ওয়ানডেতে শচীন টেন্ডুলকার দ্বিশতক হাঁকানোর আগে ওয়ানডে ক্রিকেটের চার দশকের ইতিহাসে একটিও দ্বিশত রানের ইনিংস ছিলো না। শচীন দ্বিশতক হাঁকানোর পর শুধুমাত্র রোহিত শর্মাই তিনটি দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৪ রানের ইনিংসও রয়েছে। এছাড়া বীরেন্দর শেহওয়াগ, ক্রিস গেইল, মার্টিন গাপটিল এবং ফাখার জামানও ওয়ানডেতে দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। যেখানে একসময় ওয়ানডে দ্বিশতক হাঁকানো ছিলো অসাধ্য সাধন, সেখানে এখন প্রায়শ নতুন নতুন ব্যাটসম্যানরা এই কীর্তি গড়ে দেখাচ্ছেন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন ছিলো শতক হাঁকানো। ক্রমশ সেটিও নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে পড়েছে। ক্রিস গেইল তো টি-টোয়েন্টিতে শতক হাঁকানো অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। গেইল এবং ফিঞ্চরা ১২০ বলের ম্যাচেও দ্বিশতকের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। দেখা যাবে একদিন টি-টোয়েন্টিতেও দ্বিশতক হাঁকাবে ব্যাটসম্যানরা। ক্রিস গেইল ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শতক হাঁকানোর পর ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে কোনো ব্যাটসম্যান আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে শতক হাঁকাতে পারেননি। বর্তমানে তো রোহিত শর্মার নামের পাশে রয়েছে চারটি টি-টোয়েন্টি শতক। অ্যারন ফিঞ্চের রয়েছে দুটি দেড় শতাধিক রানের ইনিংস। এর মধ্যে একটি ১৭২ রানের।
এক দশক আগেও টি-টোয়েন্টিতে এক ইনিংসে একজন ব্যাটসম্যানের শতক হাঁকানো বেশ বড় অর্জন ছিলো। বর্তমানে তো স্পেন, কুয়েতের মতো দলের ব্যাটসম্যানদেরও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে শতক রয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে এক ইনিংসে একজন ব্যাটসম্যানের শতক হাঁকানোর ফলে এখন খুব কম লোকেই বিস্ময় প্রকাশ করে। এখন তো টি-টোয়েন্টিতে ১২০ বলের ইনিংসে দুই ব্যাটসম্যানের শতক হাঁকানোর ঘটনাও ঘটছে। চলতি বছরেই এমন ঘটনা দুবার ঘটলো। সর্বপ্রথম ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগে মিডলসেক্সের বিপক্ষে গ্লস্টারশায়ারের দুই ব্যাটসম্যান শতক হাঁকিয়েছিলেন। এরপর ২০১৬ সালের আইপিএলে গুজরাট লায়ন্সের বিপক্ষে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের দুই ব্যাটসম্যান শতক হাঁকান। ২০১৯ সালে রংপুর রাইডার্স এবং সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের ব্যাটসম্যানরাও এই কীর্তি গড়েন।
এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচে একের অধিক শতক হাঁকানোর ঘটনা ঘটেছে মোট ২০ বার। এর মধ্যে এক ইনিংসে দুজন ব্যাটসম্যান শতক হাঁকানোর ঘটেছে চারবার। দুই ব্যাটসম্যানের শতক হাঁকানোর ঘটনাগুলো সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
কেভিন ও’ব্রায়েন এবং হামিশ মার্শাল
২০১১ সালের ২৬ জুন, ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি কাপে মিডলসেক্সের মুখোমুখি হয় গ্লস্টারশায়ার। মিডলসেক্সের অধিনায়ক ডেভিড মালান টসে জিতে গ্লস্টারশায়ারকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। তার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত করতে সময় নেননি গ্লস্টারশায়ারের দুই ওপেনার কেভিন ও’ব্রায়েন এবং হামিশ মার্শাল। দুজন আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন। কেভিন ও’ব্রায়েন ২৩ বলে এবং হামিশ মার্শাল ৩৩ বলে অর্ধশতক হাঁকান। অর্ধশতক হাঁকানোর পর দুজনই আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।
কেভিন ও’ব্রায়েন মাত্র ৪৪ বলে সাতটি চার এবং নয়টি ছয়ের মারে শতক পূর্ণ করেন। হামিশ মার্শালও দ্রুতগতিতে রান তুলে মাত্র ৫৩ বলে ১১টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে শতক হাঁকান। শেষপর্যন্ত ও’ব্রায়েন ৫২ বলে সাতটি চার এবং ১১টি ছয়ের মারে ১১৯ রান করে সাজঘরে ফেরেন। মার্শাল শতক হাঁকানোর পরের বলেই ১০২ রান করে ফেরেন। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে এই দুজন মাত্র ১৫.৩ ওভারে ১৯২ রান যোগ করেছিলেন। শেষদিকে কেন উইলিয়ামসনের সাত বলে ১৮ রানের ইনিংসে নির্ধারিত ২০ ওভারে তিন উইকেটে ২৫৪ রান সংগ্রহ করে গ্লস্টারশায়ার।
টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো কোনো দলের দুই ব্যাটসম্যানের শতক হাঁকানোর দিনে ডেভিড মালানের মিডলসেক্স কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি। জন লুইস ৩১ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট শিকার করলে তারা আট উইকেটে ১৪৯ রানে থেমে যায়। ফলে গ্লস্টারশায়ার ১০৫ রানের বড় ব্যবধানে জয় পায়।
বিরাট কোহলি এবং এবি ডি ভিলিয়ার্স
২০১৬ সালের ১৪ই মে, আইপিএলে গ্রুপ পর্বের ৪৪তম ম্যাচে গুজরাট লায়ন্সের মুখোমুখি হয় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। ডেভিড মালানের মতো ব্রেন্ডন ম্যাককালামও টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার ভুল সিদ্ধান্ত নেন। ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়ে শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি ক্রিস গেইল, বিরাট কোহলি, ডি ভিলিয়ার্স এবং শেন ওয়াটসনদের নিয়ে সাজানো ব্যাঙ্গালোরের। ইনিংসের ৩.৫ ওভারে ক্রিস গেইল যখন সাজঘরে ফেরেন তখন তাদের সংগ্রহ মাত্র ১৯ রান। গেইল ১৩ বল মোকাবেলা করে মাত্র ছয় রান করেন।
গেইলের বিদায়ের ক্রিজে আসেন ডি ভিলিয়ার্স। তিনি শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে থাকেন। মাত্র ২৫ বলে ছয়টি চার এবং তিনটি ছয়ের মারে অর্ধশতক হাঁকানোর পর ৪৩ বলে শতক হাঁকান। শেষপর্যন্ত মাত্র ৫২ বলে দশটি চার এবং এক ডজন ছয়ের মারে অপরাজিত ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। তিনি প্রথমে ধীরগতিতে ব্যাটিং করলেও ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠেন। ৩৯ বলে অর্ধশতক হাঁকানোর পর পরবর্তী ৫০ রান তুলতে বল খেলেন মাত্র ১৪টি। ইনিংসের এক বল বাকি থাকতে আউট হওয়ার আগে খেলেন ৫৫ বলে ১০৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। তার ইনিংসটিতে পাঁচটি চার এবং আটটি ছয়ের মার ছিলো।
বিরাট কোহলি এবং ডি ভিলিয়ার্স জোড়া শতক হাঁকানোর পথে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে মাত্র ৯৭ বলে ২২৯ রান যোগ করেছিলেন। ফলে ব্যাঙ্গালোর তিন উইকেটে ২৪৮ রান সংগ্রহ করে। ব্যাঙ্গালোরের বড় সংগ্রহের পর ব্যাট করতে নেমে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি গুজরাট। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ডোয়াইন স্মিথ, অ্যারন ফিঞ্চ, দীনেশ কার্তিকের মতো ব্যাটসম্যান থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১০৪ রানে গুটিয়ে যায় তারা। ক্রিস জর্ডান মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে চারটি এবং যুযবেন্দ্র চাহাল ১৯ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট শিকার করে ব্যাঙ্গালোরের ১৪৪ রানের বড় জয় নিশ্চিত করেছিলেন।
অ্যালেক্স হেলস এবং রাইলি রুশো
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ৬ষ্ঠ আসরের গ্রুপ পর্বে ৩০তম ম্যাচে মুখোমুখি হয় রংপুর রাইডার্স এবং চট্টগ্রাম ভাইকিংস। ২০১৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। গ্রুপ পর্বের ৩০তম ম্যাচে চট্টগ্রামের বিপক্ষে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ক্রিস গেইলের উইকেট হারায় রংপুর। এরপর দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে অ্যালেক্স হেলস এবং রাইলি রুশো ১৭৪ রান যোগ করে দলকে বড় সংগ্রহের ভিত গড়ে দেন। হেলস মাত্র ৪৮ বলে ১১টি চার এবং পাঁচটি ছয়ের মারে ১০০ রান করে সাজঘরে ফেরেন। এই মাঠে হেলসের সুখকর স্মৃতি রয়েছে। এর আগে নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি শতকও এই মাঠে হাঁকয়েছিলেন।
হেলসের বিদায়ের পর রানের চাকা সচল রাখেন বিপিএলে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রুশো। তিনি শেষপর্যন্ত অপরাজিত থেকে ৫১ বলে আটটি চার এবং ছয়টি ছয়ের মারে ১০০ রান করেন। এই দুজনের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে রংপুর রাইডার্স চার উইকেটে ২৩৯ রান সংগ্রহ করে। চট্টগ্রাম ভাইকিংস ২৪০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে। ইয়াসির আলির ৭৮ রান ছাড়া আর কেউই উল্লেখযোগ্য রান তুলতে পারেননি। চট্টগ্রাম ভাইকিংস শেষপর্যন্ত আট উইকেটে ১৬৭ রান করে থেমে যায়। ফলে রংপুর রাইডার্স ৭২ রানের জয় পায়।
ডেভিড ওয়ার্নার এবং জনি বেয়ারস্টো
কাকতালীয়ভাবে যে চার ইনিংসে দুজন ব্যাটসম্যান শতক হাঁকিয়েছেন, সবগুলো ম্যাচে বিপক্ষ দল টসে জিতে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায়। আইপিএলের চলতি মৌসুমের ১১তম ম্যাচে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের মুখোমুখি হয় সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ। ব্যাঙ্গালোরের অধিনায়ক বিরাট কোহলি টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ব্যাট করার আমন্ত্রণ পেয়ে শুরু থেকেই আগ্রাসী মনোভাবে ব্যাট করছিলেন দুই ওপেনার বেয়ারস্টো এবং ওয়ার্নার। হায়দ্রাবাদের অসহনীয় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের ব্যাটেও। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে রেকর্ড ১৮৫ রান যোগ করেছিলেন।
অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকা জনি বেয়ারস্টো যখন সাজঘরে ফেরেন তখন ১৬.২ ওভারে হায়দ্রাবাদের সংগ্রহ ১৮৫ রান। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৫৬ বলে ১২টি চার এবং সাতটি ছয়ের মারে ১১৪ রান। তার তাণ্ডবলীলা শেষ হওয়ার পর ওয়ার্নার ঝড় শুরু হয়। তিনি এই গরমেও অর্ধেক রান করেছেন দৌড়িয়ে। শেষপর্যন্ত অপরাজিত থাকা ওয়ার্নার ৫৫ বল খেলে সমান পাঁচটি চার এবং ছয় হাঁকিয়ে ১০০ রান করেছিলেন। এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে এক ইনিংসে জোড়া শতক হাঁকানোর শেষ ঘটনা এটি।
জনি বেয়ারস্টো এবং ডেভিড ওয়ার্নারের শতকের উপর ভর করে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ দুই উইকেটে ২৩১ রান সংগ্রহ করেছিলো। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ব্যাঙ্গালোর মোহাম্মদ নবীর বোলিং তোপের মুখে পড়ে ৩৫ রান তুলতেই ছয় উইকেট হারিয়ে বসে। নবী মাত্র ১১ রানের বিনিময়ে চারটি এবং সন্দ্বীপ শর্মা তিন উইকেট শিকার করলে ব্যাঙ্গালোর ১১৩ রানে গুটিয়ে যায়। এতে করে হায়দ্রাবাদ ১১৮ রানের বড় ব্যবধানে জয় পায়।