ছত্রিশ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষ আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন লিওনেল মেসি। সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জিতেছেন গোল্ডেন বল, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে পেয়ে গেছেন ফুটবলীয়-অমরত্বের সনদপত্র। অনেক অপেক্ষার এই বিশ্বকাপ জেতার প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মেসি। আর্জেন্টাইন রেডিও স্টেশন ‘উরবানা প্লেই‘কে দেওয়া এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে হৃদয়ের সকল দরজা খুলে দিয়েছেন মেসি, বলেছেন যা কিছু ছিল বলার। সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশই থাকছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতি…
“ঐ দিন থেকে আমরা নিজেদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচয় দিতে পারি। অসাধারণ একটা দিন ছিল। আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে এমন একটা দিনের স্বপ্ন দেখে এসেছি। অবশেষে সেটা সত্যি হলো।”
রেপ্লিকা ট্রফি নিয়ে উদযাপন…
“আমি প্রথমে জানতাম না। উদযাপনের এক পর্যায়ে আমি জানতে পেরেছিলাম যে এটা রেপ্লিকা, তবে এটা আসলে তেমন বড় কোনো ব্যাপার না। আমরা ততক্ষণে ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরে উদযাপন করে ফেলেছি, আর আমাদের দলের মধ্যে আমিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ট্রফি স্পর্শ করেছি।”
ফাইনালের আগের রাতে…
“প্রতি রাতের মতোই আমি ঘুমানোর আগে আন্তোনেলার (মেসির স্ত্রী আন্তোনেলা রোকুজ্জো) সাথে কথা বলেছিলাম। এটা নতুন কিছু নয়। তবে আমরা ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে কথা বলিনি। আর পুরো বিশ্বকাপজুড়েই সবকিছু খুব শান্ত ছিল, ফাইনালের আগেও। তবে একই সাথে আমরা খুব করে এই ট্রফিটা জয়ের চেষ্টা করছিলাম। ফাইনালের আগের রাতে আমার ঘুম খুব ভালো হয়েছিল। আমি একদমই চাপে ছিলাম না, খুব শান্ত ছিলাম।
আরেকবার পুরো ফাইনাল ম্যাচটা দেখা প্রসঙ্গে…
“না। আমি হাইলাইটস দেখেছি, ছোট ছোট কিছু ক্লিপ দেখেছি, কিন্তু পুরো ফাইনাল ম্যাচটা এখনো দেখিনি।”
বিশ্বকাপ ট্রফিতে প্রথম চুমু…
“আমি যখন মঞ্চে উঠলাম, ঝলমলে স্টেডিয়ামে ট্রফিটা জ্বলজ্বল করছিল, যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলছিলো, ‘এসো, আমাকে জড়িয়ে ধরো’। এরপর আমি আর বেশি কিছু ভাবার চেষ্টা করিনি।”
সার্জিও আগুয়েরোর সাথে লাইভ স্ট্রিম…
“কুন (সার্জিও আগুয়েরো) আমার সাথে স্ট্রিম করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম যে, দর্শকদের জন্য এটা তেমন আনন্দদায়ক হবে না। এরপর আমি (রদ্রিগো) ডি পল, (লিয়ান্দ্রো) পারেদেস আর পাপুকে (আলেহান্দ্রো গোমেজ) ডেকে নিই, এবং কিছুক্ষণ হাসাহাসি করি।”
ইনস্টাগ্রামে সর্বাধিক লাইকপ্রাপ্ত ছবি…
“আমি ভাবিনি যে এই ছবিটা ইনস্টাগ্রামে সবচেয়ে বেশি লাইক পাবে। তবে এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কত বেশি মানুষ আমার হাতে ট্রফিটা দেখতে চেয়েছে।”
বিশ্বকাপ জয়ের পরে প্রাপ্ত শুভেচ্ছাবার্তা…
“এত বেশি শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল যে, আমি আমার ইনস্টাগ্রামে লগইন করতে পারছিলাম না। আমি আমি তখন হোয়াটসঅ্যাপে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছিলাম। সব মিলিয়ে ইনস্টাগ্রামে প্রায় এক মিলিয়ন শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল। এত বেশি বার্তার কারণে আমি রজার ফেদেরারসহ অনেক অ্যাথলেটের শুভেচ্ছার উত্তর দিতে পারিনি। আর তাছাড়া আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি সময় দিই না।”
ইনস্টাগ্রামে মেসির অ্যাকাউন্টের পেছনের মানুষ…
“আমি নিজেই আমার ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করি। এই কাজের জন্য কোন আলাদা কোম্পানি বা ম্যানেজার নেই।”
বিশ্বকাপ জয়ের আগে-পরে সমালোচনা…
“জাতীয় দলের জার্সিতে এত দিন ধরে এত কষ্টের পরে, এতবার ফাইনালে পরাজয়ের হতাশার পরে, এত কাছে গিয়েও ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে না পারার পরে, আমাকে অনেক বেশি সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। আমার পরিবারও এই ব্যাপারগুলো সহ্য করেছে, কখনো কখনো আমার চেয়ে বেশি। প্রথমে কোপা আমেরিকা, এবং এরপর বিশ্বকাপ জয়ের পরে এই সমালোচনাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সব শান্ত।”
ফাইনাল জয়ের পরে দলের শেফকে জড়িয়ে ধরা…
“তার সাথে আমার সম্পর্কটা খুবই ভালো। এই ধরনের টুর্নামেন্টে এমন মানুষদের সাথেই আমাদের সময় কাটে। আর আমি আঠারো বছর বয়স থেকে এমন টুর্নামেন্টে তার (শেফ) সঙ্গ পেয়েছি। আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি একসাথে। মাঠে খেলার সময়ে আমরা যেমন উত্তেজিত থাকি, তিনি এর চেয়ে কোনো অংশে কম উত্তেজিত থাকেন না।”
কোচিং স্টাফদের প্রসঙ্গে…
“পুরো কোচিং প্যানেলটাই অসাধারণ। এই প্যানেলের অনেকেই সাবেক খেলোয়াড়। আমরা প্রতিনিয়ত যে বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে যাই, তাঁরাও সেই বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে গেছেন। তাঁরা জানেন কীভাবে এই ব্যাপারগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। তাঁদের বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে। প্রতিটা মুহূর্তেই তাঁরা জানতেন কী করতে হবে বা কী বলতে হবে।”
দিয়েগো ম্যারাডোনা প্রসঙ্গে…
“দিয়েগো যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার হাতে ট্রফি তুলে দিতেন। ঐ ছবিটা খুব সুন্দর হতো। আমার মনে হয়, দিয়েগো এবং আর যারা আমাকে ভালোবাসতেন, তারা প্রত্যেকেই ওপর থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন, আমাদের সাহস দিয়ে গেছেন।”
কোপা আমেরিকার পর বিশ্বকাপ জয়…
“আমার বিশ্বাস, স্রষ্টা এটা আমার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, এবং এর চেয়ে ভালো আর কোনো কিছু হতে পারে না। আমি প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাইতে পারতাম না।”
টাইব্রেকারে মন্তিয়েলের শট…
“ঐ মুহূর্তে আমার মধ্যে যা চলছিল, সেটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। অনেক কিছু ঘুরছিল মাথায়, মনে হচ্ছিল আনন্দের আতিশয্যে ফেটে পড়ব। আবার একই সাথে অবিশ্বাসও কাজ করছিল, আমরা আসলেই জিতে গিয়েছি! তবে পুরোটা সময়জুড়ে আমি স্রষ্টাকে স্মরণ করছিলাম। খুব করে চাইছিলাম, যেন মন্তিয়েল গোল করতে পারে, আর আমাদের দুঃখগুলো দূর হয়ে যায়।”
বিশ্বকাপের কঠিনতম ম্যাচ…
“আমার মতে, মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচটা আমাদের জন্য কঠিনতম পরীক্ষা ছিল। এছাড়া প্রতিটা ম্যাচেই আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো খেলেছি, কেননা আমরা সবসময়ই আমাদের করণীয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানতাম। আমাদের কোচিং স্টাফরাও আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন।”
নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ…
“ঐ সময়ে আমি অনেক বেশি আবেগতাড়িত ছিলাম। এটা অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত কিছু ছিল না। আমাকে কয়েকজন খেলোয়াড় ম্যাচের আগে জিজ্ঞেস করেছিল যে, লুই ফন হালের বক্তব্য আমি শুনেছি কি না (হাসি)। আর ওয়েগহর্স্টকে বলা কথাটার ব্যাপারে? আমি আসলে নিজের এই রূপটা প্রকাশ্যে আনতে পছন্দ করি না, কিন্তু এটা এভাবেই এসে গেছে। ঐ ম্যাচে অনেক বেশি চাপ ছিল।”
সন্তানদের প্রতিক্রিয়া…
“ওরা আর সব আর্জেন্টাইনদের মতোই, শুরুতে কষ্ট পেয়েছে, পরে আনন্দে ভেসেছে। নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে আমাদের জয়ের পরে থিয়াগো কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সৌদি আরবের বিপক্ষে আমাদের পরাজয়ের পরে মাতেও আমাদের পরের রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা হিসাব করা শুরু করেছিল।”
ষোল বছর বয়সী মেসির প্রতি পরামর্শ...
“ষোল বছর বয়সী মেসিকে এটাই বলবো যে, তার জন্য অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করছে। তার যাত্রাটা অনেক সুন্দর হবে; কিছু প্রতিবন্ধকতা আসবে, কিন্তু সেগুলোকে সে অতিক্রম করতে পারবে। কখনোই হাল ছেড়ে দিও না, স্বপ্ন দেখা থামিয়ো না। কারণ শেষ পর্যন্ত সেই পুরস্কারটাই পাবে, যেটা সে চেয়েছিল সবচেয়ে বেশি।”