২০০৬ সালে ফতুল্লা টেস্টে অজিদের বিপক্ষে তিন উইকেটের হার, ২০১২ সালে মিরপুরে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানের হার, ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের সাথে বেঙ্গালুরুতে ১ রানের হার, ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে সেই ভারতই আবার ম্যাচ জিতে নেয় ইনিংসের শেষ বলে। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতেও খুব কাছে গিয়ে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল টিম টাইগার। তবে দেশের ক্রিকেটে প্রথম আক্ষেপ গল্প সেই ঐতিহাসিক মুলতান টেস্ট। আক্ষেপ হাহাকারের মুলতান টেস্ট নিয়েই আজকের আলোচনা।
২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে তীরে এসে তরী ডুবিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ক্ষত আজও দগদগে। সেদিন ম্যাচটা জিততে পারলে হয়তো টেস্টে আমাদের এমন বেহাল দশা হতো না, আমাদের ক্রিকেটও আরো এগিয়ে যেত খুব সম্ভবত। মুলতান টেস্টের মাত্র তিন বছর আগেই টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে নবীন এক দলের জন্য বড় একটা ধাক্কা ছিল সেই মুলতান ট্র্যাজেডি। ম্যাচশেষে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন মাঠ ছেড়েছিলেন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। বিষাদের সেই দৃশ্যটা আজও কি ভুলতে পেরেছে ক্রিকেটপ্রেমীরা?
সন্দেহজনক বেশ কিছু ঘটনাক্রম আর ইনজামাম-উল হকের ক্যারিয়ার বাঁচানো অপরাজিত ১৩৮ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস, সব মিলিয়ে ১ উইকেটে ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে হান্নান সরকার আর জাভেদ ওমর দেখেশুনে খেলতে থাকেন। দলীয় ২৮ রানে হান্নান সরকার আউট হলে জাভেদ ওমরের সাথে ৭০ রানের পার্টনারশিপ গড়েন হাবিবুল বাশার। দলীয় ১০২ রানের সময় ব্যক্তিগত ৩৮ রান করে আউট হন জাভেদ ওমর। মাঝে হাবিবুল বাশারের ৭২ আর লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে রাজিন সালেহ’র গুরুত্বপূর্ণ ৪৯ রানের উপর ভর করে প্রথম ইনিংসে ২৮১ রান তুলেছিল বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ রফিকের স্পিন বিষে নীল পাকিস্তান। মোহাম্মদ রফিক আর খালেদ মাহমুদ সুজনের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে মাত্র ১৭৫ রানে অলআউট হয়ে যায় রশিদ লতিফের দল। ৩৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট তুলে নেন রফিক। সুজনের শিকার ৪ উইকেট।
১০৬ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৭৭ রানে ৫ উইকেট ফেলে দিয়ে ম্যাচে ফিরে পাকিস্তান। তখন শাব্বির আহমেদের এক বিষাক্ত বাউন্স অলক কাপালির হেলমেটের ভেতর দিয়ে কপালে আঘাত করে। রক্তাক্ত অলক তবুও মাঠ ছাড়েননি সেদিন। সবাইকে অবাক করে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যাট চালিয়ে যান অলক কাপালি। কতখানি মানসিকভাবে দৃঢ়চেতা হলে এত বড় ইনজুরি নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়ায় করা যায়? তবে এর কিছুক্ষণ পর বুড়ো আঙুলে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। দলের ৭ উইকেট পরে গেলে আবারও আহত বাঘের মতো মাঠে নামেন অলক।
এরপরই ঘটে মুলতান টেস্টের সবচেয়ে ন্যক্করজনক ঘটনা। ইয়াসির আলীর বল ব্যাটের কানায় ছুঁয়ে যায় উইকেটরক্ষক রশিদ লতিফের কাছে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বলকে তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হন। হাত ফসকে বল মাটিতে পড়ে যায়। মাটি থেকে কুড়িয়ে আউটের আবেদন করলে আম্পায়ার অশোক ডি সিলভা আঙ্গুল তুলে জানিয়েও দেন যে, অলক আউট। ডি সিলভার এই ‘নগ্ন’ আম্পায়ারিং মুলতান টেস্টে ক্রিকেটের স্পিরিটকে সেদিন গলা টিপে হত্যা করেছিল।
শেষ পর্যন্ত ১৫৪ রানে থামে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। জয়ের জন্য পাকিস্তানের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৬১ রান। হাতে সময় আছে দু’দিনের বেশি। ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে পাকিস্তান। ৮১ রান তুলতেই নেই টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান। ১৬৪ রানের সময় সাকলায়েন মুশতাক আউট হলে উইকেটে স্বীকৃতি ব্যাটসম্যান হিসেবে থাকে কেবল ইনজামাম-উল হক। ৭ উইকেটে ১৬৭ রান তুলে তৃতীয় দিন শেষ করে পাকিস্তান। জয়ের জন্য পাকিস্তানের দরকার ৯৮ রান। আর বাংলাদেশের দরকার তিন উইকেট।
পরের দিন প্রথম আলোর হেডলাইন, ‘প্রথম টেস্ট জয়ের হাতছানি, মূল বাধা ইনজামাম’। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স, এরপর চলতি সিরিজে ৫ ইনিংসে মাত্র ৮৮ রান। এই দুঃসময়ে এই ইনিংসই তার ক্যারিয়ার বাঁচাতে পারে, নয়তো দল থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা। চতুর্থ দিন ম্যাচ শুরুর আগে নিয়ম ভঙ্গ করে উইকেটে পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয় মাঠকর্মীরা। ম্যাচ চলাকালীন উইকেটে হাত দেওয়ার নিয়ম নাই। নিজেদের ফায়দা তুলে নিতে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছাকৃতভাবেই এটি করেছিল তারা। সবুজ উইকেটে পানি দেওয়ার দরুন বল আর উপরেই উঠতে চায় না, কীসের কী বাউন্স! যেখানে চতুর্থ দিনে আমাদের বোলারদের উইকেট থেকে সুবিধা পাবার কথা, সেখানে ওদের ব্যাটসম্যানদের জন্য যেন স্বর্গ হয়ে গেল মুলতানের উইকেট! শাব্বির আহমেদকে নিয়ে দেখেশুনে খেলতে থাকেন ইনজামাম-উল হক। দলীয় ২০৮ রানে থামে শাব্বির-ইনজি জুটি। রফিকের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন শাব্বির।
জয়ের জন্য আরো দরকার ৫৬ রান। উইকেটে আসেন উমর গুল। রফিকের বলে উমর গুলের নিশ্চিত লেগ বিফোর উইকেটের আবেদন ফিরিয়ে দেন আম্পায়ার অশোক ডি সিলভা। এরপর ঘটনার জন্য রফিক একটা স্যালুট পাবার যোগ্য। নন-স্ট্রাইকে উমর গুল বোলিং প্রান্তে রফিক। বল যখন রিলিজ করবেন, তখন উমর রান নেওয়ার জন্য বের হয়ে উইকেটের মাঝখানে চলে গেছেন। এখন রফিক যদি উইকেটের বেল ফেলে দেয়, উমর গুল তাহলে আউট, যেটা ক্রিকেটে বৈধ। নিশ্চিত আউট ভেবে উমর গুল আর ফিরে আসার চেষ্টা না ড্রেসিংরুমের দিকে হাটা দিয়েছেন। হাত দিয়ে উমর গুলকে ফিরে আসতে ইশারা করেন রফিক। অথচ চাইলেই রফিক ম্যানকাডিং করতে পারতেন গুলকে রান আউট করে। রফিক পরে বলেছিলেন,
“লাভ কী হতো? আমরা ম্যাচ জিততাম। কিন্তু মানুষ আমাদের ছোটলোক বলতো। আমরা তো ছোটলোক না। কত ম্যাচ জিতবো, ছোটলোকি করে লাভ আছে?”
এখানে মোহাম্মদ রফিক আর রশিদ লতিফদের মধ্যে পার্থক্য।
জায়গায় দাঁড়িয়ে যান উমর গুল। ভেজা উইকেটে ব্যাটিং করাটাও তখন সহজ হয়ে গেছে। এই জুটি ২০৮ থেকে ইনিংস টেনে নিয়ে গেছেন ২৫৭ রানে। ২৫৭ রানে উমর গুল রানআউট হলে নবম উইকেটের পতন ঘটে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসেন অভিষিক্ত ইয়াসির আলী। তখনও ওই ওভারের আরো ৫ বল বাকি। স্ট্রাইকে ইয়াসির আলী। সেই ওভারে বোলিং করছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন। জয়ের জন্য মরিয়া টাইগারদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বল ডট দেন ইয়াসির, তবে পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিয়ে ইনজিকে স্ট্রাইক দেন। স্ট্রাইকে এসেই বাউন্ডারি মেরে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করেন ইনজামাম। বুনো উল্লাসে ফেটে পড়েন ইনজামামরা।
জয়ের একবারে দ্বারপ্রান্তে গিয়েও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ে আহত বাঘেরা। অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনের সেই কান্না আজও অশ্রুসিক্ত করে কোটি ক্রিকেটপ্রেমীদের। দেশের ক্রিকেটের প্রথম আক্ষেপ হাহাকারের গল্প সেই মুলতান ট্র্যাজেডি।