১
২০০২ সালের কথা। উইজডেন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলো গত শতাব্দীর সেরা ভারতীয় ক্রিকেটার নির্বাচন করার। কাজটা খুব সহজ ছিল না। যুগে যুগে ভারতে তারকা ক্রিকেটার কম আসেনি। এরপরেও সংক্ষিপ্ত তালিকায় ১৬ জনের নাম নিয়ে আসা হলো, যার মাঝে সুনীল গাভাস্কার, আজহারউদ্দিন, অনিল কুম্বলে, বিশান সিং বেদি, বিজয় হাজারে এবং শচীন টেন্ডুলকারের নামও ছিল।
১৬ জনের তালিকা থেকে শেষপর্যন্ত নামিয়ে তিনজনের তালিকায় নিয়ে আসার পর দেখা গেল, তিনজনই যথেষ্ট বড় মাপের খেলোয়াড়; শচীন, গাভাস্কার এবং কপিল। শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি জিতে নিলেন কপিল।
প্রশ্ন হচ্ছে শচীন কিংবা গাভাস্কারের চেয়ে পরিসংখ্যানে অনেকখানি পিছিয়ে থাকার পরেও কীভাবে কপিল তাদের দুজনকে হারিয়ে দিতে পারলেন। এই বিষয়টি বুঝতে হলে কপিল দেবের সময়কার কিছু ইতিহাস আপনাকে জানতে হবে।
তাহলে চলুন, চোখ বুলিয়ে আসা যাক ক্রিকেটের কিছু ইতিহাস থেকেই।
২
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলটাকে নিয়ে খুব বেশি আশা কারোরই ছিল না। আগের দুই আসরে ৬টি ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল মাত্র ১টি ম্যাচে, সেটাও পুঁচকে পূর্ব আফ্রিকার বিরুদ্ধে। এর মাঝে হেরে গিয়েছিল শ্রীলংকার বিপক্ষে এক ম্যাচে, যারা কি না তখনও টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি। শুধু অতীত ইতিহাসই নয়, সাম্প্রতিক অতীতও কোনো আশার প্রদীপ জ্বালাতে পারছিল না। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হেরে যাওয়ার পর মাত্র ২৪ বছর বয়সী একটি ছেলেকে অধিনায়ক করে যখন বিশ্বকাপে পাঠানো হলো, তখন দলের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করাটাও উচিত ছিল না।
তবে কপিল দেব নামের সেই নতুন অধিনায়কের অধীনে ভারতের শুরুটা হয় চমক জাগানোর মাধ্যমেই। নিজেদের প্রথম ম্যাচেই আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোটা অবশ্য তখন অঘটনের স্বীকৃতিই পেয়েছিল। পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে হারালেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে যায় ১৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে। সেই ম্যাচে অবশ্য কপিল দেব তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করেন (৫/৪৩)। পরের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেও হেরে যাওয়ার পর ভারতের পরের পর্বে যাওয়ার সমীকরণটা মোটামুটি কঠিন হয়ে যায়। শেষ দুই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে আর অস্ট্রেলিয়াকে হারাতেই হবে, যে জিম্বাবুয়ে সেই টুর্নামেন্টেই অস্ট্রেলিয়াকেও একটা ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছে।
এরকম একটি কঠিন সমীকরণ হাতে নিয়ে টস জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন কপিল। তবে জিম্বাবুয়ের বোলারদের অসাধারণ বোলিংয়ে সিদ্ধান্তটা বুমেরাং হতে থাকে। ম্যাচের দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার। একটু পরেই দলীয় ৬ রানের অপর ওপেনার শ্রীকান্তও শূন্য রানে আউট হন। মাত্র ৯ রানে আরো দুই ব্যাটসম্যান আউট হলে ভারত আক্ষরিক অর্থেই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেই সময় ম্যাচ জেতার ভাবনা দূরে থাকুক, একটি সম্মানজনক স্কোর করতে পারাটাই ভারতের প্রথম লক্ষ্য ছিল। সেই সময় ব্যাট হাতে মাঠে নামেন কপিল দেব।
৩
দলীয় ১৭ রানেই যখন পঞ্চম উইকেটের পতন ঘটলো, বিপর্যয় সামাল দেবার জন্য তখন প্রয়োজন ছিল একজন ধৈর্যশীল ব্যাটসম্যান, যিনি কি না একটা লম্বা ইনিংসও খেলতে পারবেন। ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কপিল দেব ছিলেন আক্রমণাত্মক। তখন পর্যন্ত ২১.৬৩ গড় আর ১০৫.১৭ স্ট্রাইক রেটের অধিকারী এবং মাত্র ৩টি হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলা একজন ব্যাটসম্যান সেই পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য উপযুক্ত ছিলেন কি না সেটাও তখন প্রশ্নের মুখোমুখি।
তবে চ্যাম্পিয়নরা নাকি পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারে। সেই কাজটাই করলেন তরুণ কপিল। রজার বিনি আর মদন লালকে নিয়ে গড়লেন ৬০ আর ৬২ রানের দুটো জুটি, যেখানে বিনি আর মদনের অবদান মাত্র ২২ আর ১৭। এত চেষ্টার পরেও ১৪০ রানে ৮ম ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন মদন লাল আউট হলেন, তখন ভারতের ১৫০ রানের নীচে অলআউট হয়ে যাওয়াটাও বিচিত্র কিছু ছিল না। কিন্তু সেখান থেকেই পাল্টা আক্রমণ করলেন কপিল দেব, উইকেট কিপার কিরমানীকে নিয়ে গড়লেন ১২৬ রানের এক জুটি।
কপিল দেবের ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের এক ঝকঝকে ইনিংসের কল্যাণে ৬০ ওভার শেষে ভারত দাঁড় করাতে পারলো ২৬৬ রানের এক সম্মানজনক স্কোর। মজার বিষয় হচ্ছে, কপিল দেবের সেই সেঞ্চুরির ইনিংসটাই একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোনো ভারতীয় ব্যাটসম্যানের করা প্রথম সেঞ্চুরি। সুনীল গাভাস্কারের মতে, এটা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ইনিংস। উইজডেনের গত শতাব্দীর সেরা ১০০টি ইনিংসের যে তালিকা করা হয়েছিল, তাতেও ইনিংসটির অবস্থান ৪ নম্বরে।
অধিনায়কের সেঞ্চুরিতেই যেন পুরো দল উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। জিম্বাবুয়েকে হারানোর পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকেও হারিয়ে সেমিতে মুখোমুখি হলো ইংল্যান্ডের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে পেলেন সবচেয়ে বেশি উইকেট (৩/৩৫)।
ফাইনালে ভারত মুখোমুখি হলো দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের। মাত্র ১৮৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন নিশ্চিত জয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই উল্টোদিক থেকে অনেকখানি দৌড়ে অসাধারণ দক্ষতায় ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচটি তালুবন্দি করে ভারতীয় দলের ভেতরে উদ্দীপনার সঞ্চার করলেন কপিল দেব। প্রথম এশীয় অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জিতলেন কপিল দেব।
৪
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ব্যাটসম্যান কপিল দেবের কীর্তি নিয়ে আলোচনা করা হলেও তার মূল শক্তির জায়গাটা ছিল বোলিংয়ে। হরিয়ানার এক মধ্যবিত্ত ঘরে ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন কপিল দেব। স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই কপিল খেলার প্রতি আগ্রহী হন এবং হরিয়ানার ঘরোয়া ক্রিকেট দলে সুযোগ পান। প্রথম ম্যাচেই পাঞ্জাবের বিপক্ষে ৬ উইকেট নিয়ে চমক সৃষ্টি করেন এবং সেই মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ১২১টি উইকেট দখল করেন।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেলার সুবাদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তার ডাক পড়ে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৯৭৯-৮০ সালে ৬ ম্যাচের সিরিজে ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হন, যেখানে জয় পাওয়া দুটি ম্যাচেই কপিলের অসামান্য অবদান ছিল। বোম্বের ম্যাচটিতে ব্যাট হাতে খেলেন ৬৯ রানের এক ইনিংস, আর মাদ্রাজের ম্যাচে ১০ উইকেট পাওয়ার সাথে সাথে খেলেন ৯৮ বলে ৮৪ রানের ইনিংস।
ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কারটাও জিতে নেন তিনি। ধীরে ধীরে ক্রিকেট বিশ্বের একজন নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডারে পরিণত হতে থাকেন কপিল।
৫
তবে ব্যাটিং কিংবা বোলিং ছাড়াও কপিলের যে বিষয়টি ভারতকে বিশ্বক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করেছিল, সেটা হচ্ছে তার অধিনায়কত্ব। বিশ্বকাপের কথা তো আগেই বলা হলো। সেই সময় ভারত আজকের মতো এত শক্তিশালী দল ছিল না। কপিলের নেতৃত্বেই ১৯৮৬ সালে ভারত ইংল্যান্ডের মাঠে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতে নেয়। এছাড়া ১৯৮০-৮১ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে তার ২৮ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার ফলেই অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৮৩ রানে অলআউট হয় এবং ভারত সিরিজ ড্র করতে সমর্থ হয়। সেটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারতের প্রথম কোনো সিরিজ ড্র করতে পারা। এরপরে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারত কখনো টেস্ট সিরিজ জিতে আসতে পারেনি।
এগুলো ছাড়াও কপিল দেব টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি একইসাথে ব্যাটিংয়ে ৪,০০০ রান আর বোলিংয়ে ৪০০ উইকেট শিকারের অনবদ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনিই একমাত্র অধিনায়ক, যিনি এক ইনিংসে ৯ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
যুগে যুগে ভারত উঁচু মানের স্পিনার এবং ব্যাটসম্যান উপহার দিলেও ফাস্ট বোলিংয়ে একেবারেই অনুর্বর ছিল। কপিল দেবই প্রথম ভারতীয়দের মনে বিশ্বাস জন্মান যে, ভারতেও ফাস্ট বোলার হওয়া সম্ভব। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময়ই ভারতের পেস আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন। উপমহাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ছুঁয়েছেন ৪০০ উইকেটের মাইলফলক। সবচেয়ে কমবয়সী টেস্ট বোলার হিসেবে নিয়েছেন ১০০ (২১ বছর ২৫ দিন), ২০০ (২৪ বছর) ও ৩০০ (২৭ বছর ২ দিন) উইকেট। একটা সময় টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দুই ফরম্যাটেই সবচেয়ে বেশি উইকেটধারী ছিলেন। আশির দশকের পুরোটা সময় যে চারজন অলরাউন্ডার পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে আলোকিত করে রেখেছিলেন, কপিল দেব ছিলেন তাদের মাঝে একজন।
১৯৯৪ সালে অবসর নেওয়ার পর থেকেই ভারত আরেকজন কপিল দেবের অপেক্ষায় রয়েছে। এখন পর্যন্ত সেই অপেক্ষার অবসান হয়নি, অচিরেই হবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
ক্রিকেট সম্পর্কে আরও জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো
১) শচীন রূপকথা
২) নায়ক
৩) সাকিব আল হাসান – আপন চোখে ভিন্ন চোখে