে। তার পাঁজরের একটা অংশ কেটে ফেলে দিতে হয়। কারণ, ফুসফুসে সেটা আলাদা করে চাপ দিচ্ছিল। ওদিকে টানা রক্তক্ষরণে শরীর আরো দুর্বল হচ্ছিল তার। অপারেশনের ধকলটাও তাই শরীর নিতে পারেনি। টানা ১২ দিনের লড়াই শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভ্যারিটি। ১৯৪৩ সালের ৩১ জুলাইয়ের বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন ইংল্যান্ডের সেরা বাঁহাতি স্পিনারদের একজন। অথচ সিসিলি মিশনের আগে গ্রীন হাওয়ার্ডস ব্যাটালিয়নের জেনারেল মাইলস পরিকল্পনা করছিলেন ভ্যারিটিকে ছুটি দেয়ার, যাতে করে তিনি আবারও ইয়র্কশায়ারের হয়ে ক্রিকেট খেলতে পারেন। অপেক্ষা ছিল শুধু সিসিলি মিশনটা শেষ হওয়ার।
ওদিকে ইংল্যান্ডে ভ্যারিটির পরিবারের কাছে তার মৃত্যুর খবর তখনো পৌঁছায়নি। কয়েক সপ্তাহ পর ভ্যারিটির সাবেক অধিনায়ক ডগলাস জারডিন চিঠি লেখেন ভ্যারিটির স্ত্রী ক্যাথলিনের কাছে। এরপর জানতে পারেন তারা।
যুগে যুগে কত বড় বড় চরিত্র এসেছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটে। সেই ডব্লিউ.জি. গ্রেস থেকে শুরু করে হালের বেন স্টোকস – মাঝে অনেকগুলো নাম, অনেকগুলো বর্ণিল চরিত্র, অগণিত রেকর্ড। তবুও সেই বিশাল ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হ্যাডলি ভ্যারিটি। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার রবার্টসন গ্লাসগো উইজডেনে লিখেছেন,
‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৬ ইনিংসে ৯১.৪২ গড় ব্র্যাডম্যানের। আমার ধারণা, ভ্যারিটির কারণেই সেটা ১৫০ ছাড়ায়নি। ব্র্যাডম্যানের বিপক্ষে যে তিন-চারজন বোলার চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পেরেছেন, তাদের মধ্যে একজন ভ্যারিটি।’
মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে ছিলেন সিংহহৃদয়। মাঠে প্রতিপক্ষকে তোয়াক্কা করেননি। একের পর এক ডেলিভারিতে পরাস্ত করেছেন; মার খেয়েছেন, তবুও হাল ছাড়েননি। ঠিক তেমন ছিলেন যুদ্ধের ময়দানেও। বুকে গুলি লাগার পরেও চিৎকার করে বলেছেন,
‘কিপ গোয়িং।’
পৃথিবীতে মাত্র ৩৮ বছর ৭০ দিনে বেঁচে ছিলেন হ্যাডলি ভ্যারিটি। ক্রিকেট মাঠে কাটিয়েছেন মাত্র দশ বছর, খুব অল্প সময়ই বলা চলে। তবুও তার কী দারুণ প্রভাব! ছোট্ট সময়, কিন্তু যে কীর্তিগুলো রেখে গেছেন, তা এখনো উজ্জ্বল। সেই অ্যাশেজ কিংবদন্তি, ইয়র্কশায়ারের জাদুকরী স্পিনার, যাকে সমঝে চলতেন ব্র্যাডম্যানও। সেই দারুণ ক্রিকেটার, যিনি প্রাণ হারিয়েছেন দেশের জন্য। শর্ট বাট স্প্লেন্ডিড লাইফ!