
মহিলা টেনিসের এক অনন্য প্রতিভা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। ২০০৬ এর দশ সেপ্টেম্বরের ফ্ল্যাশিং মেডো ছিল তার টেনিস জীবনের শেষ খেলার সাক্ষী। অবশ্য এর আগেও তিনি অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু সাময়িক সে অবসর থেকে আবার স্বমহিমায় ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ অবতীর্ণ হয়েছেন, জয় করে নিয়েছেন একের পর এক পুরস্কার। টেনিসের উন্মুক্ত যুগের জীবন্ত কিংবদন্তি বলা হয় মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাকে। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক বিশ্বের ১নং মহিলা খেলোয়াড় বিলি জিন কিং বলেছিলেন, “প্রমিলাদের টেনিস ইতিহাসের জীবিত খেলোয়াড়ের মধ্যে একক, দ্বৈত এবং মিশ্র দ্বৈতে তিনিই সর্বোত্তম।”
এহেন মার্টিনাকে নিয়ে আমেরিকানদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাঁহাতি এই টেনিস খেলোয়ারের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ অক্টোবর চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে। অবশ্য ১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। টেনিস ছিল তার রক্তে। তার দিদিমা ছিলেন সেই সময়ের একজন টেনিস প্লেয়ার। টেনিসের সাথে গাঁটছড়াটাও বাঁধা হয়ে গিয়েছিল খুব অল্প বয়সেই। ৯ বছর বয়সে চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাক্তন চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবপ্রাপ্ত জর্জ পার্মার অধীনে প্রফেশনাল টেনিসে দীক্ষা লাভ করেন তিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ফ্লোরিডায় জীবনের প্রথম প্রফেশনাল খেতাব জেতেন। তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল তিনি বেশ লম্বা দৌঁড়ের ঘোড়া। মার্টিনার র্যাকেটই মেয়েদের পাওয়ার গেমকে তখন নতুন মাত্রা দিয়েছিল। এরপর জীবনের বড়সড় সম্মানগুলো পেতে আর বেশি দেরি হয়নি তার।

১৯৮৩ সালের ইউএস ওপেন টেনিসে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে মার্টিনার বিখ্যাত সার্ভ। Image Source: boomsbeat.com
১৯৭৮ সালে উইম্বলডনে তিনি জীবনের প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জিতেছিলেন। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে তখন তার স্থানটা নিশ্চয় অনুমান করা যাচ্ছে? হ্যাঁ, অবশ্যই এক নম্বর। সেই সময় উইম্বলডন থেকে ফরাসি ওপেন ছুঁয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, সব ম্যাচেই তার শেষ হাসি এক অতি পরিচিত ছবি। ১৯৮৪ সালে ফরাসি ওপেন জেতায় একই সঙ্গে চারটি গ্র্যান্ড স্লাম জেতার বাসনাও তার কাছে অধরা থাকেনি।
আবার ১৯৮৪ সালে জেতা চারটি উইমেনস ডাবলসও দৃষ্টান্ত! ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭, মাত্র তিন বছরে ১১টা গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনাল কোর্টে তার জোরালো উপস্থিতি। আর অবশ্যই অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ছ’টিতে চ্যাম্পিয়ন তিনি। ১৯৮৫ সালে মার্টিনা তার শততম সিঙ্গেল টাইটেল জিতে নাম লেখান জিমি কনর্স ও ক্রিস ইভার্ট লয়েড এর পাশে। ওয়াশিংটন টেনিস টুর্নামেন্টে বুলগেরিয়ার ম্যানুয়েলা মালিভাকে ৬-৩ ও ৬-২ এ হারিয়ে ইতিহাস গড়েন এই টেনিস রানি।

১৯৮৩-৮৪ সালের ইউ এস ওপেন ওমেন চ্যাম্পিয়নশিপে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। Image Source: Sports Highlights
ঠিক এই সময় ফাটাফাটি ফোর হ্যান্ড দিয়ে টেনিসকে শাসন করতে আসেন জার্মানির স্টেফি গ্রাফ। স্টেফির আবির্ভাবে অনেকেই ধরে নিয়েছিল মার্টনা নাভ্রাতিলোভার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিত। এবার মার্টিনার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তবে কি স্টেফির স্টাইল মার্টিনার খেলাকে আদৌ কোণঠাসা করতে পেরেছিল? সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মুশকিল। তবে প্রতিবার প্রাণশক্তিতে ভরপুর খেলা খেলতে খেলতে তিনি বোধ হয় তখন একটু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তবে ‘রণে ভঙ্গ’ কথাটি মার্টিনার অভিধানে কখনও ছিল না। কারণ ১৯৮৭-এর ইউ এস ওপেন বা ১৯৯১-এর ইউ এস ওপেনের সেমি ফাইনালে তার বাঁ-হাতি খেলা গ্রাফের ফোর হ্যান্ডকে হার মানিয়েছে।

১৯৯০ সালের নবম এবং মার্টিনার শেষ উইম্বলডন খেতাব। ImageSource: CNN.com
১৯৯০ সালে ৩৩ বছর বয়সে তিনি জীবনের শেষ গ্র্যান্ড স্লামটি জেতেন। কিন্তু এর পরেও তো তার দীর্ঘ জয়ের ইতিহাস। ২০০৩ সালে উইম্বলডন এবং অস্ট্রেলিয়ান ওপেন মিক্সড ডাবলস ট্রফিও তো লিয়েন্ডার-মার্টিনা জুটির। রেকর্ডের প্রশ্ন তো আসবেই! হ্যাঁ, সবচেয়ে বয়স্ক হিসেবে গ্র্যান্ড স্লাম জেতেন মার্টিনা। উইম্বলেডনের এককের ফাইনালে ১২বার অংশগ্রহণ করে রেকর্ডসংখ্যক ৯বার বিজয়ী হন। তার মধ্যে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালে একনাগাড়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি এবং বিলি জিন কিং- প্রত্যেকেই ২০বার উইম্বলেডন জয় করেন। মার্গারেট কোর্ট এবং ডরিস হার্টের সাথে তিনিও গ্র্যান্ড স্ল্যামের বক্সড সেট নামে পরিচিত গ্র্যান্ড স্ল্যামের একক, দ্বৈত এবং মিশ্র দ্বৈত জয় করেন।
এর সঙ্গে রয়েছে ১৬৭টি সিঙ্গেল টপ লেভেল শিরোপা, ১৭৭টি ডাবলস শিরোপা এবং ১৮টি গ্রান্ড স্লাম (৯টি উইম্বলডন, ৪টি ইউএস ওপেন, ৩টি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ২টি ফ্রেঞ্চ ওপেন)।

১৯৮৫-র অষ্ট্রেলিয়া ওপেনে প্রতিপক্ষের রিটার্ন ফেরাতে ব্যস্ত মার্টিনা। Image Source: sporting-heroes.net
এ ছাড়া টানা ৭৪টি খেলায় জয়ী হওয়া প্রথম নারী তারকা তিনি। স্টেফি গ্রাফের পর দ্বিতীয় নারী টেনিস তারকা হিসেবে টানা ১১ গ্রান্ড স্ল্যামের ফাইনালে ওঠেন তিনি। ১৩ বার ফাইনালে ওঠেন গ্রাফ। নারী দ্বৈতে প্যাম শ্রিভারের সঙ্গে ১০৯ ম্যাচে জেতেন মার্টিনা। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে টানা ছয়বার উইম্বলডন খেতাব জেতেন তিনি। সে বছরগুলোতে তার জয়-পরাজয়ের পরিসংখ্যানটি ছিল, ৮৬-১, ৭৮-২, ৯০-৩ ও ৮৯-৩!

১৯৮২ সালের নারী দ্বৈতে প্যাম শ্রিভারের সঙ্গে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার উইম্বলডন খেতাব। Image Source: Sporting Heroes
তবে এবার যে পাকাপাকিভাবেই অবসরের পালা, সে কথা কারো অজানা ছিলো না। আর অবসর নেওয়ার দিনে টেনিস মহল স্বীকার করতে বাধ্য যে, মার্টিনার ৩৪ বছরের টেনিস জীবন আন্তর্জাতিক টেনিসের একটা যুগ। আসলে পারফরম্যান্স নিয়ে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অনেকে ক্রীড়া জগৎ ছাড়তে বাধ্য হন। ফলে শুরুটা অসাধারণ হলেও শেষ মুহূর্তে তালটা কোথায় যেন কেটে যায়। আর সেখানেই মার্টিনা অনন্য। শেষ ম্যাচেও বিজয়ী হয়ে আন্তর্জাতিক টেনিস সার্কিট ছাড়ার মধ্যেই রয়েছে মার্টিনার আভিজাত্যপূর্ণ জীবনের আরও একটা দিক।
সে কারনেই হাজার ক্যামেরার ঝলকানি চিরকালই তার দিকে তাক হয়ে থাকতে বাধ্য। না, কোনো ফ্যাশন শো বা অন্য কারণে নয়, এক এবং অদ্বিতীয় কারণ, তার খেলা। বয়স বাড়লেও যে ‘খেলার বয়স’ বাড়ে না, এমন এক প্রমাণ কি আর রোজ মেলে?

টেনিস থেকে অবসর নেয়ার পর মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। Image Source: CNN.com
একক, দ্বৈত ও মিশ্র দ্বৈত মিলিয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে মার্কিন তারকা নাভ্রাতিলোভার। ২০১২ সালে অ্যাগ্নিয়েস্কা রাদওয়ানস্কার কোচ হয়ে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা শুরু করেন তার কোচিং কেরিয়ার। নিজের কোচিং ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডব্লিউটিএ’র ওয়েবসাইটে নাভ্রাতিলোভা বলেছেন, “আমার মনে হচ্ছে আবারও কোর্টে নামতে যাচ্ছি এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি।” কিন্তু ৫ মাস পর তিনি রাদওয়ানস্কার কোচ হিসেবে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন।

কোচের ভূমিকায় মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। Image Source: CNN.com
তবে এই টেনিস ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত জীবনটা ছিল প্রথম থেকেই এলোমেলো। মাত্র ১৯ বয়সেই ভাগ্য গড়তে নিজের দেশ ছেড়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে আক্রান্ত হন ক্যানসারে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ায় সুস্থ হয়ে ওঠেন দ্রুতই। সমকামী এই তারকা বিয়ে করেছেন ১৯৯১ সালের মিস ইউনিভার্স এর রানার্সআপ জুলিয়া লেমিগোভাকে। বর্তমানে জুলিয়ার আগের পক্ষের দুই মেয়েকে দত্তক নিয়ে বেশ ভালোই আছেন মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা।

জুলিয়া লেমিগোভার সাথে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। ImageSource: arthosuchak.com
টেনিসের উন্মুক্ত যুগের জীবন্ত কিংবদন্তি বলা হয় মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাকে। কেবল নিজের সময়ের নয়, টেনিস ইতিহাসের সর্বকালের সেরা তারকা এই নারী। আর এ কারণেই বিশ্বের সাবেক নম্বর ওয়ান বিলি জিন কিং নাভ্রাতিলোভাকে ‘কিংবদন্তিদের কিংবদন্তি’ বলে অভিহিত করে থাকেন।