চার বছর পর আবার ফিরে এসেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ক্রিকেটের জন্মভুমি ইংল্যান্ডের মাটিতে এবারের বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে মোট দশটি দেশ। গত ৩০ মে স্বাগতিক ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচটির মধ্য দিয়ে পর্দা ওঠে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ এর। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মাঠে গড়িয়েছে মোট ২৯টি ম্যাচ। প্রথম রাউন্ডের মোট ৪৫টি ম্যাচ শেষে দশটি দল থেকে সেমিফাইনালে যাবে চারটি দল। কোন চারটি দল সেমিফাইনালের দৌঁড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে? কাদের মধ্যে হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচ? এ প্রশ্নগুলির উত্তর জানতে প্রথম রাউন্ডের শেষদিকে এসে এখন চলছে পয়েন্ট টেবিলের হিসাবনিকাশের পালা।
এবারের বিশ্বকাপটি রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রথম রাউন্ডে প্রতিটি দলকে অন্য সকল দলের মুখোমুখি হতে হবে। সে হিসেবে প্রতিটি দলকে নয়টি করে ম্যাচ খেলতে হবে এবার। নয়টি ম্যাচ শেষে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা চারটি দল সেমিফাইনালে চলে যাবে। পয়েন্ট সমান থাকা সাপেক্ষে নেট রানরেটে এগিয়ে থাকা দলটি সেমিফাইনালে যাবে। বাকি ছয়টি দলকে অপেক্ষা করতে হবে আরো চারটি বছর, বিশ্বকাপ ২০২৩ এর জন্যে।
এ তো গেল এবারের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট বাছাইয়ের পদ্ধতি। তা এর মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? সেরা চারের লড়াইয়ে বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? চলুন, এবারে দেখে নেয়া যাক, পয়েন্ট টেবিলে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত কোথায় আছে।
বাংলাদেশ দল এখন পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচ খেলেছে, যার মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২১ রানের জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাত উইকেটের জয়, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৬ রানের হার, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৮ রানের হার, আর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই উইকেটের পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি বেরসিক বৃষ্টির কারণে ভেসে গিয়েছে। দুই জয়, তিন পরাজয় ও একটি পরিত্যক্ত ম্যাচ মিলে বাংলাদেশের মোট পয়েন্ট এখন পাঁচ, নেট রানরেট -০.৪০৭। পয়েন্ট টেবিলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ষষ্ঠ স্থানে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি না। উত্তরটি দেয়া খুবই জটিল। কারণ এখানে একটি নয়, অনেকগুলি সমীকরণ রয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার নির্ণয়ের সমীকরণ নয়, বরং তিন দ্বিগুণে ছয় বা চার দ্বিগুণে আটের সমীকরণ মেলাতে হবে এর উত্তর পেতে হলে।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই রাউন্ড রবিনের ছয়টি ম্যাচ শেষ করেছে। বাংলাদেশের বাকি তিনটি ম্যাচ হবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের বিপক্ষে। বাংলাদেশ যদি এ তিনটি ম্যাচের মাঝে দুইটি, কিংবা তিনটি ম্যাচই হেরে যায়, সেক্ষেত্রে দৃশ্যত বাংলাদেশের পক্ষে সেরা চারে থাকা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশকে ধরতে হবে বাড়ি ফেরার পথ।
এবার মোটামুটিভাবে শক্তিমত্তা ও বিগত ম্যাচগুলিতে পারফরম্যান্সের বিচারে সম্ভাব্য একটি ফলাফলের হিসেব করা যাক৷ ধরে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ যদি বাকি সব কয়টি ম্যাচ জেতে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট হবে ১১। তখন বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত বলা চলে। কিন্তু, দলীয় সক্ষমতা বিচারে যদি বাস্তব একটি দৃশ্য কল্পনা করি?
ধরে নেয়া যাক, বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে হারলো, কিন্তু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিতে গেল। তখন বাংলাদেশের মোট পয়েন্ট দাঁড়াবে ৯ পয়েন্ট। কিন্তু ইতিমধ্যে ১০, ৯, ৮ ও ৭ পয়েন্ট অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড তাদের বাকি থাকা ম্যাচগুলি থেকে মোটামুটিভাবে ২ পয়েন্ট করে পেলেও তাদের পয়েন্ট টেবিলে সেরা চার থেকে অবস্থান কোনোভাবেই নামবে না। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশকে শুধু জিতলেই চলবে না, বরঞ্চ উপরের দিকের অবস্থানে থাকা দলগুলোর পা হড়কানোর জন্যেও প্রার্থনা করতে হবে।
বর্তমান অবস্থায় সেমিফাইনাল অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে রয়েছে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার। অন্যদিকে, টুর্নামেন্ট থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়ও প্রায় নিশ্চিত। তবে পয়েন্ট টেবিলের হিসেব বেশ কিছুটা জটিল হয়ে গিয়েছে ইংল্যান্ড-শ্রীলংকা ম্যাচে শ্রীলঙ্কা কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে জয় পাওয়ায়, যার ফলে শ্রীলঙ্কা ৬ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরে চলে এসেছে। লঙ্কানরা যদি পরের দুই ম্যাচ জিতে যায়, তাহলে তাদের পয়েন্ট হবে ১০। সেক্ষেত্রে লঙ্কানদের ছোঁয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কা এক ম্যাচ জিতলে এবং বাকি দুই ম্যাচ হারলেই কেবল তাদেরকে পেছনে ফেলার সুযোগ থাকবে বাংলাদেশের সামনে। তবে শ্রীলঙ্কার পরের তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষ যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারত। এই তিন ম্যাচ থেকে দু’টিতে জয় পাওয়াই শ্রীলঙ্কার জন্যে বেশ কষ্টসাধ্য হতে পারে বিধায় ধরে নেয়া যায়, শ্রীলঙ্কার জন্যে এ যাত্রা সেমিফাইনালে খেলাটা হয়তো বা না-ও হতে পারে।
এবার ইংল্যান্ডের হিসেবে আসা যাক। ইংল্যান্ডের পরের তিন প্রতিপক্ষ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও ভারত। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড ভয়ংকর হলেও পাকিস্তানের বিপক্ষে হার ও সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পনের পর ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স বেশ ভাবিয়ে তুলছে ক্রিকেটবোদ্ধাদের। পরের তিনটি ম্যাচে ইংল্যান্ডকে সম্ভবত এ বিশ্বকাপের সেরা তিনটি দলের মুখোমুখি হতে হবে। যদি এ তিনটি ম্যাচের সব কয়টি ইংল্যান্ড হেরে যায়, তবে সেক্ষেত্রে তাদের পয়েন্ট থাকবে ৮। সেক্ষেত্রে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ী হওয়া সাপেক্ষে এক পয়েন্টে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে চলে যাবে।
অন্যদিকে, পাঁচ ম্যাচ শেষে তিন পয়েন্ট হাতে নিয়ে বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দাবার ছক যেকোনো সময় উলটে দিয়ে তারা চলে আসতে পারে উপরের দিকে। এ দু’টি দলের প্রত্যেকের চারটি করে ম্যাচ বাকি আছে। অর্থাৎ, চার ম্যাচের তিনটিতেও জয় পেলে তাদের পয়েন্ট দাঁড়াবে ৯ পয়েন্ট করে, যা বাংলাদেশের সমান হয়ে দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে নেট রানরেটের হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেমিফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরের চারটি প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ড, ভারত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। নিউ জিল্যান্ড ও ভারত যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয়, তবে সাত পয়েন্ট হাতে নিয়ে তাদের সেমিফাইনাল স্বপ্ন মোটামুটিভাবে এখানেই শেষ।
চলুন, দেখে আসি পাকিস্তানের অবস্থান। পাকিস্তানের বাকি চারটি ম্যাচ হবে শ্রীলঙ্কা, নিউ জিল্যান্ড, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বিপক্ষে। ধরে নেয়া যাক, পাকিস্তান এ চারটি ম্যাচের মাঝে দু’টি ম্যাচ জিতল। আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারাতে পারলে তাদের পয়েন্ট হবে তখন সাত। সেক্ষেত্রে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো তাদেরও ধরতে হবে বাড়ির পথ। বাংলাদেশ পথ ধরবে সেমিফাইনালের।
এ তো গেল দৃশ্যত সব হিসাবনিকাশ। এর বাইরে সবচেয়ে বড় হিসেবটি এখনো বাকি। তা হলো বৃষ্টির হিসেব। ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার মতিগতি বোঝা বড় দায়। খোদ আইসিসিই ইংল্যান্ডের এহেন আবহাওয়া নিয়ে বেশ বিপদে পড়ে গেছে। রিজার্ভ ডে ব্যবস্থা না থাকায় এবারের বিশ্বকাপে বেশ কিছু ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, কিছু ম্যাচ শেষ করতে হয়েছে ডি/এল মেথডে। আর যার কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে পয়েন্ট টেবিলের উপরে থাকা দলগুলির যেমন ভাগ্য পুড়েছে, একইসাথে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গিয়ে প্রায় উপহারস্বরূপই একটি করে পয়েন্ট পেয়ে গিয়েছে কিছু দল। এ বেরসিক বৃষ্টি যে বাকি ম্যাচগুলিতেও হানা দেবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে ম্যাচ বাতিল, কিংবা ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা, দু’টিই পয়েন্ট টেবিলের সকল হিসেব ওলটপালট করে দিতে সক্ষম। ৫০ ওভারের ম্যাচ কমিয়ে যদি ২০ বা ৩০ ওভারে নামিয়ে আনা হয়, তবে সেক্ষেত্রে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে থাকা দলগুলিও যেকোনো মুহূর্তে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং, সকল জটিল সমীকরণ মেলানো শেষেও ইংল্যান্ডের আকাশের মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এ ফিচারটি লেখার আগ পর্যন্ত বিশ্বকাপের গ্রুপ রাউন্ডের আর মাত্র ১৮টি ম্যাচ বাকি। এই ১৮ ম্যাচের মাঝেই নির্ধারণ হয়ে যাবে বাংলাদেশের ‘সেমিফাইনাল’ভাগ্য। তবে, বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের যা পারফরম্যান্স, সে হিসেবে ভক্তরা সেমিফাইনালের মঞ্চে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে টাইগারদের দেখতে চাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। এত সব জটিল সমীকরণ আর সম্ভাবনার পরও তাই দিনশেষে একটিই চাওয়া; খেলবে টাইগার, জিতবে টাইগার!