কলম্বোর রাজপথ থেকে শুরু করে দেয়াল, সব কিছু মালিঙ্গার ছবিতে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট মোটরসাইকেলের গ্রুপ, কপালে মালিঙ্গার ছবি সম্বলিত পট্টি লাগিয়ে উদযাপন করছে। বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, সবখানে চায়ের কাপে ঝড়ের বিষয় একটাই, মালিঙ্গা।
কারণ শ্রীলঙ্কার ফাস্ট বোলার লাসিথ মালিঙ্গা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাই এত আয়োজন, এত উৎসব। প্রিয় ক্রিকেটারকে বিদায়টা ঘটা করেই দিতে চায় শ্রীলঙ্কান সমর্থকরা। নিজের শেষ ম্যাচটা মালিঙ্গা খেলেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে মালিঙ্গাকে সমর্থন দিতে এসে টইটম্বুর হয়েছিল পুরো গ্যালারি। সেখানে মুহুর্মুহু উল্লাস,
‘মালি, ইউ আর মাই স্লিঙ্গা’।
যেন সমর্থনে গলা চিরে আসছিল একেকটা তোপধ্বনি। তাতেই ভড়কে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। হারটা অবশ্য ‘নিশ্চিত’ই ছিল, তারপরও প্রতিপক্ষের গ্যালারি থেকে মালিঙ্গার জন্য উচ্ছ্বসিত সমর্থন বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠেছিল দুয়োধ্বনির মতো। তাতে করে একটু আগেভাগেই যেন হেরে বসে তামিম ইকবালের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল।
ম্যাচশেষে মালিঙ্গার বিদায়ী ভাষণে আবেগাপ্লুত হয়েছিল শ্রীলঙ্কা দল, গ্যালারির সমর্থক, আমন্ত্রিত অতিথি থেকে শুরু করে বাংলাদেশ দলের সদস্যরা পর্যন্ত। টেস্টে ৩০ ম্যাচে ১০১ উইকেট, ২২৬ ওয়ানডেতে ৩৩৮ উইকেট, আর ৭৩ টি-টোয়েন্টিতে ৯৭ উইকেট নেওয়া মালিঙ্গা অবশ্যই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরাদের একজন হতে পারেন, কিন্তু সর্বেসর্বা নন। তার সময়ে, নিজের ক্যারিয়ারে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য পর্যায়ে। তবে তার আগেও একই পথে হেঁটেছেন আরও অনেকে। মোদ্দা কথা, শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে ফাস্ট বোলার লাসিথ মালিঙ্গা মহানায়ক নন, তবে নায়কদের একজন।
তারপরও মালিঙ্গাকে নিয়ে এত আয়োজন। কারণ, তিনি ইতিহাসে যেমন অন্যতম, তেমনই নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে বারবার জয় করেছেন সমর্থকদের মন। মালিঙ্গা কিন্তু ক্রিকেটটা এখনই ছাড়ছেন না। তবে শ্রীলঙ্কার জার্সিতে তাকে আর দেখতে না পাওয়ার বেদনা কাঁদাবে কোটি সমর্থককে। নিজের বিদায়ী ম্যাচেও যে বোলিং করেছেন মালিঙ্গা, তাতে সময় বলে দেয়, আরও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি মালিঙ্গার।
সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সামনে এই মুহূর্তে আলোচনা মাশরাফি বিন মর্তুজা নিয়ে। ২০০০ সাল থেকে বহু চড়াই উৎরাই পার করে এগিয়ে চলা মাশরাফির ক্যারিয়ারটা যেন এক মোচড়ে থেমে গেল বিশ্বকাপ ২০১৯ এর পারফরম্যান্স দিয়ে। যেন মাথায় তুলে রাখা কোটি সমর্থক কেবল একটি টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সকে পুঁজি করেই ‘অবসর, অবসর’ বলে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল দেশের সেরা অধিনায়ক, দেশের সর্বকালের সেরা এক ফাস্ট বোলার, এক ক্রিকেট যোদ্ধাকে।
মাশরাফির ইনজুরি নিয়ে কথা বলে পক্ষপাতিত্ব করা কিংবা আবেগী হওয়ার সময় আর নেই, তা মানতেই হবে। কিন্তু বিশ্বকাপের অর্জন দিয়ে সব বিচারেরও যে সুযোগ নেই, সেটাও মনে রাখা প্রয়োজন। পরিসংখ্যান বলছে, ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপে নিজেদের ৮ ম্যাচে মাত্র এক উইকেট পাওয়া মাশরাফি মূলত এই আসরে ভুগছিলেন ফর্মহীনতায়। তার আগের ১০ ম্যাচে একই বোলার উইকেট তুলে নিয়েছেন ১৩টি।
মাশরাফি অবশ্য আগেই বলে রেখেছিলেন, এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। তবে আরও বছরখানেক খেলতে পারেন তিনি। যেহেতু ইনজুরির কারণে টেস্ট খেলেন না, টি-টোয়েন্টি থেকেও অবসর নিয়েছেন আরও আগে। তাই ওয়ানডেতে যতটা পারতেন খেলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। সেটা হবে না হয়তো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সমর্থকদের আড্ডা, এমনকি ক্রিকেট বোর্ডও যেন বলে বসছে, ‘হয়েছে বাপু, তোমাকে কেউ চায় না। তুমি এবার ক্ষান্ত দাও!’
কিছু কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মাশরাফির বিদায়টাও যেন তেমনই। বিশ্বকাপশেষে শ্রীলঙ্কা সফরেও তারই নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনও করলেন। সেখানেও উঠেছিল অবসরের প্রশ্ন। বলে দিয়েছিলেন, এটাই তার শেষবারের মতো শ্রীলঙ্কা সফর।
কিন্তু একই দিনে ফ্লাডলাইটের আলোয় অনুশীলন করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে থেমে গেল তার সফর। বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী জানান, মাশরাফির হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরির চোটে পড়েছেন। পুরোপুরি সুস্থ হতে ৩-৪ সপ্তাহ সময় লাগবে।
পরের ঘটনাটুকু সবার জানা। মাশরাফি-সাকিব-লিটনবিহীন বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সবগুলো ম্যাচে হেরেছে বাজেভাবে। এর মধ্যেও মাশরাফির অবসরের আলোচনা থেমে নেই। প্রশ্ন উঠেছে, মাশরাফিকে অন্তত মালিঙ্গার মতো করে হলেও তো অবসরের দিনটা মনে রাখার মতো করবে?
যদিও এখন পর্যন্ত এ দেশের ক্রিকেটে কোনো নায়কের বিদায় ‘মনে রাখার মতো’ হয়নি। মাশরাফিকে নিয়ে প্রবাদ আছে, তিনি যেদিন ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন, সেদিন ঢাকার রিকশাওয়ালা রিকশা চালানো বন্ধ রাখবেন, রিকশায় বসে কাঁদবেন। এইটুকু কথাতেই টের পাওয়া যায় মাশরাফির জনপ্রিয়তা। তবে সেই জনপ্রিয়তা কোনো এক অজানা কারণে তলানিতে ঠেকেছে।
মাশরাফির বিদায় নিয়ে আলোচনা উঠেছিল বিসিবিতেও। দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই সংস্থা দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটারের বিদায়টা কীভাবে দেবে, তা নিয়ে সমর্থকদের ভাবনাও কম নয়। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, সে পরিকল্পনা নড়বড়ে অবস্থানে।
শ্রীলঙ্কা সফরের সময়ে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি সিরিজের আয়োজন করবে বিসিবি। সেখানে অংশ নেবেন বিশ্বের তারকা সব ক্রিকেটাররা। এই আয়োজনেই বিদায় জানানো হতে পারে মাশরাফিকে।
সেই আলোচনাও পিছিয়ে যায় নতুন করে। যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো ওয়ানডে সিরিজ নেই, আর মাশরাফিকেও ঘরের মাটিতেই বিদায় দেওয়া হবে, তাই সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু তা-ই নয়, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের তেমন কোনো উৎসাহ এখনও বিসিবির মধ্যে দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজ দিয়ে অবসর নিতে পারেন মাশরাফি।
এর আগে বিসিবি সভাপতি ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের সাথে এক আলাপে বলেছিলেন,
‘মাশরাফিকে দেশের মাটিতে স্মরণীয় বিদায় দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। আমরা (সিরিজ) এমনভাবে আয়োজন করব, যাতে সে দেশের মাটিতেই বীরের মতো বিদায় নিতে পারে।’
তিনি আরও বলেন,
‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে দু’টি বড় চরিত্র। এক, মাশরাফি, সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়ক। দ্বিতীয়, সাকিব আল হাসান, সর্বকালের সেরা পারফরমার। সেই সেরা অধিনায়ককেই আমরা চেষ্টা করব দেশের মাটিতে সম্ভাব্য সেরা বিদায়ের ব্যবস্থা করতে, এবং সেটা যেন স্মরণীয় হয়।’
কিন্তু সেই ‘স্মরণীয়’ ব্যাপারটা নিয়ে এখনও বিসিবির তেমন কোনো আয়োজন দেখা যায়নি। অন্যদিকে, বিশ্রামের মধ্যেই সাংসদ হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মাশরাফি। বিশ্বকাপে তার ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, সেটা নিয়ে তিনি কতটা করছেন, তা অজানা।
২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে অভিষেক করা ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ এখনও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পেস বোলার। ক্যারিয়ারে তার হাত ধরেই প্রথম ‘পারফেক্ট’ ফাস্ট বোলার পেয়েছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। তাকে অনুসরণ করে এখনও হাজারো ছেলে এ দেশে ফাস্ট বোলার হতে চায়, তার মতো হতে চায়। দেশের ক্রিকেটে তার অবদান অনস্বীকার্য। দুই পায়ের হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার হওয়ার কারণে সাদা বলের টেস্ট খেলা হয় না তার। টি-টোয়ন্টি থেকে ২০১৭ সালে অবসর নেওয়ার পর এখনও ওয়ানডেতেই খেলে যাচ্ছেন। দেশের সফলতম অধিনায়ক তিনি। তার নেতৃত্বে সবচেয়ে সফল হয়েছে বাংলাদেশ।
এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৩৬ টেস্ট ম্যাচ, নিয়েছেন ৭৮ উইকেট। সর্বশেষ ২০০৯ সালে টেস্ট ম্যাচ খেললেও এখনও পেস বোলার হিসেবে তিনিই দেশের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। ওয়ানডে খেলেছেন ২১৭টি, নিয়েছেন ২৬৬ উইকেট। ৫৪ টি-টোয়েন্টিতে তুলে নিয়েছেন ৪২ উইকেট।
ক্রিকেটে ফর্মহীনতা খুব সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সেই ফর্মহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে যে সময় দরকার, সেটা দেওয়াটাও জরুরী। এই মাশরাফিই বারবার তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য বলে এসেছেন, খারাপ খেললেই দল থেকে বের করা নয়, সময় দেওয়া জরুরী।
মাশরাফি বাংলাদেশে একজনই। আরও একজন আসতে কত আলোকবর্ষ সময় লাগবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই মাশরাফির বিদায়টাও হোক মনে রাখার মতোই, যেমনটা তিনি ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় সমর্থকদের মনজুড়েই ছিলেন।