Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পাবলো আইমার: অবমূল্যায়িত এক মার্জিত জাদুকর

“এই বয়সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানেই নেই।” ফুটবল মাঠ ছেড়ে পড়ার টেবিলেই ছেলেকে দেখতে চাইতেন রিকার্ডো আইমার। একদিক দিয়ে রিকার্ডো ঠিকই ছিলেন। ১৩ বছর বয়সী পাবলো আইমারের জন্য পড়াশোনা করাটাই ছিলো সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু পাবলো বাবার কথা কানেই নেননি। না শুনে ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকতেন।

পেশাদার ফুটবলার হওয়ার বাসনায় নিজের ইচ্ছার জোরেই রিভারপ্লেট ক্লাবের হয়ে ট্রায়াল দেন তিনি। মাত্র দুই ট্রায়ালেই ক্লাব লিজেন্ড ড্যানিয়েল প্যাসারেলার পছন্দ হয়ে যায় আইমারকে। পাবলো আইমারের ফুটবলে মুগ্ধ হয়ে তিনি নিজে এসে রিকার্ডো আইমারের সাথে কথা বলে আইমারকে ফুটবলের জগতে পরিচিত করিয়ে দেন। ২২ বছর পর রিকার্ডোর ছেলে পাবলো ফুটবলের অন্যতম এক জাদুকর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তাতে নিশ্চয়ই গর্ববোধ করেছিলেন বাবা রিকার্ডো।

আর অন্য সব আর্জেন্টাইন কিংবদন্তীর মতো আইমারের জন্ম বুয়েন্স আয়ার্সে নয়। তার জন্ম রিও কুয়ের্তাতে। রাস্তার মাঝে ফুটবল খেলে খেলে অভ্যস্ত আইমারের ছিলো নজরকাড়া সহজাত ড্রিবলিং। সাথে ছিলো দুর্দান্ত বল নিয়ন্ত্রণ। তাই রিভারপ্লেটের মূল দলে খুব দ্রুতই অভিষেক হয়ে যায় আইমারের। মাত্র ১৬ বছরে প্রথম পেশাদার ম্যাচ খেলেন তিনি। এই অল্প বয়সেই নজরকাড়া পারফরম্যান্সে সবাইকে মুগ্ধ করেন আইমার। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী ম্যারাডোনা নিজেই আইমারকে নিজের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা দেন। তার মতে, এত প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা তিনি খুব কমই দেখেছেন। আর এতে করেই ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোতেও আইমারের চাহিদা বেড়ে যায়। অবশেষে ৮২ ম্যাচে ২১ গোল ও ২৮ অ্যাসিস্ট করে রিভারপ্লেটকে বিদায় জানিয়ে ইউরোপে আসেন তিনি। এর পরবর্তী ১৫ বছরের ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে আইমার দেখেছেন নিজের উত্থান-পতন দুটোই।

রিভারপ্লেটে আইমার; Image Source: Golazo Argentina

স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ড থেকে অনেক প্রস্তাবনা পেয়ে শেষমেষ আইমার বেছে নেন ভ্যালেন্সিয়াকে। সেই সময় ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম পরাশক্তি ছিলো ভ্যালেন্সিয়া। ২০০১ সালে আইমারকে ভ্যালেন্সিয়া দলে ভেড়ায়। রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য তারা রেকর্ড ফি-তে জিদানকে ভেড়াতে চাইলেও অল্পের জন্য তা হাতছাড়া হয়ে যায়। আগের মৌসুমে পঞ্চম হওয়া ভ্যালেন্সিয়া সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচ খেলার সুযোগও পেয়ে যায়। লিওন, আর্সেনাল ও লিডসকে একে একে হারিয়ে ফাইনালে মিলানে তারা মুখোমুখি হয় বায়ার্ন মিউনিখের।

সেই সময়ে ভ্যালেন্সিয়ার দায়িত্বে ছিলেন হেক্টর কুপার। জ্‌লাতকো জাহোভিচ, রুবেন বারোজা, ভিসেন্তেদের মতো খেলোয়াড় থাকতেও কুপারের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো আইমারকে দেওয়া স্বাধীনতা। পুরো মাঠ জুড়েই ছিলো আইমারের বিচরণ। আর আইমারের মাঝমাঠের বিচক্ষণতাই ভ্যালেন্সিয়াকে দিয়েছিলো অতিরিক্ত সুবিধা। মেস্তায়ায় তার খেলা দেখে স্বয়ং ইয়োহান ক্রুয়েফও প্রশংসায় মেতে ছিলেন। ভক্তরা নাম দিয়েছিলো এল মাগো, যার অর্থ জাদুকর। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ওয়েন হারগ্রিভস আইমারকে বোতলবন্দী করে রাখলে ম্যাচের হাফ টাইমেই আইমারকে তুলে নিয়ে ডেভিড আলবেলদাকে নামান কুপার। পরবর্তীতে পেনাল্টিতে বায়ার্ন মিউনিখের সাথে হেরেও যায় ভ্যালেন্সিয়া। অল্পের জন্য শিরোপা ছুঁতে ব্যর্থ হলেও সবার প্রশংসা জুটেছিলো ভ্যালেন্সিয়ার। তবে সেই মৌসুম শেষেই ভ্যালেন্সিয়াকে বিদায় জানিয়ে ইন্টার মিলানে চলে যান হেক্টর কুপার।

ভ্যালেন্সিয়ার জার্সি গায়ে আইমার; Image Credit: Twittter

কুপারের বিদায়ে ডাগ আউটে আসেন টেনেরিফে ম্যানেজার রাফায়েল বেনিতেজ। সেই সময়টাতে রিয়াল মাদ্রিদের ছিলো রক্ষণের সমস্যা। অন্যদিকে বার্সেলোনাও ভুগছিলো মাঠে। সেই সুবাদে রবার্তো আয়ালা ও মাউরিসিও পেলেগ্রিনির রক্ষণের ফলে লা লিগা ঘরে তোলে ভ্যালেন্সিয়া। ৩৮ ম্যাচে মাত্র ২৭ গোল হজম করে তারা। মৌসুম শেষে দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেপোর্তিভো লা করুনার চেয়ে পয়েন্ট বেশি ছিলো সাত। আর আইমারের ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লিগে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়া ছাড়াও পুরো খেলার নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন এই জাদুকরই।

বারাজা ও আইমার দুজন মিলেই মাঝমাঠ সামলিয়েছেন দারুণভাবে। নিচ থেকে নেমে প্লেমেকিংয়ের দায়িত্ব ছিলো আইমারের হাতে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও সেবার ৫ গোলে সহায়তা করে টুর্নামেন্টে রুই কস্তার সাথে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি গোলে সহায়তা করেছিলেন আইমার। পরের মৌসুমে কিছুটা পিছে পড়ে গেলেও তারপরেই আসলো ভ্যালেন্সিয়ার এখন পর্যন্ত ইতিহাস সেরা সিজন। সেবার লা লিগাসহ উয়েফা কাপ ডাবল ঘরে তোলে ভ্যালেন্সিয়া। কিন্তু এরপরেই আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যেতে শুরু করে তারা। ২০০৮ সালের কোপা দেল রে বাদ দিলে বলার মতো কিছুই অর্জন করতে পারেনি। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়াও সেভিয়া, ভিয়ারিয়াল, এথলেটিক বিলবাওয়ের মতো ক্লাবেরও পিছে পড়তে শুরু করে।

আইমারের ক্যারিয়ারে যেন ভ্যালেন্সিয়ার পথই অনুসরণ করা শুরু করলো। ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার থেকে গড়পড়তা মানের খেলোয়াড়ে পরিণত হলেন তিনি, যার জন্য অনেকাংশে দায়ী তার ইঞ্জুরি। বিরতিহীনভাবে সব ম্যাচ খেলার প্রভাবই পড়ে আইমারের খেলায়। বেনিতেজের লিভারপুলে চলে যাওয়ার পর এবার ডাগ আউটে আসেন রানিয়েরি। আইমারকে তিনি খেলানো শুরু করেন ফ্লাংকে। নিজের সহজাত স্বাধীনতা হারিয়ে আইমারের খেলার মানও কমে যায়। বেশিরভাগ সময় সাইড বেঞ্চে কাটাতে শুরু করেন তিনি। ২০০৫ এর গ্রীষ্মে ভ্যালেন্সিয়াকে লিগ টেবিলে সাত নাম্বারে রেখে রানিয়েরি চলে গেলে তার জায়গায় আসেন সানচেজ ফ্লোরেস। তিনি আইমারকে আবার আগের মতো স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। সাথে সাথেই হারিয়ে যাওয়া আইমার জেগে ওঠেন ফিনিক্স পাখির মতো। ফ্লোরেসের অধীনে সেই মৌসুমে ৩৫ ম্যাচ খেলে প্রতিটি ম্যাচেই নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি।

রিয়াল জারাগোজার সেই দুর্দান্ত দলটি; Image Credit: Anthony Reyes/Getty Image

তবে ২০০৫/০৬ মৌসুমেই ভ্যালেন্সিয়া ছাড়েন তিনি। সেই মৌসুমে রাফায়েল বেনিতেজ লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতান। পুরোনো শিষ্যকে তিনি লিভারপুলে নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। সবাই যখন ধরেই নিচ্ছিলো আইমার এনফিল্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আইমার যোগ দেন রিয়াল জারাগোজায়। কারণ তিনি মনে করেছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্লাবে খেলার জন্য তিনি এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নন। তবে আইমারের ট্রান্সফার রিয়াল জারাগোজার ইতিহাসে অন্যতম সেরা ট্রান্সফার হয়েই আছে। সেই সময়কার জারাগোজা দলও হেলাফেলার ছিলো না। ডিয়েগো মিলিতো, গ্যাব্রিয়েল মিলিতো, রবার্তো আয়ালা, জেরার্ড পিকেরাও ছিলেন দলে। যে মিলিতো পরের মৌসুমে পিচিচি ট্রফির দৌড়ে নিস্টরলয়ের পেছনেই থেকে লিগ শেষ করলেন। আইমার নিজেও থাকলেন ছন্দে। ৩১ লিগ ম্যাচে ৫ গোল ও ১১ অ্যাসিস্ট করে দলকে পয়েন্ট টেবিলে নিয়ে গেলেন ছয় নাম্বারে।

কিন্তু এরপরে যা ঘটলো তাতে আইমারের কিছুই করার ছিলো না। অর্থনৈতিক সমস্যা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের বিদায়ের ফলে রিয়াল জারাগোজা পরের মৌসুমে এক লাফে চলে যায় লিগের ১৮ নাম্বারে। যার ফলে অবনমিত হয়ে ক্লাবটিকে খেলতে হয় দ্বিতীয় স্তরের বিভাগ সেগুন্দায়। তবে নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম বাজে মৌসুম কাটানোর পরও ২৮ বছর বয়সী আইমারের জন্য বড় বড় ক্লাবগুলোর আগ্রহ এতটুকু কমেনি। আইমারের কাছে অনেকগুলো পথ খোলা ছিলো। চাইলে রিভারপ্লেটেও ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু আইমার ইউরোপেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

বেনফিকায় সতীর্থ স্যাভিওলার সাথে; Image Credit: Uefa.com

বেনফিকায় তখন রুই কস্তার বিদায়কাল। তার শূন্যস্থান পূরণ করতেই আইমারের আগমন পর্তুগালের এই ক্লাবে। নুনো গোমেজ, জোসে এন্তনিও রেয়েস, আঙ্গেল ডি মারিয়া, অস্কার কারদোজোসহ বেনফিকা দল তখন বেশ গোছানো। প্রথম মৌসুমে ইঞ্জুরির জন্য শুরুতে নিজেকে মেলে ধরতে না পারলেও শেষে এসে ক্লাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হন আইমার। সে মৌসুমে পর্তুগিজ কাপ জিতে নেয় বেনফিকা। ২০০৮/০৯ মৌসুমে নিজের পুরানো রিভারপ্লেট বন্ধু স্যাভিওলাকে ক্লাবে পান আইমার। প্যারাগুইয়ান কারদোজো ও দুই আর্জেন্টাইন স্যাভিওলা, আইমার মিলে ভয়ঙ্কর ল্যাটিন ট্রায়ো গড়ে তোলেন। সাথে তাদের সহযোগিতায় ছিলেন ডি মারিয়াও। সে মৌসুমে লিগে কাউকে পাত্তা না দিয়েই শিরোপা ঘরে তোলে বেনফিকা। তবে সেই মৌসুমই শেষ হয়ে থাকে আইমারের জন্য। ইঞ্জুরি আর বয়স বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ ত্যাগ করেন তিনি। বেনফিকার হয়ে ১০৭ ম্যাচ খেলে ৩৪টি গোলে সহায়তা করেন আইমার। ইউরোপ ত্যাগ করে এক মৌসুমের জন্য মালয়েশিয়ান লিগে খেলে অবসর ঘোষণা জানান।

আর্জেন্টিনায় সেভাবে সুযোগই পাননি আইমার; Image Credit: AFA

নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারের মতোই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই পাড়ি দেন আইমার। ক্যারিয়ারের বড় সময়ই আড়ালে থেকেছেন ভেরন আর রিকুয়েলমের জন্য। ১৯৯৭ ফিফা যুব বিশ্বকাপ জিতেছিলেন রিকুয়েলমে, ক্যাম্বিয়াসো, ওয়াল্টার স্যামুয়েলদের সঙ্গী হয়েই। অথচ আন্তর্জাতিকে এদের চেয়ে অনেক কম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। আলবিসেলেস্তেদের হয়ে জার্সি গায়ে জড়িয়েছেন মাত্র ৫২ বার। যে রিকুয়েলমের জন্য জায়গা পেতেন না, সেই রিকুয়েলমেকে হটিয়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপ দলে। তবে টানা ধারাবাহিকতা আর ইঞ্জুরির দরুন আর্জেন্টিনায় কখনোই সেভাবে সুযোগ পাননি তিনি।

আইমারকেই আদর্শ মানেন লিওনেল মেসি; Image Credit: Youtube

দিনশেষে আইমারের অবস্থান কোথায়? আর্জেন্টিনায় ঝলক দেখিয়ে দুই ইউরোপিয়ান বড় ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া আর বেনফিকার হয়ে জিতেছেন ৮টি বড় শিরোপা। এমনকি ভ্যালেন্সিয়ার ইতিহাসের সেরা মৌসুমের কান্ডারি ছিলেন তিনিই। তবুও শিরোপার বিচারে অন্যান্য বিখ্যাত ফুটবলারদের চেয়ে ঢের পিছিয়ে আইমার। ম্যারাডোনা ট্যাগলাইনে গায়ে লাগিয়ে খেলেছেন পুরো সময়। বাড়তি চাপও ছিলো। তবে ট্রফি বাদ দিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করতে গেলে আইমার অনেক উপরেই থাকবেন, যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রোজারিওর লিওনেল মেসি নামের এক ছোট ছেলে নিজের ফুটবলীয় আদর্শ বানিয়েছেন এই এল মাগোকেই।

খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This Bangla article is about the story of Pablo Aimar, an Argentine footballer. Necessary link are hyperlinked in the article.

Feature Image: Tomas Pavel Ibara/Ronaldo.com

Related Articles