মায়ান্তি ল্যাঙ্গার, নামটি ক্রিকেট ভক্তদের কাছে মোটামুটি পরিচিত। অবশ্য মোটামুটি বললে ভুলই বলা হবে, এককথায় সুপরিচিত। স্টার স্পোর্টসের নিয়মিত মুখ। পেশায় উপস্থাপিকা এবং ক্রীড়া সাংবাদিক। বর্তমানে উপস্থাপনা করছেন আইপিএল এর বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান কেন্ট ক্রিকেট লাইভে। আইপিএল-এ এর আগে অর্চনা বিজয়া, রোশেল রাও, শিবানি দান্ডেকারের মতো উপস্থাপিকারা কাজ করেছেন।
তবে আপনি যদি তাদের সাথে মায়ান্তিকে এক করে ফেলেন সেক্ষেত্রে ভুলটা আপনারই। সাবেক ক্রিকেটার না হওয়া সত্ত্বেও মায়ান্তির ভেতরে রয়েছে ক্রিকেট বিশ্লেষণ করার দারুণ ক্ষমতা। এককথায় বলা চলে ক্রিকেটের বিউটি উইথ ব্রেইন। তার মস্তিষ্ক যেন ক্রিকেট প্রতিভার ভাণ্ডার। মায়ান্তির মধ্যে রয়েছে অসাধারণ উপস্থাপনা, শব্দশৈলী, বাচনভঙ্গি ও বিশ্লেষণের দুর্দান্ত প্রতিভা। তার সামনে বড় বড় ক্রিকেট বোদ্ধারাও যেন হার মেনে যাবে।
কাজ করেছেন সুনীল গাভাস্কার, ড্যানি মরিসন, ওয়াসিম আকরামদের মতো খ্যাতনামা ক্রিকেটারদের সাথে। আইপিএল-এর বিশ্লেষণধর্মী শো ক্রিকেট লাইভে বর্তমানে কাজ করছেন নাসের হুসেইন, ডিন জোন্স এর মতো ক্রিকেট বোদ্ধাদের সাথে। তবে উপস্থাপিকা হওয়ার বাইরেও মায়ান্তির বড় এক পরিচয়, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট বিনির স্ত্রী। তবে ক্রিকেটার স্বামীর পরিচয় থাকা সত্ত্বেও সব ছাপিয়ে নিজের দুর্দান্ত ক্রিকেট প্রতিভায় মায়ান্তি নিজ যোগ্যতায় হয়ে উঠেছেন ক্রিকেট বিশ্বের জনপ্রিয় উপস্থাপিকা।
১৯৮৫ সালে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত খ্রিস্টান পরিবারে মায়ান্তির জন্ম। বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল সঞ্জীব ল্যাঙ্গার জাতিসংঘে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মা প্রেমিন্দা ল্যাঙ্গার একজন স্কুল শিক্ষিকা। মায়ান্তির জন্ম ভারতে হলেও তার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ছোট্ট মায়ান্তিকে বাবা কিনে দিয়েছিলেন ক্রিকেট ব্যাট।
ক্রিকেট ও ফুটবলের প্রতি মেয়ের আগ্রহকে বাবা-মা সাদরে গ্রহণ করেছেন। মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন স্কুলের ফুটবল টিমে। পরে তার পরিবার ভারতে চলে আসলে মায়ান্তি ভর্তি হন দিল্লির হিন্দু কলেজে। স্কুল ফুটবলের অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে কলেজে এসেও। খেলেছেন কলেজ ফুটবল টিমেও। ফুটবল খেলাটা ছিল তার কাছে ভালো লাগার বিষয়। তবে কখনো পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নিতে চাননি তিনি। ইচ্ছে ছিল একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়ার। কিন্তু তার ক্রিকেট প্রতিভা তাকে বানিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টার গার্ল।
উপস্থাপিকা হিসেবে ক্যারিয়ার
ফিফা বিচ ফুটবল দিয়ে তার উপস্থাপনা জীবন শুরু। সফলতার গল্পও লেখা শুরু করেন সেখান থেকেই। নজরে আসেন জি স্পোর্টস-এর। সুযোগ পান জি স্পোর্টসের খেলাধুলা বিষয়ক অনুষ্ঠান ফুটবল ক্যাফেতে।
বেশ কয়েক বছর চুক্তিবদ্ধ ছিলেন জি স্পোর্টসের সাথে। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট উপস্থাপনা করেছেন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) এ। ২০১০ সালে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে ইএসপিএনে ছিলেন উপস্থাপিকা হিসেবে। ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরেও ২০১০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে চারু শর্মার সাথে ছিলেন সহ উপস্থাপকের ভূমিকায়। ২০১০ থেকে কাজ করছেন স্টার স্পোর্টসে। মাঝে কিছুদিন কাজ করেছেন টেন স্পোর্টসেও। উপস্থাপিকা হিসেবে কাজ করেছেন ২০১১ ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এবং ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো আইসিসির বড় কোনো ইভেন্টে। তবে ইদানীং ক্রিকেট নিয়ে বেশি কাজ করলেও ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে স্টার স্পোর্টসের বুম হাতে তাকে দেখা গিয়েছিল মাঠে।
প্রেম প্রণয় ও সংসার
ক্রীড়া উপস্থাপিকা হিসেবে ভারতীয় ক্রিকেটে মায়ান্তির তখন জয়জয়কার। স্টার স্পোর্টসের মতো বড় এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করার সুবাদে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, বিরাট, স্মিথ, ওয়ার্নার, হাশিম আমলা, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ক্রিস গেইল, সাকিব আল হাসান, শেন ওয়াটসন, ডোয়াইন ব্রাভোর মতো নামকরা সব খেলোয়াড়দের।
২০১২ সালের প্রথমদিকের ঘটনা। সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট বিনির। স্টুয়ার্ট বিনি ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য সাবেক ক্রিকেটার রজার বিনির ছেলে। টিভি পর্দায় মায়ান্তিকে দেখলেও বাস্তবে সেটি ছিল মায়ান্তিকে প্রথম দেখা। ব্যাপারটি স্টুয়ার্টের কাছে ‘লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট’ এর মতো। দ্বিধাবোধ না করে মায়ান্তিকে দিয়ে বসলেন প্রেমের প্রস্তাব। মায়ান্তিও গ্রহণ করলেন সে প্রস্তাব। তবে বয়সে মায়ান্তির চেয়ে ৪ মাসের ছোট স্টুয়ার্ট। পরিচয় হওয়ার ৬ মাস পরেই ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন মায়ান্তি ল্যাঙ্গার ও স্টুয়ার্ট বিনি।
আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে আসে মায়ান্তির জীবনের অজানা সব দিক। ক্রিকেট এবং ফুটবলের মধ্যে কোনটি তার প্রিয়? মায়ান্তির সোজাসাপ্টা জবাব, সাবেক ফুটবলার হিসেবে অবশ্যই ফুটবল। স্টুয়ার্ট ছাড়া ভারতীয় কোন ক্রিকেটার তার পছন্দের, এমন প্রশ্নে মায়ান্তি একটু হেসেই উত্তর দেন- “সে এমনিতেও আমার প্রিয় খেলোয়াড় নয়। আসলে একজন পেশাদার উপস্থাপকের কোনো পছন্দের খেলোয়াড় থাকতে নেই।” নিজের বিবাহিত জীবন নিয়ে জানতে চাইলে মায়ান্তি জানান, একজন ক্রিকেটারের সাথে বিয়ে হওয়ার পর আমি বুঝেছি ক্রিকেটাররা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। একটা খারাপ ইনিংস কিংবা হার তাদের অনেক বেশি কষ্ট দেয়।
গতবছর কর্ণাটক প্রিমিয়ার লিগে স্টুয়ার্ট খেলেছেন বেনাগাভি প্যান্থার্সের হয়ে। দিনটি ছিল তাদের ৫ম বিবাহ বার্ষিকী। ব্যাঙ্গালুরু ব্লাস্টার্সের বিপক্ষে ৪৬ বলে খেলেছিলেন ৮৭ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস। বল হাতে নিয়েছেন ২ উইকেট। স্টার স্পোর্টসের বুম হাতে মায়ান্তি গিয়েছিল তার সাক্ষাৎকার নিতে। শুরুর দিকে বেশ লজ্জাতে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্টুয়ার্ট। তবে খানিকক্ষণ পর দুজনই পেশাদারিত্বের সাথে বিষয়টি মোকাবেলা করেন। স্টুয়ার্ট বলেই দিলেন দিনটা আমার জন্য বিশেষ। এর আগে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টুয়ার্টের, তবে বিয়ের পর এটিই ছিল মায়ান্তিকে দেওয়া স্টুয়ার্টের প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার।
চলমান আইপিএলে ফাহাদ খান নামে মায়ান্তির এক ভক্ত টুইটারে জানায় “আপনাকে দেখলে আমার আইপিএল দেখতে ইচ্ছে করে না। আপনার মতো ব্যক্তি খুব কমই আছে। আপনাকে ডিনারে নিয়ে যেতে পারলে আমি খুবই খুশি হতাম। আপনি কত সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবে না।” ভক্তের দাওয়াতকে সানন্দেই গ্রহণ করেছেন মায়ান্তি, ফিরতি এক টুইট বার্তায় মায়ান্তি জানান,“আমি এবং আমার স্বামী আপনার সাথে ডিনারে যেতে রাজি।”
উপস্থাপনা বর্তমানে অনেক জনপ্রিয় পেশা। তবে সেটি যদি হয় ক্রিকেট কিংবা ফুটবল সম্বন্ধীয় কোনো উপস্থাপনা তাহলে শুধু নিজের গ্ল্যামারকে নিয়ে এ পেশায় না আসাই ভালো। একজন উপস্থাপকের ক্রিকেটীয় জ্ঞানটাই যেন হয় মুল পুঁজি। আপনার উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে দর্শক যেমন আপনাকে বাহবা দেবে ঠিক তেমনই আপনার হাস্যকর উপস্থাপনার কারণে আপনি হয়ে উঠতে পারেন জাতীয় ভাঁড়। তাই যারা ক্রীড়া উপস্থাপনাকে পেশা হিসেবে নিতে চান তারা ক্রিকেট বা ফুটবল বা অন্যান্য খেলার নিয়মকানুন ও কৌশল রপ্ত করে তবেই এ পেশায় আসুন। হয়তবা আপনিই হয়ে উঠবেন ক্রিকেট বিশ্বের ২য় মায়ান্তি ।
ফিচার ইমেজ : Sportzwiki