তাবৎ দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ক্রীড়াজগতও তার ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সাথে সাথে সকল খেলাতেই কম-বেশি পরিবর্তন আসছে। কিন্তু ক্রিকেটের মতো এত বেশি পরিবর্তন যে আর কোনো খেলাতেই আসছে না, তা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়।
সর্বশেষ ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর ইংল্যান্ডে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তখন প্রতি ইনিংস একটি ডিউক বল দিয়ে খেলা হতো। ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন ছিল মাত্র ১৫ ওভারের জন্য। আর কোনো কারণে প্রথমদিন খেলা সম্পন্ন না হলে, সেই খেলা গড়াত রিজার্ভ ডে’তে।
২০ বছর পর আবারো ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফিরছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু এবার বদল এসেছে ক্রিকেটীয় অনেক নিয়মকানুনেই। এখন প্রতি ইনিংসে দুইটি কোকাবুরা বল ব্যবহৃত হচ্ছে। ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন রয়েছে তিন ধরনের। খেলোয়াড়দের সামনে রয়েছে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মনঃপুত না হলে সেটির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগও।
নিয়মকানুনের পরিবর্তন মাঠের ক্রিকেটেও কিন্তু প্রচুর প্রভাব ফেলে। যেমন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপেও নো বলের জন্য ব্যাটিং দলের খাতায় অতিরিক্ত এক রান যোগ হতো না। কিন্তু এখন সেরকম এক-দুই রানই ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আবার এখন এক ইনিংসে দুইটি বল ব্যবহৃত হওয়ার সুবাদে, ৩০ ওভারের পরই বল তার রঙ হারাতে শুরু করে না বটে, কিন্তু রিভার্স সুইং নামক ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদানটি হারাতে বসেছে তার অস্তিত্ব।
তবে নিয়মকানুনের পরিবর্তনই সামগ্রিকভাবে ক্রিকেটের পরিবর্তনের একমাত্র প্রভাবক নয়। এক্ষেত্রে বড় অবদান আছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেরও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ততম সংস্করণ এসে বদলে দিয়েছে খেলোয়াড়দের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি, যার বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাচ্ছে ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও।
সব মিলিয়ে ১৯৯৯ সালের ক্রিকেটের সাথে চলতি বছর তথা ২০১৯ সালের ক্রিকেটের দেখা যাচ্ছে বিস্তর ফারাক। কিন্তু সেই ফারাকটা আসলে কতটুকু? চলুন পাঠক, সবিস্তারে পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা খুঁজে বের করি, ২০ বছর আগে-পরের ব্যবধানে ক্রিকেটে ঠিক কী কী উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
ডিফেন্ড, নাকি চেজ?
গত শতকের শেষ দশকেও একদিনের ক্রিকেটে আগে ব্যাটিং করাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে এক বাক্যে মেনে নিত সকলে। কারণ, আগে ব্যাটিং করলে চাপমুক্ত হয়ে খেলা যায়। তাছাড়া উইকেট ও আউটফিল্ডের কন্ডিশন সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিপক্ষের উপর একযোগে এগারোজন মিলে ঝাঁপিয়েও পড়া যায়।
কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘অস্বাস্থ্যকর’ প্রভাবে এখন বদলে গেছে ক্রিকেটারদের মনস্তত্ত্ব। আগে ব্যাটিংকে তারা এখন আর নেক নজরে দেখছে না অনেকেই। বরং তাদের বিশ্বাস, প্রতিপক্ষের রান তাড়া করাটাই অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধাজনক। আর সেই বিশ্বাসের প্রতিফলনও কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাইশ গজে। বিশাল বিশাল রানের পাহাড়ও অনায়াসে ডিঙিয়ে ফেলছে পরে ব্যাটিং করা দলগুলো।
তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিবেচনায় আনা জরুরি। তা হলো, ম্যাচটি কি ডে, নাকি ডে-নাইট। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ সালের পর থেকে ডে ম্যাচে বরাবরই টসজয়ী অধিনায়করা যতবার আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি নিয়েছে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত। তবে ডে-নাইট ম্যাচে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সময়ই আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টসজয়ী অধিনায়করা।
অপরদিকে, ম্যাচের চূড়ান্ত ফলাফলের ক্ষেত্রেও ডে ও ডে-নাইট ম্যাচের পার্থক্যটা লক্ষণীয়। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত সবসময়ই ডে ম্যাচে পর ব্যাট করা দলের জয়ের হার বেশি ছিল। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ধীরে ধীরে পাল্লা আগে ব্যাট করা দলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, এবং সাম্প্রতিক সময়ে আগে ব্যাট করা দলের জয়ের হারই বেশি। কিন্তু ডে-নাইট ম্যাচে ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত আগে ব্যাট করা দলের জয়ের হার সবসময়ই অনেক বেশি ছিল। ২০১১ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত পরে ব্যাট করা দলের জয়ের হার বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৮ সালের শেষ পর্যন্ত ডে-নাইট ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করা ও পরে ব্যাট করা দলগুলোর জয়ের হার সমান।
ওডিআই বিশেষজ্ঞ
এখন সময়টা বিশেষজ্ঞদের। সকল কাজের কাজিদের থেকে যেকোনো একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কদরই সবখানে বেশি। একই চিত্র একদিনের ক্রিকেটেও। যেহেতু টি-টোয়েন্টির আগমনের ফলে একটি ফরম্যাট বেড়েছে, এবং প্রতি বছর অনুষ্ঠিত ম্যাচের সংখ্যাও বেড়েছে, তাই আন্তর্জাতিক দলগুলো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ওডিআই বিশেষজ্ঞদেরকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এখানে ওডিআই বিশেষজ্ঞ বলতে সেইসব ক্রিকেটারকে বোঝানো হচ্ছে, যারা তাদের দলের অর্ধেকের বেশি একদিনের ম্যাচ খেলেছে, এবং অর্ধেকের কম টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে দেখা যাবে, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড বাদে প্রতিটি দলেই বিশেষজ্ঞ খেলোয়াড়ের শতকরা হার বেড়েছে।
তবে শুধু অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডই নয়, পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড দলেও ১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগেও বিশেষজ্ঞ ক্রিকেটার খেলানোর বেশ ভালো চল ছিল। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকা দলে হুট করে বিশেষজ্ঞ খেলোয়াড় খেলানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়াটা চোখে পড়ার মতো।
ম্যাচপ্রতি ছয়
বর্তমান সময় একদিনের ক্রিকেটে রানরেট এত বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ হলো, ওভার বাউন্ডারি। ১৯৯৯ ও ২০০৩ বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী সময়ে একদিনের ক্রিকেটে প্রতি ৮টি চারের বিপরীতে একটি ছয় মারা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রতি ৫টি চারের বিপরীতে একটি ছয় মারা হচ্ছে। এছাড়া ১৯৯৯ ও ২০০৩ বিশ্বকাপের মধ্যে ম্যাচপ্রতি চার মারা হয়েছিল ৩৫টি। এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০। অথচ তখনকার ম্যাচপ্রতি ৪টি ছয় এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
নতুন বলে স্পিন
ক্রিকেটে ক্রমাগতই ব্যাটসম্যানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ঠেকানোর জন্য ফিল্ডিং দলও কিন্তু নিত্যনতুন ফন্দি বের করছে। যেমন, চলতি শতকে স্পিনারদের হাতে নতুন বল তুলে দেয়ার প্রবণতা খুব বেশি বেড়ে গিয়েছে। ২০০৩ থেকে ২০০৭ বিশ্বকাপের মধ্যবর্তী সময়ে স্পিনাররা প্রতি ম্যাচের প্রথম ১০ ওভারে গড়ে মাত্র ১.৬টি বল করতো। বাকি ৫৮.৪টি বলের দখল পেসারদের হাতেই ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে স্পিনাররা প্রথম ১০ ওভারে গড়ে ১৪টি বল করছে। এখন তো আবার স্পিনারদের দিয়ে দলের বোলিং ওপেনও করা হচ্ছে।
রহস্যের ছোঁয়া
সাম্প্রতিক সময়ে স্পিনাররা কেবল দারুণ প্রভাবশালীই হয়ে ওঠেনি, প্রথাবিরুদ্ধ অ্যাকশনের মাধ্যমে তাদের সাফল্য লাভের হারও অনেক বেড়ে গিয়েছে। রিস্ট স্পিনারদেরকে বলা হচ্ছে রহস্য স্পিনার, কেননা সকল স্পিনারের পক্ষে তাদের মতো অ্যাকশনে বল করা সম্ভব নয়। ১৯৯৯ থেকে শুরু করে, ২০১১ বাদে বাকি প্রতিটি বিশ্বকাপের বছরেই আইসিসি ওডিআই বোলার র্যাংকিংয়ের সেরা দশে এমন এক বা একাধিক রহস্য স্পিনারের উপস্থিতি ছিল। আর এ বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত তো র্যাংকিংয়ের সেরা দশের অর্ধেকই এমন রহস্য স্পিনার।
বাঁ-হাতি পেসারদের রাজত্ব
গতির ক্ষেত্রে বাঁ-হাতি পেসাররাই অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিশেষ করে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে তাদেরকেই রাজত্ব করতে দেখা যায়। সর্বশেষ ৫টি বিশ্বকাপের মধ্যে ৪টিতেই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার ছিলেন বাঁহাতি পেসার। তাছাড়া সর্বশেষ ৭টি বিশ্বকাপের মধ্যে ৫টির চ্যাম্পিয়ন দলই বাঁহাতি পেসারদের হাত ধরেই সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করেছে। ১৯৯২ সালে ওয়াসিম আকরাম, ১৯৯৬ সালে চামিন্দা ভাস, ২০০৭ সালে নাথান ব্র্যাকেন, ২০১১ সালে জহির খান ও আশিষ নেহরা, এবং ২০১৫ সালে মিচেল স্টার্ক নিজ নিজ দলকে শিরোপা জেতানোয় এই বাঁহাতি পেসারদেরই ছিল সর্বোচ্চ অবদান। ২০১৯ বিশ্বকাপেও প্রতিটি বড় দলের স্কোয়াডেই একজন শীর্ষস্থানীয় বাঁহাঁতি পেসার দেখা যাবে। ব্যতিক্রম কেবল ভারত। তারাও দীর্ঘদিন ধরে এমন একজনের খোঁজে রয়েছে, কিন্তু প্রতিপক্ষের জন্য সত্যিকারের হুমকিস্বরূপ বাঁহাতি কাউকে তারা এখনো আবিষ্কার করতে পারেনি।
উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান
উইকেটকিপারদের কাজ হলো উইকেটের পিছনে দাঁড়ানো, সেই কাজটি তারা ঠিকমতো করতে পারলেই হলো – এমনটিই ছিল গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত অধিকাংশ ক্রিকেটবোদ্ধার মনোভাব। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। কেবল উইকেটের পেছনের দক্ষতাই কাউকে জাতীয় দলে জায়গা পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে উইকেটকিপার হিসেবে খেলেছিলেন স্টিভ পালফ্রামান, যিনি ১২৫টি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেও কোনো সেঞ্চুরি পাননি। আজকের দিনে হলে তিনি কোনোভাবেই বিশ্বকাপে খেলতে পারতেন না। কারণ, এখন উইকেটকিপারদেরকে ব্যাট হাতেও সমান সামর্থ্যবান হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তো এমনও দেখা যায় যে, একটি দলের উইকেটকিপারই সেই দলের সেরা ব্যাটসম্যান। আর তা না হলেও, স্রেফ ফিনিশার হিসেবেও যে একজন উইকেটকিপারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, ভারতীয় দলের সাম্প্রতিক সাফল্যে মহেন্দ্র সিং ধোনির অবদান থেকেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।
সেরা ব্যাটসম্যান বনাম সেরা হিটার
একটা সময় পর্যন্ত দলের সেরা ব্যাটসম্যানরাই ছিল দলের সেরা হিটার। দলের রানের চাকাকে গতিশীল করতে তাদের অবদানই ছিল মুখ্য। কিন্তু এরপর বেশ কয়েক বছর দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের উপর থেকে চাপ কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল। তখন তাদের দায়িত্ব ছিল দীর্ঘ সময় ক্রিজে থেকে দলের জন্য একটা সুন্দর সূচনা ও শক্ত ভিত গড়ে দেয়া। শেষ মুহূর্তে বিগ-হিটিংয়ের মাধ্যমে দলের রানরেট বাড়িয়ে নেয়ার জন্য বিকল্প ব্যাটসম্যান থাকতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার সেই গুরুদায়িত্ব দলের সেরা ব্যাটসম্যানদের উপরই ফিরে এসেছে। এখন দলের সেরা ব্যাটসম্যানদেরই ইনিংসের ভিত গড়ে দেয়া থেকে শুরু করে রানের চাকা সচল করা, সবকিছু একা হাতে সামলাতে হচ্ছে।
ধারাবাহিক দল বনাম টুর্নামেন্ট সেরা দল
একটি দল যখন কোনো টুর্নামেন্টের আগে খুব ধারাবাহিক পারফর্ম করে আসতে থাকে, তখন সেই দলটিকেই দেয়া হয় টুর্নামেন্ট ফেবারিটের তকমা। কিন্তু সকল দলের পক্ষেই কি টুর্নামেন্ট পূর্ববর্তী ধারাবাহিকতা মূল টুর্নামেন্টেও ধরে রাখা সম্ভব হয়? সর্বশেষ ৫টি বিশ্বকাপের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো, অস্ট্রেলিয়া টুর্নামেন্ট-পূর্ববর্তী ধারাবাহিকতা ধরে রাখার ব্যাপারে যতটা সফল, দক্ষিণ আফ্রিকা ঠিক ততটাই ব্যর্থ। আসন্ন বিশ্বকাপের আগে দারুণ ধারাবাহিক স্বাগতিক ইংল্যান্ড। দেখা যাক, অস্ট্রেলিয়া নাকি দক্ষিণ আফ্রিকা, কাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারা।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/