এটাই বাস্তবতা, মেনে নিয়েছে তামাম দুনিয়া। ভারতীয় প্রিমিয়ার লিগের সময় ক্রিকেটারদের বেঁধে রাখা যাবে না, এ নিয়ে এখন আর উচ্চবাচ্যও হয় না কোথাও। ওহ, বাংলাদেশে হয়। আইপিএল খেলার ছাড়পত্র ক্রিকেটাররা পাবেন কি না, এ নিয়ে এ দেশে যুক্তি-যুক্তি খণ্ডন চলে প্রতি বছরই। সাকিব আল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান এবং লিটন কুমার দাসের আইপিএলের ছাড়পত্র নিয়ে যেমন জল ঘোলা হলো এবারও।
সাকিব-লিটনরা আইপিএলে যেতে অনুমতি চেয়েছিলেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই। আর্থিক প্রাপ্তিযোগের ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। বছরজুড়ে বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলে যে পরিমাণ টাকা-পয়সা তারা জমা করবেন, তার চেয়ে বেশি আয়-রোজগার করা সম্ভব আইপিএলের দুই মাসেই। ক্রিকেটারদের পেশাজীবনটা যেখানে মাত্র ১৫-১৭ বছরই লম্বা, সেখানে উপার্জনের চিন্তা দোষের কী!
তবে, অর্থ-কড়ির আলাপ দূরে সরিয়ে রাখলেও কি আইপিএলের কোনো উপকারিতা নেই? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের কাছে। ভদ্রলোক তখন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের টিম ডিরেক্টর, অর্থাৎ, মরগান-বাটলাররা তার কথায় ওঠেন-বসেন। এর আগ পর্যন্ত আইপিএল কিংবা অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর জন্য খেলোয়াড়দের ছাড়তে অনীহাই ছিল ইসিবির। কেভিন পিটারসেনের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে বসচাও হয়েছে এ নিয়ে, ইংল্যান্ড দলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন কেভিন পিটারসেন। কিন্তু, ২০১৫ বিশ্বকাপের বিপর্যয়ের পরে এই চিন্তাধারায় বদল নিয়ে এসেছিলেন স্ট্রাউস। যারা সুযোগ পাচ্ছেন আইপিএলে, তাদেরই দিতে শুরু করলেন ‘এনওসি’। কারণ হিসেবে দাঁড় করালেন একটা নিরেট পরিসংখ্যান, ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলেছেন যে ৪৪ ক্রিকেটার, তার মধ্যে ৩৮ জনেরই আইপিএল খেলার অভিজ্ঞতা আছে কখনো না কখনো।
আইপিএলের অভিজ্ঞতাটা কেন প্রভাব ফেলছে, তার একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছিলেন স্ট্রাউস। আইপিএলের প্রতি দলে যেহেতু মাত্র চারজন করে বিদেশি খেলার সুযোগ পান, তাদের ওপর পারফরম্যান্সের প্রত্যাশা থাকে আকাশসমান। কোটি-দর্শক আপনার কাছে পারফরম্যান্স চাইছে, এই চাপ নিয়ে ম্যাচের পর ম্যাচ খেললে আপনার স্নায়ু তো শক্ত হবে এমনিতেই। এই স্নায়ুর শীতলতা খেলোয়াড়ের পক্ষে কাজ করবে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময়েও। স্ট্রাউস তো বলছেন, ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালের সুপার ওভারেও যে খেই হারাননি মাত্রই ২২ বছরে পা ফেলা জফরা আর্চার, তার মূলে আইপিএলে খেলার অভিজ্ঞতাই।
মাঠের খেলা ছেড়ে অনুশীলনে আসুন, আইপিএলকে বেঞ্চমার্ক মানতে হবে সেখানেও। সারা বছর তো জাতীয় দলের সতীর্থদের সঙ্গেই ধরাবাঁধা অনুশীলন, কিন্তু আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগগুলো সুযোগ করে দিচ্ছে অনুশীলনেই আন্দ্রে রাসেল-সুনীল নারাইনদের মুখোমুখি হওয়ার, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সর্বকাল-সেরার কাতারে যাদের নামটা রাখতেই হবে।
সেরাদের সঙ্গে অনুশীলন যে কেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে মাঠের পারফরম্যান্সে, তার অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে খুঁজলে। যতদিন দৌড়েছেন, উসাইন বোল্ট সবচেয়ে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছিলেন ইয়োহান ব্লেকের কাছ থেকেই। এই ব্লেক শুধু যে জাতে বোল্টের স্বদেশী, তা-ই নন, দুজনে অনুশীলনও করতেন এক সঙ্গে। রায়ান লোকটি আর মাইকেল ফেলপসের বন্ধুত্বের গল্পও আপনার অজানা নয় নিশ্চিত। অলিম্পিকের পুলের মতো অনুশীলনেও দুজন টক্কর লাগাতেন সমানে সমানে।
কেন একই সঙ্গে অনুশীলন করা দুজন লোকই গড়ে তুলতে পারছেন সবচেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, তার একটা ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন বোল্ট নিজেই। নিজের ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন বোল্ট নিজেও। ইতিহাসের দ্রুততম মানব হওয়ার পর লেখা আত্মজীবনীতে বলেওছেন, স্বীয় প্রতিভার কথা তার জানা ছিল। এই কারণেই অনুশীলন কিংবা জিম সেশন মাঝেমধ্যেই বাদ পড়ত তার। তবে, যেদিন থেকে তার কোচ গ্লেন মিলস অনুশীলনে নিয়ে এলেন ব্লেককে, তার অনুশীলনের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পরিচিত হলেন, তখন থেকেই অনুশীলনে বাড়তি মন লাগালেন বোল্ট। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কিংবা অলিম্পিকে নিজের রাজত্ব ধরে রাখা আরও সহজ হয়েছিল তাই।
আরেকটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ক্রীড়া মনোবিদদের কাছ থেকে। হয় কী, বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই অনুশীলনের পারফরম্যান্সটা অনূদিত করতে পারেন না মূল মঞ্চে। প্রতিযোগিতায় উত্তেজনার পারদ চড়া থাকে, ফলাফলের দিকে মন থাকে বেশি, তুলনায় প্রস্তুতিটা হয় বেশ নিস্তরঙ্গ। কিন্তু, অনুশীলনটাই যদি হয় উচ্চ তীব্রতার, তখনই লড়তে হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে, সত্যিকারের মঞ্চে গিয়ে খেলোয়াড়েরা নিজেদের শান্ত রাখতে পারেন তত।
সাকিব আল হাসানকে জিজ্ঞাসা করলে বেরিয়ে আসবে আইপিএলের আরেকটা উপকারিতা। ২০১৯ আইপিএলে সেভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি৷ তবে সময়টা বেগারও যেতে দেননি। দেশ থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে, ফিটনেসে সময় দিয়েছেন। প্রত্যেক দলের বিশ্লেষককে ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘ধরো, তোমার দলের বিপক্ষে খেলতে নেমেছি। আমাকে কোথায় বল করতে বলবে তুমি?’ তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নেমে পড়েছিলেন অনুশীলনে, পাল্টা আক্রমণের রসদ জমাতে। আর অনুশীলন সুবিধা নিয়ে কিছু বলাই তো বাহুল্য। গুচ্ছের টাকা খরচ করে দল গড়ছে দলগুলো, অনুশীলনের জন্যেও এমন কিছু সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে এখনো কল্পনাই। এই সব মিলে-মিশে যে ফলটা হলো, বিশ্বকাপে ৬০৬ রান, ১১ উইকেট। ইতিহাসের পাতায় অনায়াসে ঠাঁই।
ওই বিশ্বকাপে যে তিনে ব্যাট করেছিলেন সাকিব, তার জন্যেও কি একটা কৃতিত্ব পাওয়া উচিত নয় আইপিএলের? আইপিএলে গিয়েই তো এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে তার ‘তিন নম্বরে ব্যাট করা উচিত কি না’ বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে ফিরেছিলেন তিনি।
বিশ্বায়নের ক্রিকেটের যুগে ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের গল্পগুলো অবশ্য অবাক করার কথা নয়। বরং, ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে নিজেকে ক্রিকেট-ভাবনা শানিত করতে আইপিএলের মতো মঞ্চগুলো দারুণ। সাকিবই যেমন নিজের ব্যাটিং-ভাবনা বদলের একটা কৃতিত্ব দিয়েছিলেন কলকাতার এক সময়ের কোচ ট্রেভর বেলিসকে।
কেকেআরে খেলার সময় ট্রেভর বেলিস বলেছিলেন, আমরা আমাদের হাতে যতটুকু সময় আছে বলে মনে করি, বিশেষ করে নিচের দিকে যারা ব্যাট করে, তাদের জন্য সময়টা আসলে একটু বেশি থাকে। আমরা হয়তো ভাবি মাত্র ১০ বল আছে, তবে এই ১০ বল কিন্তু অনেক।
– সাকিব আল হাসান
কেমন করে অনেক, সেই ব্যাখ্যাও মিলেছিল বেলিসের কাছ থেকে। ১০ বলের কথা ভেবে কেউ প্রথম বলেই মারতে যায়, তাহলে আউট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু, কোনো ব্যাটার যদি প্রথম তিন বলে তিনটা সিঙ্গেল নিয়ে পরের ৭ বলে মারার চেষ্টা করেন, সেক্ষেত্রে তার সফল হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রসঙ্গ এলেই দেশপ্রেমের আদর্শে বলীয়ান হয়ে ওঠে বিসিবি। বারংবার স্মরণ করিয়ে দিতে চান কর্তারা, ‘সবার আগে দেশ।’ তবে তারা তো এই কথাটাও বোঝেন, বিশ্বকাপ নিশ্চিত হয়ে গেছে, একটা মাত্র টেস্টে সাকিব-লিটনকে খেলিয়ে বদলে ফেলা যাবে না হাতি-ঘোড়ার চেহারা। তার চেয়ে সাকিব-লিটন-মোস্তাফিজকে আইপিএল খেলার সুযোগ দেওয়া হলে কিছু না বদলাক, অন্তত ভারতের কন্ডিশন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পাবেন তারা। এই অভিজ্ঞতা-জ্ঞান তারা যদি ছড়িয়ে দিতে পারেন গোটা দলের মধ্যে, উপকারটা বাংলাদেশ দলই পাবে।
আর মঞ্চটাই বা ভুলে যাচ্ছেন কেন? অনেক সাধের বিশ্বকাপ।