২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব চলছে। আর্জেন্টিনার কোচ তখন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কিন্তু ম্যারাডোনার অধীনে আর্জেন্টিনা একদম খাদের কিনারায়। বাছাইপর্বে তারা টানা হেরেছে ব্রাজিল,ইকুয়েডর ও প্যারাগুয়ের সাথে। এমনকি বলিভিয়ার মতো দলও আলবিসেস্তেদের হারিয়েছে ৬-১ গোলে। শেষ ম্যাচ পেরুর সাথে, সমীকরণ একদম সহজ। জিতলে বিশ্বকাপের মূল পর্বে যেতে পারবে আর্জেন্টিনা, আর হেরে গেলে সরাসরি বিশ্বকাপ থেকে বাদ।
এই মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আর্জেন্টিনার কোচ ডিয়েগো ম্যারাডোনা ডাকলেন রিয়াল মাদ্রিদের তরুণ স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়াইন ও বোকা জুনিয়র্সের ৩৫ বছর বয়সী স্ট্রাইকার মার্টিন পালের্মোকে। একসময় এই পালের্মো আর্জেন্টিনা দলে ছিলেন সব থেকে সমালোচিত খেলোয়াড়। সেই ১৯৯৯ সালের পর থেকে তাকে কখনোই জাতীয় দলে ডাকা হয়নি। কী কারণে তাকে সবাই বিষ নজরে দেখতো, সে বিষয়ে পরে আসছি।
তো সেই বাঁচা-মরা ম্যাচের শুরু থেকে ছিলেন আনকোরা স্ট্রাইকার হিগুয়াইন। মার্টিন পার্লেমো নেমেছিলেন দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে। প্রথমার্ধ শেষ হবার কয়েক মুহূর্ত আগে পাবলো আইমারের ডিফেন্সচেরা পাসে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম গোল করেন হিগুয়াইন। সবকিছু ভালোমতোই চলছিল। কিন্তু ৮৯ মিনিটে পেরুর স্ট্রাইকার রেনগিফো গোল করে ম্যাচ সমতায় নিয়ে আসেন। এ ম্যাচে আর্জেন্টিনার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে জয়; ম্যাচ যদি ড্র হয়, তবুও আর্জেন্টিনা ২০১০ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে না। তাই রেনগিফো’র ঐ গোলের পর সব স্বপ্ন যখন ধীরে ধীরে স্লান হয়ে পড়ছিল, তখনই আর্জেন্টিনাকে নতুন করে ভাবতে শেখান মার্টিন পালের্মো। ৯২ মিনিটে গোল করে তিনি আর্জেন্টিনাকে পৌঁছে দেন বিশ্বকাপে। যদিও পরবর্তী সময়ে কখনোই পালের্মো দলে নিয়মিত সুযোগ পাননি। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে দলে থাকলেও পুরো বিশ্বকাপে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছিল মাত্র ১০ মিনিটের জন্য। যদিও গ্রিসের বিপক্ষে শেষ সময়ে নেমে ১টি গোলও করেছিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালের কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি চলছে। সেবারের আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছিল প্যারাগুয়ে। আর্জেন্টিনার দলের দায়িত্বে তখন মার্সেলো বিয়েলসা। কোপা আমেরিকাকে সামনে রেখে তিনি আর্জেন্টিনার দল সাজাচ্ছেন। ২১ বছর বয়সী রোমান রিকেলমে, ১৯ বছর বয়সী পাবলো আইমার, বোকা জুনিয়র্সের তরুণ ডিফেন্ডার ওয়াল্টার স্যামুয়েল তার দলে প্রাধান্য পেল। রবার্তো আয়ালা, ডিয়েগো সিমিওনে, হাভিয়ের জানেত্তি বা মরিসিও পচেত্তিনো’র মতো পুরনো আস্থারাও দল থেকে বাদ পড়লেন না। তবে আক্রমণে তিনি বোকা জুনিয়র্স থেকে ২৫ বছর বয়সী এক স্ট্রাইকারকে দলে ডাকলেন, নাম মার্টিন পালের্মো। পালের্মো কয়েক মৌসুম ধরে লা বমবনেরা’দের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন, কিন্তু জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। তবে কোপা আমেরিকার মতো মঞ্চে পালের্মোকে প্রথমবার জাতীয় দলের জার্সি পড়ার সুযোগ করে দেন মার্সেলো বিয়েলসা।
এবার একটু মার্টিন পালের্মো প্রসঙ্গে আসা যাক। ১৯৭৩ সালের ৭ই নভেম্বর আর্জেন্টিনার লা প্লাতায় জন্ম নেয়া পালের্মো ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ স্ট্রাইকার। ১৯৯২ সালে লা প্লাতার ক্লাবে নিজের পেশাদারি জীবন শুরু করলেও তিনি ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়ে খেলেছেন বোকা জুনিয়র্সের হয়ে। মাঝে স্পেনের রিয়াল বেটিস, আলাভেজ ও ভিয়ারিয়ালের হয়ে খেললেও ২০০৪ সালে আবার তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন। ক্যারিয়ারে বড় ধরণের ইনজুরি কয়েকবার আঘাত হানলেও পালের্মো পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই প্রচুর গোল করেছেন। ২৩৬ গোল করে বোকা জুনিয়র্সের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। শুধুই আর সব আর্জেন্টাইনদের মতো দেশের জার্সি গায়ে চড়িয়ে নিজেও ঝিমিয়ে গিয়েছিলেন।
আবার ফিরে যাওয়া যাক ১৯৯৯ সালের প্যারাগুয়ে কোপা আমেরিকায়। সেবারের আসরে ফেভারিট দেশ ছিল প্রথমত ব্রাজিল। কিন্তু এরপরেই নাম আসবে আর্জেন্টিনার। কারণ খেলোয়াড় থেকে কোচ সবাই ছিলেন প্রশংসনীয় ও মেধাবী। আর্জেন্টিনা খুব সহজ গ্রুপে ছিল না। গ্রুপ সি’তে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া, উরুগুয়ে ও ইকুয়েডর। আলবিসেলেস্তে’দের কোপা আমেরিকা যাত্রা শুরু হয় ইকুয়েডরের বিপক্ষে। তাতে ৩-১ গোলের সহজ জয় পায় আর্জেন্টিনা। ডিয়েগো সিমিওনে ১২ মিনিটের গোলের পর মার্টিন পালের্মো অভিষেক ম্যাচে জোড়া গোল করেন।
এরপরই আসে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ। কোপা আমেরিকা এরকম পাগলাটে ম্যাচ আগে কখনও দেখেনি। কলম্বিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে মার্সেলো বিয়েলসা শুরু থেকে একাদশে রেখেছিলেন পালের্মোকে। কলম্বিয়ার বিপক্ষে মাত্র পঞ্চম মিনিটে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। বামপাশ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলো আলবিসেলেস্তেরা। বল গোলপোস্টে ক্রস করতেই পালের্মো লাফিয়ে উঠেছিলেন ভলি নিতে। কিন্তু ক্রস ঠিকঠাক হলেও পালের্মো যে পজিশনে ছিলেন, তাতে গোল হবার তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার অ্যালেক্সান্ডার ভিভেরস তেমনটা ভাবেননি। তিনি অহেতুক বলে হাত লাগিয়ে আর্জেন্টিনাকে পেনাল্টি উপহার দেন। মার্টিন পালের্মো শট নিতে এগিয়ে আসেন। তার শারীরিক গড়ন দারুণ, দৌঁড়ে এসে প্রবল গতিতে এক শট নেন। কিন্তু বল ক্রসবারে লেগে জালে জড়ানোর বদলে উপরের দিকে চলে যায়।
পালের্মোর এমন পেনাল্টি মিস দেখে সাইডলাইনে আর্জেন্টাইন কোচ বিয়েলসা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পালের্মো নির্বিকার মুখে ফেরত যাচ্ছেন নিজের পজিশনে। ম্যাচের মাত্র পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে, আরও অনেক সময় আছে তাদের জন্য। কিন্তু রেফারি উবালদো আকুইনো তখনও ভাবেননি, এটি তার জীবনে ভয়াবহ একটি ম্যাচ হতে যাচ্ছে।
ম্যাচের যখন ১০ মিনিট অতিবাহিত হচ্ছে, আবারও রেফারির বাঁশি বেজে উঠল। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার নেলসন ভিভানস ডি-বক্সে ফাউল করে বসেছেন কলম্বিয়ার আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আর্লে বেটানকোর্টকে। আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক জার্মান বুর্গাসের সামনে পেনাল্টি কিক নিতে আসলেন ইভান কর্দোবা। তার বুলেট শট রুখে দেবার কোনো সুযোগ ছিল না বুর্গাসের সামনে। কর্দোবা গোল উদযাপনে মাতলেন, নিজের জার্সি তুলে ভেতরে ‘২’ প্রিন্ট করা টি-শার্ট বের করে আকাশের দিকে ইশারা করলেন। সেদিন ছিল কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার আন্দ্রেস এস্কোবারের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী, যিনি নিহত হয়েছিলেন কলম্বিয়ার হয়ে সামান্য পেনাল্টি মিস করার জন্য। ম্যাচের মাত্র ১০ মিনিটে পেনাল্টি গোলে এগিয়ে গেল কলম্বিয়া। পার্লেমো তাকিয়ে দেখলেন কর্দোবার উদযাপন, তখনও তিনি ভাবেননি কেমন কালো রাতের সাক্ষী হতে হবে তাকে।
দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হবার দুই মিনিট হতে না হতেই কলম্বিয়া আবার পেনাল্টি পেল ক্যাপ্টেন আয়ালার ভুলে। ফাউলের শিকাল হয়েছিলেন রিকার্ড, পেনাল্টিও নিতে এলেন তিনি। কিন্তু তার দুর্বল শট সহজেই থামিয়ে দিলেন বুর্গাস। কিন্তু প্রথমার্ধের ঐ গোলের ফলে এগিয়ে থাকল কলম্বিয়াই।
মার্সেলো বিয়েলসা বিরক্ত। তার স্বভাব ও চরিত্র কেমন, তা না বললেও আজ চলবে। এই অবস্থায় তার বিরক্তির মাত্র বাড়িয়ে দিলেন হাভিয়ের জানেত্তি। কলম্বিয়ার রুবেন কুইনতারার মুখে কনুই দিয়ে অযথা গুতো দেবার কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু জানেত্তি এই কুকর্ম করে হজম করলেন লাল কার্ড। ১০ জনে পরিণত হওয়া আর্জেন্টিনাকে চেপে ধরল কলম্বিয়া।
৫৫ মিনিটে আর্জেন্টিনা গোল সুযোগ তৈরি করেছিল রিকেলমের দৌলতে। রিকেলমে বল উড়িয়ে মেরেছিলেন পালের্মোর কাছে। কিন্তু পালের্মোর হেড গিয়ে সোজা লাগে ভিভেরসের হাতে। আবারও পেনাল্টি আর্জেন্টিনার পক্ষে। সমতায় আসার মোক্ষম সুযোগ। দুর্দান্ত মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়ে বল হাতে তুলে পেনাল্টি নিতে এগিয়ে আসেন পালের্মো। টিভির ধারাভাষ্যকর মার্সেলো আরাউজু উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, ‘ভামোস, মার্টিন, ভামোস’ বলে। নির্বিকার মুখে পালের্মো তার স্বভাবসুলভ জোড়ালো শট নিলেন। তা এতই জোড়ালো যে, ক্রসবারেরও সামান্য উপর দিয়ে বল সোজা গ্যালারিতে আছড়ে পড়ল। পালের্মোর টানা দুই পেনাল্টি মিস দেখে মার্সেলো বিয়েলসা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। এতটাই ঝামেলা শুরু করলেন যে, রেফারি কোন উচ্চবাচ্য না করে, তাকে ডাগআউট থেকে গ্যালারিতে পাঠাতে বাধ্য হলেন।
পালের্মোর দ্বিতীয় পেনাল্টি মিসের পর আর্জেন্টিনাকে কোণঠাসা করে ফেলে কলম্বিয়ার গতিময় আক্রমণ। ১০ জনে পরিণত হওয়া দল আর তাদের সামলাতে পারেনি। ৭৯ ও ৮৭ মিনিটে আর্জেন্টিনা দুই গোল হজম করে ম্যাচ থেকে ছিঁটকে যায়। কিন্তু ব্যবধান কমানোর আরও একটি সুযোগ আসে আর্জেন্টিনার সামনে। পালের্মো কলম্বিয়ার ডি-বক্সে কর্দোবাকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যেতে গেলে তাকে ট্যাকল করে বসে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার। ফলে এক ম্যাচে পঞ্চমবারের মতো পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে বাধ্য হন রেফারি।
সবাই ভেবেছিল রিকেলমে বা সিমিওনে হয়তো পেনাল্টি নিতে আসবেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আবারও পেনাল্টি শট নিতে এগিয়ে আসেন পালের্মো। আগের দুইবার জাল খুঁজে পায়নি তার জোড়ালো শট। তাই কিছুটা ধীরগতির পেনাল্টি নিলেন তিনি। কিন্তু এবার নায়ক হিসেবে আবির্ভাব হলেন কলম্বিয়ান গোলরক্ষণ মিগুয়েল কালেরো, পালের্মোর শট দারুণ দক্ষতায় থামিয়ে দেন তিনি।
তিন পেনাল্টি পাবার পরও আর্জেন্টিনা সে ম্যাচে গোল করতে পারেনি। কোপা আমেরিকার ইতিহাস তো দূরের কথা, বিশ্বের অন্য কোথাও এক ম্যাচে তিন পেনাল্টি মিসের কাহিনীও কেউ তৈরি করেনি। পরবর্তীতে মার্টিন পালের্মোর এই লজ্জাজনক রেকর্ড গিনেস বুকেও জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি, এক ম্যাচে মোট পাঁচটি পেনাল্টির রেকর্ডও বেশ বিরল।
কলম্বিয়ার কাছে এমনভাবে হারার পর উরুগুয়ের বিপক্ষে গোল পেয়েছিলেন মার্টিন পালের্মো। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ২-১ গোলে হেরে আর্জেন্টিনার সে আসরের কোপা আমেরিকার যাত্রা থামে। এরপরই জাতীয় দল থেকে হারিয়ে যান পালের্মো। ২০০৯ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনা যখন তাকে আবার দলে ডাকেন, ততদিনে তার বয়স ৩৫ হয়ে গেছে। কিন্তু ১০ বছর পর প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ আর হাতছাড়া করেননি তিনি। পেরুর বিপক্ষে তার গোলের কারণেই ২০১০ বিশ্বকাপ খেলেছিল আর্জেন্টিনা।
কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেই স্মৃতি হয়তো পালের্মোকে সারাজীবন লজ্জার মুখে ফেলবে। যদিও স্মৃতির কথা দূরে থাক, তিনিই আবার তার এই অতীতের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বোকা জুনিয়র্সের ট্রেনিং ম্যাচে তিনি আবার তিন পেনাল্টি মিস করার কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। বোকা জুনিয়র্সের দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক হাভিয়ের গার্সিয়া থামিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রথম দুই পেনাল্টি, অন্যটা তিনি নিজেই গোলপোস্টের উপর দিয়ে উড়িয়ে মেরেছিলেন। তবে পালের্মোর ভাগ্য ভালো ছিল, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলেও এটা কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ ছিল না।
এক ম্যাচে তিন পেনাল্টি মিস, ভিয়ারিয়ালের হয়ে গোল উদযাপন করতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলা, ৪০ গজ দূর থেকে হেডে জয়সূচক গোল করা, শেষ মিনিটে গোল করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপের মঞ্চে তোলার মতো অবাক করা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন মার্টিন পালের্মো। তার ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাসের জন্যই হয়তো চাইলেও স্মৃতির পাতা থেকে এত সহজে হারিয়ে যাননি মার্টিন পালের্মো।