ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল স্টেডিয়ামে এর আগে ৮ ম্যাচের মধ্যে একই দল টস এবং ম্যাচ দুটো একইসাথে জিতেনি। নিউজিল্যান্ড সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়নি, বাংলাদেশকে ৭৭ রানে হারিয়ে বুঝিয়ে দিলো যে ঘরের মাটিতে তাদেরকে হারানো কতটা কঠিন।
ইতিহাসও তাদের হয়ে কথা বলে, শেষবার নিজেদের মাটিতে ওডিয়াই সিরিজ হেরেছিলো সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০১৩ মৌসুমে। এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা সবাই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিজেদের শেষ ওডিয়াই সিরিজ হেরে দেশে ফিরেছে। এখন পর্যন্ত এশিয়ার দলগুলো নিউজিল্যান্ড সফরে ১২৭ টি ওডিয়াই ম্যাচে মাত্র ৩৭ টি জয়ের দেখা পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সাম্প্রতিক পারফরমেন্স ততোটা সুখকর না নিউজিল্যান্ডের, কিন্তু নিজেদের মাটিতে কতটা ভয়ংকর দল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ৩৪১ রান করে বাংলাদেশকে ৩৪২ রান লক্ষিত ছুড়ে দেয় নিউজিল্যান্ড। জবাবে সাকিব আল হাসানের ৫৪ বলে ৫৯ রান, মোসাদ্দেকের অপরাজিত ৫০* রান এবং মুশফিকের ৪২* রানের ইনিংসে হারের ব্যবধান কমায় বাংলাদেশ।
নিউজিল্যান্ডের দেয়া ৩৪২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই নড়বড়ে ছিলো বাংলাদেশের ব্যাটসমানরা। প্রথম ১০ ওভারে মাত্র দুটি সিঙ্গেল নিতে সক্ষম হয় তামিম, ইমরুল, সৌম্যরা। পাহাড়সম লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ব্যক্তিগত ১৬ রানের মাথায় সাউদির বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান ইমরুল কায়েস। ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ সৌম্য সরকার নিজের ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারেননি, ৮ বলে মাত্র ১ রান জিমি নিশামের প্রথম শিকারে পরিণত হন। এরপর কোন রান না করেই ফিরে যান অভিজ্ঞ রিয়াদ। নেশামের বোলিং তোপে মাত্র ৪৮ রানেই টপ অর্ডারের ৩ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে বসে বাংলাদেশ।
তামিমের ধীরগতির ৩৮ রান এবং সাকিবের দ্রুত ৫৯ রানের ইনিংসে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা চালায় বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল ইনিংসের ৮১ রানের সময় নেশামের বলে এবং সাকিব আল হাসান ১৪৪ রানে লুকি ফার্গুসেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরে গেলে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ। তখনো আশার আলো হয়ে ক্রিজে ছিলো মুশফিক এবং তার সাথে। জুটি বেঁধেছিলো সৈকত, কিন্তু দলীয় ২১৯ রানের মাথায় মুশফিক দ্রুত রান নিতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে ব্যক্তিগত ৪২ রানের মাথায়। সেখানেই বাংলাদেশের সব আশা শেষ হয়ে যায়, শেষদিকে সৈকত ঝড়ো ব্যাট চালিয়ে ৪৪ বলে ৫ চার এবং ৩ ছয়ের মারে ৫০* রানে অপরাজিত থাকেন। কিউই বোলারদের মধ্যে নিশাম এবং ফার্গুসেন ৩ টি এবং সাউদি ২ টি উইকেট শিকার করেন।
দিনের শুরুতে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল স্টেডিয়ামে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কিউই অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। তার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করে শুরু থেকেই মারমুখী ভঙ্গিতে খেলতে থাকে সম্প্রতি চ্যাপেল-হ্যাডলি ট্রফিতে শতক হাঁকানো মার্টিন গাপটিল। অতিরিক্ত শট খেলতে গিয়ে ইনিংসের ৬ষ্ঠ ওভারে ১ম বলে মুস্তাফিজের স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে বল আকাশে উঠিয়ে দেয় গাপটিল, সৌম্য সরকার ধীরস্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ক্যাচ লুফে নেওয়ার মধ্য দিয়ে কিউইদের প্রথম উইকেটের পতন ঘটে ৩১ রানে।
দীর্ঘ ৯ মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে এসে মুস্তাফিজ নিজের তৃতীয় ওভারেই সফলতা পান। ১ম উইকেট পতনের পর ক্রিজে আসে কিউই অধিনায়ক উইলিয়ামসন, ক্রিজে এসেই দ্রুত রান তোলার দিকে মনোযোগী হন উইলিয়ামসন।
সেঞ্চুরিয়ান টম লাথামের সাথে ২য় উইকেট জুটিতে ৪৯ বলে ৪৮ রান যোগ করেন কিউই কাপ্তান। যার মধ্যে উইলিয়ামসন একাই করেন ৩৬ বলে ৩১ রান। ইনিংসের ১৫ তম ওভারে লাথাম-উইলিয়ামসনের ৪৮ রানের জুটি ভাঙেন তাসকিন আহমেদ, মুশফিকুর রাহিমের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে যায় মাত্র ৯৬ তম ইনিংসে ৪,০০০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করা উইলিয়ামসন।
উইলিয়ামসনের বিদায়ের পর ক্রিজে আসে রস টেইলরের ইনজুরির কারণে ছয় বছর পর সুযোগ পাওয়া নেইল ব্রুম। নিজের ফিরতি ম্যাচে ১৭ রানের মাথায় সাকিবের বলে রিয়াদের হাতে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যাওয়ার পরেও সেই সাকিবের বলেই ২২ রান করে ফিরে যায় নেইল ব্রুম, ততক্ষণে লাথামের সাথে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৬১ বলে ৫৫ রান যোগ করেন ব্রুম।
ইনজুরির কারণে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ওডিয়াইতে দলে না থাকা অলরাউন্ডার জেমস নিশাম সাকিবের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হয়ে মাত্র ১২ রানেই ফিরে যায়। জিমি যখন সাজঘরে ফিরে যায় তখন নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ ২৮.৪ ওভারে ৪ উইকেটে ১৫৮ রান।
তখনো ক্রিজের একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন ওপেনার টম লাথাম, তার সাথে জুটি বাঁধতে ক্রিজে আসেন কলিন মুনরো।
দু’জনেই বাংলাদেশি বোলারদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে মাত্র ১০৭ বলে ১৫৮ রানের জুটি গড়েন, এই দু’জন যখন জুটি বাঁধেন তখন নিউজিল্যান্ডের ঠিক ১৫৮ রান ছিলো।
টম লাথাম ওডিয়াই ক্রিকেটে নিজের ২য় শতক হাঁকিয়ে ১২১ বলে ৭ চার এবং ৪ টি ছয়ের মারে ১৩৭ রান করেন মুস্তাফিজুর রহমানের শিকারে পরিণত হয়। টম লাথামের এটি ওডিয়াই ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ইনিংস, এর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১১০* রানের ইনিংসটি ওডিয়াইতে তার সর্বোচ্চ ইনিংস ছিলো। টেস্টে ক্রিকেটেও টম লাথামের সর্বোচ্চ ইনিংস ১৩৭ রানের।
অপরপ্রান্তে কলিন মুনরো মাত্র ৬১ বলে ৪ টি ছয় এবং দিগুণ চারের মারে ৮৭ রানের ইনিংস খেলে সাকিবের তৃতীয় শিকারে পরিণত হন। কলিন মুনরোর ও এটি ওডিয়াইতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস, এর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষেই ৮৫ রানের ইনিংসটি তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস ছিলো। এই দুইয়ের ব্যাটে চড়ে নিউজিল্যান্ড নির্ধারিত ওভার শেষে ৭ উইকেটে ৩৪১ রান করে, যা হ্যাগলি ওভালে দলীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এর আগে কানাডার বিপক্ষে স্কটল্যান্ডের ৯ উইকেটে ৩৪১ রান এই মাঠে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ছিলো।
টম লাথাম এবং কলিন মুনরোর ব্যাটিং তাণ্ডবের দিনে বাংলাদেশের হয়ে সাকিব আল হাসান ১০ ওভার বল করে ৬৯ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট শিকার করেন। এতে করে মাশরাফিকে টপকে বর্তমানে ২১৮ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের হয়ে ওডিয়াইতে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিব আল হাসানের দখলে। এছাড়া কাঁধের সার্জারি শেষে নির্বাসন কাটিয়ে জাতীয় দলে ফিরে ১০ ওভারে ৬২ রানের বিনিময়ে দুই ওপেনারকে সাজঘরে ফেরত পাঠান।
টম লাথাম ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন। দুই দলের ৩ ম্যাচ সিরিজের ২য় একদিনের ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ২৯ শে ডিসেম্বরে সাক্সটন ওভাল, নেলসনে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর – নিউজিল্যান্ড – ৩৪১/৭ ; ওভার-৫০ ( লাথাম ১৩৭, মুনরো ৮৭, উইলিয়ামসন ৩১ ; সাকিব ৩/৬৯, মুস্তাফিজ ২/৬২, তাসকিন ২/৭০)
বাংলাদেশ – ২৬৪/৯ : ওভার – ৪৪.৫ ( সাকিব ৫৯, মোসাদ্দেক ৫০*, মুশফিক ৪২ ( রিটায়ার্ড নট আউট) : নেশাম ৩/৩৬, লুকি ফার্গুসেন ৩/৫৪, সাউদি ২/৬৩)
ফলাফল – নিউজিল্যান্ড ৭৭ রানে জয়ী।