এমনিতেই চলমান ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে ইংল্যান্ডের প্রাপ্তির অভাব নেই। জস বাটলারের নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসনের দেখা পাওয়া গিয়েছে আহমেদাবাদের দুরূহ উইকেটে, জেসন রয়ও কিছুটা ফর্মে ফেরার আভাস দিয়েছেন এ সিরিজ দিয়ে। মাঝের ওভারগুলোতে আদিল রশিদে মরগান ভরসা করতেন আগে থেকেই, এবারের সিরিজে মিলেছে নতুন বলে কার্যকর আদিল রশিদের দেখাও।
সিরিজ থেকে ইংল্যান্ড নতুন করে পেয়েছে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের খোঁজও, মার্ক উড বেশে।
***
চুলচেরা বিশ্লেষণের আগে কেবল প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ে, এমন সংখ্যাগুলোর দিকেই তাকিয়ে দেখুন! মাঝে চোটে পড়ে দ্বিতীয় ম্যাচটাও খেলতে পারেননি, বাকি তিন ম্যাচে ১২ ওভার বল করে উইকেট তুলেছেন পাঁচটি, ওভারপ্রতি রান খরচার হার ৬.৩। আর কেবল তো উইকেট শিকারই তো নয়, বরং যেভাবে শিকার ধরেছেন, সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে মার্ক উডের গল্প।
গত সপ্তাহে উড গতির তোড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছেন সমস্ত রেকর্ড নথি। ১ম আর ৩য় টি-২০তে উডের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ১৪৭ আর ১৪৫ কি.মি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের হয়ে দ্রুততম স্পেলের তালিকায় দু’টি পারফরম্যান্সই জায়গা করে নিয়েছে সেরা চারে।
অবশ্য উডকে যারা নিয়মিত অনুসরণ করছেন বেশ কয়েক বছর যাবৎ, এমন কীর্তিতে তারা বিস্মিত হচ্ছেন না মোটেই। শেষ দুই বছরের খতিয়ান খুলে বসলে দেখা যাচ্ছে, কমপক্ষে পাঁচটি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, এমন বোলারদের ভেতরে ইংল্যান্ডের এই এনফোর্সারের চাইতে বেশি গতি তুলতে পারেননি না আর কেউ।
উডের উচ্চগতি ইয়োন মরগানের কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। এই গতির সুবিধা ইংল্যান্ড পাচ্ছে প্রতিপক্ষের গোটা ইনিংসজুড়েই, বিশেষত পাওয়ারপ্লেতে। এমনিতে পাওয়ারপ্লের বোলিং নিয়ে এবারকার সিরিজের আগে বেশ ভালোই ভুগতে হচ্ছিল তাদের। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ হতে শুরু করে পরের দুই বছরে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর ভেতরে সবচেয়ে বাজে পাওয়ারপ্লে বোলিং গড় ছিল এই ইংল্যান্ডেরই। ইংল্যান্ডের এহেন জঘন্য বোলিং প্রশ্ন জাগিয়েছিল, তবে কি ডেভিড উইলিকে বড্ড বেশি তাড়াতাড়ি ছেঁটে ফেলা হলো? প্রশ্নটা যখন পাওয়ারপ্লের বোলিং, তখন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে উইলি তো সেরাদের কাতারেই থাকেন!
তবে চলমান সিরিজের বোলিং দিয়ে সব সংশয়-জিজ্ঞাসা ঝেঁটিয়ে দূর করেছেন উড। সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি অব্দি শুরুর ৬ ওভারে ইংল্যান্ড উইকেট তুলেছে তিনটি, যার দু’টিই মিলেছে উডের ঝড়ো বোলিংয়ের সুবাদে। তামাম ক্যারিয়ারে পাওয়ারপ্লেতে বল করে উড এখন অব্দি উইকেট নিয়েছেন ৯টি, মাত্র ১২.৬ স্ট্রাইকরেট তাকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে উইলিরও আগে।
ইংল্যান্ড শিবির উডের ফায়দা লুটছে মাঝের ওভারেও। ‘একাদশে দু’জন উচ্চগতিসম্পন্ন বোলার নাও, তাদের যেকোনো একজনকে দিয়ে মাঝের ওভারে বল করাও’ – ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এই কৌশলটা মানা হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। প্রতিপক্ষের স্বাচ্ছন্দ্যে স্পিন খেলতে পারঙ্গম ব্যাটসম্যানকে দমিয়ে রাখতে এই তরিকা কাজেও দিয়েছে বেশ। ইংল্যান্ডও এই কৌশল বাস্তবায়নের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছে মার্ক উড এবং জোফরা আর্চারে।
মঙ্গলবারের ম্যাচে শ্রেয়াস আয়ারের উইকেটটিই হতে পারে তা প্রমাণে আদর্শ নিদর্শন। স্পিন খেলতে আয়ারের পটুতার কথা অবিদিত নয় ক্রিকেট অনুসারীদের কাছে, পেস বলটাও সামলাতে পারেন ভালোই; শুধু বাড়তি পেসওয়ালা শর্ট বলগুলোতেই কিছুটা দিগভ্রান্ত মনে হয় তাকে। আয়ার ক্রিজে আসতেই ইংল্যান্ড তাই লেলিয়ে দিয়েছিল উডকে। পরিকল্পনা কাজেও দিয়েছে বেশ ভালোভাবে, ক্রিজের ভেতরে এলেবেলে নেচে আয়ার ক্যাচ দিয়েছিলেন ডিপ পয়েন্টে দাঁড়ানো ডেভিড মালানের হাতে।
আয়ারের এই উইকেটটি যে কোনো তুক-তাক নয়, বরং উড এমন কার্য সম্পাদন করছেন ধারাবাহিকভাবেই, তা বুঝতে আবারও চোখ ফেরানো যেতে পারে পরিসংখ্যানে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের হয়ে গত দু’বছরে উড সবচেয়ে কার্যকর ছিলেন মাঝের ওভারগুলোতেই।
এক ডেথ ওভারের উডই কিছুটা ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছেন ইংলিশ কোচিং স্টাফদের মনে। এমনিতেই শেষের ওভারগুলোতে খুব একটা বল হাতে নিতে হয় না তার, শেষ দুই বছরে ছোঁড়া ১৯৮ ডেলিভারির মাত্র ৩৬টিই করেছেন ইনিংস সমাপনীর পাঁচ ওভারে। আর যখন করেছেন, তখনও ওভারপ্রতি রান বিলিয়েছেন ১০.৭ করে, ক্রিকভিজের মতে সে সময়টায় তার বোলিং ইমপ্যাক্ট শূন্যেরও নিচে।
কী কারণে এমন আকাশপাতাল তফাৎ হচ্ছে, তা বুঝতে চাইলে নজর দেয়া যায় তার বোলিং লেংথে। পাওয়ারপ্লেতে কিংবা ৭-১৫ ওভার সময়কালে, উড বেশিরভাগ বলই ফেলতে চেয়েছেন পিচের ৪-৮ মিটার অঞ্চলে। কিন্তু শেষাংশে গিয়ে গুড লেংথকে ছেঁটে ফেলে আশ্রয় খুঁজছেন ফুল লেংথের বলে, যে পরিকল্পনাটা কাজে দেয়নি এখন অব্দি।
তবে শেষের ওভারের এই কালিমাটুকু বাদ দিলে উড দীপ্তি ছড়াচ্ছেন শরৎ রাতের জোৎস্নার মতোই। ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজ জিতিয়েছেন একবার, আর বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও ছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় তার আগুনে গতির দেখা মিলেছে, দেখা মিলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজেও। সাদা বলের ক্রিকেটে অধিনায়ক ইয়োন মরগানের নির্ভরতা হয়ে রয়েছেন অনেকদিন ধরেই; আসছে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলো থেকে নগদনারায়ণে ফুলে-ফেঁপে উঠবে তার ব্যাংক-ব্যালান্স, প্রত্যাশা রয়েছে এমনই। কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে তাই অকপট ঘোষণা দিয়ে দেওয়াই যায়, বেশিরভাগ ক্রিকেটারের জীবনেই যা হয়ে রয়েছে আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন, উড ইতঃমধ্যে অর্জন করে ফেলেছেন তার চাইতে ঢের বেশি।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, উড ‘গুড’ নাকি ‘গ্রেট’, এ প্রশ্নের জবাব জানাটা এখনো বাকি; আর জবাবটা নাকি মিলবে এই বছরই। অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাশেজ বসছে এ বছরেরই একদম শেষভাগে, সেখানে তিনি কেমন করেন, মূল প্রশ্নটা সেখানেই। সঙ্গে আতশকাঁচের তলায় আসবে অক্টোবরেই ভারতে বসতে যাওয়া বিশ্ব টি-টোয়েন্টির আসরের পারফরম্যান্স, পরপর দু’বছরে দু’টো বিশ্ব আসর জেতাতে পারলে উডের মহিমা নিয়ে কারও সংশয় থাকবার কথা নয়!
***
তবে সম্ভাবনার পিঠেই খেলা করছে শঙ্কা। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলেই হালকা অস্বস্তি বোধ করায় মাঠে নামতে পারেননি দ্বিতীয় ম্যাচে, এর আগেও চোটাঘাতে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত করতে হয়েছে ক্রিকেট থেকে দূরে। এবং চোটে পড়ার কারণ একটিই, শরীরের সঙ্গে আপস না করে দ্রুতগতিতে বল করা।
প্রশ্নটা তাই এখন ইংল্যান্ড ম্যানেজমেন্টের কাছে। মার্ক উডকে তারা কীভাবে ব্যবহার করবেন? কতটুকু ব্যবহার করবেন? এমনিতেই বিলেত শিবিরে চলছে পেস বোলারদের রমরমা কারবার। জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডদের মতো অভিজ্ঞরা তো আছেনই, ক্রিস ওকস-জোফরা আর্চারদের সঙ্গে দলে জায়গা পাকা করতে লড়ছেন স্যাম কারেনও। আর অনবরত ৯০ মাইল/ঘণ্টা গতি তুলতে পারেন বলে ওলি স্টোনও চলে এসেছেন নির্বাচকদের নজরে। সামনে তাই ইংরেজ নির্বাচকদের কাজ হবে একটিই, অ্যাশেজের পূর্ব-অব্দি যতটা সম্ভব সুরক্ষাবলয়ে রাখতে হবে উড নামের সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে। ইতঃমধ্যেই খেলোয়াড়দের সুরক্ষায় ‘আবর্তন চক্র’ চালু করেছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের নীতিনির্ধারকেরা। মার্ক উডকে সে চক্রের ভেতর দিয়ে যেতে হবে বিশেষ করে।
অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে না, এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা হবে ম্যাচের ফলে সামান্য রকমফের হলেই। দল খারাপ খেলবে, বিশ্লেষকমহলে নিন্দার ঝড় উঠবে। আর জস বাটলার, জফরা আর্চার, মার্ক উডদের মতো ফ্যান-ফেবারিটরা না থাকলে ম্যাচ নিয়ে দর্শক আগ্রহটাও কমে যাবে অনেকাংশে, টান পড়বে অর্থভাণ্ডারে। তবে বিশ্ব টি-২০তে কিংবা অ্যাশেজে, পূর্ণ ফিট উডকে পেতে চাইলে সমালোচনাগুলো আপাতত কানে তুলো গুঁজেই সহ্য করে যেতে হবে ইংরেজ কাপ্তান-নির্বাচকদের।
নইলে তো মার্ক উড নামের অগ্নিবাণ নিজের আগুনে নিজেই পুড়ে খাক হবে।