১.
২০০৬ বিশ্বকাপ। ৩০ জুন বার্লিনে কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক জার্মানির মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। অতিরিক্ত সময় শেষেও ১-১ থাকায় ম্যাচটি গড়ায় টাইব্রেকারে। বিশ্বকাপের টাইব্রেকার ইতিহাস তার আগ পর্যন্ত দুই দলের পক্ষ হয়েই কথা বলেছে। আর্জেন্টিনা ও জার্মানির কোনো দলেরই হার নেই টাইব্রেকারে। জিতেছেও দুই দল সমান ৩ বার করে। সেই রেকর্ড সেবার কোনো এক দলের ভাঙতে যাচ্ছে, তা সুনিশ্চিতই ছিল। আর সেই পোড়া কপাল ছিল আর্জেন্টিনার। জার্মান কিপার লেহম্যান ঠেকিয়ে দেন আয়ালা ও ক্যাম্বিয়াসোর দুইটি শট।
ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। তবে ম্যাচশেষে শোনা গেল, লেহম্যান তার শিন প্যাডের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটি কাগজ। তো সেখানে কী লেখা ছিল? লেখা ছিল আর্জেন্টিনার পেনাল্টি টেকারদের শট নেওয়ার সম্ভাব্য সাইড। সে দেখে দেখে লেহম্যান ঝাঁপ দিয়েছিলেন। এমনকি আয়ালা আর ক্যাম্বিয়াসোর বাম সাইডে নেওয়া শট বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন নাকি ওই কাগজ দেখে দেখেই।
“ম্যাচশেষে দেখলাম, ড্রেসিংরুমে আমার মোজার পাশে কাগজটি পড়ে আছে। তখন তেমন গুরুত্ব না দিলেও কি ভেবে যেন কাগজটি রেখে দিয়েছিলাম।”
ভাগ্যিস, লেহম্যান রেখে দিয়েছেন। তাই বলেই স্বস্তি। কারণ? পরবর্তীতে চ্যারিটির জন্য এই কাগজ যে নিলামে বিক্রয় হয়েছিল ১.৩ মিলিয়ন ইউরোতে!
আচ্ছা লেহম্যান-কাণ্ড বাদ দেই। সে বহু বছর আগের কাহিনী। বরং সদ্যই হওয়া এক কাহিনী বলা যাক। এখানেও অবশ্য আর্জেন্টিনা। তবে এবার আর কপাল পোড়ার গল্প নয়।
বলছিলাম সদ্যই সমাপ্ত হওয়া কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালের কথা। মুখোমুখি হয়েছিলো কলম্বিয়া আর আর্জেন্টিনা। নির্ধারিত সময় শেষেও ম্যাচের নিষ্পত্তি না হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে কলম্বিয়ার ইয়েরি মিনা যখন শট নিতে আসছিলেন আর্জেন্টাইন গোলকিপার মার্টিনেজ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাকে বলতে লাগলেন,
“তোমাকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। আমি জানি তুমি কোন সাইডে শট নেবে। আর আমি সেটা সেইভ করতে যাচ্ছি।”
পরের কাহিনী কমবেশি সবারই জানা। ইয়েরি মিনার শট ঠেকিয়ে দেওয়ার পর কথার বুলি দিয়ে ডেভিনসন সানচেজকেও পরাস্ত করেছিলেন এমি মার্টিনেজ। কিন্তু মার্টিনেজ এর কাছে তো ছিলো না লেহম্যানের কাগজের মতো কোনো ‘চিটকোড’। তবে শক্তির জায়গায় তারতম্য থাকলেও কী? দিনশেষে দুইজনই বিজয়ী। লেহম্যানের কাছে ছিল তথ্য-উপাত্ত, আর মার্টিনেজের শক্তির জায়গা ছিল ‘মাইন্ড গেইম’।
তাতে একটি প্রশ্ন অবশ্য এসেই যায়। টাইব্রেকার শটে গোলকিপারদের সুবিধা কি একটু বেশিই? সেইসব নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
২.
পেনাল্টি নেওয়া কি সহজ বিষয়? মাত্র ১২ গজ দূর থেকে আপনাকে গোল করতে হবে। সামনে থাকবে না কোনো ডিফেন্ডার, বাধা শুধু একজন গোলকিপার। কিন্তু আদতেই কি তাই? পুরো স্টেডিয়ামের চোখও কিন্তু আপনার উপর। এই খেলায় হারানোর কিছু থাকলে সেটা আপনারই। গোলকিপারের হারজিত নেই; যদি না স্বয়ং গোলকিপারই পেনাল্টি শটটি নি্তে আসে। এমনকি টিভি সেটের সামনে বসা লক্ষ লক্ষ সমর্থক তাকিয়ে আপনার দিকে। সেই স্নায়ুচাপের সুবিধা পুরোপুরি বর্তায় গোলকিপারের উপরই।
তাই আপনি আধুনিক ফুটবলের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, আগের তুলনায় পেনাল্টি সেইভ হচ্ছে অনেক বেশি। অবশ্য পেনাল্টি পাওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে বেশ। কিন্তু আধুনিক যুগে গোলকিপারদের বাড়তি এক সুবিধা এনে দিয়েছে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ। চেলসির কথাই ধরা যাক। ২০০৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে চেলসি দ্বারস্থ হয়েছিল এক জার্মান কোম্পানির কাছে। সেই কোম্পানির কাছে সংগ্রহে ছিল বিগত কয়েক বছরে নেওয়া ১৬,০০০ পে্নাল্টির হিসাব। সেই তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে চেলসি বের করল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলকিপার ফন ডার সারের বাম দিকের পেনাল্টি ফেরানোতে বেশ দুর্বলতা আছে।
যেই ভাবা, সেই কাজ। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, টাইব্রেকারে ম্যাচ গড়ালে সব পেনাল্টিই নেওয়া হবে বাম দিকে। পাঠক হয়তো ভাবছেন, চেলসিরই তো সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার কথা। কিন্তু সেটি হয়নি। তার মানে, তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই করলেই মিলে যাবে, সেটাও এক ধরনের বোকামিই বটে। তবে পিলে চমকানোর ব্যাপার ছিল, আদতেই মিলে গিয়েছিল সেবার সব। শুধু দুইটি ‘কিন্তু’ বাদে। জন টেরির বাম দিকের পেনাল্টি ফিরে এসেছিল পোস্টে লেগে। তার দায়ভার পুরোপুরি টেরির উপরই বর্তায়। আর অন্যদিকে আনেলকা ভেবে বসেছিলেন, একটা অন্তত ডানে মারা উচিৎ। আর তার এই ভাবনাতেই চেলসির স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। ফন ডার সারের একমাত্র সেইভটি ছিল ডানে মারা আনেলকার শটটি। ২০০৮ সালে যদি এভাবে তথ্য-প্রযুক্তির ভিত্তিতে সাহায্য করতে পারে, তাহলে বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে গোলকিপারের সুবিধা বেড়েছে আরো অনেকখানিই।
৩.
পেনাল্টি জুজু কাটানো নিয়েও অবশ্য গবেষণা কম হয়নি। বিশেষ করে টাইব্রেকারে নিয়ে আরো বেশি। লন্ডনের ইকোনমিকসের এক প্রফেসর ১,৩৪৩ পেনাল্টি কিক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাতে ছিল প্রায় ১২৯টি টাইব্রেকারে যাওয়া ম্যাচ। সেখানে দেখা গিয়েছে প্রায় ৬০.৫% ম্যাচই জিতেছে আগে পেনাল্টি নেওয়া দল। স্বভাবতই এই খেলায় গোলকিপারের চাপ কম। তাই আগে কিংবা পরের পেনাল্টিতে গোলকিপারের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু প্রথমে নেওয়া পেনাল্টি-টেকার বল জালে জড়ালে পুরো চাপ এসে পড়ে প্রতিপক্ষের প্রথমজনের উপর।
আবার টাইব্রেকার ছাড়া ম্যাচে উপহার পাওয়া পেনাল্টিগুলোতে চাপ কম থাকে, তা নিয়েও এক চোট গবেষণা হয়ে গেছে। সাধারণ পেনাল্টিতে দেখা যায়, ৮৬ শতাংশ সময়ে সঠিকভাবে বল জালে জড়াতে পারেন খেলোয়াড়েরা। কিন্তু অন্যদিকে সেটি যখন টাইব্রেকার শুটআউটে এসে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে শতাংশের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৬ শতাংশে। আবার ব্যাপারটি যদি এমন হয় যে এই পেনাল্টিতে গোল করলেই টাইব্রেকারে আপনার দল জিতে যাবে, সেক্ষেত্রে ৯২ শতাংশ বারই খেলোয়াড়রা হয়েছেন সফল। অথচ পুরো ব্যাপারটি যখন উল্টো হয়ে যায়, তখন অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। অর্থাৎ বিষয়টি যদি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে আপনি গোল না করলে দল হেরে যাবে, সেখানে শতাংশের হার কমে দাড়ায় ৬২ শতাংশে। এ থেকেই স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, খেলোয়াড়দের স্নায়ুচাপ ধরে রাখার ব্যাপারটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
তবে নার্ভকে জয় করতে পারলেই যে আপনি শতভাগ নিশ্চয়তায় গোল করতে পারবেন, তা-ও কিন্তু নয়। পারফেক্ট পেনাল্টি নেওয়ার ধরনও এখন বাতলে দিয়েছেন গবেষকরা। তো কেমন সেই পারফেক্ট পেনাল্টি?
সাইকোলজিস্ট জিয়ার জরডেটের মতে, প্রথম ধাপটা হচ্ছে পেনাল্টি নেওয়ার আগে কখনোই পিছনে না ফেরা। তাতে করে আপনার দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, শট নেওয়ার আগে বেশিক্ষণ ধরে গোলকিপারকে লক্ষ্য করাও ঠিক নয়। পেনাল্টি টেকারের মূল লক্ষ্য হবে সে কোথায় পেনাল্টি শটটি মারতে যাচ্ছে। আর পেনাল্টি নেওয়ার সময় দ্রুতই শটটি নেওয়া হবে ভুলের শামিল। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে রেফারির হুইসেলের সাথে সাথে পেনাল্টি নেওয়ার সাফল্যের হার মাত্র ৫৭%। অথচ একটু লম্বা দম নিয়ে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মারা পেনাল্টির সাফল্যের হার ৮০%।
তবে পেনাল্টি নেওয়ার আগে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কোথায় পেনাল্টি নেওয়াটা সবচেয়ে সুবিধাজনক। যারা ফুটবল নিয়ে এক-আধটু জানেন, তারাও এক বাক্যে বলবেন যে টপ কর্নারই সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান। আদতেও তাই। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠও আছে। টপ কর্নার লক্ষ্য করতে যেয়ে একটু উনিশ-বিশ হলেই কিন্তু বল গোলবারের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও ফেলনা নয়। বাস্তব উদাহরণ স্বয়ং লিওনেল মেসির কোপা আমেরিকা ফাইনালের পেনাল্টি। তবে ঠিকঠাকমতো লক্ষ্যে রাখতে পারলে গোলকিপারদের টপ কর্নারের পেনাল্টি আটকে দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ইংল্যান্ড বনাম জার্মানি ১৯৯৬ ইউরোর সেমিফাইনালের কথাই ধরা যাক। সেদিন ১১টি পেনাল্টির ১০টিই ছিল টপ কর্নারে। আর বাকি একটিই আটকে দিয়েছিলেন গোলরক্ষক। আর সেই হতভাগ্য পেনাল্টি টেকার ছিলেন গ্যারেথ সাউথগেট। কারণ? তিনি শটটি মেরেছিলেন নিচু করে।
তবে আরেকটি প্রশ্নও চলে আসে সে সাথে। টপ কর্নার তো বোঝা গেল। কিন্তু কোন দিকের টপ কর্নার? বামে নাকি ডানে? গবেষকরা এই বিষয়ে বলেছেন, ৬১.৫% পেনাল্টি টেকার তার স্ট্রং ফুটের দিকেই পেনাল্টি নিয়ে থাকেন। আরো স্পষ্ট তথ্য দিতে চাইলে শতকরা ৫৯ শতাংশ পেনাল্টি নেওয়া হয় ডানদিকে। স্বভাবতই বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরই স্ট্রং ফুট সাধারণত ডান পা।
তবে পেনাল্টি লক্ষ্যভেদ হলেই কিন্তু আপনার কাজ শেষ নয়। উদযাপনও একটি মাইন্ড গেমের অংশ। ইউরো ও বিশ্বকাপের ১৫১টি টাইব্রেকার গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে, লক্ষ্যভেদ করার পর উদযাপন আপনার প্রতিপক্ষকে আরেকটু বেশি চাপে ফেলে দেয়।
তবে মজার ব্যাপার হলো, পেনাল্টি মিসে গোলকিপারদের আরো একটি মাইন্ড গেম রয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও বিষয়টি হচ্ছে গোলকিপারদের জার্সির রং। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, লাল রংয়ের জার্সি পরা গোলকিপারদের বিপক্ষে পেনাল্টি সাফল্যের হার মাত্র ৫৪%। আর জার্সির রং হলুদ হলে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯%। তবে সবচেয়ে বেশি সাফল্যের হার হচ্ছে নীল আর সবুজ জার্সির বিপক্ষে। যেখানে নীলের বিপক্ষে সাফল্যের শতকরা হার ৭২%, সবুজের বেলায় সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশে। তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায়, গোলকিপারদের গায়ের জার্সির রংও খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়।
৪.
শুরুর কাহিনীতে আসা যাক। এমিলিয়ানো মার্টিনেজের মতো কথা দিয়েই আপনি প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করে ফেলতে পারবেন, ব্যাপারটি এতটা সহজ ও নয়। ২০১২ ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে টাইব্রেকার আগে চিৎকার চেচামেচি করে প্রতিপক্ষকে স্নায়ুচাপে ভুগাতে চেয়েছিলেন জো হার্ট। কিন্তু হলো উল্টোটা। বরং পিরলো জো হার্টকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে নিলেন বিখ্যাত পানেনকা শট। তাই মাইন্ড গেমে গোলকিপারদের সুবিধা থাকলেও ‘কুল-হেডেড’ খেলোয়াড়দের বিপক্ষে সবসময়ই জেতাটা দুষ্কর।
তবে বর্তমানের চিত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে যে আধুনিক ফুটবলে পেনাল্টি মিস বেড়েছে বেশ। এই গত ইউরোর কথাই ধরুন না। টাইব্রেকার বাদে পেনাল্টি হয়েছে ১৭টি, তার মধ্যে মিস হয়েছে ৮টিই। অবশ্য মিস বললে গোলকিপারদের উপেক্ষাই করা হয়। মূলত গোলকিপারই ঠেকিয়ে দিয়েছেন ৭টি।
এবার প্রিমিয়ার লিগের দিকেই তাকানো যাক। বিগত তিন মৌসুমে যথাক্রমে পেনাল্টি নেওয়ার সংখ্যা ৯২, ১০৩, ও ৮০টি। সেখানে পেনাল্টি সেভের সংখ্যা যথাক্রমে ১৩, ১৬ ও ২১টি। শতকরার হিসেবে ১৪.১%, ১৫.৫% ও ২৬.৩%। অথচ প্রিমিয়ার লিগের শুরুর দিককার চিত্রে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে পেনাল্টি সেভের শতকরা হার ছিলো মোটে ৩.৩%। আর পরের দুই মৌসুমে যথাক্রমে ২.৪% ও ০%। অল্প সময়ের ব্যবধানে এত বিস্তর ফারাক কেন?
এ বিষয়ে একটু ধারণা দিয়েছিলেন কিংবদন্তী গোলরক্ষক পিটার স্মাইকেল।
“আমাদের সময় পেনাল্টি ছিল শুধুই একটি লটারির মতো। কে পেনাল্টি নিতে আসছে, তা নিয়ে আমাদের কখনোই মাথা ব্যথা ছিল না। বরং আমরা পেনাল্টি নেওয়ার জন্য কেউ আসার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতাম, আমি লেফট নাকি রাইটে ঝাঁপ দিব। কিন্তু বর্তমানে প্রতিটি পেনাল্টি টেকারের মুভ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আর আলোচনা হয়। তাতে করে তাদের দুর্বলতাও বের হয়ে আসে।”
তবে বর্তমানের আরেক বিখ্যাত পেনাল্টি আটকে দেওয়া গোলরক্ষক দিয়েগো আলভেসের কাছে পেনাল্টি বর্তমানে ট্যাকটিক্সের চেয়ে মাইন্ড গেমের মধ্যেই পড়ে বেশি। ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৫০ পেনাল্টির মুখোমুখি হয়ে ২৪টিই আটকে দিয়েছেন আলভেস, আর গোল খেয়েছেন ২৪টিতে; বাকি দু’টি ছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট। নিজের মাইন্ডগেম খেলার ব্যাপারে আলভেস মনে করিয়ে দিয়েছেন বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এপিকটেটাসের কথা,
“যে আপনাকে রাগান্বিত করতে সক্ষম হবে, সে আপনাকে বশে আনতেও সক্ষম হবে।”
আলভেসের কথা মেনে নিয়ে যদি মাইন্ডগেমই মূল ক্যারিশমা হয়ে থাকে, তাহলে তো সব গোলকিপারদের একই কাজ করা উচিৎ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সবাই এই ডার্ক আর্টসে পারদর্শী নন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ডাচ গোলকিপার জেসপার সিলেসেনের কথাই। ডাচদের প্রধান গোলকিপার হলেও ক্যারিয়ারে কোনো পেনাল্টি সেইভ নেই এই কিপারের। উল্টো ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে কোস্টারিকা বধে নায়ক হয়ে উঠা টিম ক্রালকে একেবারে শেষের দিকে সিলেসেনের সাথে বদলি করিয়েছিলেন ভ্যান হাল। দীর্ঘদেহি টিম ক্রাল যে ভালো করবেন, ভ্যান হাল তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। আর সেটি যে মোটেও ফাটকা ছিল না, সেটা তো বলাই বাহুল্য।
৫.
জেন্স লেহম্যানের কাহিনীতে যাওয়া যাক। সেই ম্যাচের এই ‘কাগজ-কাণ্ড’র পর রিকেলমে বলেছিলেন অন্য কথা। তার মতে, লেহ্যমানের কাগজে নাকি কিছুই লিখা ছিল না। বরং কাগজ বের করে খানিকটা সময় নষ্ট আর প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়ার জন্যই এই কাজটি করেছেন লেহম্যান। সেটি সত্যিও হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। তাতে তো আর ফলাফল পরিবর্তন হবে না। বরং লেহম্যানের জন্য ব্যাপারটি আরো দারুণ একটা কৃতিত্বই হবে বৈকি।
বর্তমানে পেনাল্টির জন্য আপনি চোখ বন্ধ করেই মেসি-রোনালদোর উপর ভরসা করতে পারেন। লেওয়ান্ডস্কি অথবা হ্যারি কেইনরাও থাকবেন এই তালিকায়। তবে তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা পেনাল্টি টেকারের নাম নেওয়া হলে সর্বপ্রথমে আসবে ম্যাথিউ লি টিসিয়ারের নাম। এই সাউদাম্পটন কিংবদন্তি ক্যারিয়ারে ৪৯টি পেনাল্টি নিয়ে গোল করেছেন ৪৮টিতেই। লি টিসিয়ারের মতে, স্নায়ুচাপের চেয়ে বড় বিষয় অনুশীলন। তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিনই ট্রেইনিং শেষে ইয়ুথ এক গোলকিপার দাঁড় করিয়ে পেনাল্টি অনুশীলন করতেন তিনি। মূলত সেই গোলকিপারের সাথে বাজি লাগতেন। প্রতি পেনাল্টি সেভের বিনিময়ে কিছু ডলার দিতেন তাকে। স্বভাবতই নিজেও টাকা হারাতে চাইতেন না বলে সেই স্নায়ুচাপ পরিস্থিতি তৈরি করেই চাপ জয় করতে শিখেছেন তিনি।
৬.
দিনশেষে বলা যায়, আপনি যতই তথ্যউপাত্ত ঘেটে থাকেন না কেন, সবশেষে পেনাল্টিতে স্নায়ুচাপই হয়ে ওঠে এভারেস্ট-সমান। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের টাইব্রেকারের একটি ঘটনা বলা যাক। ইংল্যান্ড বনাম পর্তুগাল সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি। টাইব্রেকারে নাম ছিল জেমি ক্যারাঘারের। অথচ তিনি মাঠেই নেমেছিলেন ১১৮ মিনিটে। একবারও বল পায়ে স্পর্শ না করে পেনাল্টি শ্যুটআউটে গিয়েছিলেন জেমি। প্রথমে গোল করলেও রেফারি হুইসেল বাজানোর আগেই শট নেওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো তাকে শট নিতে দেওয়া হয়। ঠিক সেই সময়টাতে দ্বিধায় পড়ে যান ক্যারাঘার। তার মনে হতে থাকে, গোলকিপার তো প্রথমবারের পর এখন বুঝে যাচ্ছে আমি কোনদিকে শটটি নিতে পারি। এরকম দোলাচালে দাঁড়িয়ে তিনি ঠিক করলেন, এবার প্রথমবার যেদিকে শট নিয়েছিলেন, তা না নিয়ে অন্য দিকেই মারবেন। বিধি বাম, শটটি ঠেকিয়ে দেন প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক। আর তাতেই ইংল্যান্ডের বিদায়ঘণ্টাও বাজে। ক্যারাঘার বলেছেন, সেই স্মৃতি এখনো তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন সাউথগেট আর ব্যাজিও। প্রতি ইউরোর আসর বসলেই সাউথগেটের মনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পারে ‘৯৬ ইউরোর সেমিফাইনাল, তেমনটাই তো জানিয়েছেন তিনি। আর ব্যাজিও বলেছেন, আজীবন তাকে তাড়া করে বেড়াবে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে সেই টাইব্রেকার মিসটি, যার জন্য ইতালির ‘নায়ক’ থেকে কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তিনি হয়ে ওঠেন ‘ট্রাজিক হিরো’।
পেনাল্টি তবে আর সহজ কিছু রইলো কই! এ তো সাক্ষাৎ ‘ডার্ক আর্টস’ই বটে। কাউকে ভাসায় বিজয়ের স্বর্গসুখে, কাউকে ডুবায় আজীবন হতাশার যন্ত্রণায়!