বাইশ গজেই জীবনের অর্ধেক
জন্মটা যদি শ্রীলংকায় না হয়ে অন্য কোনো দেশে হতো, তাহলে বোধ হয় ভালো হতো। আবার তা না হয়ে যদি মুরালিধরন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার না হয়ে অন্য দেশের ক্রিকেটার হতেন! এই দুটি ‘যদি’র মধ্যে একটি ‘যদি’ও যদি ঘটত, তাহলে শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরন, অনিল কুম্বলের সাথে রঙ্গনা হেরাথ নামটিও উচ্চারিত হতো!
২১ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ডি সিলভা, মারভান আতাপাত্তু, রাসেল আর্নল্ডদের সাথে। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে খেলেছেন থিসারা পেরেরা, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস, দিনেশ চান্দিমালদের সাথে। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন ক্রিকেটের বাইশ গজে।
ক্যারিয়ারের প্রারম্ভে লম্বা সময় থেকেছেন দলের বাইরে। কেননা ওই দলে একজন মুরালিধরন ছিলেন। দলে দুজনের ভূমিকা ছিল প্রায় একই রকম। মুরালি ডান হাতি অফ ব্রেক বোলার, অন্যদিকে হেরাথ ছিলেন বাম হাতি অর্থোডক্স বোলার। মুরালিধরন লঙ্কান ক্রিকেটের বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়েছিলেন। নিজের ভাগ্যকে দুষতেই পারেন হেরাথ, বড্ড ‘অসময়ে’ যে ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল তার!
মুরালি-ছায়ায় ঢাকা তারকা
সাদা পোশাকের একজন কার্যকরী বোলাররের নাম রঙ্গনা হেরাথ। শুরুটা গলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৯ সালে। কিংবদন্তি রিকি পন্টিংকে দিয়ে উইকেটের খাতা খুলেছিলেন হেরাথ। পরে একে একে ফিরিয়েছিলেন শেন ওয়ার্ন, ডেমিয়েন ফ্লেমিং এবং স্টিভ ওয়াহ্কে।
ড্র হওয়া সেই গল টেস্টে এক ইনিংসেই চার উইকেট নিয়েছিলেন হেরাথ। আশাজাগানিয়া শুরুর পরও মুরালির ছায়ায় ছিলেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে। ক্যারিয়ারের প্রথম নয় বছরে খেলেছেন মাত্র চৌদ্দ টেস্ট। ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সাদা পোশাকে একটি ম্যাচও খেলার সৌভাগ্য হয়নি হেরাথের।
মুরালি তখন লঙ্কান স্কোয়াডের অটো চয়েজ। ওদিকে ক্রিকেটের বাইরে ব্যক্তিজীবনে রঙ্গনা হেরাথের ছিল আরেকটি পরিচয়- ব্যাংকার। খেলার বাইরে থাকার সময় ব্যাংকের চাকরিটাই ছিল হেরাথের ‘অন্ধের যষ্টি’। ২০০০ সাল থেকে কলম্বোর সম্পথ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন তিনি।
গল টেস্ট দিয়ে রাজসিক প্রত্যাবর্তন
২০০৯ সালে গলে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান টেস্ট। মুরালিধরন তখনও লঙ্কান ক্রিকেটের প্রতিটি গেমপ্ল্যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সেই মুরালিই ছিটকে গেলেন ইনজুরির জন্য। আর এদিকে মুরালির চোটই যেন আর্শীবাদ হয়ে ধরা দিল হেরাথের ক্যারিয়ারে।
‘রাঙ্গা’ তখন ইংলিশ মুলুকে লিগ খেলছেন। সে সময়ের লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা আর কোচ চণ্ডিকার আস্থাভাজন হেরাথের শরণাপন্ন হলেন লঙ্কান বোর্ড। হেরাথও তাতে সাড়া দিলেন সাত পাঁচ না ভেবেই। অপ্রত্যাশিতভাবে দলে সুযোগ পেয়ে গেলেন।
ইংল্যান্ড থেকে উড়িয়ে আনা হলো হেরাথকে। একে তো অনেকদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে, দ্বিতীয়ত দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি তখনও কাটেনি। এই টেস্টে নিজেকে প্রমাণ করতে না পারলে হয়ত চিরতরেই হারিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে- সেই ভাবনাও তখন প্রবল তার নিজের মধ্যে! ওদিকে ৩১ বছর বয়সী হেরাথের ফিটনেসে এতদিনে পড়ে গেছে বয়সের ছাপ, চুলেও ধরে গেছে পাক।
ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে হেরাথ যেন আবার প্রথম থেকে সব শুরু করলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে গল টেস্ট দিয়ে রাজসিক প্রত্যাবর্তন। যেন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন!
প্রথম ইনিংসে মিসবাহ-ইউসুফের ব্যাটে চড়ে পাকিস্তান বড় সংগ্রহের পথে। তখন তাদের থামাতে একটা ব্রেক-থ্রু দরকার ছিল। সেই কাজের কাজটাই করলেন হেরাথ। মিসবাহকে জয়াবর্ধনের হাতে ক্যাচ বানিয়ে সাড়ে তিনশর আগেই পাকিস্তানকে আটকে দেন তিনি।
দ্বিতীয় ইনিংসে হেরাথের মায়াবী স্পিন বিষে নীল পুরো পাকিস্তান শিবির। মাত্র ১১৭ রানে গুটিয়ে যায় ইউনিস খানের দল। দুই ইনিংস মিলে ৫ উইকেট নিয়ে গল টেস্টে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন রঙ্গনা হেরাথ।
গল্পটা বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর
গল টেস্টের পর ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যায় হেরাথের ক্যারিয়ার। পি সারা ওভালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ও নেন পাঁচ উইকেট। তৃতীয় টেস্টে আবারো পাঁচ উইকেট। পাকিস্তান সিরিজে তিন টেস্ট মিলে হেরাথের শিকার ১৫ উইকেট।
অভিষেকের পর থেকে ২০০৯ সালের আগপর্যন্ত হেরাথের উইকেট-সংখ্যা শুনলে আপনার পিলে চমকে উঠবে। ১৯৯৯-২০০৯, এই দশ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে উইকেট সংখ্যা মাত্র ৩৬! এ তো দেখলেন মুদ্রার কেবল একটি পিঠ। মুদ্রার আরেক পিঠ হলো, এই দশ বছরে হেরাথ খেলেছেন মাত্র ১৪ টেস্ট! তবে এখানেই থেমে যাননি।
পরের গল্পটা বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর; পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সাফল্যের চূড়ায় ওঠার গল্প। খর্বাকৃতির হেরাথের অতি সাধারণ মায়াবী হাসির মতো বোলিং স্টাইলটাও ছিল খুব সাধারণ। বোলিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে সময় নিতেন না। তড়িঘড়ি করে বল নিয়ে এসে অতি সাধারণ ভঙ্গিমায় বল ফেলতেন পিচের অর্ধেকের পর।
এভাবেই ক্রমাগত একই লাইন ও লেন্থ মেইনটেইন করে স্পেলের পর স্পেল বল করে যেতেন। তার বোলিং এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যাটসম্যানরা তার বলে সামনে ঝুঁকতে বাধ্য হতেন। বাধ্য করেই ছাড়তেন হেরাথ! এরপরেই ঘটত আসল বিপত্তি।
ব্যাটসম্যান যখন ফ্রন্টফুটে রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে খেলতে যেতেন, তখনই বলের লাইন মিস করতেন। ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বল গিয়ে লাগত স্টাম্পে- ক্লিন বোল্ড! নয়ত আচমকা ফুল লেন্থের বল গিয়ে লাগত প্যাডে। সঙ্গে সঙ্গে আবেদন; আর তারপরই আম্পায়ার আঙুল তুলে ব্যাটসম্যানকে জানিয়ে দিতেন তুমি আউট।
মাঝেমাঝে ভয়ঙ্কর আর্মারও ছাড়তেন, সেটিও ব্যাটসম্যানদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াত। যেকোনো উইকেটে ইচ্ছামতো টার্ন করানোও ছিল তার অন্যতম প্রধান অস্ত্র।
বিশ্বকাপজয়ী হেরাথ
সাদা পোশাকের কথা তো অনেক হলো। এবার সাদা বলের ভেল্কির একটা নমুনা দেখানো যাক। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা। কোয়ার্টার ফাইনালে শ্রীলঙ্কার প্রতিপক্ষ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নিউজিল্যান্ড। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের মরুভূমির মতো উইকেটে প্রথম ব্যাট করে লঙ্কানদের সংগ্রহ মাত্র ১১৯ রান। এর আগে চারটা মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা দল এই শ্রীলঙ্কা। তবে কি আরো একবার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ছিটকে যাবে?
না, সেটি হতে দেননি একজন রঙ্গনা হেরাথ। একাই ছারখার করে দিয়েছিলেন কিউইদের! মাত্র ৩.৩ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। গাপটিল, ম্যাককালামদের বিপক্ষে সেদিন এক হাতে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন হেরাথ। বিধ্বংসী এক স্পেলে মূহুর্তের মধ্যে কিউইদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে ক্যারিয়ারের শেষটা আরো ভালো হতে পারত। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে হেরেছিল তার দল। হেরাথ নিয়েছিলেন তিন উইকেট। তবে এতটুকু ভেবে সান্ত্বনা পেতেই পারেন, ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি শিরোপাজয়ী দলে তিনিও যে ছিলেন! বহু-প্রতীক্ষিত বিশ্বকাপ তো কিংবদন্তি মুরালিধরনেরও ছোঁবার সৌভাগ্য হয়নি!
পরিসংখ্যানে রঙ্গনা হেরাথ
• ৯৩ টেস্টে ৪৩৩ উইকেট, ওয়ানডেতে ৭১ ম্যাচে ৭৪ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে ১৭ ম্যাচে ১৮ উইকেট।
• মুরালি থাকাকালীন সময়ে ২০ ম্যাচে ৩৭ গড়ে ৭১ উইকেট নেওয়া হেরাথ, মুরালি যাওয়ার পরে প্রায় ২৬ গড়ে ৭০ ম্যাচে নিয়েছেন ৩৫৯ উইকেট।
• বাঁহাতি বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেট শিকারি, স্পিনারদের মধ্যে চতুর্থ।
• চতুর্থ ইনিংসে মুরালি, ওয়ার্ন পাঁচ উইকেট নিয়েছে সাতবার করে আর হেরাথ নিয়েছে ১২ বার। এতেই বোঝা যায় ম্যাচ জেতানোতে তার কার্যকারিতা।
• ৯৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে ইনিংসে চার উইকেট নিয়েছেন ২০ বার, পাঁচ উইকেট ৩০ বার। আর ম্যাচে ১০ উইকেট ৯ বার। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ৯/১২৭।
• সাকিব, মুরালি, স্টেইন আর হেরাথের রয়েছে সব টেস্ট খেলুড়ে (আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান ছাড়া) প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।
পরিসংখ্যান যেমন নিছকই সংখ্যা, বয়সও তার কাছে ছিল কেবলই গাণিতিক প্রতীকের দুটি চিহ্ন মাত্র! বয়সের ভারে নুয়ে যাননি, বরং তার বয়সের সাথে সাথে মায়াবী স্পিনে মুগ্ধ হয়েছেন ক্রিকেট দুনিয়া। ফিল্ডার হেরাথও কম যান না। রঙিন পোশাকে ৩৮-৪০ বছর বয়সী হেরাথ বাউন্ডারি লাইনে দাড়িয়ে শরীরকে শূন্যে ভাসিয়ে যে ক্যাচগুলো ধরতেন, তা ছিল চোখের প্রশান্তি! সেই ক্যাচগুলো প্রায়ই ম্যাচের গতিপথ ঘুরিয়ে দিত।
খাটো গড়নের গোলগাল হেরাথের সেই ট্রেডমার্ক মিষ্টি হাসিটার মতোই তার স্পিন ভেল্কি এখনও হয়ত ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দাগ কাটে। পুরাতন ওয়াইনের স্বাদ যেমন একটু বেশি, তেমনি বুড়ো হেরাথের বোলিং ধারটাও ক্যারিয়ারের গোধূলি-লগ্নে প্রতিপক্ষকে ভুগিয়েছিল বাড়াবাড়িরকমের। তাই তো তিনি সাধারণেই অসাধারণ!