Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেসি এবং বার্সেলোনা: বিচ্ছেদ, পতন ও সম্পর্কের সমাপ্তি

১৪ ডিসেম্বর, ২০০০। বার্সেলোনার টেকনিক্যাল সেক্রেটারি চার্লস রেক্সাস তড়িঘড়ি করে সামান্য এক ন্যাপকিনে লিওনেল মেসি নামক এক আর্জেন্টাইন বালককে ক্লাবে ভেড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিলেন। শুধু প্রতিশ্রুতিই নয়, মেসির গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ছিল। তার চিকিৎসার ব্যয়বহুল খরচ বার্সা টানতে রাজি হয়ে গেল। মেসি তখনও প্রমাণিত কেউ নন। তবুও বার্সেলোনা এমন ঝুঁকি নিল তার অসামান্য প্রতিভার ঝলক দেখে। বার্সেলোনার কাছে এই চুক্তি একরকম বিনিয়োগ হলেও মেসি হয়ে গেলেন ঋণী। 

মেসি সেই ঋণ শোধ করেছেন। একজন প্রতিভাবান কিশোর পরিণত হয়েছে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ে। আর বার্সেলোনার জন্য তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন। বার্সেলোনার সাথে মেসির সম্পর্ক প্রায় ২০ বছরের। আর খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমে মুগ্ধ করছেন প্রায় ১৬ বছর ধরে। সেই মেসি দূর থেকে বার্তা পাঠালেন সম্পর্ক ছিন্ন করতে। ক্লাবকে বিদায় জানানোর তিক্ত এক আবেদন জানাতে। বয়স ৩৩ হলেও মেসির জাদু তো ফুরিয়ে যায়নি। এক আট গোলের হার তার মানসিক শক্তির সর্বোচ্চ নিংড়ে নিতে পারার কথা না। তবে কেন এ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত? সম্পর্ক ভেঙে ফেলার বার্তা? 

 আট গোলের হার তার মানসিক শক্তির সর্বোচ্চ নিংড়ে নিতে পারার কথা না ©Manu Fernandez/Pool via Getty Images

মেসির সমস্ত ক্ষোভ ও রাগ বর্তমান বার্সেলোনার বোর্ডের উপর। তার এই অসম সিদ্ধান্ত তিনি অবশ্যই দীর্ঘসময় ভেবেচিন্তেই নিয়েছেন। মাত্র একটি লজ্জাজনক হারের পর এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়া যুক্তিযুক্তও নয়। সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো বার্সা বর্তমানে পতনের মুখে। আর এই তলানি থেকে আবার উপরে ওঠার মতো যে পরিকল্পনা থাকা উচিত, তা-ও ক্লাবের নেই। যেখানে পরিকল্পনা নেই, লড়াইয়ের ইচ্ছাশক্তি নেই, সেখানের স্মৃতি আকঁড়ে ধরে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। কারণ, ক্যারিয়ারের শেষ দিনগুলোতে তার প্রাপ্তির খাতা খালি থেকে যাচ্ছে, আর অপরদিকে জমা হচ্ছে আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস।

বার্সেলোনার মতো ক্লাবের এমন অধঃপতনের কারণ কী? কারণগুলো ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা পরে হবে। তবে শুরুটা বেশ পরিষ্কারভাবেই বলা যায়। বার্সেলোনার সভাপতির চেয়ারে জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউকে বসানোই ছিল অধঃপতনের সূচনা। বার্তোমেউ একজন আগাগোড়া ব্যবসায়ী। ক্লাবকে উন্নতির প্রত্যাশার মুখোশ পড়ে, ব্যবসার কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়া এ মানুষটা ক্লাবে এসেছিলেন ব্যবসার খাতিরেই। সেটা যদিও সবাই করে, তবে অর্থ উপার্জনের নাম করে ক্লাবকে ধীরে ধীরে ধ্বসিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়তো সকলে তৈরি করে না।

বার্সেলোনার সভাপতির চেয়ারে জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউকে বসানোই ছিল অধঃপতনের সূচনা ©fcbarcelona

বার্তোমেউ ক্লাবের সভাপতি হবার পর বার্সেলোনার কোচ ছিলেন লুইস এনরিকে। বার্সেলোনায় তখন জাভি, ইনিয়েস্তা বা দানি আলভেজ সবাই আছেন। পিকে বা মধ্যমাঠের বুসকেটস ফর্মের তুঙ্গে। এছাড়াও আক্রমণে ‘এমএসএন’ত্রয়ী। বার্সেলোনা ‘১৪-‘১৫ মৌসুমে ট্রেবল জিতে নেয়। দুর্দান্ত একটি দল, তাদের খেলার ধরনও বার্সেলোনার দর্শনসুলভ। ট্রেবল জিতে ক্লাবকে বিদায় জানান জাভি। পরের বছর ফ্রি ট্রান্সফারে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান ফুলব্যাক দানি আলভেজ। এক সময় আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও সিদ্ধান্ত নেন বার্সেলোনা ছাড়ার। ত্রাস ছড়ানোর মত একটি একাদশ চোখের পলকে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। কিন্তু বার্সেলোনার সভাপতি ও ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর এই শূন্যস্থানগুলোকে একদম এড়িয়ে যান। আর খেলোয়াড়দের সাথে প্রথম সমস্যা হয় দানি আলভেজের বিদায়ের সময়।      

খেলোয়াড়দের সাথে বোর্ডের প্রথম সমস্যা হয় দানি আলভেজের বিদায়ের সময় © Twitter

আলভেজ যখন বার্সা ছেড়ে জুভেন্টাসে পাড়ি জমান, তার বয়স হয়েছিল ৩৪ বছর। কিন্তু বয়সের প্রভাব তার খেলার উপর তখনও পড়েনি। তার বার্সা ছাড়ার প্রধান কারণ ছিল ক্লাবের সভাপতি বার্তোমেউয়ের সাথে দ্বন্ধ। শুধু আলভেজ নয়, বার্সেলোনার একাদশের পুরনো খেলোয়াড়দের সাথে সভাপতির সমস্যা হয়েছে বারবারই। নিজেদের প্রশংসা ও দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের নামে কুৎসা রটানোর জন্য এক সংস্থাকে ভাড়া করেছিল বার্তোমেউ বোর্ড। কাতালোনিয়ার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা নানাভাবে এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করেছে। কিছুদিন আগে করোনাভাইরাসের সময় বার্সা বোর্ডের অনেকেই ইঙ্গিত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, খেলোয়াড়েরা বেতন কমাতে চাচ্ছে না, তারা লোভী। অথচ পরবর্তীতে তারাই বেতনের ৭০ ভাগ কম নিয়েছে। আবার কিছু অর্থ দিয়ে ক্লাবের কর্মীদের সহায়তাও করেছে, যাতে তারা বেতন থেকে বঞ্চিত না হয়। মাঠের খেলা ছাপিয়ে বা দলের উন্নতি বাদ দিয়ে সভাপতির সাথে খেলোয়াড়দের এমন বিরূপ সম্পর্ক মেসির ক্লাব ছাড়ার পেছনে অবশ্যই একটি বড় কারণ।

একাদশে প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়ের অভাব। ইনিয়েস্তা, জাভি বা নেইমারের শূন্যস্থানে নতুন কোনো খেলোয়াড়কে আনা সম্ভব হয়নি। বিপুল পরিমাণ অর্থের বদলে দলে এসেছে গ্রিজমান, ভিদাল, কৌতিনহো ও ডি ইয়ং; তাদের প্রত্যেকের বেতন চড়া। অথচ এক ডি ইয়ং ছাড়া বাকিদের ক্লাবে কোনো প্রয়োজন নেই! কিন্তু তারা কেন ক্লাবে?

তবে কৌতিনহো বা গ্রিজমানের মতো তারকা খেলোয়াড়দের ধরে আনাও বার্তোমেউ বোর্ডের ব্যবসায়িক দিকের অন্যতম চাল। কারণ, নেইমারের বিদায়ের পর স্পন্সর থেকে আয়ের পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তাই ব্যবসায়িক খাতিরে হলেও দলে এমন তারকা খেলোয়াড়ের থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দলের অধঃপতনের সময় বার্সেলোনা বোর্ড কখনও তাদের মাঠের পারফরম্যান্সের দিকে নজর রাখেনি। উদ্ভট ‘স্পোর্টিং প্রজেক্ট’ এর নাম করে ঠিকই খেলোয়াড়দের পেছনে ব্যবসা করেছে তারা। রীতিমতো ক্লাবকে তারা তৈরি করেছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।

কৌতিনহো বা গ্রিজমানের ব্যর্থতার দায়ভার কে নেবে?  ©Youtube

২০০৬ সালে বার্সেলোনা প্রথম তাদের জার্সিতে স্পন্সরের নাম বসায়। তবে সেখানেও ছিল তাদের মহত্বের পরিচয়। কারণ, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনিসেফের সাথে তাদের অর্থ বিনিময়ের কোনো চুক্তি করা হয়নি। কিন্তু ইউনিসেফের সাথে বার্সেলোনার ৫ বছরের চুক্তি শেষ হয়ে যাবার পর তৎকালীন সভাপতি স্যান্দ্রো রাসেল ও সহ-সভাপতি বার্তোমেউ জার্সিতে নতুন স্পন্সর হিসেবে চুক্তি করে ‘কাতার ফাউন্ডেশন’-এর সাথে। ঐ বছর থেকেই বার্সেলোনা তাদের অলাভজনক চিন্তাধারা থেকে পিছিয়ে আসে। স্পন্সরের দিক থেকেও বার্তোমেউ বোর্ড বার্সাকে তুলে ধরেন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কাতার ফাউন্ডেশনের সাথে চুক্তি শেষে বার্সেলোনায় নতুন স্পন্সর হিসেবে আসে “রাকুতেন”। কিন্তু বার্সেলোনা তাদের পুরনো চিন্তাধারায় ফেরত যাওয়া তো দূরের কথা, ক্লাবের বাণিজ্যিক দিক ছাড়া গত ৫ বছরের অন্য কোনো দিকে অগ্রগতি হয়নি বার্সেলোনার। সবকিছু ছাপিয়ে বার্সেলোনা স্রেফ একটি ফুটবল ক্লাব।

চলতি বছরের শুরুতে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম মেসির কাছে জানতে চেয়েছিল তার ভবিষ্যত চিন্তাভাবনা নিয়ে। তখন মেসি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ক্লাবে নিয়মিত শিরোপা জিতে যাওয়ার মতো ‘স্পোর্টিং প্রজেক্ট’ না থাকলে তারও থাকার সম্ভাবনা নেই। স্বৈরাচারী সভাপতির অধীনে বার্সেলোনারও ‘স্পোর্টিং প্রজেক্ট’ হয়তো আছে। কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। যদি থাকত, রোমা-অ্যানফিল্ড-লিসবনের মতো লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হতো না। 

সান্তোস থেকে নেইমার বার্সেলোনাতে আসার পর মেসির সাথে তার ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। সেটা মাঠের ফুটবলে ও মাঠের বাইরেও। কিন্তু সেই নেইমার থাকেননি, মেসির ছায়া থেকে বের হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ২০১৭ সালে পাড়ি জমান পিএসজিতে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি টের পান, তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। নেইমার তখন চেয়েছিলেন পুনরায় বার্সেলোনাতে ফিরতে। সে সময় স্বয়ং মেসি বোর্ডকে বলেছিলেন, নেইমারকে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু পিএসজি ২২২ মিলিয়ন ইউরোর কমে নেইমারকে দিতে রাজি হয়নি। আর বার্সেলোনার কোষাগারেও তখন ঐ পরিমাণ অর্থ ছিল না। নামমাত্র দেমবেলে ও কৌতিনহোকে দলে ভিড়িয়ে বার্তোমেউ অর্থ কর্জ করে ততদিনে অর্থ বিনিয়োগও করে ফেলেছেন। তাই নেইমারকে আর ফেরানো হয়নি।

মেসি বোর্ডকে বলেছিলেন নেইমারকে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে © Diario – AS

বার্তোমেউ বোর্ডের দুর্দান্ত স্পোর্টিং প্রজেক্টকে ভেঙে দেখা যাক। রোসেল বার্তোমেউ বোর্ডের অধীনে বার্সেলোনা খেলোয়াড় কিনেছে ৩৩ জন। এর ভেতর প্রায় ৮০ ভাগ খেলোয়াড় ক্লাবের সাথে খায় খাইয়ে নিতে পারেনি। এর ভেতর আবার ডগলাস, অ্যালেক্স সং, তুরান, গোমেজ, পাকো আলকাসের, ম্যালকমের মতো খেলোয়াড় ছিলেন চূড়ান্ত রকমের হতাশাজনক। নেইমার, সুয়ারেজ, রাকিটিচ, টার স্টেগান, লংলে প্রশংসনীয় ট্রান্সফার হলেও অর্থ পানিতে ফেলার মতো কিছু খেলোয়াড় বার্সা কিনেছে শেষ তিন বছর এরিক আবিদালের আমলে।

রেকর্ড পরিমাণ অর্থ খরচ করা পর মাত্র দুই মৌসুমের পারফরম্যান্স দেখে কৌতিনহোকে পাঠানো হলো লোনে, দেমবেলে ও সুয়ারেজ ইনজুরড। এই বছরের শুরুতে দলের আক্রমণ ভাগে অবশিষ্ট মাত্র তিনজন খেলোয়াড় – ১৬ বছর বয়সী আনসু ফাতি, গ্রিজমান এবং মেসি। লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা কার্লোস পেরেজ নামে এক উইঙ্গারকে মূল একাদশে জায়গা করে দিয়েছিলেন তৎকালীন কোচ ভালভার্দে। ১১ ম্যাচ সুযোগ পেয়ে ২ গোল করা পেরেজকে মাত্র ১২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে হুট করে বিক্রি করে দেয়া হয় রোমার কাছে। বিপরীতে, কিছুদিন পর বাধ্য হয়ে ১৮ মিলিয়ন দিয়ে কিনতে হয় স্ট্রাইকার কার্লোস ব্রাথওয়েটকে। কি পাগলাটে চিন্তাভাবনা!

বার্সেলোনার মধ্যমাঠে অনেক খেলোয়াড়ের আনাগোনা। ভিদাল, রাকিটিচ, বুসকেটস থেকে সে সময়ে বেশ ভালো খেলছিলেন লা মাসিয়া থেকে উঠে আসা কার্লোস আলেনা। অথচ তাকে হুট করে রিয়াল বেটিসে লোনে পাঠানো হয়। একই কথা রক্ষণভাগেও। পিকে বর্তমানে আগের মতো ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার অবস্থায় নেই। উমতিতিও ইনজুরির কবলে পরে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছেন। ডিফেন্ডারের ভীষণ অভাব। নতুন ডিফেন্ডার বার্সেলোনাতে তো এলোই না, উল্টে লোনে পাঠানো হলো জ্যাঁ-ক্লেই তোদিবোকে! দলের প্রধান স্ট্রাইকার সুয়ারেজ আগেই বলে রেখেছিলেন, তার বিকল্প খোঁজার সময় চলে এসেছে। কিন্ত সেদিকে বার্সেলোনা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। দুই ফুলব্যাক আলবা ও সেমেদোও প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ। বার্সেলোনার তথাকথিত স্পোর্টিং ডিরেক্টরের কোনো নজর সেদিকে নেই।

ক্লাবের পছন্দে আনা প্রত্যেক কোচ তার ইচ্ছা অনুযায়ী একাদশও নামাতে পারতেন না। কিছুদিন আগে বরখাস্ত হওয়া কোচ কিকে সেতিয়েনের কথাই তা পরিষ্কার করে দেয় যে, ক্লাবের উপর মহল থেকে প্রচ্ছন্ন একটি চাপ সবসময় কোচদের উপর থাকে। তাই ইচ্ছা করলেই ক্লাবের পুরোনো খেলোয়াড়দের স্কোয়াড থেকে ছাঁটাই করা যায় না। রোনাল্ড আরাউহো, রিকি পুইগ বা আনসু ফাতির মতো তরুণদের বদলে বুড়িয়ে যাওয়া পিকে, ভিদাল বা সুয়ারেজ কেন নিয়মিত একাদশে থাকতেন, তার উত্তর কী এখন পরিষ্কার নয়?

তবে এখানে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যেখানে বার্তোমেউ বোর্ডের সাথে খেলোয়াড়দের সম্পর্ক প্রায় সাপে-নেউলে, সেখানে কেন বর্তমান বোর্ড তাদের নিয়মিত খেলানোর জন্য কোচদের চাপের মুখে রাখবে? এর উত্তর আপনি অবশ্যই জানেন। তবে তার জন্য আপনাকে কিছুটা বার্তোমেউয়ের মতো একজন চতুর এবং অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ীর চরিত্র ধার করে কয়েক মিনিট ভাবতে হবে।  

নতুন কোচ হিসেবে সেতিয়েনকে চাননি মেসি  ©fcbarcelona

দলের কী প্রয়োজন, কোচ কী চায়, এদিকে না ভেবে বার্সোলোনা ছুটেছে তারকা খেলোয়াড়ের পেছনে। অথচ একজন সঠিক কোচকে বাছাই করতে তারা করেছে গড়িমসি। এনরিকে বিদায় নেবার পর বার্সেলোনার পাসিং ফুটবলের দেখা আর মেলেনি। কারণ, ভালভার্দে মধ্যমসারির একটি দল থেকে উঠে আসা কোচ। তার কাছে ফলাফলই ছিল মুখ্য। লা লিগা তিনি জিতিয়েছেন টানা দুইবার, কিন্তু ইউরোপের মঞ্চে গিয়ে ব্যর্থ। এখানে কোচের ব্যর্থতা ছাড়াও ২০১৭ থেকে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়া বার্সেলোনার জেতার মানসিকতাও যেন উধাও। সাফল্য তাই আসেনি। অ্যানফিল্ডের ঐ ঘটনার পর অন্য কোনো ক্লাব হলে ভালভার্দেকে তখনই ছাঁটাই করে দিত। কিন্তু বার্সেলোনা তা করল পরের মৌসুমের মাঝপথে গিয়ে। স্বয়ং লিওনেল মেসি ভালভার্দের বিদায়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। নতুন কোচ হিসেবে সেতিয়েনকে নিয়ে আসাও ভালোভাবে দেখেননি তিনি। 

নিজের পছন্দের খেলোয়াড়কে চেয়েও তিনি পাননি। নিজের চোখে দেখেছেন ক্লাবের অবনতি ও ফ্লপ ট্রান্সফারের ইতিহাস। দলের কোচ নিবার্চনের ক্ষেত্রেও তার সিদ্ধান্তকে বিন্দুমাত্র প্রাধান্য দেয়া হয়নি, অথচ নিন্দুকেরা বলে ক্লাব চালান আসলে মেসি! এমন ছোট ছোট অসন্তোষ জমতে শুরু করেছিল মেসির মনে। তাই ২০১৭ সালে চুক্তির সময় জুড়ে দিয়েছিলেন প্রত্যেক মৌসুম শেষে নিজের ইচ্ছায় ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছার কথা। প্রায় ২০ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ার পার করে ফেলা এই আর্জেন্টাইন অনেক আগেই বর্তমান পরিস্থিতিকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। এরপরও তিনি অপেক্ষা করে গেছেন পরিবর্তনের। যদি পরিবর্তন আসে, তবে ভাগ্য ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি, বার্তোমেউ তার ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনার ভেতরেই বসবাস করেছেন। আর বার্সেলোনা নিচে নামতে নামতে একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবং সেই অবনতির ফলাফলই বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ২-৮ গোল। আর এই ম্যাচই দীর্ঘদিনের টুকরো টুকরো অসন্তোষ ও ক্ষোভকে একত্র করে মেসিকে নিয়ে গেছে প্রস্থানের দোড়গোড়ায়।

বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষের হার মেসির সকল প্রত্যাশার ভীত নড়িয়ে দিয়েছে  ©Manu Fernandez/Pool via Getty Images

মেসির ক্ষোভ বার্সেলোনা বোর্ডের উপর। বিশেষ করে সভাপতি জোসেপ বার্তোমেউয়ের সাথে। তবে বার্তোমেউ যদি সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান, মেসিও কী তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন? উত্তর হচ্ছে, না। তার সম্ভাবনা নেই। বার্তোমেউ তার পদ থেকে সরে দাঁড়ালে সেখানে আসবেন বর্তমান সহ-সভাপতি। এক্ষেত্রে, বার্সেলোনার ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন আসে না। আর আমূল পরিবর্তন না আসলে মেসিও থাকবেন না।

এছাড়াও, স্প্যানিশ রেডিও ‘ওন্দা চেরো’র আলফ্রেদো মার্টিনেজের ভাষ্যমতে,

“মেসি নাটক করছে না। তার এমন সিদ্ধান্ত বার্তোমেউকে সরানোর ফন্দি নয়। বার্তোমেউয়ের থাকা বা না থাকার সাথে তার সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব ফেলবে না। বার্তোমেউ যদি সভাপতি পদ থেকে সরেও দাঁড়ান, মেসিকে ফিরে পাবে না বার্সেলোনা। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি।”

মেসি বার্সা ছাড়তে চান ©Twitter

আর সভাপতি বার্তোমেউ যদি আদতেও তার ব্যাবসায়িক চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে দল গোছানোর পরিকল্পনা করেন, তাতেও বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। সারাজীবন তিনি ব্যবসায়িক ট্যাকটিক্স মাথায় রেখে ট্রান্সফার মার্কেটে অর্থই ঢেলে গেছেন, উন্নতি আর করতে পারেননি। হুট করে তার মাথার দলকে উন্নত করার বুদ্ধি চেপে বসবে, আর তিনি দল গোছানো কাজে ব্যস্ত হয়ে পরবেন, তা ভাবাও দিবাস্বপ্ন। আর যদি ভুল করে তা করার কথা ভাবেনও, এই ভঙ্গুর দলকে দাঁড় করাতে লেগে যাবে প্রায় দুই মৌসুমের মতো। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে মেসি কেন আবার পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ক্লাবে থেকে যাবেন, গত কয়েক মৌসুমের অবস্থা দেখে যেখানে তার ভরসা শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে?

মেসি হয়তো চলে যাবেন, অথবা যাবেন না, ক্লাব হয়তো যেতে দেবে না। তার দলবদলে আইনি মারপ্যাঁচও আছে। কিন্তু সম্পর্কটা ভেঙে গেছে, একসময় ‘অবাস্তব’ মনে হওয়া এক ভাবনাই সত্যি হতে চলেছে। তাই বার্সেলোনা ও লিওনেল মেসির পথ আলাদা হয়ে যাওয়াই হয়তো ভবিতব্য। মেসি এখনো শীর্ষ পর্যায়ে আরও কয়েক বছর খেলে যেতে পারবেন। আর বার্সেলোনার ভয়াল সময় মাত্র শুরু। এবার না হয় মেসি তার ভালোবাসার ক্লাবের এই পরিণতি দূর পরবাস থেকেই দেখলেন!

 

Feature Image Source : David Ramos/Getty Images

Related Articles