
নাম্বার টেন ফুটবলের একটি অন্যতম আইকনিক পজিশন। যুগে যুগে আমরা ম্যারাডোনা, জিকো, প্লাটিনি, ব্যাজিওর মতো নাম্বার টেনের দেখা আমরা পেয়েছি। আবার এই যুগে এসে পেয়েছি মেসুত ওজিলের মতো পিওর নাম্বার টেন।
মাঠের পজিশনের দিক থেকে একজন নাম্বার টেন সচরাচর একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবেই খেলেন। নিজের দলের অ্যাটাকার আর মিডফিল্ডারদের একদম মাঝে যোগসূত্র হিসেবে আর বিপক্ষ দলের ডিফেন্স লাইনের একটু নিচে মূলত তার অবস্থান। তার কাজ কী মাঠে? দলের প্লেয়ার যাতে সামনে পাস দেওয়ার একজন হিসেবে তাকে খুঁজে পায়, আবার যথাযথ খেলোয়াড় খুঁজে নিয়ে বল পাস করে খেলাটাকে সচল রাখা। মাঠের মূল অ্যাটাকিং খেলাটা তারা ধরে রাখে। এই কারণে কিন্তু তাদের অনেক সময় প্লেমেকারও বলা হয়। তাদের এই ভিশনটা রাখা খুব জরুরী যা তাদের পাসিং এবং মাথার কাল্পনিক ম্যাপে অন্যান্য প্লেয়ারদের প্লেয়ারদের সম্ভাব্য অবস্থান নির্ণয় করাতে সাহায্য করতে পারে। যে খেলোয়াড় যত ভালোভাবে এইটা করপ্তে পারবেন, তিনি এই পজিশনের জন্য তত পারফেক্ট। এইজন্য আমরা মেসুত ওজিলের মতো পিওর নাম্বার টেন যারা আছেন, তাদের দুর্দান্ত ভিশন দেখতে পাই। এই ইমাজিনারি ক্ষমতার জন্য ইটালিয়ান ভাষায় এদের বলা হত “ফ্যান্টাসিস্তা”।
তো এইরকম নাম্বার টেন যারা আছেন, তাদের জন্য ডিফেন্সিভ ডিউটিগুলোতে ছাড় দেওয়া হয়। তার নিচে তার যে টিমমেটরা থাকে, তারা তার হয়ে এটি সামাল দেয়। যেমন জিদান যখন নাম্বার টেন রোলে খেলতেন, তখন তাকে নিচে থেকে সাপোর্ট দিতেন দেশম-কন্তে-ডেভিডসরা। তাদের বাড়তি ওয়ার্করেট জিদানকে একরকম নিচে নামা থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি দিত। ‘৯৮ সালের ফ্রান্সের দলটি ছিল এমনই। এই দলের জিদান নাম্বার ১০ রোলের সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ।

যুগের পরিবর্তনে অন্যন্য রোলগুলার সাথে সাথে এই নাম্বার টেনেও পরিবর্তন আসে অনেক। মডার্ন ফুটবলে আমরা এখন নাম্বার টেন রোলের প্লেয়ারদের তেমন একটা দেখতে পাই না। কিন্তু কেন?
মডার্ন ফুটবলে এই রোলটি তেমন একটা কাজে আসছিল না । কারণ মডার্ন ফুটবলে প্রেসিংকে এগিয়ে রাখা হয়। হাই-প্রেসিংয়ে খেলা ম্যানচেস্টার সিটি, বায়ার্ন মিউনিখ বিপক্ষ দলকে এতই কোণঠাসা করে ফেলে যে তারা উপরে উঠার সুযোগই তেমন পায় না। এই সুবিধা নিতে সব দলই এখন প্রেসিংকে গুরুত্ব দেয়। তাই তারা মাঠের সব খেলোয়াড়ের কাছ থেকেই প্রেসিং, হাই ওয়ার্করেট ও ফল ব্যাক করে ডিফেন্সিভ ডিউটি আশা করে। তো সেখানে একটা নাম্বার টেন দলে রেখে, তাকে দিয়ে বাকিদের অর্ধেক কাজ করানোর মত বিলাসিতা করতে অনেক দলই রাজি না। আবার এই নাম্বার টেনের কাজ থাকে ক্রিয়েটিভিটিতে। কিন্তু এই মডার্ন ফুটবলে ক্রিয়েটিভিটি এখন আর সীমাবদ্ধ নয়। ওভারল্যাপিং ফুলব্যাক, ডিপ লায়িং প্লেমেকার, ফলস নাইন এইসব রোলে থাকা প্লেয়াররাও এখন নিজেদের স্বাভাবিক ডিফেন্ডিং, ডেসট্রয়িং, ফিনিশিংয়ের কাজের পাশাপাশি ক্রিয়েটিভিটিও রাখেন। তো এইজন্য মাঠে নাম্বার টেনের অভাব তেমন বোঝা যায় না।

এইসব কারণে নাম্বার টেনকে সরিয়ে ফেলে ৪-৩-৩ ফরমেশনে আরেকটা সিএম যোগ করে মিডফিল্ডে তাদের প্রভাব বাড়ায়। ম্যানেজাররা এভাবেই মিডফিল্ডে তাদের নিউমেরিক্যাল অ্যাডভান্টেজ বাড়াতে পছন্দ করেন।
কিন্তু এখন আবার অনেক ম্যানেজার নতুন করে পছন্দ করছেন ৪-২-৩-১ ফরমেশনটিকে। এটি আসলে ৪-৩-৩ ফরমেশনের একটি সাকসেসর। এই ফরমেশনে মাঠের বাকি খেলোয়াড়দের সাথে সুন্দরভাবে নাম্বার টেন রোলে থাকা প্লেয়ারকে কানেক্ট করে যায়। সেন্টারব্যাকরা সিএম হয়ে, ফুলব্যাকরা উইঙ্গার হয়ে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের কাছে বল পাঠান। এরপর তার সামনে থাকা মূল স্ট্রাইকারের সাথে তার একটি সিঙ্গেল কানেকশন থাকে। নাম্বার টেনকে এইক্ষেত্রে একটু হার্ডওয়ার্ক করতে হয়, একটু নিচে নেমে বাকি সিএমদের সাথে কোঅপারেট করতে হয়। তখন সাপোর্টের জন্য দুই উইঙ্গার ট্র্যাক ব্যাক করে ডিপে নেমে আসেন। তাদের মার্ক করতে অপনেন্ট ফুলব্যাকরা চলে আসেন, আর তখন তাদের ডিফেন্স লাইনের সামনে একটি শূন্যস্থান ক্রিয়েট হয়। এই অবস্থায় নিজের দলের ফুলব্যাক ওভারল্যাপ করে ওই শূন্যস্থানে বল আনার চেষ্টা করেন। ওই নাম্বার টেন তার ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগিয়ে তাদের সাথে মিলে অ্যাটাক তৈরি করে। ফুলব্যাকরা তার সাপোর্টে পাশে ফ্রি অপশন হিসেবে থাকেন, বা অপোনেন্ট ডিফেন্সের পিছনে দৌড় দেন থ্রু বল পাওয়ার জন্য।
বর্তমানে আবার অনেক টপ লেভেলের দলগুলো আবার এই নাম্বার টেন রোলের খেলোয়াড়দের ফিরিয়ে আনছে। রেজাল্টও কিন্তু তারা পাচ্ছে হাতে হাতে। এই যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলাচ্ছে ব্রুনো ফার্নান্দেজকে, আর্সেনাল এমিল স্মিথ রো আর মার্টিন ওডেগার্ডকে, লেস্টার সিটি জেমস ম্যাডিসনকে।

ফার্নান্দেজ ইউনাইটেডের সবচেয়ে বেশি পাস পাওয়া খেলোয়াড়। সে শুধু মাঝেই না, দুই উইংয়েও রোমিং করে। ডিফেন্সিভ সাপোর্ট দেওয়ার জন্য দুই ফুলব্যাক একটু উপরে এসে সিএম থাকা ফ্রেড-পগবার সাপোর্টে থাকে। ফ্রেড আর পগবার সাপোর্টে উপরে ব্রুনো কিছুটা ভারমুক্ত থাকেন। কাউন্টার অ্যাটাক-নির্ভর ইউনাইটেড যখন খেলা তৈরি করতে থাকে, সেখানে ব্রুনো তুলনামূলক উপরেই থাকেন বলের জন্য। এনডিডি আর টেইলম্যানসের সাপোর্টে লেস্টারে সেম কাজটা করেন ম্যাডিসন। উপরে ভার্ডির মতো ফিনিশার থাকায় ম্যাডিসনের কাজটাও সহজ হয়।
আর্সেনাল ওজিলকে দিয়ে চালাতে পারেনি এই মডার্ন ফুটবলের জন্য। ওজিল কোনোভাবেই ট্র্যাক ব্যাক করবেন না, আবার তাকে সাকা-সেবায়োস সাপোর্টও দিতে পারতেন না। গত দুই বছর আর্সেনালে কোনো প্রপার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিল না। তাই ওজিল ডিফেন্সে কন্ট্রিবিউট না করায় প্রচুর কাউন্টার অ্যাটাক খেতে হতো আর্সেনালকে। এখন এমিল স্মিথ রো আছেন ওজিলের জায়গায়, সাথে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে লোনে আছেন মার্টিন ওডেগার্ড। এই দুইজনের জন্য সেবায়োসের চাইতে আর্তেতা কিন্তু এলনেনিকেই খেলাতে পছন্দ করেন ডিফেন্সিভ সাপোর্ট বেশি পেতে। টমার পার্টেকে আনার অন্যতম প্রধান কারণও ছিল এটিই। গত বছর তাই ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলা আর্সেনাল এইবার ফিরে গেছে আর্সেন ওয়েঙ্গারের আমলের ৪-২-৩-১ ফরমেশনে।
এখন আর্সেন ওয়েঙ্গারের সময়ে কেন ওজিল ফর্মে ছিল? উত্তর, ককুলিন-রামজি-এলনেনি-আর্তেতা-উইলশেয়ারের পর্যাপ্ত ডিফেন্সিভ সাপোর্ট। গত ২০১৯-২০ মৌসুমে কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছাড়াই খেলে আর্সেনাল। উনাই এমেরির সিজনের মাঝেই ধরা খাওয়ার অন্যতম কারণ এটি। ফুটবলের এই সর্বশেষ ক্ল্যাসিকাল নাম্বার টেন তাই আর্সেনালে ২০১৮-১৯ মৌসুম থেকে আর পর্যাপ্ত ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারেননি। ওজিলের এই ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক কম থাকার ফলাফল হারে হারে টের পেয়েছিল গত মৌসুমে আর্সেনাল। আক্রমণে ওজিলের ওভাব অবামেয়াং আর বুকায়ো সাকা মিলে কিছুটা পুষিয়ে দিয়ে গত মৌসুমে ৩-৪-৩ ফর্মেশনে আর্সেনালের জন্য সাফল্য নিয়ে আসেন।
অনেকে আবার টমাস মুলারের নাম বলবেন এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার রোলে। কিন্তু তিনি আসলে স্ট্রাইকারের একটু নিচে খেলা সেকেন্ড স্ট্রাইকারের মতো, কোনো নাম্বার টেন নন। তবে তার এই রোলটা আসলে আরো ইউনিক, যাকে বলা হয় ‘রমডয়টার’ – অনেকটা ত্রেকারতেস্তাদের অ্যাটাকিং রোল প্লে করার মতো। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, ত্রেকারতেস্তারা প্রধানত কাজ করে অন দ্য বলে, সেখানে রমডয়টার মুলার সেটা করেন অফ দ্য বলে।
নাম্বার টেনের জন্য পজিশনিং আর ট্যাকটিকাল ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়তে হয়, নাহলে যুতসই পারফর্ম করা দুষ্কর। নিচে নেমে বল ক্যারি করা, বল হারালে বলের পেছনে দৌড়ানো… এগুলো করতেই হবে। মাঠের সব খেলোয়াড়ের কাজ এখন অনেকটাই একই রকম হচ্ছে। তো এইজন্য একজন প্লেয়ারকে একাধিক রোলে পারদর্শী হতে হয়। কোনো পজিশনে কোনো খেলোয়াড় না থাকতে পারলে সেই পজিশনটি অন্য কারোর গিয়ে ফিলআপ করতে হয়। এতে মাঠে দলের মূল স্ট্রাকচারটা বজায় থাকে।

আবার অন্য পজিশনে থাকা খেলোয়াড়কে দিয়েও এই কাজ করানো যায়। যেমন ম্যানসিটি এইটা করে নাম্বার এইট পজিশনে থাকা কেভিন ডি ব্রুইনকে দিয়ে। দুই নাম্বার এইট তারা একসাথে উপরে উঠিয়ে ডব্লিউ-শেপের ফরমেশন তৈরি করে অ্যাটাকে যান। দুই ফুলব্যাক ডিপেই থাকেন, উপরে পাঁচজন খেলোয়াড় থাকায় পাসিং অপশনও বেশি থাকে, আবার কেডিবি ডিফেন্স লাইন ক্রস না করায় তাকে মার্ক করতেও অসুবিধা হয়। ফলে কেডিবির সুবিধা হয় ট্র্যাক ন্যাক করে নতুন করে অ্যাটাকে উঠতে। গত মৌসুমে গুন্ডোগান আর সিলভাকে রোটেট করে খেলান পেপ গার্দিওলা। অ্যাটাকে ওঠার সময় সেফ গেমের জন্য বেশিরভাগ সময় রদ্রি নিচে থেকে যেতেন এই ডিএম রোলে, গুন্ডোগান বা সিলভা খুব একটা উপরে না উঠে হোল্ডিং মিডে অবস্থান নিতেন, আর উপরে ডি ব্রুইনকে নাম্বার টেন রোলে দিয়ে মুক্তভাবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের সামনে অপারেট করার সুযোগ করে দিতেন। আবার এভারটন হামেস রদ্রিগেজকে দিয়ে ওয়াইড পজিশন থেকে কাট ইন করে ভিতরে এনে অ্যাটাক করতে দিতেন। আরেক ওয়াড প্লেয়ার রিচার্লিসন টাচলাইনেই থাকেন বলের জন্য বা একটু ভিতরে এসে ১-২ শেপ তৈরি করেন, নিচে পর্যাপ্ত ব্যাকআপ লাগে তারও। এইভাবে হামেসের পজিশন চেঞ্জ করে তার পিওর নাম্বার টেন রোলটাকে মডার্ন ফুটবলের উপযোগী ‘কনভার্টেড নাম্বার টেন’ রোলে পরিণত করে নিয়েছেন তার প্রিয় গুরু কার্লো আনচেলত্তি।
ফুটবলে সবসময়ই প্রয়োজন হয় নতুন নতুন ট্যাকটিক্সের। এক সিস্টেমে কোনো দলই চলতে পারে না। অন্যান্য দলগুলি তাদের সেই ট্যাকটিক্সটা অ্যাডাপ্ট করে নিলে তখন স্বাভাবিক খেলাই নষ্ট হয়ে যায়। ফুটবল ম্যানেজারদের এইটা একটা বড় পরীক্ষা যে তারা প্রতিটা ম্যাচের জন্য কতটা ইউনিকভাবে তার দলকে সাজাতে পারে। কোনোভাবে প্রতিপক্ষকে কনফিউশনে ফেলতে পারলেই ম্যাচের ফলাফল নিজেদের দিকে আনা সহজ হয়। আস্তে আস্তে যখন নাম্বার টেনদের যে দুর্বলতা রয়েছে, তাকে পুঁজি করে যখন অন্য দলগুলি তাদের দল সাজাতো, তখন সব কোচই নাম্বার টেনের মতো ক্লাসিক কিন্তু লাক্সারিয়াস রোলটাকে বাইরে রেখেই দল সাজিয়েছেন। আবার এখন যখন তাদের এই দুর্বলতাগুলোকে কীভাবে এড়ানো যায় তার সমাধান আসছে, তখন কয়েকটি দল আবারও তাদের ফিরিয়ে এনে দল সাজাচ্ছে। তারা এসে আবারও ডিফেন্স লাইনে ভীতি ছড়াচ্ছেন। যেহেতু তাদের একবার ফিরিয়ে আনা গেছে, তো আশা করা যাচ্ছে আস্তে আস্তে এই রোলে আরো কিছু নতুন উদ্ভাবনী পরিবর্তন এনে মডার্ন ফুটবলে আরো চ্যালেঞ্জিং একটি রোল হিসেবে দেখা যাবে।