Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যালকম মার্শাল: সিংহহৃদয় এক ক্রিকেটার

https://assets.roar.media/Bangla/2017/04/>

ল্যারি গোমেজের সেঞ্চুরিতে সাহায্য করতে ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে গেলেন ম্যালকম মার্শাল © গেটি ইমেজ

হেডিংলি টেস্ট, ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তৃতীয় টেস্ট, উইজডেন ট্রফি, ১৯৮৪

প্রথম ইনিংসে নিজের ষষ্ঠ ওভার করে গালিতে ফিল্ডিং করতে এসে হঠাৎ বামহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ভেঙে ফেললেন ম্যালকম মার্শাল। দলের সাথে থাকা চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন পরবর্তী দশ দিনের মধ্যে যেন কোনোভাবেই খেলতে না নামেন তিনি। জোয়েল গার্নার এবং মাইকেল হোল্ডিং দলে থাকলেও অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের সবচেয়ে বড় ভরসাটা তখন তিনিই, সেটা খুব ভালোভাবেই জানা ছিলো ইংল্যান্ডের। ফলে ইংলিশ শিবিরে কিছুটা হলেও যেন স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিলো।

টেস্টের তৃতীয় দিনে মাইকেল হোল্ডিং এবং ল্যারি গোমেজের ৮২ রানের জুটির বদৌলতে ততক্ষণে উইন্ডিজ লিড পেয়ে গেছে ১৮ রানের। ভালো খেলতে থাকা হোল্ডিং হঠাৎ বব উইলিসের বলে পল অ্যালটের তালুবন্দী হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন যখন, ল্যারি গোমেজের ব্যক্তিগত রান তখন ৯৪। ব্যাটিংয়ে নামবেন গার্নার, তাঁর ব্যাটিংয়ের রেকর্ড ইতিপূর্বে তেমন সুবিধার নয়। এমন মুহুর্তে ড্রেসিংরুমে মার্শাল ঘোষণা করলেন, প্রয়োজন পড়লে তিনি ব্যাটিংয়ে নামবেন।

ড্রেসিংরুমে হইচই পড়ে গেলো, “আয় হায়, এই ছেলে বলেটা কি! এমন কি প্রয়োজন পড়লো এখন যে তাঁকে ব্যাটিংয়ে নামতেই হবে?” স্মিত হাসলেন মার্শাল, প্রয়োজনটা যে গোমেজের সেঞ্চুরি পেতে যথাসম্ভব সাহায্য করা! সবাই যথাসাধ্য তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, হাতে খুব বেশি সময় না থাকায় তিনি সেই জেদ বজায় রাখলেন। কারো কোনো কথা শুনলেন না, তিনি ব্যাটিং করতে নামবেনই!

স্কোরবোর্ডে আর দুটো রান যোগ হতে না হতেই গার্নার প্যাভিলিয়নমুখো হলেন। ইংলিশ শিবির মাঠে উল্লাস শুরু করলো ইনিংসের সমাপ্তি ধরে নিয়েই, যতক্ষণ পর্যন্ত না মার্শাল ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন। হতভম্ব হয়ে ইংলিশ অধিনায়ক ডেভিড গাওয়ার দেখলেন, বামহাতের বুড়ো আঙুলে দুটো ফ্র্যাকচার নিয়ে টেপ লাগিয়ে ব্যাটিংয়ে নামছেন ম্যালকম মার্শাল। সেখানেই তো ম্যাচটায় পিছিয়ে পড়লো ইংল্যান্ড!

নাহ, খুব অসাধারণ কোনো ইনিংস খেলেননি সেদিন, আট বল খেলে করতে পেরেছিলেন মাত্র চার রান। কিন্তু যে কারণে মাঠে নামা, সেটা কিন্তু ঠিকই হয়ে গিয়েছিল ; ইনিংস শেষে গোমেজ অপরাজিত ছিলেন ১০৪ রানে। কিন্তু একই সাথে সারা বিশ্ব দেখেছিলো সিংহহৃদয় এক ক্রিকেটারকে, যিনি বোথাম-উইলিস-অ্যালটদের সামনে ভাঙা হাত নিয়ে খেলতে নামার সাহস দেখিয়েছিলেন।

সারা বিশ্ব দেখেছিলো সিংহহৃদয় এক ক্রিকেটারকে, যিনি বোথাম-উইলিস-অ্যালটদের সামনে ভাঙা হাত নিয়ে খেলতে নামার সাহস দেখিয়েছিলেন। © গেটি ইমেজ

ইতিহাসে ঢুকে যাওয়ার জন্য এই একটা ঘটনাই হতে পারতো যথেষ্ট। কিন্তু তিনি নিজের সেরাটা যেন তুলে রেখেছিলেন এরপরের ঘটনাক্রমের জন্য।

আউট হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই মার্শাল ফিল্ডিংয়ের জন্য পুরোদস্তুর প্রস্তুত হয়ে আবার ডাগআউটে এসে হাজির। প্রমাদ গুণলেন ক্লাইভ লয়েড, Is this boy serious?” অধিনায়ক ততক্ষণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন ‘ম্যাকো’র কাজকর্ম দেখে, এবার আর বাধা দিলেন না তিনি। অন্যদিকে ইংলিশ শিবিরে কিছুটা স্বস্তি ঘোরাফেরা করছে তখনো। বেচারা অ্যান্ডি লয়েডের (সাবেক ইংলিশ ব্যাটসম্যান) ক্যারিয়ারের ইতি টেনে দিয়েছেন সিরিজের প্রথম টেস্টে, এছাড়াও যথেষ্ট বাগড়া বাধিয়েছেন আগের ম্যাচগুলোতে। ফলে মার্শালের ইনজুরি হাতে ব্যাটিংয়ে নামা ইংল্যান্ডের জন্য কিছুটা হলেও আশার প্রদীপটা জ্বালিয়ে রেখেছিলো টিমটিম করে, যদি না নামেন আর মার্শাল!

কিন্তু সেদিন যেন কালবৈশাখী হতেই মনস্থির করে নেমেছিলেন ‘ম্যাকো’! ইংলিশদের আর এক দফা হতবুদ্ধি করে দিয়ে ফিল্ডিংয়েও নেমে গেলেন তিনি, আর সেই ধাক্কাটা সামলাতে না পেরেই কিনা কে জানে, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ। ম্যালকম মার্শালের বোলিং ফিগার? ২৬ – ৯ – ৫৩ -৭ !! বলাই বাহুল্য, সেটাই ছিলো ঐ সময়ে মার্শালের সেরা বোলিং বিশ্লেষণ।

হেডিংলি টেস্টে সাত উইকেট নেওয়ার পথে মার্শালের উল্লাস © গেটি ইমেজ

যাত্রা হলো শুরু

বারবাডোজের ব্রিজটাউনে জন্মের এক বছরের মাথায় পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত বাবাকে হারান মার্শাল, পরে মা বিয়ে করেন আবারও। বাবার অনুপস্থিতিতে মার্শালকে ক্রিকেট খেলতে সহায়তা করেন তাঁর দাদা, তাঁরই ইন্ধনে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সাল থেকে ‘ব্যাংকস ব্রিউরি ক্লাব’এর হয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। এরপর ওই বছরেরই আগস্টে প্রথমবারের মতো অভিষেক হয় ৪০ ওভারের ক্রিকেটে। শুরুটা অবশ্য হয়েছিলো একেবারে যাচ্ছেতাই, খেলায় তিনি করেন শূন্য রান এবং আট ওভারে দেন ৫৩ রান।

১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮ তারিখে বারবাডোসের পক্ষে লিস্ট-এ ক্রিকেটের গেডেস গ্র্যান্ট/হ্যারিসন লাইন ট্রফিতে প্রথমবারের মতো সিনিয়র ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় তাঁর। কিন্তু অভিষেকেই তিনি শূন্য রান করেই ফিরে আসেন, পরে বোলিংয়েও হতাশাজনক পারফরম্যান্স করে উইকেট লাভে ব্যর্থ হন। আরেকজনের ইনজুরির সৌজন্যে চারদিন পর জ্যামাইকার বিপক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। রান করতে ব্যর্থ হলেও জ্যামাইকার প্রথম ইনিংসে ৬/৭৭ নিয়ে ধ্বস নামান। এরপর ‘ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট কাপ’ বিদ্রোহের কারণে জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারই খেলতে অস্বীকৃতি জানালে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নামার সুযোগ চলে আসে মার্শালের সামনে।

সেই শুরু তাঁর, এরপর থেকে আর কোনোদিন পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেকে রান করতে ব্যর্থ হলেও ছয় উইকেট নিয়ে ধ্বস নামান মার্শাল © গেটি ইমেজ

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে

১৯৭৮-৭৯ মৌসুম চলছে, কয়েকদিন আগেই জ্যামাইকার বিপক্ষে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হলো মার্শালের। শুরুটা খারাপ হয়নি একদম, প্রথম ম্যাচেই পেয়ে বসেছেন ছয় উইকেট। অন্যদিকে তখন মাত্রই এসেছে কেরি প্যাকারের ‘ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ’, চারিদিকে সেই উন্মাদনায় হঠাৎই প্রথম সারির ক্রিকেটাররা একযোগে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছেন। ফলে হুট করেই জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান মার্শাল। যখন রেডিওতে প্রথম খবরটি শোনেন, তিনি দাবি করেন, “আরে ভাই, আমি তো এইটাও জানি না যে ভারত কোথায়!”

সে সিরিজে মাত্র তিন টেস্ট খেলে উইকেট নিতে পেরেছিলেন সাকুল্যে তিনটি, গড় ছিলো ৮৮! তবে সবগুলো প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ হিসেব করলে সব মিলিয়ে উইকেট পেয়েছিলেন ৩৭টি, যা তাঁকে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে কাউন্টিতে খেলার সুযোগ এনে দেয়। তিনি হ্যাম্পশায়ারের হয়েই ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত একটানা কাউন্টিতে খেলে গেছেন।

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপের দলেও ছিলেন মার্শাল, তবে শেষ পর্যন্ত কোনো ম্যাচে খেলার সুযোগ পাননি। কীভাবে পাবেন? দলে যে আগে থেকেই আছেন জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফটরা! খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গেলেন মার্শাল, দলে আসতে হলে পারফর্ম করেই দলে আসতে হবে। আর সেটা থেকেই উদ্দীপ্ত হয়েই কিনা কে জানে, ১৯৮০ সাল থেকে তারকাদ্যুতি ছড়াতে শুরু করলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে বিধ্বংসী পারফর্ম করে অ্যান্ডি রবার্টস, কলিন ক্রফটদের ছিটকে ফেলে জায়গা করে নিলেন মূল দলে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে ২৪ রানে ৭ উইকেট নিয়ে একাই ধ্বসিয়ে দিলেন, তবে ম্যাচটা ড্র হয়ে গেলো। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে তেমন একটা টেস্ট খেলতে পারেননি বটে, তবে ১৯৮২ সালেই যেন পুরো বিশ্ব ‘ম্যাকো-রাজত্ব’ দেখতে শুরু করলো। সে বছরই তিনি ১৩৪টি উইকেট পান, এর মধ্যে ক্যারিয়ারসেরা ৮-৭১ বোলিং বিশ্লেষণের একটি ম্যাচও ছিলো! ফলে আবারও ডাক পেলেন জাতীয় দলে, আর এবার পাকাপাকিভাবে ইতিহাসে নাম লেখানোর বন্দোবস্ত করে রাখতে শুরু করলেন।

দ্বিতীয় দফায় ডাক পাআর পর ইতিহাসে নাম লেখানোর পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করতে শুরু করে দেন মার্শাল © পিএ ফটোজ

এভারেস্টের চূড়ায়

উইন্ডিজ দলে ম্যালকম মার্শাল যোগ দেওয়ার পর রীতিমত ভয়াবহ একটা বোলিং লাইনআপ পেয়ে গেল তাঁরা। একদিকে জোয়েল গার্নারের আগুনের গোলার মতো ছুটে আসা ‘টো-ব্রেকিং’ ইয়র্কারগুলো, অন্যদিকে কলিন ক্রাফটের কৃপণ বোলিং, সাথে যোগ হলো মার্শালের দারুণ নিয়ন্ত্রণ, গতি, সুইং আর মুভমেন্ট। সব মিলিয়ে এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলো এই বোলিং লাইনআপ, ওই সিরিজে ইংল্যান্ডের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা পর্যন্ত রীতিমত ভয়ে গুটিসুটি মেরে ক্রিজে পড়ে থাকতে চাইতো। কিছুদিন যেতে না যেতেই ম্যালকম মার্শাল তাঁর তূণে যোগ করলেন নতুন তীর, লেগ কাটার। ব্যাটসম্যানরা রীতিমত খাবি খেতে শুরু করলো তাঁর বলে; আর নিখুঁত বাউন্সার যখন নিয়মিত ছুঁড়তে শুরু করলেন, খুব সম্ভবত তাঁর চেয়ে বিপজ্জনক বোলার ঐ সময়ে আর কেউ ছিলো না। মার্শাল একের পর এক বাউন্সার ছুড়ে যেতেন, ব্যাটসম্যানরা কোনোমতে পালিয়ে বাঁচতেন। তবু অদ্ভুত ব্যাপার, ব্যাটসম্যানদের তেমন বড় কোনো ইনজুরিতে পড়ার কথা সেভাবে শোনা যায় না!

মার্শাল বরাবরই ব্যাটসম্যানকে আক্রমণ করতে চাইতেন। যেমন ধরুন ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যান্ডি লয়েডের কথা, অভিষেক ম্যাচে তিনি শুধু লয়েডকে নাচান নি, তাঁকে বাউন্সারে কাবু করে এমনকি হাসপাতালেও পাঠিয়েছেন! বেচারা লয়েড এরপর সেভাবে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগটাও আর পাননি। আর দিলীপ ভেংসরকারের সাথে তাঁর বৈরিতা তো বহুল চর্চিত! তিনি স্ট্রাইকে আসলেই মার্শাল যেভাবে রাউন্ড দ্য উইকেটে গিয়ে বোলিং শুরু করছিলেন, ‘আল্টিমেট অ্যাটাক’ খুব সম্ভবত একেই বলে।

ব্যাটসম্যানের অবস্থা আদতেই তখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” হয়ে যাচ্ছিলো। তবে সৌভাগ্যবশত ম্যালকম মার্শাল নিয়মিতভাবে এটা করতে শুরু করেননি, নেহায়েত মাঝেমধ্যে ‘অকেশনালি’ এরকম করে বসতেন। নতুবা তখনকার আম্পায়ারদের পক্ষে সে আগুন নেভানো খুব সহজ কোনো কম্ম ছিলো না বৈকি!

মার্শাল বরাবরই ব্যাটসম্যানকে আক্রমণ করতে চাইতেন। © গেটি ইমেজ

ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন ম্যালকম মার্শাল? একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ১৫ টেস্টের ১৪টিতেই জয় পেয়েছিলো উইন্ডিজ। যে ম্যাচে জয় পায়নি, সে ম্যাচে ইনজুরির কারণে মাঠে নামতে পারেননি মার্শাল। আর সেই সুযোগ লুফে নিয়ে গ্রাহাম গুচ একটা হান্ড্রেড মেরে বসলেন, উইন্ডিজের হাত থেকেও বেরিয়ে গেলো ম্যাচটা। হ্যাঁ, উইন্ডিজের হাতে রবার্টস, গার্নার, হোল্ডিংয়ের মতো বিকল্প ছিলো বটে, কিন্তু একজন মার্শাল ছিলো না, যে কিনা স্রেফ রানআপ থেকেই ছড়াতে পারতেন আতংক। আর বলটা হাত থেকে ছোড়ার পর তো রীতিমত বিভীষিকা হয়ে উঠতেন, বিখ্যাত সেই হেডিংলি টেস্টে ভাঙা বাম হাত নিয়ে বোলিং করেও মাইক গ্যাটিংয়ের নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন!

নিজের দিনে মার্শাল হয়ে উঠতে পারতেন দুঃসহ সুন্দর, তাঁকে সামলানোর মতো ব্যাটসম্যানও নেহায়েত কম ছিলো। ১৯৮৭ সালে লর্ডসে রেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডের সাথে খেলার আয়োজন করে এমসিসি। এক দলে বোলার ছিলেন মার্শাল, হ্যাডলি এবং ক্লাইভ রাইস ; অন্য দলে ইমরান খান, কোর্টনি ওয়ালশ এবং কপিল দেব। নিপাট ব্যাটিং প্রদর্শনীর জন্যই মূলত এ ম্যাচের আয়োজন ছিলো, অন্তত পিচের অবস্থা দেখে তেমনই ঠাওর হচ্ছিলো। ফলাফল তথৈবচ, তবে সেখানেও একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন মার্শাল।

যেখানে তিনি অনন্য

যখন তাঁর বয়স নেহায়েতই কম, তখন রানআপে বেশ খানিকটা দূরত্ব দৌড়ে আসতেন। তাতে যতটা না ছিলো ছন্দ, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণ ছিলো আতঙ্ক। তরুণ বয়স থেকেই তিনি ছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক, আর সময়ের সাথে সাথে সেটা যেন হয়ে উঠেছিলো বিভীষিকা। কিছুটা বাঁকা রানআপে দৌড়ে এসে ছোট্ট লাফ দিয়ে দুর্দান্ত গতিতে বল ছুঁড়ে দিতেন, আর বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যান তাঁর পেস, বাউন্স, সুইং, কিংবা কাটারে খাবি খেতো। কিছুটা অভিজ্ঞতা হতেই বুঝতে পারলেন, বিশাল রানআপের সাথে তাঁর বলের পেসের বিশেষ সম্পর্ক নেই। তাঁর চেয়ে বরং ওই স্ট্যামিনাটা পরের জন্য জমিয়ে রাখাটা ভালো। এরপর আস্তে আস্তে রানআপ কমিয়ে আনলেন বেশ, তবে ধার যেন তাতে আরো বাড়লো পাল্লা দিয়ে!

হেডিংলি টেস্টে ভাঙা বাম হাত নিয়ে বোলিং করেও মাইক গ্যাটিংয়ের নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন! © গেটি ইমেজ

কিছুটা ওপেন-চেস্টেডভাবে বল ডেলিভারি করতেন, একদম অপ্রথাগতভাবে। তবে হুট করে প্রয়োজনমতো এমনভাবে অ্যাকশনের সাথে মিলিয়ে নিতেন নিজেকে, বলকে নিজের খুশিমত যেকোনো দিকে সুইং করাতে কখনোই তেমন বেগ পেতে হয়নি মার্শালকে। আর তাঁর হাত ছিল অবিশ্বাস্যরকমের দ্রুত, ঠিক যেন গলফ কিংবদন্তী টাইগার উডস!

আর ছিল প্রচন্ড মানসিক জোর। অন্যান্য উইন্ডিজ ক্রিকেটারদের তুলনায় উচ্চতা ছিলো বেশ কম, আর ফাস্ট বোলারদেরকেই শুধু বিবেচনায় আনলে সেটাকে আরো অপ্রতুল মনে হতে বাধ্য। অথচ কি অনায়াসে সেটাকে নিজের শক্তির জায়গায় পরিণত করেছিলেন মার্শাল! আর সেই হেডিংলি টেস্টের কথা আর না-ই বা বললাম।

কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই পিছু হটতে শেখেননি মার্শাল, হারতে একদম পছন্দ করতেন না। দলে এসেছিলেন ধূমকেতুর মতোই আকস্মিকভাবে, তবে শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটাকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের একটি।

সেরাদের সেরা?

আচ্ছা, কে সবচেয়ে দ্রুততম ছিলেন? কে ছিলেন সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলার? রে লিন্ডওয়াল, যার তূণে ছিলো পারফেক্ট ইয়র্কার, বাউন্সার, সুইংয়ের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ? নাকি ডেনিস লিলি, একই সাথে আগ্রাসী, বিস্ফোরক এবং ভয়াবহ পেস-বাউন্সে পরিপূর্ণ একজন ফাস্ট বোলার? নাকি ইমরান খান-ওয়াসিম আকরামদের মতো রিভার্স সুইংয়ের জাদুকরেরা? কিংবা কার্টলি অ্যামব্রোসের মতো বিধ্বংসী ফাস্ট বোলার, যার বলকে প্রায়শঃই আগুনের গোলা বলে ভুল করলেও তেমন দোষ দেওয়া যাবে না?

এসব নিয়ে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যায়। তবে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দিনশেষে উঠে আসবে কেবল দুটো নাম। ডেনিস লিলি এবং ম্যালকম মার্শাল। দুজনেই ছিলেন পরিপূর্ণ দুই ফাস্ট বোলার, কোনো কিছুরই কমতি ছিলো না তাঁদের। তবু দুজনের মধ্যে যদি তুলনা করতে হয়, দশবারের মধ্যে নয়বারই হয়তো যে কেউ বেছে নেবেন মার্শালকে।

কিন্তু কেন? এমন কি বিশেষ পার্থক্য আছে, যাতে তিনি এই দু’জনের আলোচনা থেকেও পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন অনেকটা দূরত্বে?

উত্তরটা সম্ভবত লুকিয়ে রয়েছে তাঁর সামর্থ্যে, তাঁর অসাধারণ স্কিলে। ডেনিস লিলির কাছ থেকেই শিখেছিলেন লেগ কাটার, এরপর সেটাকে ‘ডেডলি’ করে তুলেছেন ধীরে ধীরে। আগে থেকেই ছিলো পেস–সুইং–বাউন্স, সাথে একদম নিজস্ব একটা ডেলিভারি করতেন তিনি। ইনসুইং বা আউটসুইং করতে করতে হঠাৎ শেষ মুহুর্তে গ্রিপ বদলে স্পিনারদের ‘গুগলি’র মতো করে বল ছাড়তেন হঠাৎ। আর তাতেই ব্যাটসম্যানের জন্য তাঁকে মনে হতো দুর্বোধ্য!

ডেনিস লিলিঃ নিশ্চিতভাবেই একজন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার © গেটি ইমেজ

শুধু কি তাই? রিভার্স সুইংয়ের আগমনের আরো বেশ কিছুদিন আগেই লিলি উপমহাদেশে খেলে গেছেন, তাতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি তিনি। ভারতের বিপক্ষে কখনো খেলার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর, পাকিস্তানের বিপক্ষে খেললেও উইকেট নিতে পেরেছিলেন মাত্র তিনটি। অন্যদিকে উপমহাদেশের মাটিতে ভারত এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে বেশ কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন মার্শাল, আর তাতে দুর্ধর্ষ পারফর্মও করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি জানিয়েছেন জোরেসোরে।

দু’জনেই ছিলেন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার ; কিন্তু যখন প্রশ্ন সেরাদের সেরা কে, মার্শাল বোধ করি তখন লিলিকে ছেড়ে এগিয়ে যান আরো অনেকটা!

কখনো হার মানতে না শেখা এই কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার শেষ অবধি জীবনের খেলায় হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন ক্যান্সারের কাছে। যেই ‘ম্যাকো’ শত প্রতিকূলতায়ও সাহস না হারাতে শিখিয়েছিলেন, সেই ম্যালকম মার্শালের আজ ৫৯তম জন্মদিনে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে সামান্য এই স্মৃতিচারণ। সেই কবেই পাড়ি জমিয়েছেন স্বর্গের পথে; কে জানে, স্বর্গের ক্রিকেট টুর্নামেন্টে এখন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে বাউন্সারে কাবু করে “হার্ড লাক বয়” বলে পিঠ চাপড়ে দেন কিনা!

তথ্যসূত্র১) thecricketmonthly.com/story/776219/leading-from-the-tail

২) espncricinfo.com/ci/engine/current/match/63377.html

৩) thecricketmonthly.com/story/952887/maco-the-warrior–and-sarfraz-the-magician

৪) thecricketmonthly.com/story/928221/he-ll-get-you-one-handed

৫) bn.wikipedia.org/wiki/ম্যালকম_মার্শাল

৬) espncricinfo.com/ci/content/story/136076.html

৭) espncricinfo.com/magazine/content/story/467701.html

Related Articles