প্রতিভা বনাম পরিশ্রম। যুগ যুগ ধরেই বিভিন্ন শাখায় আলোচনাটা বিদ্যমান। ফুটবলেও ‘মেসি বনাম রোনালদো’ টপিকে এই বিষয়টা চলে আসে। ‘মেসি প্রতিভাবান আর রোনালদো পরিশ্রমী’ বাক্যটা বহুল প্রচলিত এবং বহুল চর্চিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাক্যটার সত্যতা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? সত্যি সত্যিই কি মেসি আজ এতদূর এসেছেন কেবলমাত্র প্রতিভার জোরে? কিংবা রোনালদো আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন কেবলমাত্র পরিশ্রম দিয়েই? মেসি কি পরিশ্রম করেন না, কিংবা রোনালদো কি প্রতিভাহীন? যদি বিষয়টা সত্য না হয় তাহলেই বা বেশির ভাগ মানুষ এমনটা ভাবেন কেন? মূল বিষয়টাই বা কেমন?
মুল বিষয়ে যাওয়ার আগে ‘প্রতিভা’ জিনিসটা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
১.
‘প্রতিভা’ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে চিন্তা ও মতের পার্থক্য রয়েছে। প্রতিভা সম্পর্কে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্নভাবে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেছেন এটা জন্মগত, আবার কারো কারো মতে এটা অর্জিত। অনেকের ধারণা, প্রতিভা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়, অধ্যবসায় করলে যেকোনো জিনিসই পায়ের তলায় লুটাতে বাধ্য।
অনেকেই আবার এ কথাটি ভুল মনে করেন। তাদের মতে, প্রতিভা অনেক বড় একটি বিষয়, একে অগ্রাহ্য করা উচিত নয়। তাদের মতে, যদি নিয়ম মেনে চলা আর অধ্যবসায়ের কারণেই সব কিছু হয়ে যেত, তাহলে দেশজুড়ে রবীন্দ্রনাথ বানানোর ট্রেনিং সেন্টার খোলা হতো। অনেকেই চেষ্টা করেছেন জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের মতো করে লিখতে, কিন্তু সবাই কি তার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন? এই পক্ষের মতে, অধ্যবস্যায় করলেই কেউ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের মতো হতে পারবেন না।
মনোবিদ ফ্রয়েডের মতে, প্রতিভা জন্মগত, তবে এর বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশটাও প্রয়োজন। যেমন, বাংলাদেশের কোনো একটা ছেলে হয়তো খুব ভালো বেসবল খেলার প্রতিভা নিয়ে জন্মালো। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু বেসবল খেলার কাঠামো নেই, তাই সেই ছেলের প্রতিভা প্রকাশের সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।
সব পক্ষের কথারই গুরুত্ব আছে। তবে যেকোনো ব্যাপারেই পরিশ্রম অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এটি সতত প্রমাণিত। শুধু প্রতিভা দিয়ে কেউ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, এটাই সত্য। অনেক প্রতিভাবান মানুষ খামখেয়ালি স্বভাবের কারণে ঝরে গিয়েছেন অকালে কিংবা সুযোগ পেয়েও সর্বোচ্চ অর্জনটুকু করতে পারেননি।
আবার প্রত্যেক মানুষই একই সমান প্রতিভা নিয়েও জন্মায় না। ভারতীয় ক্রিকেটার বিনোদ কাম্বলি এর বড় একটি উদাহরণ। এককালে শচীনের সাথে একই কাতারে উচ্চারিত হতো তার নাম, এবং অনেকে তাকে শচীনের চেয়েও বেশি প্রতিভাবান মনে করতো। এমনকি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তার পারফরম্যান্সও শচীনের চেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু প্রতিভার সাথে পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে শচীন নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, আর কাম্বলিকে ইতিহাসে স্মরণ করা হয় হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা হিসেবেই।
তাহলে প্রতিভা থাকা আর না থাকার মাঝে পার্থক্য কোথায়?
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বোঝা যাবে। বাংলাদেশের কোচদের কথা অনুযায়ী, সাকিব আল হাসান ট্রেনিংয়ে যতটা পরিশ্রম করেন, তার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন অন্য খেলোয়াড়েরা। কিন্তু এরপরও তুলনামূলক বিচারে সাকিব বেশি সফল। এর কারণটা কী? কারণ হলো, সাকিব যথেষ্ট স্মার্ট খেলোয়াড়। অন্য খেলোয়াড়দের যে বিষয়টি আয়ত্ত্ব করতে এক সপ্তাহ সময় লাগে, তাতে হয়তো সাকিবের সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। প্রতিভা না থাকলে এমনটি সম্ভব নয়।
তবে সফল হবার জন্য প্রতিটি মানুষকেই তার শক্তির জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। ধরা যাক, ‘ক’ নামের কোনো মানুষ ছবি আঁকার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন। হয়তো ১০০ নাম্বারের মাঝে ছবি আঁকার প্রতিভায় সে পাবে ৬০। আবার সেই একই ব্যক্তি হয়তো ক্রিকেটে ১০০ নাম্বারের মাঝে পাবে ৩০। এখন দুই ক্ষেত্রেই সে পরিশ্রম করে হয়তো নিজেকে ৮০ নম্বর পাবার মতো উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ছবি আঁকায় সফল হবার জন্য তাকে যতটুকু সময় ব্যয় করতে হবে, তার চাইতে বেশি সময় ব্যয় করতে হবে ক্রিকেটে সফল হবার জন্য। আবার ‘খ’ নামের যে মানুষটা ক্রিকেটে ৬০ নম্বরের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবেই ‘ক’ নামের মানুষের চাইতে কিছু বেশি সুবিধা পাবেন। এই দুই ব্যক্তি যদি ক্রিকেটে একই সমান পরিশ্রম করেন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যদি একই থাকে, তাহলে ‘ক’ এর চাইতে ‘খ’ ক্রিকেটে উন্নতি বেশি করবেন।
সত্যিকার অর্থে প্রতিভা মাপার কোনো যন্ত্র এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নি। তবে অনেকজন মানুষের মাঝে কেউ যদি প্রতিভাবান হন, তাহলে অন্যদের চোখে সেটা ধরা পড়ে। এই নির্ণয় করার ক্ষমতাটাই মানুষের একটা বিশেষত্ব, যা তাকে যন্ত্র থেকে আলাদা করে।
প্রতিভা এবং পরিশ্রম নিয়ে কিছুটা ধারণা আশা করি পাওয়া গেল। এখন চলে আসা যাক মেসি-রোনালদো নিয়ে।
২.
কোনো সন্দেহ নেই যে ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দু’জনেই প্রতিভাবান। তবে সত্যিকার অর্থে মেসির প্রতিভাটা একটু ভিন্ন লেভেলের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেসিই কি ফুটবল ইতিহাসের সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যক্তি? পেলে, ম্যারাডোনা, ডি স্টেফানো, ক্রুয়েফ, পুসকাস, জর্জ বেস্ট – এদের কথা বাদ দেওয়া যাক। মেসির প্রায় সমসাময়িক রোনালদিনহোকেই কিন্তু অনেকে মেসির চাইতে প্রতিভাবান মনে করে থাকেন।
এর অর্থ হচ্ছে, কেবল প্রতিভা থাকলেই হয় না, এর কদর করতে হয়। প্রতিভা মেসিকে কী দিয়েছে? ড্রিবলিং করার সহজাত ক্ষমতা, পজিশনিং সেন্স, ভিশন – হয়তো আরো অনেক কিছু। তবে এসব প্রতিভা তো আরো অনেক খেলোয়াড়েরই ছিল। পরিশ্রমের মাধ্যমে এই কদরটাই মেসি করতে পেরেছেন কিংবা করে চলেছেন বলেই আজ নিজেকে এই উচ্চতায় নিয়ে আসতে পেরেছেন। পর্যাপ্ত প্রতিভা নিয়েও কিন্তু রোনালদিনহো, রবিনহো কিংবা জর্জ বেস্টের মতো খেলোয়াড়েরা মেসির পর্যায়ে পৌছাতে পারেননি।
মেসির পরিশ্রমের একটা উদাহরণ দেওয়া যায় ফ্রি-কিকে উন্নতির বিষয়টা। একটা সময় ফ্রি-কিকে ক্রিসের তুলনায় মেসি বেশ পিছিয়ে ছিলেন। তবে গত কয়েক বছরে এই জায়গাটায় যথেষ্ট উন্নতি করে মেসি আজ ইতিহাসের সেরা ফ্রি-কিক টেকারদের একজন।
মেসি পরিশ্রম করেন না – এই কথাটা যে ভুল সেটা হয়তো প্রমাণ করতে পারা গেল।
একই সাথে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও কিন্তু যথেষ্ট প্রতিভাবানই ছিলেন। তবে তার শক্তির জায়গাটা একটু ভিন্ন ধরনের। সরাসরি খেলোয়াড়ি বিষয়গুলোর চাইতে সহায়ক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তিনি একটু এগিয়ে। যেমন লিডারশিপ, পিছিয়ে পড়লেও হাল ছেড়ে না দিয়ে সামনে এগোনোর মনোবল কিংবা নিজের শক্তির জায়গাটা বুঝতে পেরে সেটার পরিপূর্ণ ব্যবহার করা। গতিশীলতা, উচ্চতার সদ্ব্যবহার কিংবা অফুরন্ত দম – রোনালদোর খেলোয়াড়ি প্রতিভার জায়গাগুলোর মাঝে এগুলো অন্যতম।
একই সাথে দুই পায়ে প্রায় সমান জোরে শুট করার দক্ষতাও তাকে নিয়ে গিয়েছে অন্য পর্যায়ে। তবে এই দক্ষতাটা তার জন্মগত প্রতিভা নয়, প্র্যাকটিসের মাধ্যমে তিনি এই দক্ষতা অর্জন করেছেন।
তবে সাধারণ মানুষ কিংবা বিশেষজ্ঞরা যে বিষয়গুলোকে প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করে, সেই বিষয়গুলোতে মেসির চাইতে ক্রিস খানিকটা পিছিয়েই আছেন। এমনকি তর্কসাপেক্ষে প্রতিভার বিবেচনায় হয়তো ক্রিস পিছিয়ে আছেন নেইমার, রোনালদিনহো কিংবা রবিনহোর চাইতেও। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে ক্রিস অবশ্যই পুরো ক্যারিয়ার বিবেচনায় উল্লেখিত খেলোয়াড়দের চেয়ে এগিয়েই থাকবেন।
৩.
প্রতিভাবান আর পরিশ্রমী ব্যক্তিদের মাঝে প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা একটা দিক থেকে কিছুটা সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রতিটি মানুষেরই সাধারণত পরিশ্রমী মানুষের চাইতে প্রতিভাবান মানুষের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা থাকে। প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরা পর্যাপ্ত সফলতা না পেলেও যুগে যুগে মানুষের মনে বিচরণ করেন। একজন সফল পরিশ্রমী মানুষের চাইতে একজন সফল প্রতিভাবান মানুষকেই মানুষ বেশি কদর করে থাকে সচরাচর।
সফলতার কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক। অনেক ব্যর্থ প্রতিভাবান মানুষকে নিয়েও মানুষ আক্ষেপ করে। কিন্তু সেই তুলনায় পরিশ্রম করে ব্যর্থ মানুষদের নাম ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না বললেই চলে। ক্রিকেটার বিনোদ কাম্বলি কিংবা ফুটবলার রোনালদিনহোকে নিয়ে যুগে যুগেই মানুষের মনে আক্ষেপ থাকবে। প্রতিভা নিয়েও পর্যাপ্ত সফলতা না পাওয়ায় সমর্থকদের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মনেও এদের নিয়ে আক্ষেপ অনেক। অন্যদিকে কোনো পরিশ্রমী ব্যক্তি যদি পর্যাপ্ত সফলতা না পায়, তাহলে তাকে সাধারণ মানুষ মনে রাখে না।
মেসির মতো খেলোয়াড় যথেষ্ট সফল না হলেও মানুষ তাকে যতটা মনে রাখত, ততটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে রাখত না। এটাই বাস্তবতা।
ঠিক এই কারণেই মানুষ ভাবে যে মেসির সফলতার মূল কারণটা জন্মগত প্রতিভা, আর ক্রিসের সফলতার মূল জায়গাটা পরিশ্রম। এর মানে এটা নয় যে, ক্রিস প্রতিভাহীন কিংবা মেসি অলস।
সত্যিকার অর্থে প্রতিভাকে অনেকটা কালিযুক্ত কলমের সাথে তুলনা করা যায়। কালিবিহীন কলম দিয়ে সারাদিন লিখলেও খাতায় কোনো কিছু ফুটিয়ে তোলা যাবে না। সেই ক্ষেত্রে পরিশ্রমটা হয়ে উঠবে পণ্ডশ্রম। আবার কালিযুক্ত কলম নিয়ে বসে থাকলেও খাতায় কিছু ফুটবে না। কেবলমাত্র কালিযুক্ত কলম দিয়ে একনিষ্ঠভাবে খাতায় লিখলেই কোনো কিছু সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে।
সব মিলিয়ে কোনো অসম্ভব প্রতিভাবান ব্যক্তি যদি অসম্ভব পরিশ্রমী হন, তাহলেই মানুষ অভাবনীয় কিছু দেখার সুযোগ পাবে। সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর জন্য প্রতিভার পাশাপাশি পরিশ্রম কিংবা কাজটার প্রতি আত্মনিবেদনের বিকল্প নেই, এই কথাটার সার্থক প্রমাণই বর্তমান যুগের মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।