Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের ইতিকথা

একসময় ফুটবল ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। বৃষ্টির দিনে কাদামাটি মাখামাখি করে ফুটবল খেলার চল এখনো থাকলেও জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সব জায়গায় ক্রিকেট আজ ফুটবলকে ছাপিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ফিফার র‍্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে গেলেও সেরাদের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। সবসময় কিন্তু এমনটা ছিল না। দীর্ঘ একটা সময় আমরা অপেক্ষায় থাকতাম বাংলাদেশ ৫০ ওভার ব্যাট করবে কিংবা ১০০ রানের নিচে হারবে। এগুলোই ছিল সেসময় ভাল খেলার সংজ্ঞা। চলুন দেখে আসা যাক কিভাবে বাংলায় ক্রিকেট আসল, এরপর কিভাবে ক্রিকেটের উত্থান হলো ফুটবল এমনকি জাতীয় খেলা হা-ডু-ডুকে ছাপিয়ে।

রেললাইনে ক্রিকেট, Source: Tom Shaw, Getty Image

পৃথিবীর আর সব জায়গার মতো ভারতবর্ষেও ক্রিকেট এসেছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ক্রিকেটের সূচনা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে। ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচের কথা জানা যায় ১৭৯২ সালে, কলকাতায়। খুব দ্রুতই পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারে ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে থাকে। কিন্তু পূর্ব বাংলা মানে বর্তমান বাংলাদেশে ক্রিকেট আরো অনেক পরে আসে। এর প্রধান কারণ ছিল ইউরোপীয়দের অনুপস্থিতি। প্রচুর নদ-নদীতে বেষ্টিত বাংলাকে ব্রিটিশরা অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি বলে উন্নয়নও হয়নি দীর্ঘদিন। ১৮৬০ সালের দিকে ব্রিটিশরা প্রথম বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের উন্নয়নে অবকাঠামো বানানো শুরু করে। রাস্তাঘাট বানানোর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের ফলে ইউরোপীয়রা ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে সেসময় থেকে। এর ফলে ক্রিকেটের সাথে পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের মানুষের এবং ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো দ্রুতই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৭৬ সালে ঢাকায় ইউরোপীয় একাদশ বনাম স্থানীয়দের দলের একটি ম্যাচও হয়, স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয়রা জয়লাভ করে।

দেশভাগের আগপর্যন্ত বাংলা দল ছিল দুই বাংলার মিলিত দল কলকাতা ভিত্তিক একটি দল, কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন ছিল এই দলের হোম গ্রাউন্ড। ১৯৩৪ সালে বিসিসিআই রঞ্জি ট্রফির সূচনা করে, কিন্তু ‘বেঙ্গল দল’ সেবার খেলেনি। পরের বছর ডিসেম্বরে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পাওয়ার পরের মাসেই মানে ১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে রঞ্জি ট্রফিতে খেলা শুরু করে। সাফল্যও আসে বেশ দ্রুত, প্রথমবারেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়ে মাদ্রাজের কাছে হেরে যায় বেঙ্গল দল। ১৯৩৭ সালে তারা হয় রানার্স-আপ, আর ঠিক দু’বছর পর ১৯৩৯ সালে চ্যাম্পিয়ন। ঢাকায় প্রথম ম্যাচের কথা জানা যায় বাংলা গভর্নর একাদশের সাথে একটি ম্যাচ, যা হয়েছিল সেসময়ের ঢাকা স্টেডিয়ামের বেঙ্গল জিমখানায়। এই ঢাকা স্টেডিয়াম হচ্ছে আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বেঙ্গল দলও ভাগ হয়ে যায়। বর্তমান বাংলাদেশ হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ আর পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায় ভারতের। পাকিস্তান হবার পর প্রায় ৮ বছর বাংলাদেশে কোনো প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ হয়নি। ১৯৫৪-৫৫ সালে ক্রিকেট আবার ফিরে আসে বাংলাদেশের মাটিতে।

১৯৫৪-৫৫ থেকে ১৯৭০-৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৩টি দল পাকিস্তানের কায়েদ-এ-আজম ট্রফি এবং আইয়ুব ট্রফিতে খেলে, যদিও বেশিরভাগ দলই এক-দুবারের বেশি খেলতে পারেনি। ‘পূর্ব পাকিস্তান দল’ খেলে সবচেয়ে বেশি ৯ বার। এরপর রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪ বার এবং পূর্ব পাকিস্তান সবুজ দল ও পূর্ব পাকিস্তান সাদা দল ৩ বার করে খেলে। ১৯৫৪-৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মূল দল ভারত ক্রিকেট দলের সাথে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচও খেলে।

বাংলাদেশে প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয় ১৯৫৫ সালে, ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। এই ম্যাচটি হয় বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। চট্টগ্রামের এম. এ.আজিজ স্টেডিয়ামে অনেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ হলেও পাকিস্তান আমলে কখনো কোনো টেস্ট ম্যাচ হয়নি। পুরো ষাটের দশক জুড়েই পাকিস্তান ঢাকায় অনেকগুলো ম্যাচ খেলে।

১৯৭০ এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমির কারণে রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলেও প্রথমে তা ক্রিকেটে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মাটিতে শেষ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ হয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড একাদশ আর বিশ্ব একাদশের মাঝে। এই ম্যাচটি হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত। ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ স্থগিতের ঘোষণায় বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ শুরু করে এবং ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র হয়। মার্চ মাসে কায়েদ-এ-আজম ট্রফির দুটি ম্যাচ ঢাকায় হবার কথা থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য ম্যাচ দুটি স্থগিত করা হয়। পাকিস্তান আমলে এরপর আর কোনো ক্রিকেট ম্যাচ হয়নি বাংলাদেশের মাটিতে।

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোই ছিল সরকারের মূল লক্ষ্য। এরপরেও ১৯৭২ সালে সরকার গঠন করে ;বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড’। বর্তমানে এটিই ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)’ ক্রিকেটের অভিভাবক হিসেবে কাজ করছে। ঢাকায় ক্রিকেট বেশ জনপ্রিয় ছিল, সেখানেই দেশের প্রথম প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেট শুরু হয় ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ক্লাবভিত্তিক ক্রিকেটের নক আউট টুর্নামেন্ট ছিল সেটি। ১৯৭৪-৭৫ থেকে জাতীয় পর্যায়ে ক্লাব ক্রিকেটের লীগ শুরু হয় যা প্রায় প্রতি মৌসুমেই অনুষ্ঠিত হয়েছে এখন পর্যন্ত। যদিও এই টুর্নামেন্ট কখনোই প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পায়নি।

১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে এমসিসির একটি দল বাংলাদেশে আসে, তারা বেশ কয়েকটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশে। এ সময়ই বাংলাদেশের জাতীয় দল গঠন করা হয় প্রথমবারের মতো। এমসিসি জাতীয় দল ছাড়াও আরো কিছু ম্যাচ খেলে। এই ম্যাচগুলো যদিও প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পায়নি, বাংলাদেশ এমসিসিকে বেশ ভাল ইম্প্রেস করে এই ম্যাচগুলোতে। ফলস্বরূপ ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে ক্রিকেটের নতুন যাত্রা শুরু করে।

১৯৭৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো শ্রীলংকা বাংলাদেশে আসে পূর্ণ আন্তর্জাতিক দল হিসেবে। সেসময় শ্রীলংকা টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলেও চার বছর পরই পেয়ে যায়। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মানদন্ডের কারণে ম্যাচগুলো প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পায়নি। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে হায়দ্রাবাদ ব্লুজ বাংলাদেশে একটি ম্যাচ খেলে। সে বছরই এমসিসি আবার বাংলাদেশে আসে, ৬টি ম্যাচ খেলে জাতীয় দলের বিপক্ষে। এবারও কোনোটিই প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পায়নি।

১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছিল। গ্রুপ পর্বে প্রথম ম্যাচে ফিজিকে হারিয়ে শুভ সূচনা করলেও পরের ম্যাচে কানাডার কাছে বাজেভাবে হারে। তৃতীয় ম্যাচে মালয়শিয়াকে হারানোর পর সমীকরণ দাঁড়ায় শেষ ম্যাচে ডেনমার্ককে হারালেই সেমিফাইনাল। কিন্তু ডেনমার্কের কাছে মাত্র ১০ রানে হেরে গ্রুপ পর্বেই শেষ হয় বাংলাদেশের যাত্রা।

১৯৮২ সালে আইসিসি ট্রফি আবারো ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া আর নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে খুব অল্প ব্যাবধানে জেতে, কিন্তু বারমুডার কাছে খুব বাজেভাবে হেরে যায়। তবে বৃষ্টির কল্যাণে সেমিফাইনালে ওঠা বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে মাত্র ১২৪ রানে অল আউট হয়ে হেরে যায়। এরপর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও পাপুয়া নিউগিনির কাছে তিন উইকেটে হেরে টুর্নামেন্টে চতুর্থ হয়।

১৯৮৩-৮৪ সালে বাংলাদেশ প্রথম কোনো টুর্নামেন্টের হোস্ট হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান টুর্নামেন্টে জাতীয় দল খেলে হংকং, সিংগাপুর এবং বিসিবি অনুর্ধ্ব-২৫ দলের বিরুদ্ধে। এই টুর্নামেন্টে ফাইনালে হংকংকে তিন উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জেতে।

১৯৮৪-৮৫ সালে নিউজিল্যান্ড দল আসে বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিসিবি অনুর্ধ্ব-২৫ দলের বিরুদ্ধে দুটি স্বল্প ওভারের ম্যাচ খেলে নিউজিল্যান্ড। মার্চে শ্রীলংকা একটি তিনদিনের ম্যাচ খেলার জন্য বাংলাদেশে আসে, গাজী আশরাফের নেতৃত্বে সেই ম্যাচ ড্র হয়।

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপে খেলার আমন্ত্রণ পায়। এতদিন পর্যন্ত খেলা ম্যাচগুলো একটিও লিস্ট-এ বা ওডিআই মর্যাদার ছিল না। ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো লিস্ট-এ ম্যাচ খেলে অর্থাৎ এ দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেকটি নতুন যাত্রার শুরু হয়। গাজী আশরাফের নেতৃত্বে ম্যাচটি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, শ্রীলংকার টাইরনে ফার্নান্দো স্টেডিয়ামে। মাত্র ৯৪ রানে অলআউট হয়ে সাত উইকেটে ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে শ্রীলংকার কাছেও একই ব্যাবধানে হারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জাতীয় দল, Source: Wikimedia

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের হোস্ট হয়, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ওডিআই ম্যাচ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার সাথে সবগুলো ম্যাচ হেরে শেষ হয় বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট। ১৯৯০ সালে হায়দ্রাবাদ ব্লুজ এবং ডেনমার্ক বাংলাদেশে আসে, যদিও তাদের সাথে ম্যাচগুলো ওডিআই মর্যাদার ছিল না। সে বছরই আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ আবার সেমিফাইনালে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে যায়।

১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সার্ক টুর্নামেন্টের আয়োজন করে, যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় দল ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার এ দলের বিপক্ষে খেলে। শ্রীলংকা এ দলকে সাত উইকেটে হারালেও পরের ম্যাচে পাকিস্তান এ দলের বিপক্ষে হেরে যায় পাঁচ উইকেটে। শেষ ম্যাচে দর্শকদের গন্ডগোলের কারণে ভারত এ দলের বিপক্ষে ম্যাচ বাতিল হয়।

এরপর জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান বাংলাদেশে এসে দুই-একটি করে ম্যাচ খেলে যায়। বাংলাদেশ একটি ম্যাচ জিততে না পারলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করছিল। ১৯৯৪ সালে আইসিসির এক হিসেবে বাংলাদেশে ৯৩ হাজার ক্রিকেট খেলোয়াড় রয়েছে বলে দেখানো হয়। সে বছরই কেনিয়ায় আইসিসি ট্রফিতে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যায় বাংলাদেশ। ডিসেম্বরে আবারো সার্ক টুর্নামেন্টের আয়োজন করে বাংলাদেশ। এবার ফাইনাল পর্যন্ত গেলেও ভারত এ দলের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ। ১৯৯৫ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খেলে। কিন্তু আগের মতোই সব ম্যাচ হেরে যায়।

১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফি থেকে শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের জয়যাত্রা। গ্রুপ পর্বের পাঁচটি ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল লীগ, যেখানে নেদারল্যান্ড আর হংকংকে পরাজিত করে আর আয়ারল্যান্ডের সাথে ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যাক্ত হয়। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ।

এরপরের ফাইনালটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, কেনিয়ার বিরুদ্ধে। মজার ব্যাপার হলো বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচটি হয়েছিল দু’দিন ধরে। কেনিয়া প্রথমে ব্যাট করে ২৪১ রান করে। বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ ব্যাট করতে নামে পরের দিন, টার্গেট দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬। ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট হারালেও মিডল অর্ডারের দৃঢ়তায় ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত শেষ বলে রান নিয়ে এক ঐতিহাসিক জয় পায় বাংলাদেশ।

ট্রফি হাতে আকরাম খান, Source: Cricinfo.com

১৯৯৭ সালের ১৭-১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অফিশিয়াল প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে, নিউজিল্যান্ডের সেডন পার্কে, নর্দান কনফারেন্স টিমের বিপক্ষে। ইনিংস এবং ১৫১ রানে হেরে সে ম্যাচটি মোটেও স্মরণীয় করে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ আয়োজন করে আইসিসি নকআউট ট্রফির। সবগুলো টেস্ট খেলুড়ে দেশ নিয়ে ছিল সে টুর্নামেন্ট, যেটি এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার একমাত্র বড় টুর্নামেন্ট জয় হিসেবে রয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার মধ্যে।

১৯৯৯ সালে শুরু হয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে, পরের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুটি ম্যাচই বাজেভাবে হারে বাংলাদেশ। তৃতীয় ম্যাচে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় আসে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২ রানে। নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপটা স্মরণীয় করে রাখে বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের সাথে জয়ের পথে বাংলাদেশে, Source: Sportskedda

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কয়েকধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়। ২৬ জুন ২০০০, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেই স্মরণীয় দিন। সে বছরই নভেম্বরের ১০ তারিখে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলতে নামে প্রথম টেস্ট। প্রথমে ব্যাট করে আমিনুল ইসলামের রেকর্ড সেঞ্চুরিতে বেশ ভাল স্কোর করলেও দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিং ব্যার্থতায় হেরে যেতে হয় ৯ উইকেটে। এ সময়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেরও বেশ প্রসার ঘটে। জাতীয় ক্রিকেট লীগ শুরু হয় ১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে। পরের মৌসুমেই জাতীয় ক্রিকেট লীগ প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পায়।

প্রথম টেস্ট ম্যাচের শুরুতে দুই অধিনায়ক, Source: Tigercricket

১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে জয়ের পর দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থা ছিল শোচনীয়, ওয়ানডেতে টানা ৪৭ ম্যাচ না জেতার এক লজ্জার রেকর্ড হয় বাংলাদেশের। বৃষ্টির কল্যাণে টানা হারের রেকর্ডটা ২৩ ম্যাচের চেয়ে বেশি হতে পারেনি। আগের বিশ্বকাপ যতটা স্মরণীয় ছিল, ২০০৩ বিশ্বকাপ ঠিক ততটাই দুর্ভাগা ছিল বাংলাদেশের জন্য, একটি ম্যাচও জেতা হয়নি সেবার। ঈদের দিন কানাডার কাছে হেরে জয়বিহীন ভুলে যাবার এক বিশ্বকাপ হয়ে যায় সেবারের বিশ্বকাপ।

দীর্ঘ ৪৭ ম্যাচ পর বাংলাদেশ ওয়ানডেতে জয় পায় জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। তবে টেস্ট জেতা তখনো হয়ে উঠেনি। সবার কাছে রীতিমত ধবল ধোলাই ছিল নিয়মিত ঘটনা। কোনোমতে ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে পারলে বা টেস্টে কেউ ৫০ করলে সেটাই দর্শকদের কাছে অনেক বড় ছিল।

২০০৩ সালে মুলতান টেস্ট বাংলাদেশের শোকগাঁথার এক অপর নাম। আম্পায়ারের ভুল আর পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণে জিততে থাকা বাংলাদেশ হেরে যায় সেই ম্যাচ। সেই সিরিজেই অলক কাপালি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে হ্যাট্রটিক করেন।

এরপর আসে ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৪। ভারত মহাসাগরে সুনামীর প্রলয়ে ধ্বংসলীলা চলে, সেই সাথে ঢাকায় বাংলাদেশ ১৫ রানে ভারতকে হারিয়ে দেয় তিন ম্যাচ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে। সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রায় জিতেই গিয়েছিল, মাত্র ১১ রানে হেরে যেতে হয় সেবার। শেষ ম্যাচে অবশ্য ভারত কোনো সুযোগই দেয়নি বাংলাদেশকে। ভারতের পর বাংলাদেশের বড় শিকার হয় অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডেতে এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর রেকর্ড ঐ একবারই। ২০০৫ সালের ১৮ জুন কার্ডিফে প্রথমে ব্যাট করা অস্ট্রেলিয়ার ২৫০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শুরুতে বেশ ভাল বিপর্যয়েই পড়ে বাংলাদেশ। এরপর হাবিবুল বাশার আর মোহাম্মদ আশরাফুলের পার্টনারশিপে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। আশরাফুলের সেঞ্চুরিতে জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যায় বাংলাদেশে। জেসন গিলেস্পির করা শেষ ওভারের প্রথম বলে ছয় মেরে জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন আফতাব আহমেদ। পরের বলেই সিংগেল নিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা আপসেটের জন্ম দেয় বাংলাদেশ।

অস্ট্রেলিয়ার সাথে শতকের পর আশরাফুল, পাশে হতাশ পন্টিং, Source: Cricinfo

২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি আসে বহুল প্রতীক্ষিত প্রথম টেস্ট জয়। চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট জয় করে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে হাবিবুল বাশারের ৯৪ রানে ভর করে ৪৮৮ রান করে বাংলাদেশ। মোহাম্মদ রফিকের ঘূর্ণি জাদুতে জিম্বাবুয়ে আটকে যায় ৩১২ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ করে ২০৪ রান। শেষ ইনিংসে এনামুল হক জুনিয়রের ঘূর্ণিতে পরাজিত হয় জিম্বাবুয়ে। পরের ম্যাচ ড্র করে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় করাও হয়ে যায় বাংলাদেশের। সেবারই জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজও জয় করে বাংলাদেশ, তাও ২-০ তে পিছিয়ে থেকে পরের তিনটি ম্যাচ জেতার এক অনবদ্য রেকর্ড করে।

প্রথম টেস্ট জয়ের পর বাংলাদেশের ভিক্টরি ল্যাপ, Source: Cricinfo.com

২০০৬ সালে দেশের মাটিতে শ্রীলংকার সাথে প্রথম ওয়ানডে জেতে বাংলাদেশ। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে প্রথমে ব্যাট করে শ্রীলংকা ২১২ রানে অলআউট হয়ে যায়। তিন ওভার আর চার উইকেট হাতে রেখেই ম্যাচ জিতে যায় বাংলাদেশ।

এপ্রিলে ফতুল্লায় অস্ট্রেলিয়ার সাথেও প্রায় জয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। শাহরিয়ার নাফিসের ১৩৮ রানের সুবাদে ৪২৭ রানে শেষ হয় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে বেশ ভাল চাপে ফেললেও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১৪৪ রানে ফলোঅন এড়ায় অস্ট্রেলিয়া। ১৫৮ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেও মাত্র ১৪৮ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসেও শুরুতে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে। কিন্তু এবারো রিকি পন্টিং এর ব্যাটে ভর করে তিন উইকেটে জিতে যায় ম্যাচটি।

২০০৭ সালের বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক নতুন মাইলফলক। প্রথম ম্যাচেই টপ ফেভারিট ভারতকে হারিয়ে আগের বিশ্বকাপের ভূত দূর করে বাংলাদেশ। এই ম্যাচেই আজকের তারকাদের উত্থানের প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছিল। জহির খানের বলে তামিম ইকবালের ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছয় মারা কিংবা সাকিব-মুশফিকের দায়িত্বশীল ব্যাটিং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। পরের ম্যাচে শ্রীলংকার কাছে হেরে সমীকরণ একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল কিন্তু শ্রীলংকার কাছে ভারতের হার আর বারমুডার বিপক্ষে বাংলাদেশের সহজ জয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্ব পার হয়ে যায়।

ভারতের সাথে জয়ের পর, Source: Cricbuzz

সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে আবারো বিশ্বকে চমকে দেয় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের সাথেও জয়ের আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা আর হয়নি। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপের আরেক চমক আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়াটা সেবার চাঁদের কলঙ্কের মতোই হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-জিম্বাবুয়ের ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ফাইনালে ওঠার জন্য বেশ জটিল সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সাকিব আল হাসানের অনবদ্য এক ইনিংসে শ্রীলংকাকে হারিয়ে বোনাস পয়েন্টসহ ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। আজকের সাকিবের সাকিব হয়ে ওঠার শুরুটা সেদিনই হয়েছিল। ফাইনালে মাত্র ১৫২ রানে অলআউট হলেও বোলিংয়ের শুরুতে শ্রীলংকার ৬ রানে ৫ উইকেট ফেলে দিয়ে আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সাঙ্গাকারার ধৈর্যশীল ব্যাটিং শ্রীলংকাকে জয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে দ্রুত দুটি উইকেট তুলে নিলেও মুরালিধরনের ভৌতিক ব্যাটিংয়ে হেরে যেতে হয় বাংলাদেশকে।

এর মাঝে উত্থান ঘটে টি-২০ ক্রিকেটের। ঘরোয়া পর্যায়ে সেভাবে না থাকলেও ২০০৭ সালের টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বেশ বড় চমক দেখায়। মোহাম্মদ আশরাফুল আর আফতাব আহমেদের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে সেদিন জয়ের বন্দরে পৌঁছে বাংলাদেশ। সাকিবের ৪ উইকেট আর প্রথম ওভারেই সৈয়দ রাসেলের গেইলকে বিদায় সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কম রানে আটকাতে ভূমিকা রেখেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারলেও সুপার এইটে উঠে যায় বাংলাদেশ। সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়া আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ভাল বোলিংয়ের পরেও ব্যাটিং ব্যার্থতায় মাত্র ৮৩ রানে অলআউট হতে হয়।

দু’বছর পর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপ অবশ্য ছিল হতাশার। ভারত আর আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় বাংলাদেশকে। ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজেদের একসময়ের প্রবল প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের থেকে বেশ এগিয়ে নিয়ে যায়। এর মাঝে ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। তবে দ্বিতীয় সারির দল হওয়ায় এই বিজয়কে অন্যরা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। সময়ের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে সাকিব আল হাসানের উত্থান এ সময় থেকেই।

এরই মাঝে আসে আইসিএল-এর ধাক্কা। ভারতের নিষিদ্ধ এই লীগে খেলতে গিয়ে নিষিদ্ধ হন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা, যাদের অনেকেই সেসময় জাতীয় দলে খেলতেন। জাতীয় দলে প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি, বেশ কিছু নতুন মুখ আসে জাতীয় দলে। এই নতুন দল নিয়েই নিউজিল্যান্ড এর সাথে বেশ ভাল টক্কর দিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে ২০১০ সালের অক্টোবরে, নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডেতে ৪-০ তে ‘বাংলাওয়াশ’ করার মাধ্যমে।

নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারানোর পর, Source: Cricinfo.com

২০১১ সালে ভারত আর শ্রীলংকার সাথে যৌথভাবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজন করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সবাইকে চমক লাগিয়ে দেয়। দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতির এক অনন্য প্রদর্শনী ছিল সে অনুষ্ঠান। সকল দলের ক্যাপ্টেনদের রিকশায় করে স্টেডিয়াম চক্কর দেয়াটা সবাইকেই বিমোহিত করে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রিকশায় তৎকালীন বাংলাদেশে অধিনায়ক সাকিব, Source: Deshirulz

প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে বাজে বোলিংয়ের কারণে হারতে হয় বেশ বড় ব্যাবধানে। পরের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের সাথে লো স্কোরিং ম্যাচে জিতে টুর্নামেন্টে টিকে থাকে বাংলাদেশ। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে মাত্র ৫৮ রানে অলআউট হয়ে সব আশা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম তিনটি ম্যাচ ঢাকায় হবার পর পরের ম্যাচ ইংল্যান্ডের সাথে হয় চট্টগ্রামে। শুরু থেকেই ভাল বোলিং করে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ডকে ২২৫ রানে অলআউট করে জয়ের আশা জাগিয়ে তোলে। শুরুতে ইমরুল কায়েসের সৌজন্যে ভাল অবস্থানে থাকলেও ব্যাটিং ব্যার্থতায় ম্যাচ হারতে বসেছিল সেদিন বাংলাদেশ। শেষে মাহমুদুল্লাহ আর শফিউলের ব্যাটিংয়ে দুই উইকেটে জিতে যায় বাংলাদেশ, সেই সাথে টিকে থাকে কোয়ার্টার ফাইনালে যাবার আশা। পরের ম্যাচে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে সেই আশা আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে মাত্র ৭৮ রানে অলআউট হয়ে সব আশা শেষ হয়ে যায়।

২০১২ সালে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। গ্রুপ পর্বে ভারত আর শ্রীলংকাকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলেও শেষে সবাইকে কাঁদিয়ে মাত্র দু’রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের পারফরম্যান্স মোটামুটি উন্নতির দিকেই ছিল। জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশের বিপক্ষে তেমন পাত্তা পেত না। দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি সিরিজ জয়ও উন্নতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালটা কেমন যেন অদ্ভুত যায় বাংলাদেশের। জেতা ম্যাচ শেষে গিয়ে হেরে যাচ্ছিল, এমনকি নবাগত আফগানিস্তানের কাছেও বাজেভাবে হেরে যায় বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের প্রথম ম্যাচ জেতে বছরের শেষের দিকে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। আর এই জয় দিয়েই শুরু হয় এক অবিস্মরণীয় যাত্রার।

২০১৫ বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ায় কন্ডিশনিং ক্যাম্পে পাড়ার দলের কাছে হেরে খুব একটা আশা দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে গ্রুপ পর্বে আফগানিস্তান আর স্কটল্যান্ডকে বেশ ভালভাবে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের আশা জিয়ে রাখে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ বৃষ্টিতে পন্ড হলে সমীকরণ দাঁড়ায় ইংল্যান্ডকে হারালেই কোয়ার্টার ফাইনাল। শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। সে ম্যাচেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করেন মাহমুদুল্লাহ। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকেও প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেতা হয়নি। এ ম্যাচেও মাহমুদুল্লাহ সেঞ্চুরি করেন। ভারতের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল জন্ম দেয় বাংলাদেশ-ভারত দ্বৈরথের। একটি বিতর্কিত নো বলের ঘটনা অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়, মোস্তফা কামাল আইসিসির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

“The Bangladesh Tigers has knocked the England Lions out of the world cup” Source: india.com

২০১৫ বিশ্বকাপের পরেই শুরু হয় দেশের মাটিতে অজেয় হয়ে ওঠা। পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়ে সবাইকে চমকে দেয় বাংলাদেশ। এ সময় উত্থান ঘটে ‘কাটার মাস্টার’ মুস্তাফিজুর রহমানের। দেশের মাটিতে এশিয়া কাপের টি-২০ ভার্সনে রানার্স-আপ হওয়া, ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট ম্যাচ জেতা, এক সময়ের প্রবল শক্তিশালী শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ১০০তম টেস্টে জয়লাভ করা, ওয়ানডে সিরিজ ড্র করা, টি-২০ সিরিজ ড্র করা আর সব শেষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠা- গত ক’বছরে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়েই আলাদা আলাদা আর্টিকেল লেখা সম্ভব।

একসময় আমরা ডেনমার্ক, পাপুয়া নিউগিনির মতো দলের কাছে হারতাম। একটি টেস্ট ড্র করার জন্য বৃষ্টির আশায় থাকতাম আর আজ আমরা বৃষ্টিতে ম্যাচ পন্ড হলে হতাশ হই। ৫০ ওভার ব্যাটিং করতে পারলেই সফল ভাবা দলের ৩০০ রানেও খুশি হতে পারি না, টার্গেট ৩৫০ হলেও আশায় থাকি তামিম ঝড়ে এই রান পার করে যাব। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেখান থেকে শুরু করেছিল, সেখান থেকে আজ অনেক অনেক দূরে চলে এসেছে। এই পথে রয়েছে কত স্মৃতি, কত বেদনা, কত হাসি- ঠিক যেন একটি জীবন, যেখানে মিশে গেছে ষোল কোটি মানুষ।

Related Articles