Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রিয় শট বিসর্জন দেয়া এক মহাকাব্যিক দ্বিশতক

আমার ভাই অজিত আমার সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল যে, আমাকে দুই ইনিংসেই নট আউট থাকতে হবে।

ব্যাট হাতে সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছিল না লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের। ২০০৩-০৪ এর অস্ট্রেলিয়া সফরের চতুর্থ টেস্টের ঘটনা। সিডনি টেস্টের আগে সফরে পাঁচ ইনিংসের একটাতেও পঞ্চাশ পেরোতে পারেননি। ০, ১, ৩৭, ০, ৪৪- এই ছিল তার পাঁচ ইনিংসের স্কোর। ভারত জাতীয় ক্রিকেট দল তাদের অন্যতম সেরা বিদেশ সফরে ছিল, কিন্তু কথা বলছিল না তাদের সেরা ব্যাটসম্যানের ব্যাট।

ম্যাচের আগে কোচ জন রাইট আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কথা বলেন শচীনের সাথে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টনিকটা আসে শচীনের ভাই অজিত টেন্ডুলকারের কাছ থেকে। অজিত শচীনকে বললেন, শচীনকে আসলে বোলাররা আউট কর‍তে পারছে না, বরং তিনি বোলারদের উইকেট দিয়ে আসছেন। তারপর তাকে চ্যালেঞ্জ দেন দুই ইনিংসে নট আউট থাকার। সফরের দুটো ইনিংসে আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখিয়েছিলেন, কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি। বারবার অফ স্টাম্পের বাইরের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে আউট হচ্ছিলেন শচীন, উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিচ্ছিলেন। আগের টেস্টের দুই ইনিংসেই আউট হয়েছিলেন একইভাবে।

ভাই অজিতের সাথে শচীন টেন্ডুলকার।
এক ফ্রেমে দুই ভাই; Image Courtesy: AFP 

রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণের নৈপুণ্যে ইতিমধ্যে অ্যাডিলেইড টেস্টে জয় পেয়েছিল ভারত। কিন্তু মেলবোর্নে ৯ উইকেটে জিতে সিরিজ সমতায় আনে অস্ট্রেলিয়া। ৪র্থ টেস্ট তাই শচীনের জন্য শেষ সুযোগ ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজের ও ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার।

দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণ করে সিডনিতে আসা ভারতীয় সমর্থকেরা চাতক পাখির মতো আশায় বসে ছিলেন, এবার বোধহয় হাসবে শচীনের ব্যাট। প্রথম দিনে লাঞ্চের মিনিট বিশেক পরে ব্যাটিংয়ে নামেন শচীন। স্কোরবোর্ড বলছে ১২৮ রানে ২ উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা ফর্মের তুঙ্গে, তার উপর একেবারেই ফর্মে নেই শচীন। স্টিভ ওয়াহর শেষ টেস্ট ম্যাচ, তার উপর সিরিজ ১-১ সমতায়। ফলে এই ম্যাচ ছিল অজিদের জন্য মর্যাদার লড়াই। তবে তাদের সামান্যই ধারণা ছিল শচীন কী করতে যাচ্ছেন সেই সম্পর্কে।

প্রথম দিনের দ্বিতীয় সেশনের শুরুতেই ব্যাটিংয়ে নামা শচীন তৃতীয় দিনের শুরুতেও ছিলেন অপরাজিত। তার মতো ব্যাটসম্যানের জন্য অসম্ভব কিছু না, তবে এই ইনিংসটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল অন্য একটা কারণে। পুরো বিশ্ব শচীন টেন্ডুলকারের অফসাইডে খেলা শটের নেশায় বুঁদ ছিল, বিশেষ করে কাভার ড্রাইভের। পেছনের পা, সামনের পা- উভয় পায়ের উপর ভর করে সম্ভবত সময়ের সেরা কাভার ড্রাইভ খেলা ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। কিন্তু এই ইনিংসে নিজের উপর নিজেই ব্যারিকেড লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেই নিজেকে বলেছিলেন, “কাভার ড্রাইভ খেলা যাবে না।” বছরের পর বছর ধরে ঐন্দ্রজালিক কাভার ড্রাইভ খেলা ব্যাটসম্যান কি না দশ ঘন্টা ধরে অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ করার চেষ্টাটাও করলেন না!

কাভার ড্রাইভের জন্য জনপ্রিয় শচীন সে ম্যাচে কাভার ড্রাইভই খেলেননি।
Image Courtesy: Cric Wizz

অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল নিরাপদে উইকেটরক্ষকের হাতে জমা পড়ছিল অনবরত। যখন বল স্ট্যাম্প বরাবর আসছিল, তখন কব্জির মোচড়ে অন সাইডে বা সোজা ব্যাটে খেলছিলেন। এর আগে খুব কমই শচীনকে স্কয়ার লেগ আর মিড অনের মাঝখানে এত শট খেলতে দেখা গিয়েছিলো। নিয়মানুবর্তিতার চরম পরাকাষ্ঠার পরিচয় দিয়ে নিরন্তর নিজের প্রিয় শট এড়িয়ে চলছিলেন লিটল মাস্টার।

অস্ট্রেলিয়াকে পেলে জ্বলে ওঠা ভিভিএস লক্ষ্মণ ছিলেন তার সেরা ফর্মে। সৌন্দর্যের বিচারে তার সঙ্গে জুটিবদ্ধ শচীনকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অন্যপ্রান্তে শচীন ছিলেন অবিচল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাইশ গজে তার ব্যাটিং যত কুৎসিতই লাগুক না কেন, পণ করে নেমেছিলেন উইকেট কোনোভাবেই দিয়ে আসবেন না লিটল মাস্টার। অজি বোলার-ফিল্ডাররা ঠাট্টাও করতে শুরু করেছিল, কিন্তু শচীনের একাগ্রতা আর মনোযোগে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেননি তারা।

ম্যাচ শুরুর আগের রাতে শচীন, তার স্ত্রী অঞ্জলি, অঞ্জলির বাবা-মা এবং শচীনের ছেলে-মেয়ে, সবাই এক মালয়েশিয়ান রেস্তোরাঁতে খেতে গিয়েছিলেন। ম্যাচের দিন তার পরিবার ভারতে ফিরে গিয়েছিল। প্রথম দিনে শচীন অপরাজিত ছিলেন ৭৩ রানে। ভাবলেন, “এই রেস্তোরাঁতে খেয়েই তো রান পেলাম!” যে-ই ভাবা সেই কাজ। প্রথম দিনের খেলা শেষে আবারো গেলেন একই রেস্তোরাঁয়। বসলেন একই টেবিলে। খেলেন একই খাবার। পরেরদিনও অজি বোলাররা আউট করতে পারেননি শচীনকে। ২২০ রানে অপরাজিত ছিলেন লিটল মাস্টার। প্রথা না ভেঙে আবারো একই রেস্তোরাঁয় গিয়ে একই টেবিলে বসে একই খাবার খান।

১৬ চারে শতক পুরো করেছিলেন শচীন, দ্বি-শতক পূরণ করার পথে মারেন ২৯টি বাউন্ডারি। ভিভিএস লক্ষ্মণের সাথে ৩৫৩ রানের অসাধারণ জুটি গড়েন তিনি। লক্ষ্মণ আউট হওয়ার পর আরো দুটো উইকেট পড়ে। কিন্তু একপ্রান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শচীন। বারবার স্মরণ করছিলেন ভাই অজিতের দেয়া চ্যালেঞ্জ।

প্রথম ইনিংসে ২৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন শচীন।
Image Courtesy: Hamish Blair/Getty Images

শচীনের অপরাজিত ২৪১ রানের ইনিংসটি ছিল দক্ষতা, ধৈর্য্য ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতিমূর্তি। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার ছিল, শচীন নিজের দুর্বলতাটা চিহ্নিত করেছিলেন এবং অতি আত্মবিশ্বাসী না হয়ে নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করেছিলেন।

অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ শচীনের এই ইনিংসের প্রশংসা করেছেন। লিখেছেন,

“To me, it was a show of incredible, fortitude, mental strength and discipline.”

শচীন টেন্ডুলকারের এই দ্বিশতক নিয়ে ব্রায়ান লারা বলেছেন,

“This was Sachin’s most disciplined innings.”

উইকেটে যখন আসেন, তখন ভারতের স্কোর ছিল ১২৮ রানে ২ উইকেট। যখন সৌরভ গাঙ্গুলী ইনিংস ঘোষণা করেন, তখনও ক্রিজে ছিলেন শচীন। রান ছিল ৭ উইকেটে ৭০৫। মোকাবেলা করেছিলেন ৪৩৬ বল, ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছেন ৬১৩ মিনিট ধরে।

প্রথম ইনিংসে অপরাজিত ছিলেন। অজিতের দেয়া চ্যালেঞ্জের পুরো হয়েছিল কেবল অর্ধেকটা। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করতে নামার আগেই রাজ্যের চাপ নেমে গেছিলো শচীনের মাথা থেকে। দ্বিতীয় ইনিংসে অনবদ্য ৬০ রানের ইনিংস খেলেন। রাহুল দ্রাবিড় ৯১ রানে আউট হওয়ার পর সৌরভ যখন ইনিংস ঘোষণা করলেন, তখনও শচীন অপরাজিত। চ্যালেঞ্জটা সফলভাবেই উতরে গেলেন লিটল মাস্টার। ম্যাচের আগে সফরে গড় ছিল বিশেরও নিচে। সেই শচীনই কি না সিরিজ শেষ করলেন ৭৬ গড় নিয়ে!

নান্দনিকতার বিচারে হয়তো এটা কোনোভাবেই কারো কোনো তালিকায় আসবে না, কিন্তু স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকারের কাছে এটি তার শ্রেষ্ঠতম ইনিংসগুলোর একটি।

Related Articles