১
বিষয়টা খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং ২০০২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলে রোমারিও সুযোগ পেলে সেটাই বিস্ময়কর হতো। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের পরপর দুই ম্যাচে বলিভিয়া আর ভেনিজুয়েলার বিপক্ষে যথাক্রমে ৩টি আর ৪টি গোল দেওয়ার পর ৩৫ বয়স্ক রোমারিও তৎকালীন ব্রাজিলিয়ান কোচ স্কলারির পরিকল্পনাতেও ছিলেন।
কিন্তু চোখের অপারেশনের অযুহাতে কোপা আমেরিকা না খেলে প্রীতি ম্যাচ খেলায় স্কলারি খেপে যান এবং রোমারিওর বাদ পড়াটা অনুমিতই ছিল। শেষপর্যন্ত ব্রাজিলের সাধারণ জনগণ, নির্বাচক, এমনকি প্রেসিডেন্টের অনুরোধের পরেও রোমারিওকে দলে না নিয়ে ভরসা রাখেন একজন তরুণের উপর। সেই তরুণের নাম রোনালদিনহো।
২
রোনালদিনহোর জন্য ২০০২ বিশ্বকাপটাই ব্রাজিলের জার্সি গায়ে প্রথম ছিল না। এর আগে ১৯৯৯ সালের কোপা আমেরিকা জয়ী দলেও তিনি খেলেছেন এবং টুর্নামেন্টে একটি গোলও করেছেন। তবে স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচের শুরু থেকে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না।
সেই সুযোগটা প্রথমে পেলেন ১৯৯৯ এর কনফেডারেশন কাপে। সেই টুর্নামেন্টে রিভালদো, রোনালদোসহ অনেক সিনিয়র খেলোয়াড় বিশ্রামে থাকায় মূল খেলোয়াড় হিসেবেই দলে জায়গা পেলেন এবং সুযোগটা কাজেও লাগালেন দুর্দান্তভাবে। ফাইনালের আগপর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই গোল করলেন, সেমিফাইনালে করলেন অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক। শুধুমাত্র ফাইনালে গোল বঞ্চিত থাকলেন, হয়তো এই কারণেই ফাইনালটা স্বাগতিক মেক্সিকোর কাছে হেরে গেলো ব্রাজিল। দল হারলেও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেলেন রোনালদিনহো।
তবে এরপরেও বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে রোমারিওকে রিপ্লেস করা সহজ বিষয় ছিল না। এর উপর রোনালদো তখন সবেমাত্র ইনজুরি থেকে ফেরত এসেছেন। বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে খুব খারাপ খেলছিলেন না তিনি, চীনের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই পেনাল্টি থেকে গোল করেন। তবে রোনালদো আর রিভালদো দুজনই দুর্দান্ত খেলতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই লাইমলাইটটা দিনহোর উপরে তখন পর্যন্ত আসেনি।
খুব বেশি সময় নিলেন না তিনি ফোকাসটা নিজের উপরে আনতে। পারফর্ম তো অনেকেই করে, তবে যে খেলোয়াড় দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিন নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন, তিনি অবশ্যই স্পেশাল। সেই প্রয়োজনের দিনটা চলে এলো কোয়ার্টার ফাইনালে। গ্রুপ পর্বে কোস্টারিকা, চীন ও তুরস্ক এবং দ্বিতীয় পর্বে বেলজিয়ামকে হারালেও মূল বাধা আসলো কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। মিডিয়ার বিচারে সেই ম্যাচটি ছিল টুর্নামেন্টের অলিখিত ফাইনাল। ইংল্যান্ড দলে তখন সোনালি প্রজন্মের সদস্যরা প্রতিনিধিত্ব করছেন। পল স্কোলস, ডেভিড বেকহাম, নিকি বাট, অ্যাশলে কোল, রিও ফার্ডিনান্দ কিংবা মাইকেল ওয়েনের মতো খেলোয়াড়েরা তখন ইংলিশ দলে।
খেলা শুরুর ২৩ মিনিটের মাথাতেই মাইকেল ওয়েনের গোলে ইংল্যান্ড এগিয়ে যায়। ব্রাজিলের সমর্থকদের মনে স্বাভাবিকভাবেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাবার সংশয়। সেই সংশয়ে প্রথম আশার প্রলেপ দিলেন রিভালদো। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান তিনি। তবে গোলটা রিভালদো করলেও এর কারিগর ছিলেন সেই রোনালদিনহো, মধ্যমাঠে থেকে দুর্দান্ত গতিতে ডিফান্ডারদেরকে ছিটকে ফেলে এক নিখুঁত পাসে রিভালদোর সাথে ইংলিশ গোলকিপারকে ওয়েন টু ওয়ান পজিশনে ফেলে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে গোল করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি রিভালদোর।
তবে এরপর দিনহো যে কাজটি করলেন, সেটার ফলে স্পটলাইটের পুরোটাই তার উপরে চলে আসলো। ম্যাচের ৫০তম মিনিটে একটি ফ্রি কিক পেলো ব্রাজিল। প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে ইংলিশ কিপার ডেভিড সিম্যানকে বোকা বানিয়ে এমনভাবে গোলটা করলেন দিনহো যে, সেটা টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোল হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়ে গেলো এবং ব্রাজিল পেলো পরের পর্বের টিকেট। টুর্নামেন্টে ২ গোল এবং ২ অ্যাসিস্ট করে জায়গা পেলেন বিশ্বকাপের অল স্টার দলে। উত্থান হলো এক নতুন সুপারস্টারের।
৩
ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করলেও সেটা রোনালদিনহোর কেন্দ্রীয় খেলোয়াড় হিসেবে পারফর্মেন্স ছিল না। রোনালদো এবং রিভালদো আক্রমণভাগের মূল খেলোয়াড় হবার কারণে রোনালদিনহো মূলত ছিলেন সাহায্যকারী খেলোয়াড়ের ভূমিকায়। ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবের হয়ে নিজেকে চেনানোর সুযোগটা পেয়ে গেলেন বার্সেলোনার হয়ে।
রোনালদিনহো যে সময়টাতে বার্সেলোনায় যোগ দিলেন, তার আগমুহূর্তে ক্লাব খুব ক্রান্তিকাল পার করছিলো। লিগ জিতেছে ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে। পরের চার মৌসুমে লিগে অবস্থান যথাক্রমে ২য়, ৪র্থ, ৪র্থ এবং ৬ষ্ঠ। বার্সেলোনার নতুন প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ডেভিড বেকহামকে দলে আনা। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের কাছে সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দলে আনেন রোনালদিনহোকে।
ক্লাবের বাজে অবস্থা চলছে, এই মুহূর্তে রোনালদিনহোর মতো তরুণ একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে দলকে কক্ষপথে ফেরানোটা অবশ্যই বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। দলে যোগ দিয়ে রোনালদিনহো দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিলেন। তবে দুর্ভাগ্য, ইনজুরির জন্য লিগের প্রথমদিকের অনেক ম্যাচ তিনি মিস করেন। মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি ইনজুরি কাটিয়ে দলে ফেরেন, তখন লিগে বার্সেলোনার অবস্থান ছিল ১২তম। সেখান থেকে মৌসুম শেষে তিনি বার্সেলোনাকে ২য় অবস্থানে নিয়ে আসেন। ক্লাবের হয়ে কোনো শিরোপা জিততে না পারলেও ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের বদৌলতে জিতে নেন ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার।
পরের মৌসুমে তিনি বার্সেলোনাকে লিগ জেতান, যা কি না ১৯৯৯ সালের পর প্রথম। সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও বার্সেলোনা ভালো শুরু করে, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে চেলসির কাছে ৫-৪ গোলে বাদ পড়ে যায়। দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় লেগে ৪-২ গোলে হারা ম্যাচের ২টি গোলই করেন রোনালদিনহো। বার্সেলোনা দ্বিতীয় পর্বে বাদ পড়লেও দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪টি গোল করেন দিনহো।
একই মৌসুমে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে ব্রাজিলের হয়ে কনফেডারেশন কাপও জিতে নেন রোনালদিনহো এবং ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন তিনি। সেই মৌসুমের ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কারও পান দিনহো।
বার্সেলোনার হয়ে রোনালদিনহোর ২০০৫-০৬ মৌসুমটা কাটে দুর্দান্ত। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জেতেন লিগ শিরোপা। এছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে ৩-০ গোলে জেতা ম্যাচে ২টি গোল করে মাদ্রিদ সমর্থকদের অভিবাদন পান, যা কি না বার্সার ইতিহাসে ম্যারাডোনার পর দ্বিতীয়। ক্যাসিয়াস, রবার্তো কার্লোস, জিদান, বেকহাম, রাউল, রবিনহো, রোনালদোদের সমন্বয়ে গড়া তারকাসমৃদ্ধ দলটিকে অবলীলায় হারানোর পেছনের মূল কারিগর ছিলেন রোনালদিনহো সেটা না বললেও চলে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও রোনালদিনহো ছিলেন দুর্দান্ত। বার্সেলোনা তখন পর্যন্ত তাদের ইতিহাসে কেবলমাত্র একবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জিতেছে, সেটাও ১৯৯১-৯২ মৌসুমে। ১৪ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাটা কতটা রোনালদিনহোময় ছিল সেটা প্রমাণ করার জন্য পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা (৪টি) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা (৭টি) ছিলেন তিনি।
দুর্দান্ত একটি মৌসুম কাটিয়ে রোনালদিনহো গেলেন ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে।
৪
ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হবার পর থেকে তখন পর্যন্ত রোনালদিনহো বাদে টানা দুবার পুরস্কারটি পাওয়া একমাত্র খেলোয়াড় ছিলেন তারই স্বদেশি রোনালদো। তবে টানা তিনবার কেউ জিততে পারেননি। ২০০৬ বিশ্বকাপ খেলতে গেলেন সেই সম্ভাবনাকে সত্য করতে। বার্সেলোনার মতো দলকে নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলকে যেভাবে অবলীলায় হারিয়েছেন তাতে শক্তিশালী ব্রাজিলকে নিয়ে বাকি সবাইকে হারানোটা খুব একটা কষ্টকর বিষয় হবার কথা ছিল না। ক্লাব পর্যায়ে শীর্ষ সাফল্য পাওয়ার পর রোনালদিনহো বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন মূলত সর্বকালের সেরা হবার জন্যই।
পেলে কিংবা ম্যারাডোনাকে যে সর্বকালের সেরার দৌড়ে এগিয়ে রাখা হয়, সেটার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিশ্বকাপ জয়। রোনালদিনহোর সেটা জয় করা হয়ে গিয়েছে আগের বিশ্বকাপেই, কিন্তু এরপরেও অপূর্ণতা হচ্ছে সেই জয়টা কেন্দ্রীয় খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া হয়নি। পেলে কিংবা ম্যারাডোনা যখন বিশ্বকাপ জিতেছেন তখন তাদেরকে ঘিরেই দলীয় পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল। সেই সুযোগ রোনালদিনহো পেলেন ২০০৬ বিশ্বকাপে। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা তিনবার ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার জেতা এবং ব্রাজিলকে ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন রোনালদিনহো।
তবে বিশ্বকাপে রোনালদিনহো ছিলেন সুপার ফ্লপ। পুরো টুর্নামেন্টে একটি গোলও করতে পারেননি। দল বাদ পড়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে। কতটা বাজে বিশ্বকাপ গিয়েছে রোনালদিনহোর সেটা বোঝা যায় একটি তথ্য থেকেই। সেই বছরের বর্ষসেরা শিরোপা জিতেছিলেন ইতালির ক্যানাভারো আর দ্বিতীয় হয়েছিলেন ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান, যারা কি না সেই মৌসুমে ক্লাবের হয়ে কোনো শিরোপাই জিততে পারেননি। অথচ ক্লাবের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পরেও রোনালদিনহো হয়েছিলেন বর্ষসেরা তালিকায় তৃতীয়।
সেই বিশ্বকাপের পর থেকেই রোনালদিনহোর পতনের শুরু হয়।
৫
২০০৬-০৭ মৌসুমে লিগে ২১ গোল করেও রোনালদিনহো বার্সেলোনাকে লিগ শিরোপা জেতাতে ব্যর্থ হন। মৌসুম শেষে রিয়াল আর বার্সেলোনার পয়েন্ট সমান থাকে, কিন্তু টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী ‘হেড টু হেড’ এ এগিয়ে থাকার কারণে শিরোপা পায় রিয়াল। মৌসুম শেষে ফিফা বর্ষসেরার সেরা তিনে থাকতেও ব্যর্থ হন দিনহো।
২০০৮-০৯ মৌসুমে এসি মিলানে গিয়েও আর সেরা ফর্মে ফিরে আসতে পারেননি। পরবর্তীতে চলে যান ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে। সেখানে অ্যাটলেটিকো মিনেইরোর হয়ে কোপা লিবার্তাদোরেস জিতলেও আর কখনোই ফিফা বর্ষসেরার সেরা তিন কিংবা ফিফ প্রো একাদশে সুযোগ পাননি। ফর্মটা এতটাই পড়তির দিকে ছিল যে, ২০১০ বিশ্বকাপে ৩০ বছর বয়সেও ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি।
২০০২ বিশ্বকাপে যে তারকা রোনালদিনহোর উত্থান ঘটেছিল, তার পতনের শুরুটা হয় ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকেই।
তবে এই অল্প সময়ের মাঝের কয়েকটা মৌসুম রোনালদিনহো পুরো বিশ্ববাসীকে এমন জাদু দেখিয়েছেন যে, তাকে নিয়ে আলোচনার সময় সেটাতেই বুঁদ হয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। পেলে-ম্যারাডোনাকে টপকে সর্বকালের সেরা হতে না পারার কারণ হিসেবে কখনোই তার দক্ষতা কিংবা মেধার অভাবকে দায়ী করা হয় না, দায়ী করা হয় তার খামখেয়ালীপানাকে।
অন্তত ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজের সেরাটা খেলতে পারলেও সর্বকালের সেরার বিবেচনায় বেশ উপরের স্থানে অবস্থান করতেন তিনি। সেটা করতে না পারার আক্ষেপ কেবল তার নিজের নয়, একইসাথে সমর্থকদেরও।