একটা মজার আলোচনা করা যাক। দুয়ারে কড়া নাড়ছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেখানে ইতোমধ্যেই কোয়ালিফাই করে ফেলেছে বাংলাদেশ। আমরা আজকে যে আলোচনা করতে চাচ্ছি, সেটি হলো গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ অব্দি বাংলাদেশ যে কয়টি ওয়ানডে খেলেছে, সেখানে ইনিংসের প্রথম ওভারটিতে কেমন পারফর্ম করেছেন ওপেনাররা? সোজা কথায়, বাংলাদেশি ওপেনাররা ওয়ানডে ইনিংসের প্রথম ওভারটি কেমন সামলান?
২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ওপেন করতে নেমেছেন মোট ছয়জন ওপেনার। এদের মধ্যে ইনিংসের প্রথম ওভারেই নতুন বলে মুখোমুখি হয়েছেন:
- তামিম ইকবাল – ৩৫ ম্যাচ
- লিটন দাস – ১৯ ম্যাচ
- সৌম্য সরকার – ১ ম্যাচ
- এনামুল হক বিজয় – ৪ ম্যাচ
- নাজমুল হোসেন শান্ত – ৩ ম্যাচে ওপেন করলেও কখনোই ইনিংসের প্রথম ওভার খেলেননি
- নাঈম শেখ – ১ ম্যাচ
এই ছয়জন ওপেনারের মধ্যে যদি আমরা তাদের প্রথম ওভারে নেওয়া রান দেখি তাহলে ইনিংসের প্রথম ওভারে নেওয়া গড় রানের তালিকাটা দাঁড়াবে এরকম:
তামিম ইকবাল
৩৫ ম্যাচে প্রথম ওভারে মুখোমুখি হয়েছেন ১৪৮ বল। এই ১৪৮ বলে তিনি রান নিয়েছেন ৮৫। গড়ে তার প্রথম ওভারে নেওয়া রান ৩.৪৪। এর মধ্যে তিনি ১০৯টা বলই ডট খেলেছেন। তার ডট দেওয়ার হার প্রায় ৭৪%। তবে এই ৩৫ ইনিংসের মধ্যে প্রথম ওভারেই তিনি প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন মাত্র একবার।
লিটন দাস
১৯ ম্যাচে ইনিংসের প্রথম ওভারেই নতুন বলে মুখোমুখি হওয়া বলের সংখ্যা মাত্র ৫৬। এই ৫৬ বলে তিনি রান নিয়েছেন মাত্র ২১। গড়ে তিনি প্রথম ওভারে রান নিয়েছেন ২.২৫ করে। এই ৫৬ বলের মধ্যে তিনি ডট দিয়েছেন ৪৩ টি বলে, ডট খেলার হারে যেটা দাঁড়ায় প্রায় ৭৭%। তবে এই ১৯ ইনিংসের মধ্যে ৩ বার তিনি প্রথম ওভারেই প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন।
তবে লিটন যে একটু ‘স্লো স্টার্টার’, সেই প্রমাণ কিন্তু গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগ অব্দি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও দেখা গেছে। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপপূর্ব ট্রাইনেশন সিরিজের আগ অব্দি লিটনের খেলা বল-বাই-বল বিশ্লেষণ থেকেই দেখা যাতে পারে, লিটন গড়ে তার ইনিংসটাকে কীভাবে বাড়ান। শুরু থেকে প্রতি ৩ বলে কত রান করেছেন, সেটার শতকরাকে প্যারামিটার ধরে একটি ইনিংস গ্রোথ বের করা হয়েছে এখানে।
এখানে, প্রথম লেখচিত্রেই আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, লিটন শুরুতে নেমেই মারতে পারেন না। তিনি খানিকটা সময় নেন, আর এরপর হাত খুলে মারতে শুরু করেন। অর্থাৎ, লিটন যদি একবার টিকে যান, তাহলে তিনি শুরুর ধীরতা পুষিয়ে দিতে পারেন।
সৌম্য সরকার
মাত্র ১ ইনিংসে শুরুর প্রথম ওভারে মুখোমুখি হয়ে তিনি করেছেন ৩ বলে ১ রান।
এনামুল হক বিজয়
বিজয়ের প্রথম ওভারেই মুখোমুখি হওয়া বলের সংখ্যা ১৩। এই ১৩ বলে তিনি রান নিয়েছেন মাত্র ৪। গড়ে তার প্রথম ওভারের রান ১.৮৪৮।
নাঈম শেখ
ওপেন করতে নেমে প্রথম ওভারে তিনি খেলতে পেরেছেন মাত্র ১ বল। সেই ১ বলে তিনি করেছেন ১ রান।
***
বুঝতেই পারছেন, ছয়জন ওপেনারের মধ্যে মাত্র দু’জনই আসলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ম্যাচ খেলেছেন যে ডেটা নিয়ে আমরা অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের ওপেনারদের নতুন বল খেলার হারকে তুলনা করতে পারি। এখন আসলে আমরা সেটিই করব।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে এই আর্টিকেলটি লেখার সময় অব্দি ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করা পাঁচজন ওপেনার হলেন:
- শাই হোপ
- তামিম ইকবাল
- শিখর ধাওয়ান
- ফখর জামান
- পল স্টার্লিং
আমি যদি তাদের পরিসংখ্যান খেয়াল করি, তাহলে প্রথম ওভারে নেওয়া গড় রানের তালিকা করলে তালিকাটা দাঁড়াবে অনেকটা এরকম:
- শাই হোপ – ৩.২২২
- তামিম ইকবাল – ৩.৪৪
- শিখর ধাওয়ান- ৩.৪৯৮
- ফখর জামান- ২.৬৬৪
- পল স্টার্লিং- ৪.৩৯৮
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রথম ওভার থেকেই আক্রমণাত্মক মনোভাবে খেলার ব্যাপারে বাংলাদেশী ওপেনাররা ঢের পিছিয়ে আছেন। বিশেষ করে যদি প্রথম ওভারেই নতুন বলে মারা বাউন্ডারির সংখ্যা তুলে ধরা হয়, তাহলে সেখানে এরকম একটি চিত্র আমরা পেতে পারি:
তামিম ইকবাল
১৪৮ বলের মধ্যে তিনি ছয় মেরেছেন একটি এবং চার মেরেছেন ১২টি।
লিটন দাস
৫৬ বলের মধ্যে তিনি চার মেরেছেন ২টি এবং কোনো ছয় মারতে পারেননি।
শাই হোপ
১৪৯ বলের মধ্যে চার মেরেছেন ৯টি এবং কোনো ছয় মারতে পারেননি।
ফখর জামান
৮১ বলের মধ্যে চার মেরেছেন ৬টি এবং কোনো ছয় মারতে পারেননি।
পল স্টার্লিং
৯০ বলের মধ্যে ৯টা চার মেরেছেন এবং কোনো ছয় মারতে পারেননি।
শিখর ধাওয়ান
১০৩ বলের মধ্যে ১০টি চার মেরেছেন এবং কোনো ছয় মারতে পারেননি।
আর আপনি যদি জানতে চান এই ওপেনারদের মধ্যে কে কেমন ডট বল খেলেন, সেক্ষেত্রে নিচের ছকে এই ওপেনারদের এই চার বছরে প্রথম ওভারে খেলা ডট বলের শতকরা হারটা আপনারা দেখে নিতে পারেন:
সম্পূরক তথ্য
পরিসংখ্যান অনুযায়ী নতুন বল খেলাতে তামিম ইকবাল যদি লিটন দাসের চাইতেও স্বচ্ছন্দ হন, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই ওপেনার হিসেবে লিটনকে কেন তামিম ইকবালের চাইতে উপরের দিকে রাখছে, সেটা আপনাদের মনে আসতে পারে। এখানে অবশ্য দুটো ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে – প্রতিপক্ষ আর বছর।
প্রতিপক্ষ বিবেচনায় নিলে তামিম ইকবাল তুলনামূলক উপরের র্যাংকের দলগুলির সাথে প্রথম ওভারে ডট খেলার প্রবণতা বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ। যেমন: দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৮১.৮% এবং নিউ জিল্যান্ডের সাথে এই সময়টায় তার ডট খেলার হার ৮৭.৫%। এক্ষেত্রে লিটনও যে খুব এগিয়ে আছে তা বলা যাবেনা। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে যেমন এই মানদন্ডে লিটনের পরিসংখ্যান ৭১.৪% এবং ভারতের সাথে তা ৮৩.৩%। উইন্ডিজের সাথে খেলা ৪ ম্যাচে তা ৮৭.৫%। তবে গত ইংল্যান্ড সিরিজে ভাল না করলেও নতুন বলের প্রথম ওভারে তার ডট খেলার হার কিছুটা হলেও কমে তা নেমে এসেছে ৬৩.৬% এ। লিটনকে অবশ্য ইংল্যান্ড সিরিজে প্রথম ওভারেই খুব বেশি নতুন বল মোকাবিলা করতে হয়নি। যে ৪ বল তিনি খেলেছেন এই সময়ে তাতে রান তো করতে পারেনই নি, উল্টো ২ বলেই ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে।
অন্যদিকে, এমন একটি ভাবনা আপনার মাথায় আসতে পারে যে লিটন যেহেতু ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে, তাহলে হয়তো ২০১৯ বিশ্বকাপ-পরবর্তী পরিসংখ্যান তাকে যথেষ্ট ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। আদতে কিন্তু মোটেও তা নয়। যেমন গত বছরই তার নতুন বলের প্রথম ওভারে ডট খেলার হার ছিল ৭৭.৮%, এই বছরে মুখোমুখি ৪ ইনিংসে যেটা ৮১.৮%। লিটন তাই নেমেই মারতে পারেন, এমনটা বলা যায় না। শুরুর দিকে তিনি নড়বড়ে থাকেন, তবে বল পুরনো হলে তিনি বলের পুরো ফায়দা তুলে নিতে পারেন। আর এই প্রমাণ আমরা পরিসংখ্যানেও দেখতে পাই। ওপেনার হিসেবে নেমে ওয়ানডেতে ২০১৯ বিশ্বকাপ-পরবর্তী সময়ে তার পাওয়ারপ্লের পরের ডট খেলার হার মাত্র ৪১.৪%, পাওয়ারপ্লের মধ্যে যেটা ৬৭.৬%।