দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু ও ব্রাজিলের কোপা আমেরিকার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া গত দশক কম ঘটনার জন্ম দেয়নি। এছাড়াও ফুটবলের জন্য গত দশক ছিল বিস্তর পরিবর্তনের। খেলার নিয়ম ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে। আগের ফুটবল ঘরানা বদলে বর্তমান ফুটবল বেশি আক্রমণাত্মক। আসুন, দেখে নেওয়া যাক সদ্য ফেলে আসা দশকে মনে রাখার মতো বিষয় ও ঘটনাগুলো।
সেই স্পেন, এই স্পেন
এ দশকের শুরুতে বিশ্বকাপ দিয়ে উত্থান ঘটেছিল এক নতুন পরাশক্তির। ‘ফেভারিট না হয়ে বিশ্বকাপ জেতা হয় না’ তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেবার বিশ্বকাপ জেতে ‘লা রোহা’রা। দুই বছর পর ইউরোতেও একই আধিপত্য। ভিসেন্তে দেল বস্কের স্পেন দল যেন অপ্রতিরোধ্য। রামোস-পুয়োল-ক্যাসিয়াস-পিকে-জাভি-ইনিয়েস্তা-ভিয়াদের স্পেন মাত্র ৪ বছরের মাঝে পরাশক্তিতে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক সেই দলকে দশকের সেরা দল হিসেবে আখ্যা দিলে তেমন ভুল হবে না।
কিন্তু ব্রাজিল বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব পার করতে না পারার পর স্পেন দলের সেই পরাশক্তির সীলমোহর গায়েব হয়ে গেল। হুট করে দল থেকে অবসর নিল একঝাঁক তারকা। ফলে স্পেন আর ঠিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ‘১৬ এর ইউরো, রাশিয়া বিশ্বকাপ – কোথাও সাফল্য নেই। তাই দুর্দান্ত শুরু করা স্প্যানিশরা দশকের শেষে এসে দেখাল মুদ্রার তিক্ত অপরপিঠ।
ফার্গুসনের বিদায় ও সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ
দু’হাত ভরে ক্লাবকে সাফল্য দেয়া ‘দ্য গ্রেট ফার্গি’র মৌসুমের শেষ ম্যাচ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে ফার্গুসন ভেবেছিলেন দুর্বল ওয়েস্টব্রমকে হেসেখেলে হারাবে তার দল। তাই অনেকটা দুর্বল দল নামিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হতে চলছে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ম্যাচগুলোর একটি।
কাগাওয়া ও বাটনারের সঙ্গে এক আত্মঘাতী গোল মিলিয়ে সহজ জয়ের পথেই এগোচ্ছিল ইউনাইটেড। ৪০ মিনিটে জেমস মরিসন এক গোল করে ব্যবধান কমান, ৩-১ গোলে শেষ হয় প্রথমার্ধ। তখন চেলসি থেকে ধারে ওয়েস্টব্রমে খেলা রোমেলু লুকাকু ৫০ মিনিটে গোল করে ব্যবধান আরও কমান। ৬৩ মিনিটের মধ্যে আরও দুই গোল করেন ইউনাইটেডের দুই স্ট্রাইকার ফন পার্সি ও হাভিয়ের হার্নান্দেজ। ফলে ৫-২ গোলে ম্যাচ শেষ হতে চলছিল।
কিন্তু অ্যালেক্স ফার্গুসনের জন্য আসল চমক তখনও বাকি! শেষ দশ মিনিটে স্যার ফার্গুসনের চোখের সামনে গুনে গুনে তিন গোল দিল ওয়েস্টব্রম। রোমেলু লুকাকু পূর্ণ করলেন তার হ্যাটট্রিক। ১০ মিনিটের ঝড়ে ৫-৫ গোলে শেষ হয় ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফার্গুসনের অধ্যায়।
ম্যানচেস্টার সিটির উত্থান ও আগুয়েরো
২০১১-১২ প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমের একদম শেষ রাউন্ডের কথা। সেবার শিরোপা কে জিতবে, সেটা নির্ধারিত হয়েছিল লিগের একদম শেষ দিনে এসে। সেই মৌসুমের শিরোপা দৌড়ে দুই নগর প্রতিপক্ষ। একদিকে স্যান্ডারল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, অন্যদিকে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে খেলছে ম্যানচেস্টার সিটি। ওয়েইন রুনির গোলে ১-০ গোলের জয় নিয়ে ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা অপেক্ষা করছিলেন সিটির পা হড়কানোর। ৯০ মিনিট শেষ পর্যন্ত স্কোরলাইন ২-১ ছিল। কিন্তু যোগ করা সময়ে ইউনাইটেডের আশায় পানি ঢেলে দেন সিটির দুই স্ট্রাইকার এডিন জেকো ও সার্জিও আগুয়েরো। ধারাভাষ্যকারের “আগুয়েরোওওও…” চিৎকারের সঙ্গে আর্জেন্টাইন তারকার জার্সি খুলে সেই বুনো উল্লাস ভুলে যাওয়া কি সম্ভব?
ম্যানচেস্টার সিটির উত্থান সেই মৌসুম থেকেই। এরপর পেপ গার্দিওলা এসে গোটা দলকে পাল্টে দিলেন। দশকের শুরুর উঠতি এক ক্লাব এখন ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তি।
ব্রাজিলের সাত গোল দুঃস্বপ্ন
শেষ বিশ্বকাপ ঘরে এসেছে এক যুগ আগে। টানা তিনটি বিশ্বকাপ পরে আবার ব্রাজিলে বিশ্বকাপের আমেজ ফিরে আসছে। ঘরের মাঠে পঞ্চম বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ব্রাজিল খেলছিল ঠিকঠাকই। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে নেইমারের মেরুদণ্ড ভেঙে এবং সিলভার হলুদ কার্ডে সেলেসাও’রা সেমিফাইনালের আগেই মানসিকভাবে পিছিয়ে গেল।
এই সুযোগের সদ্ব্যবহার জার্মানরা করল দুর্দান্তভাবে। ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিটেই ব্রাজিলের জালে জার্মানদের ৫ গোল! দ্বিতীয়ার্ধে বেলো হরিজন্তেতে ব্রাজিলের জালে বল ঢুকল আরও দুইবার। মাঝে ৬ বছর ও আরও একটি বিশ্বকাপ পার হয়ে গেলেও সেদিনের কান্না আর হতাশার স্মৃতি আজও ঘুরে বেড়ায় ব্রাজিলের আনাচে-কানাচে।
মেসি ও আর্জেন্টিনার হতাশাকাব্য
পুরো দশক জুড়ে আর্জেন্টিনার হয়ে একটি শিরোপা জেতার সুযোগ মেসি পেয়েছেন ৭ বার। সাথে ২০ বছরের বেশি সময়ের শিরোপা খরা ঘোচানোর সুযোগও এসেছিল আলবিসেলেস্তেদের জন্য। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
২০১০ বিশ্বকাপ ও ‘১১ এর কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা ভালো করেনি। কিন্তু দুর্দান্ত খেলে টানা তিনবার ফাইনাল খেলেও হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছে তাদের। ব্রাজিল বিশ্বকাপ ও পরের দুই কোপা আমেরিকায় পুরো টুর্নামেন্টে মেসি দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও ফাইনালে ছিলেন নিষ্প্রভ। তাই দুর্দান্ত এক দশক শেষেও মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপাহীন।
বার্সেলোনার ট্রেবল
এ দশকে ফুটবল বিশ্ব ট্রেবলের দেখা পেয়েছে দুইবার। একবার বায়ার্ন মিউনিখ, অন্যবার বার্সেলোনা। কিন্তু বার্সেলোনার এই ট্রেবল ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। কারণ, ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে বার্সেলোনা দুইবার ট্রেবল জেতার মর্যাদা অর্জন করে।
লুইস এনরিকের অধীনে ‘১৪-‘১৫ মৌসুমে বার্সেলোনা ছিল দুর্দান্ত ফর্মে। সে সময়ে কাতালানদের আক্রমণত্রয়ী ‘এমএসএন’ ছিল ডিফেন্ডারদের ত্রাস। গোলবন্যা বইয়ে দেওয়া আক্রমণভাগের নিচে দারুণ কার্যকর ছিলেন ইনিয়েস্তা, বুসকেটস, রাকিটিচরা। মাচেরানো ও পিকেদের রক্ষণভাগও ছিল দুর্দমনীয়। আর এই বছরই শেষবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল কাতালানরা। তাই দশকশেষে এই মৌসুম এবং বছরটি কাতালান সমর্থকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
ইতালি ও হল্যান্ডের ফিরে আসা
২০০৬ বিশ্বকাপ জেতা ইতালি দলকে পরবর্তী দুই বিশ্বকাপে একরকম খুঁজেই পাওয়া যায়নি। দলের প্রধান খেলোয়াড়দের বিদায়ের পর সঠিক পরিচালনার অভাবে ইতালির সব থেকে খারাপ সময়ে দলের হাল ধরেন রবার্তো মানচিনি। ২০২০ ইউরো বাছাইপর্বে জার্মানি ও ফ্রান্সের আগে গ্রুপপর্ব নিশ্চিত করেছে আজ্জুরি’রা। তাই আসন্ন ইউরোতে ইতালি সমর্থকেরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এ দলটিকে ঘিরে।
২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে চমক দেওয়া হল্যান্ড দল দশকের প্রথমদিকে ভালো পারফরম্যান্স উপহার দিলেও ‘১৬ এর ইউরো ও ‘১৮ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়নি তাদের। তবে পুনর্জাগরণের একটা ইশারা দিয়ে রেখেছিল ডাচরা। ক্যোমানের অধীনে নেশনস কাপ ও ইউরো বাছাইপর্বে তাই দেখা মিলেছে বদলে যাওয়া এক হল্যান্ড দলের।
পর্তুগিজদের শিরোপাতে চুমু
২০০৪ সালে যখন ইউরো ফাইনাল হেরেছিলেন, তখন তিনি উঠতি একজন ফুটবলার মাত্র। তবে ‘১৬ এর ইউরোতে দলের নায়ক তিনিই। পর্তুগালের হয়ে কিছু জিততে না পারার খোঁটা শোনা রোনালদোকে এবার আর খালি হাতে ফিরে যেতে হয়নি।
অথচ ‘১৬ ইউরোতে প্রথমেই সমীকরণ কঠিন করে তুলেছিল পর্তুগিজরা। গ্রুপপর্বে হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, অস্ট্রিয়া – তিন দলের বিপক্ষেই ড্র। ভাগ্যক্রমে পয়েন্টের মারপ্যাঁচে পরের রাউন্ডে খেলার টিকেট পায় তারা। এরপর ওয়েলস ও ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। সেখানেও ম্যাচের প্রথমেই ধাক্কা, ২০ মিনিট না পেরোতেই হাঁটুর চোট নিয়ে মাঠ ছাড়লেন রোনালদো।
কিন্তু নিয়তি তাদের পক্ষেই ছিল। ফুটবলবিধাতাও চাননি ঐ রাতে অশ্রুজল চোখে রোনালদো ফিরে যান। যদিও রোনালদোর মুখে অশ্রুই শোভা পেয়েছিল, তবে সে অশ্রু ছিল পরম আনন্দের, বিজয়ের। কারণ, ফাইনালে একদম শেষ সময়ে এডারের গোলে শেষ হাসি হেসেছিল পর্তুগিজরা। প্রথমবার দেশের হয়ে শিরোপা জেতার পর রোনালদো পর্তুগালের হয়ে জিতেছেন নেশনস লিগও।
লেস্টার সিটির রূপকথার এক গল্প
প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অর্থের ঝন়্ঝনানি। পিছিয়ে নেই চেলসি, আর্সেনালের মতো ক্লাবগুলোও। এর মাঝে লেস্টার সিটি ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পাওয়া একটি সাধারণ ক্লাবমাত্র, যাদের জয়ের পক্ষে বাজির দর ছিল ৫০০০/১।
কিন্তু কিছু কিছু গল্প আছে, যা বাস্তবতাকেও হার মানায়।
লিগ শুরু হবার পর সিটি, ইউনাইটেড, আর্সেনাল, লিভারপুল কেউই পারেনি লেস্টারের সাথে একই শক্তিতে লড়তে। প্রিমিয়ার লিগে আর সকল দলের একাদশে যখন ৫০/৬০ মিলিয়ন দিয়ে কেনা তারকা খেলোয়াড় শোভা পায়, সেখানে লেস্টার দলের হয়ে মাঠ মাতিয়ে যাচ্ছেন ৫ মিলিয়ন ইউরোরও কমে কেনা রিয়াদ মাহরেজ ও জেমি ভার্ডি। আর ফক্স’দের ডাগআউটে একজন বয়স্ক মানুষ, যার হাত থেকেই তৈরি হয়েছিল লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জেতার নীলনকশা।
প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগে খেলতে এসেই লিগ জয়, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হয়তো হবে না। লেস্টার পুনরায় কবে আবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু লেস্টার সিটির এই প্রিমিয়ার লিগের জয়ের রূপকথার গল্প আজীবন রয়ে যাবে স্মৃতির পাতায়।
মেসি ও রোনালদোর তাণ্ডব
এই দশক স্মরণীয় হয়ে থাকবে মেসি ও রোনালদো নামক দুইজন অতিমানবীয় খেলোয়াড়ের জন্য। মেসি বার্সেলোনার জন্য জিতেছেন ২০টি শিরোপা, ব্যক্তিগত অর্জন ২৬টি। সাথে মোট গোল ৫৭৯টি ও অ্যাসিস্ট সংখ্যা ১৬৪। রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস ও পর্তুগালের হয়ে রোনালদোও শিরোপা জিতেছেন ২০টি, ব্যক্তিগত অর্জন ২৪টি। মোট গোলসংখ্যা ৫৫৪ ও অ্যাসিস্ট ১৫৫টি। এক দশকের ক্যারিয়ারে মেসি ও রোনালদো জুটির মতো তাক লাগিয়ে দেবার মতো সাফল্য কে কবে পেয়েছে?
ইউরোপের ফুটবলে টাকার ঝন়্ঝনানি
লুইস ফিগোর দলবদল, অথবা পার্মা থেকে জুভেন্টাসে বুফনের ট্রান্সফারের অর্থ সে সময়ে ছিল চোখ কপালে তোলার মতো। এরপর এই দশকে প্রথমবারের মতো ১০০ মিলিয়ন দাম হয় কোনো ফুটবলারের। এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে স্পার্স থেকে গ্যারেথ বেলকে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ। এরপর বার্সেলোনা থেকে নেইমারকে ২২২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে পিএসজিতে ভেড়ানোর পর খেলোয়াড় কেনাবেচা মার্কেটে একটা আলোড়ন পড়ে যায়, যে আলোড়নে বদলে গেছে সবকিছু।
এরপর এমবাপেকেও পিএসজি কিনেছে আকাশচুম্বী অর্থে। বার্সেলোনাও দেমবেলে ও গ্রিজমানকে কিনেছে প্রচুর অর্থ খরচ করে। এক মৌসুমে ভালো খেলা কোনো খেলোয়াড় কেনার কথা এখন ৫০ মিলিয়নের কম অর্থে কেনার কথাই ভাবা যায় না। আর যদি খেলোয়াড় হয় জর্দান স্যাঞ্চো বা জোয়াও ফেলিক্সের মতো উঠতি তারকা, তাহলে তো ১০০ মিলিয়নের কমে চিন্তাও সম্ভব নয়! বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন যেন ন্যূনতম ফি।
বিশ্বকাপ ও ক্রোয়েশিয়া
ফ্রান্স, ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম – রাশিয়াতে এই দেশগুলোই ছিল হট ফেভারিট। এছাড়াও ছিল কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, স্পেন, পর্তুগালের মতো শক্তি। কিন্তু হুট করে জ্বলে উঠল আনকোড়া ক্রোয়েট দল। স্লাতকো দালিচ শেখালেন জয়ের এক আদিম মন্ত্র। আর্জেন্টিনা, ডেনমার্ক, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালের মঞ্চের টিকেট নিশ্চিত করে এক প্রকার চমক দেখিয়েছিল তারা। যদিও স্বপ্নের বিশ্বকাপ আর জেতা হয়নি। তবুও পেরেসিচ, মানজুকিচ, সুবাসিচ, রাকিটিচ, মদ্রিচদের সোনালী সময়ে স্মরণীয় সাফল্য পেয়েছে ক্রোয়েটরা।
রিয়াল মাদ্রিদের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ
চ্যাম্পিয়নস লিগ নামকরণের পর টানা দুইবার কেউ এই শিরোপা জিততে পারেনি। ‘১৩-‘১৪ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ জেতার পরের বছর ‘১৪-‘১৫ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা। সে মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের অভাবনীয় রকমের হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পর কোচের দায়িত্বে আসেন জিনেদিন জিদান। এরপরই রূপকথার গল্পের শুরু। যে শিরোপা টানা দুইবার কোনো ক্লাব জিততে পারেনি, সেখানে রোনালদো-মদ্রিচরা জিতলেন টানা তিনবার! তাই চ্যাম্পিয়নস লিগে এ দশকের সব থেকে সফল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ।
মেসি-রোনালদোর রাজত্বে মদ্রিচের হামলা
২০১০ থেকে ২০১৭, এই ৭ বছরে অনেক ফুটবল প্রতিভার উত্থান হলেও তারা কেউই দখল করতে পারেনি মেসি-রোনালদোর সিংহাসন। জাভি, ইনিয়েস্তা, রোবেন, ভ্যান পার্সিদের মতো লিজেন্ড ও নেইমার, কৌতিনহো, লেভান্ডস্কি, সুয়ারেজ, গ্রিজমান বা হ্যাজার্ডদের মতো হালের তারকা, কেউ নিতে পারেনি এই দুই মহারথীর স্থান।
কিন্তু ২০১৮ সালে দীর্ঘ ৭ বছর পর মেসি ও রোনালদো রাজত্বে হামলা করেন লুকা মদ্রিচ। বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে ফাইনালে তোলা, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা এ ক্রোয়েট মিডফিল্ডার কেড়েও নেন তাদের সিংহাসন। যদিও পরের বছরই আবারও মেসি ফেরত নেন তার হারানো স্থান। তবে ভবিষ্যতে মদ্রিচ তার নাতিপুতিদের কাছে গর্ব করে বলার মতো রসদ পেয়ে গেছেন ইতঃমধ্যেই; তিনিই যে মেসি ও রোনালদোর রাজত্ব প্রথম ভেঙেছিলেন!
নারী ফুটবলের উত্থান
পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা ফুটবল খেলা চালিয়ে গেলেও আগে তাদের ফুটবলের দিকে সবার তেমন নজর বা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এ দশকে নারীদের ফুটবলের একটা বদলের হাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। মেগান, অ্যালেক্স মরগান, লিয়েক মার্টেন্স, মার্থার মতো তারকা ফুটবলারদের নাম এ দশকে সবার মুখে মুখে ছিল।
বর্তমানে নারীদের ফুটবলকেও পুরুষদের ফুটবলের কাতারে ভাবা হচ্ছে। তাদের সকল প্রতিযোগিতায় দশকের উপস্থিতিও লক্ষ্যণীয়, পাশাপাশি ফিফা বা উয়েফার মতো সংস্থা তাদের দেখছেও ভিন্ন মর্যাদার দৃষ্টিতে। এছাড়াও, উঠতি কিশোরীরা ফুটবলকে তাদের ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে ভীষণ আগ্রহী। তাই এই দশক নারী ফুটবলকে নতুন মোড়কে জন্ম দেবার স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
‘ভিএআর’ কিংবা বিতর্ক
ফুটবলে ‘ভিএআর’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল খেলার সিদ্ধান্তগুলোকে আরও স্বচ্ছ করতে। কিন্তু এটি চালু হবার পর বিতর্কের জন্ম হয়েই যাচ্ছে। মূলত ‘ভিএআর’ বেশি ব্যবহার হয় ডি-বক্সে হ্যান্ডবল, ফাউল, রেড কার্ড ও পেনাল্টিতে। কিন্তু এখানেই এ প্রযুক্তি সিদ্ধান্ত নিতে চূড়ান্তরকমের ভুল করছে।
বর্তমানে এ প্রযুক্তির নতুন ভুক্তভোগী প্রিমিয়ার লিগ। সংক্ষিপ্ততম মার্জিনে গোল বাতিল করে আবারও নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই দশকে চালু হওয়া এ প্রযুক্তি।
এছাড়াও, এই প্রযুক্তির ভুক্তভোগী মাঠের দর্শকরাও। ‘ভিএআর’ দিয়ে গোল নিশ্চিত করার জন্য গোল হবার পরও খেলা থামিয়ে টিভি পর্দায় রিপ্লে দেখতে হচ্ছে রেফারিকে। এতে দর্শকরা তাদের দলের গোল উদযাপনটাও করতে পারছেন না। মাঠে খেলা দেখতে এসেও তারা আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এজন্য তারাও চটছেন এই প্রযুক্তির উপর। তাই আপাতত সবার চাওয়া, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও নিয়মাবলীতে আমূল পরিবর্তন আনা আবশ্যক।