Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাবিব নুরমোহামেদভ: মিক্সড মার্শাল আর্টের অপরাজেয় ঈগল

২৪ অক্টোবর, ২০২০। দুবাইয়ের ফ্ল্যাশ ফোরাম অ্যারেনায় পর্দা উঠছে দ্য আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ২৫৪-এর। করোনা মহামারির কঠিন সময়ে দর্শকশূন্য গ্যালারি নিয়েই ইউএফসি ২৫৪-এর আয়োজন। ইনডোর অ্যারেনায় কেবল কলাকুশলী ছাড়া তেমন জনসমাগম না থাকলেও মিক্সড মার্শাল আর্টের এই ইভেন্টকে ঘিরে পুরো বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা কোনো অংশেই কম নয়।

দ্য আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপে (ইউএফসি) বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফাইট হয়ে থাকে। সেসব ক্যাটাগরির ভাগ করা হয় দৈহিক ওজনের ভিত্তিতে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির ফাইটাররা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফাইট করেন মোট পাঁচটি রাউন্ডে। এক মিনিটের বিরতিসহ প্রতিটি রাউন্ড হয় পাঁচ মিনিটের। দুই ফাইটারের যেকোনো একজন নকআউট না হলে খেলা চলে পাঁচ রাউন্ড ধরে। এরপর চ্যাম্পিয়ন টাইটেল নির্ধারণ হয় প্রতি রাউন্ডের মোট পয়েন্ট হিসেব করে।

“At lonely nights I’m dreaming

About my home, my Dagestan

And I will never stop believing

And being proud of my land”

বিখ্যাত সংগীত শিল্পী স্যাবাইন কোর্সের কণ্ঠে দাগেস্তান শিরোনামের এই গানটি বেজে চলেছে ‘ফাইটিং আইল্যান্ড’-খ্যাত ইনডোর স্টেডিয়াম ‘ফ্ল্যাশ ফোরাম অ্যারেনা’য়। গানের সাথে গা হেলিয়ে-দুলিয়ে বীরদর্পে ফাইটিং রিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন জাস্টিন গেইৎজি। মিক্সড মার্শাল আর্টের লাইটওয়েট ক্যাটাগরিতে পঁচিশবারের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছেন ২২ বার, হেরেছেন কেবল ৩টি ম্যাচে। তবুও ইউএফসি মাতানো জাস্টিনের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। কারণ, আজ তার প্রতিপক্ষ হাবিব নুরমোহামেদভ।

ইউএফসিতে হাবিব মানেই অপ্রতিরোধ্য, অজেয়; Image credit: Getty Images

কেবল জাস্টিনই নয়, হাবিবের প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন! আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। ইউএফসিতে হাবিব মানেই অপ্রতিরোধ্য, অজেয়। তাই হয়তো ২২ বার বিজয়ী হওয়া জাস্টিন কিছুটা বিচলিত। আজ জিততে হলে তাকে গড়তে হবে ইতিহাস। হাবিবকে প্রথমবারের মতো হারের স্বাদ দেওয়াটাকে ইতিহাসই বলা যায়। কারণ এমএমএ- এর মঞ্চে টানা ২৮ বার বিজয়মাল্য পরা এই দাগেস্তানি ফাইটারকে কেউ পরাজিত করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।

এই নিবন্ধনে জানানো হবে দাগেস্তান থেকে উঠে আসা ইউএফসির অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হাবিব নুরমোহামেদভের গল্প।

হাবিবের শৈশব-কৈশোর

বর্তমান রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল সুম্যাডিন্সকি ডিসট্রিক্ট। ককেশীয় অঞ্চলের এই জেলার সিলদি গ্রামে ১৯৮৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাবিব নুরমোহামেদভের জন্ম। সিলদি গ্রামে জন্ম হলেও শৈশবের বেশ কিছু সময় কেটেছে দাগেস্তানের রাজধানী মাখাচখালায়। বাল্যকাল থেকেই ছিলেন ভীষণ দুরন্ত স্বভাবের। নদী কিংবা গাছ থেকে লাফঝাঁপ দেওয়া ছিল তার পছন্দের খেলা। তার শৈশব এতটাই দস্যুপনায় ভরপুর ছিল যে মাঝে মাঝে প্রতিবেশীরাও অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন। আর এসব ছেলেমানুষির শাস্তি থেকে বাঁচতে বাবার ভয়ে লুকাতেন দাদীর আঁচলে। তখন কে জানত, দাদীর আঁচলে লুকানো ছেলেটাই একদিন মিক্সড মার্শাল আর্টের ‘দ্য আনবিটেন ঈগল’ খেতাবে ভূষিত হবেন!

সিলদি, মাখাচখালার পর হাবিবের পরিবার আবাস গড়ে দাগেস্তানের আরেক গ্রাম কিরোভলে।

হাবিবের বাবা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন সেনাসদস্য হিসেবে। সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তিনি স্যাম্বো ও জুডোতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর দাগেস্তান রিপাবলিকের কমব্যাট স্যাম্বো দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিরোভল গ্রামে আসার পর একটি দোতলা বাড়িতে ওঠেন পরিবার নিয়ে, যার নিচতলায় গড়ে তোলেন জিমনেশিয়াম। সেখানেই তিনি মার্শাল আর্টের ছাত্রদের ব্যায়াম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। হাবিবের বয়স তখন ৮ বছর। এ বয়সেই বাবার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেখে মার্শাল আর্টের প্রতি আগ্রহের শুরু হয় তার।

স্যাম্বো ও জুডোতে পারদর্শী হাবিব নুরমোহামেদভের বাবা নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণকেন্দ্র; Image credit: Khabib Nurmagomedov on Twitter

একেবারে ছোটকাল থেকেই তাই হাবিব বেড়ে উঠেছেন একজন জাত স্পোর্টসম্যান হয়ে। মার্শাল আর্টে আগ্রহ শুরু হওয়ার আগেই কুস্তির প্রশিক্ষণ শুরু হয় বাবার হাত ধরে। এই প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বাল্যকালে বাবার তত্ত্বাবধায়নে লড়তে হয়েছিল ভালুকের সাথে। শিশু হাবিবের ভালুকের সাথে লড়া সেই কুস্তির ভিডিও ভাইরালও হয়েছিল ইন্টারনেট দুনিয়ায়।

ছেলের অদম্য সাহস আর মনোবল দেখে ‘কমব্যাট স্যাম্বো’ কোচের দায়িত্বে থাকা বাবা অনুমান করতে পেরেছিলেন হাবিবের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ব্যাপারে।

মিক্সড মার্শাল আর্টে হাবিব

১৫ বছর বয়সে হাবিব জুডো মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ শুরু করেন। বাল্যকাল থেকে কুস্তিতে অভ্যস্ত হওয়ায় তার জন্য জুডো ছিল কিছুটা জটিল। কিন্তু তিনি তো অদম্য! তাই পেছনে ফিরে তাকাননি। বাবার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েই টানা ২ বছর জুডোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

১৭ বছর বয়সে শুরু হয় কমব্যাট স্যাম্বোর প্রশিক্ষণ। বাবার কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ আর নিজের লাগামহীন অনুশীলন; ফলাফল, অল্প দিনেই জুডো ও কমব্যাট স্যাম্বোতে সিদ্ধহস্ত বনে যান হাবিব।

নিজেকে প্রমাণ করতে অনেকটা সিনেমার গল্পের মতোই শুরু করেন স্ট্রিট ফাইটিং, এতে তার বাবারও সম্মতিও ছিল বটে। স্ট্রিট ফাইটিং করতে যেয়ে বুঝতে পারলেন, মিক্সড মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতার মঞ্চে যেতে হলে, আরো বেশ কিছু কৌশল রপ্ত করতে হবে। এরপর আবারও চলে কঠোর প্রশিক্ষণ। ভেঙে গড়ে পেশাদার মঞ্চের জন্য প্রস্তুত করেন নিজেকে।

২০০৮ সাল, মিক্সড মার্শাল আর্ট (এমএমএ)-এর প্রতিযোগিতায় অভিষেক হয় হাবিবের। প্রথম মাসেই চারটি ম্যাচে ধরাশয়ী করেন প্রতিপক্ষের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের। এরপরের ৩ বছরে জেতেন আরো ১২টি ম্যাচ। এই সাফল্য পুরোপুরি বদলে দেয় দাগেস্তানের পাহাড়ি গ্রাম থেকে উঠে আসা হাবিব নুরমোহামেদভের জীবন সমীকরণ।

আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপে পদার্পণ

মিক্সড মার্শাল আর্টের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষিক্ত হওয়ার অল্প সময়ের মাঝেই হাবিব ডাক পান ইউএফসিতে। ২০১১ সালের শেষের দিকে চুক্তি হয় লাইটওয়েট ক্যাটাগরিতে ছয়টি ম্যাচ খেলার।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষিক্ত হওয়ার অল্প সময়ের মাঝেই হাবিব ডাক পান ইউএফসিতে; Image credit: Getty Images

২০শে জানুয়ারি ২০১২ সাল, ‘প্রিন্স অফ পার্সিয়া’ কামাল সালোরাসের মুখোমুখি হাবিব। তৃতীয় রাউন্ডে কামালকে সাবমিশন করে অর্জন করেন ইউএফসির ক্যারিয়ারে প্রথম জয়।

একই বছর জুলাইয়ে ব্রাজিলিয়ান ফাইটার গ্লেইসন টাইবাউকে পরাজিত করেন। এরপর কয়েক বছরের ব্যবধানেই মুখোমুখি হন থিয়াগো ত্যাভারেস, প্যাট হিলি, রাফায়েল ডস এঞ্জোস, মাইকেল জনসনসহ কনর ম্যাকগ্রেগরের মতো বিখ্যাত মিক্সড মার্শাল আর্টিস্ট তারকাদের সাথে। বরাবরের মতোই সবাইকে পরাজিত করেন অনন্য কৌশলে।

জনপ্রিয়তার সাথে বাড়ে চুক্তির মেয়াদ। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হাবিব বনে যান ইউএফসির সবচেয়ে বড় পোস্টার বয়। মিক্সড মার্শাল আর্ট দুনিয়া দেখে দাগেস্তান থেকে উড়ে আসা ঈগলের রাজত্ব।

হাবিব বনাম ম্যাকগ্রেগর

হাবিবের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে আলোচিত এবং কঠিন ম্যাচ বলা যায় ম্যাকগ্রেগরের সাথে ফাইটিং। এমনকি এই ম্যাচটিকে ইউএফসি ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ফাইট বললেও ভুল হবে না।

একদিকে হাবিব টানা ১০ ম্যাচ অপরাজিত, অন্যদিকে ৯ ম্যাচ খেলা ম্যাকগ্রেগরের জয় ৮ ম্যাচে। সমীকরণে খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন ম্যাকগ্রেগর। শুধু যে জনপ্রিয় ছিলেন সেটাও ঠিক নয়, ছিলেন সমালোচিতও। প্রত্যেক ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা ছিল তার নিয়মিত কাজ।

২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর নির্ধারিত হয় বহুল প্রতীক্ষিত হাবিব নুরমোহামেদভ বনাম কনর ম্যাকগ্রেগরের ম্যাচটি। স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের আগে দুই ফাইটারকে নিয়ে ফটোশ্যুট আর প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। আর সেখানেই তুমুল কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন কনর। পাশাপাশি চেয়ারে বসেই বিভিন্ন রকমের আপত্তিকর মন্তব্য শুরু করেন হাবিব সম্পর্কে। ম্যাকগ্রেগর যখন হাবিবের পরিবার-ধর্ম-জাতিগোষ্ঠী নিয়ে কটূক্তি করছিলেন, তখন হাবিব ছিলেন স্বভাবসুলভ নীরব। এমনকি কথার এক পর্যায়ে ধর্মভীরু মুসলিম হাবিবের মুখের কাছে হুইস্কির বোতল ধরেন কনর ম্যাকগ্রেগর। এত কিছুর পরও অপেশাদারিত্বের পরিচয় দেননি হাবিব, সব কিছু নীরবে সহ্য করে গেছেন সেদিন। কারণ, ম্যাচের আগে কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়াতে চাননি তিনি।

ম্যাচের দিন সব জবাব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেন ম্যাকগ্রেগরকে। একের পর এক পাঞ্চ দিয়ে বুঝিয়ে দেন দাগেস্তানি ঈগল এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। খেলার চতুর্থ রাউন্ডে ১ মিনিট বাকি থাকতে ম্যাকগ্রেগরকে গ্রাউন্ডে ফেলে গলা চেপে ধরেন। শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ট্যাপ আউট করে হাবিবের কাছে হার মেনে নেন কনর!

খেলার চতুর্থ রাউন্ডে ১ মিনিট বাকি থাকতে ম্যাকগ্রেগরকে গ্রাউন্ডে ফেলে গলায় চেপে ধরেন; Image credit: Getty Images

পরাজিত হয়ে তা মেনে নিতে পারেননি কনর। যখন হাবিবকে বিজয়ী ঘোষণা করা হচ্ছে, সে সময় আবারও বাজে মন্তব্য শুরু করেন। এই মন্তব্য ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে দুই ফাইটারের অন্যান্য সহযোগী সদস্যদের মাঝেও। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি হাবিব। রিংয়ের চারপাশে থাকা উঁচু জাল অতিক্রম করে শিকারি ঈগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিপক্ষ দলের সহযোগীদের উপর।

ধার্মিক হাবিব

শান্ত স্বভাবের হাবিবকে কখনো খেলার ময়দান ছাড়া ক্ষিপ্ত হতে দেখা যায়নি। তবুও ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে সমালোচনা তাকে স্পর্শ করেছেই। তবে সমালোচকেরা কনরের সাথে ম্যাচের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলেও হাবিব সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন গভীর ধর্মপ্রেম ও নমনীয় আচরণ দিয়ে।

আগাগোড়া মুসলিম সংস্কৃতি ধারণ করেন। নিজের আদি নৃগোষ্ঠী আভারের সুন্নি মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী পাপাখা পরিধান করেই প্রবেশ করেন প্রতিটি ম্যাচে। আর দশজন সাধারণ আভারদের মতোই হাবিবও মনে করেন, পাপাখা তার সামর্থ্যের প্রতীক। এই টুপি তার জন্মস্থান এবং জাতিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে।

পাপাখা পরেন নিজের আভারীয় সংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্যে; Image credit: Chris Young/CP

প্রতিটি ম্যাচ জেতার পর হাবিবকে দেখা যায় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদায় লুটিয়ে পড়তে। ধারাভাষ্যকার যখন মাইক্রোফোন মুখের কাছে ধরেন, উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেন,

“Alhamdulillah, God gives me everything.”

শুধু খেলার ময়দানে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও দেখা যায় তার ধার্মিকতা। পরিবারের পুরুষদের মিডিয়ার সামনে আনলেও হাবিব তার স্ত্রী কিংবা অন্য নারী সদস্যদের আলোচনার বাইরে রাখেন সবসময়।

২৪শে অক্টোবর ২০২০

পেশাদার মিক্সড মার্শাল আর্ট ক্যারিয়ারে ২৯তম ম্যাচে অপরাজেয় রেকর্ড ধরে রাখতে খেলবেন আরেক বিখ্যাত খেলোয়াড় জাস্টিন গেইৎজির সাথে, যে ব্যাপারে শুরুতেই বলা হচ্ছিল।

স্বাভাবিকভাবেই মাঠে প্রবেশ করলেন হাবিব। হাতে গ্লাভস পরে নিজের পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন জাস্টিনের সামনে। তবে আজ হাবিবও কিছুটা বিচলিত, তার চেহারায় এমন চিন্তার ছাপ ম্যাকগ্রেগরের সাথে ম্যাচেও দেখা যায়নি।

রেফারির ঘণ্টা বাজতেই শুরু হলো খেলা। কিন্তু কেন যেন সেই চিরচেনা হাবিবকে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ হলো প্রথম রাউন্ড।

দ্বিতীয় রাউন্ড, জাস্টিন প্রথমবারের মতোই পায়ে টার্গেট করে হিট করছে, হাবিব একটু রক্ষণশীলভাবেই সেগুলো প্রতিহত করছে। আচমকা জুডো স্টাইলে ট্রায়াঙ্গল চোকের প্যাঁচে ফেলে জাস্টিনের গলা চেপে ধরেন হাবিব। কিছুক্ষণ নিজেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে পরাজয় মেনে নেন জাস্টিন। হাবিবের ক্যারিয়ারে যুক্ত হয় আরও একটি সাবমিশন উইন।

ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচেও নিজের স্বরূপে ছিলেন, জাস্টিনকে সাবমিশন করে বুঝিয়ে দেন, তিনি অজেয়: Image credit: Getty Images

একদিকে আহত বাঘের মতো লুটিয়ে পড়ে আছেন জাস্টিন, অন্যদিকে ব্রুস বাফারের সেই চিরচেনা কণ্ঠে ঘোষণা করা হচ্ছে ইউএফসি-২৫৪ চ্যাম্পিয়ন হাবিব নুরমোহামেদভের নাম।

বরাবরের মতোই সেজদায় হাবিব। কিন্তু এবার তিনি কান্নায় লুটিয়ে পড়েছেন, মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন না। এত আবেগী হাবিবের দেখা কি এর আগে মিলেছে? কেন কাঁদছেন হাবিব?

উত্তরটা মিললো কিছুক্ষণের মধ্যেই, কান্নাভরা গলায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে যখন বললেন, এটাই তার শেষ ফাইট। ইউএফসির মঞ্চে আর কখনোই গ্লাভস হাতে লড়তে দেখা যাবে না তাকে।

সেদিন গ্যালারিতে দর্শক ছিল না। থাকলে হয়তো এমন আকস্মিক বিদায় স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারতেন না অনেকেই। লাইভ স্ট্রিমে যারা হাবিবের শেষ ম্যাচটি দেখছিলেন, তারাও হয়তো এই অপরাজিত ঈগলকে বিদায় জানিয়েছেন ভঙ্গুর হৃদয়ে।

কিন্তু হঠাৎই কেন এমন সিদ্ধান্ত? ৩২ বছর বয়স মাত্র! এ বয়সে কোনো ইনজুরি ছাড়া গ্লাভস ডাউন করা ভীষণ অস্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পরই হাবিব নিজেই জানালেন কারণটা। বললেন, ফাইটে আসার সময় কোনোভাবেই তার মা আসতে দিচ্ছিলেন না। কারণ, এর আগে কখনোই বাবাকে ছাড়া ফাইটে আসেননি। এই করোনাকালে অনেকেই অনেক কিছু হারিয়েছেন। হাবিবও তাদের একজন। তিনি হারিয়েছেন তার অনুপ্রেরণা, তার প্রতিটা ম্যাচ জেতার উৎসাহ। শারীরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন একেবারেই। করোনার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছেন হাবিবের বাবা। তার কাছে বাবাই ছিলেন সব। আজীবন বাবার সাহচর্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন, প্রতিটি খেলায় কোচের দায়িত্বে ছিলেন বাবা নিজে।

হাবিবের কাছে তার বাবাই ছিলেন সব। বাবার জন্যই তিনি মাঠে নামতেন, চ্যাম্পিয়ন হতেন; Image Credit: Bosslogic

হাবিব আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন,

“আমি চ্যাম্পিয়ন হবো, এটা ছিল আমার বাবার স্বপ্ন। আজ বাবাই যখন নেই, তাই আমারও আর ফাইট করার ইচ্ছে নেই। আজ ফাইটে আসার সময় মা’কে বলে এসেছি, এটাই আমার শেষ ফাইট।”

বাবার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি হাবিব। তাই খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, মিডিয়া লাইমলাইট সব বিসর্জন দিয়ে বিদায় নিয়েছেন মিক্সড মার্শাল আর্ট থেকে।

নিজের বিদায়ী ম্যাচে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন। পায়ে ছোট একটা ইনজুরিও ছিল, হারতেই পারতেন। প্রথম রাউন্ড পর্যন্ত তেমনটাই মনে হচ্ছিল, হয়তো টানা ২৮ বার জেতার পর এবার থামবে এই জয়রথ। কিন্তু তিনি তো আনপ্রেডিক্টেবল, অপরাজেয়। বিদায়বেলাতেও জানিয়ে গেছেন, তিনি ঈগল, দাগেস্তানের অপরাজেয় অদম্য এক ঈগল। রিঙে দেখা না মিলুক, জীবনের যুদ্ধে আজীবন জয়ী থাকুন হাবিব, যেমনটা ছিলেন গ্লাভস হাতে!

This Bengali article is about unbeaten UFC champion Khabib Nurmagomedov. Necessary sources are hyperlinked inside the article.

Feature Image: Jeff Bottari

Background Image: Akash Sharma

Related Articles