‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়। বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে-অকারণে বদলায়।’
এ কথা বলে গিয়েছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। বাক্যের সেই সত্যতা প্রতি মুহূর্তে মেলে। প্রতি পদক্ষেপে মেলে। ইতিহাসের কালো পাতাতেও মেলে। ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বার মৃত্যুর ২০ বছর পর আরও একবার মিলে গেছে। বাংলাদেশে খেলতে এসে বলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছিলো রমনের। তিনি ওপারে পচে গেছেন কিনা তা জানা অসাধ্য। কিন্তু আমরা বদলে গেছি। রমনের ক্ষেত্রে বলা যায়, অকারণেই বদলে গেছি। রমনকে মনে রাখার কোনো কারণ বাংলাদেশ এখনও খুঁজে পায়নি। এ কি লজ্জার, নাকি নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলা তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবে। কারণ, যে আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলতে গিয়ে মাত্র ৩৮ বছরে চলে গিয়েছিলেন দুনিয়ার ওপারে, দেশের শীর্ষস্থানীয় সেই ক্লাবেও নেই রমনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। অথচ বাংলাদেশ ছাড়াও সূদুর আয়ারল্যান্ডের যে বেলফাস্ট ক্লাবে দীর্ঘদিন খেলেছেন, সেখানে অন্তত তার একটা ছবি ঝোলানো আছে। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের তৎকালীন ক্রিকেটার, কর্মকর্তা আর হাজারো সমর্থকেরা ভোলেনি রমনকে। কে জানে, বাংলাদেশের ধসে পড়া ক্লাব ক্রিকেটের বুড়ো সমর্থকগুলো বোধ হয় এখনও খুঁজে ফেরে কোকড়া চুলের সদা হাস্যোজ্বল রমনকে।
১.
দিল্লীর ছেলে রমন ১৯৮৬ সালে ভারত জাতীয় দলে অভিষেক করেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি খেলেছেন ৪টি টেস্ট আর ৩২টি ওয়ানডে। যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান সাদা পোশাকের টেস্টে ১০২ রান তোলেন। সর্বোচ্চ ৫৩ রানের স্কোর ছিলো তার। ওয়ানডেতে একটি সেঞ্চুরি আর ছয়টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৭৮৩ রান করেছেন। ’৮৯ এর পর থেকে জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি তার। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের নাম অমর করে গেছেন। আয়ারল্যান্ডে খেলেছেন বড় একটা সময়। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট তো ছিলোই, সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজেকে বানিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বলা হয়, ঢাকাই ক্রিকেটে তিনিই প্রথম বিদেশি মহাতারকা। শুরু করেছিলেন ধানমণ্ডি পাড়ার আবাহনী লিমিটেড দিয়ে। এরপর ব্রাদার্স ইউনিয়ন, জিমসিসি ক্লাব ঘুরে আবারও আবাহনীতে। এখানেই অকাল প্রয়াণ।
ঢাকায় রমনের ক্যারিয়ারটা টিকেছে মোটে ৭ বছরের মতো। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে শুরু, ১৯৯৮ সালে মাঠ থেকেই শেষ। অভিষেক মৌসুমে আবাহনীর হয়ে ম্যাচ অব দ্য সিরিজের পুরস্কার জিতেছিলেন রমন লাম্বা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার।
রমনের মৃত্যুটা হয়তো এখনও তাড়িয়ে ফেরে সে সময়ে তার সতীর্থদের। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। শর্টে ফিল্ডিং করছিলেন রমন। ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন অপি। হেলমেট নিয়েছিলেন না লাম্বা। সতীর্থ উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট সেটা বলতেই, লাম্বা বলেছিলেন, ‘আরে ইয়ার, জাস্ট থ্রি বল’। হ্যাঁ, ওভারের আর তিন বল বাকি ছিলো। তাতেই কাল হলো। শেষ বলে অপির করা টানা শট গিয়ে লাগলো রমনের কানের বাঁ পাশে। সেখান থেকে হাওয়ায় ভেসে বল তালুবন্দী করলেন পাইলট। আউট হলেন অপি। আর রমন? উদযাপনের আতিশয্যে তার দিকে খেয়াল করতে বড় দেরি হয়ে গিয়েছিলো। উইকেটের একপাশে পড়ে ছিলেন। পরে পাইলট ব্যাপারটা খেয়াল করলে তড়িঘড়ি করে তাকে মাঠের বাইরে নেওয়া হয়। যাওয়ার আগেও ঠোঁটে সেই হাসিটা ঝোলানো ছিলোই। মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে গিয়ে বমি করলেন। তারপর হাসপাতালের পথেই অচেতন হয়ে কোমায় চলে গেলেন। ওই যে বের হলেন, জীবিত অবস্থায় আর ফেরা হয়নি লাম্বার। তবে ফিরেছিলেন তিনি। ঢাকাই ক্রিকেটে নিজের ক্লাব আবাহনীর মাঠে ফিরেছিলো কফিনে বন্দী তার নিথর দেহ। ২০ তারিখে মাঠ ছাড়লেন, ২৩ তারিখ চলে গেলেন ওপারে। আর কাঁদিয়ে গেলেন হাজারো সমর্থক, পরিবার, সতীর্থদের।
২.
আহত হওয়ার পর যখন তাকে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে রাখা হয়েছিলো, সঙ্গে ছিলেন তার আইরিশ স্ত্রী কিম লাম্বা। মেনে নিতে পারেননি রমনের এই অবস্থা। বাংলাদেশের প্রতি তার ক্ষোভ আছে। না, এ দেশ থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে নয়। কে জানে, হয়তো তার অভিযোগ রমনকে আরও আগেভাগে চিকিৎসা করানো হলে হয়তো বেঁচে যেতেন তিনি!
তবে রমনের অমন অকাল মৃত্যু বোধ হয় সবচেয়ে তাড়িয়ে ফেরে মেহরাব হোসেন অপিকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের ভাগ্যে রমন লিখে দিয়ে গেছেন কালো অধ্যায়। কারণ, তার নেওয়া শটের আঘাতেই মৃত্যু হয়েছিলো রমনের। সে কথা মনে করে অপি বলেছেন, ‘আমি ওই ঘটনার পর অনেকদিন ঘুমোতে পারিনি। আমার নিজের কাছে খুব অপরাধী মনে হতো। যদিও এটা একটা দূর্ঘটনা ছিলো।’
এ তো গেলো নিজের সঙ্গে অপির অপরাধ বোধ। চারপাশের মানুষও বারবার তাকে রমনের কথা মনে করিয়ে দিতো। যেন দোষ অপির। এগুলো আরও বেশি কষ্ট দিতো তাকে, ‘মানুষ এখনও তাকে নিয়ে আমার সাথে আলাপ করে। যখনই আমাকে কারো কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে, একটু পরই রমনের মৃত্যুর বিষয় চলে আসে।’
উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদও অপরাধ বোধে ভোগেন রমনের ওই ঘটনার পর। আফসোস করেন, তিনি যদি আরেকটু জোরাজুরি করতেন রমনকে হেলমেট নেওয়ার জন্য! তাহলে হয়তো দূর্ভাগ্য এভাবে হাতে ধরা দিতো না। রমনের ব্যাপারে এক সাক্ষাতকারে পাইলট বলেছেন, ‘মাত্র তিন বলের ব্যাপার ছিলো। তাই সে (রমন) হেলমেট নিতে চায়নি। সত্যি বলতে তখন আমিও ওকে খুব বেশি জোরাজুরি করিনি হেলমেটের জন্য।’
৩.
২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০ বছর হয়েছে রমনের প্রয়াণের। ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা ক্রিকেটার আজ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করতেন। হয়তো তাকে নিয়েও চলতো আলোচনা। এখনও চলছে যদিও। কিন্তু সেটাই বা কতটা? ২০ বছরে তার জন্য কি করতে পেরেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট? নিছক স্মৃতি রাখার জন্যও কিছু নেই। এমনকি যে আবাহনীর হয়ে খেলতে এসে জীবন হারিয়েছিলেন, সেই ক্লাবও তাকে মনে রাখেনি।
ক্লাবের কর্মকর্তা জালাল ইউনুস (বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান) স্বীকার করেছেন রমনের স্মৃতি রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ তারা নেননি। তবে আশা, ক্লাবের নতুন ভবন হলে নাকি রমনের একটি ছবি রাখা হবে। একই সঙ্গে আনার চেষ্টা করা হবে তার পরিবারকে।
যে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট ক্লাবের হয়ে খেলতেন রমন, তারা ভোলেনি দিল্লীর ছেলেকে। সেখানেই স্ত্রী কিমের সঙ্গে তার পরিচয়, তারপর পরিণয়। রমন মৃত্যুবরণ করার পর বেলফাস্ট ক্রিকেট ক্লাবে তার বড় একটা ছবি রাখা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ক্লাবের ইতিহাসে রমনের জন্য একটি অধ্যায়ও রাখা হয়েছে। অন্তত তাকে কিছুটা হলেও সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিদেশ বিভূঁইয়ের দেশটি।
আর বাংলাদেশ? খাতা-কলমে তাকে অগ্রাহ্য করা হলেও, তিনি আছেন সমর্থকদের অন্তরে। এখনও আবাহনী; এমনকি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বুড়ো সমর্থকদের কাছে তিনি যেন গল্পের কাণ্ডারি। বেঁচে থাকলে আজ হয়তো তার হাতে আরও বেশি সমৃদ্ধ হতো বাংলাদেশের ক্লাব ক্রিকেট।
দুঃখও পেতেন, যখন জানতে পারতেন এই ২০ বছর পর ঢাকাই ক্রিকেটের দুর্দশার কথা।
ফিচার ইমেজ- Cricinfo