Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিন্ন দুই বিশ্বকাপে একবার গোল্ডেন বল ও অন্যবার গোল্ডেন বুট জয়ের অনন্য কীর্তিটি যার দখলে

ফুটবল বিশ্বকাপে বেশ কিছু ব্যক্তিগত পুরস্কার আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার হচ্ছে গোল্ডেন বল। ১৯৮২ সাল থেকে অ্যাডিডাসের সৌজন্যে টুর্নামেন্টের সেরা পারফর্মারকে দেওয়া হয় এই গোল্ডেন বল। তবে ফিফা এর আগের আসরের সেরা খেলোয়াড়দেরকেও গোল্ডেন বল জয়ীদের তালিকায় রেখেছে। এছাড়া সম্মানের দিক থেকে ঠিক গোল্ডেন বলের পরই থাকবে গোল্ডেন বুট পুরস্কারটি, এক বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাকে দেওয়া হয় গোল্ডেন বুট। এটিও ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে দেওয়া শুরু হলেও এর আগের আসরগুলোর সর্বোচ্চ গোলদাতাদেরও গোল্ডেন বুট জয়ীদের তালিকায় রাখা হয়েছে।

গোলের খেলা ফুটবল। তাই যিনি সবচেয়ে বেশি গোল করেন তার গোল্ডেন বুট জয়ের সাথে সাথে সেই আসরের গোল্ডেন বল জয়েরও বেশ জোরালো সম্ভাবনা থাকে। এ পর্যন্ত ৫ জন খেলোয়াড় একই আসরে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল দুটিই জেতার নজির গড়েছেন। তারা হলেন ব্রাজিলের লিওনিদাস (১৯৩৮ বিশ্বকাপ) ও গারিঞ্চা (১৯৬২ বিশ্বকাপ), আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেস (১৮৭৮ বিশ্বকাপ), ইতালির পাওলো রসি (১৯৮২ বিশ্বকাপ) ও শিলাচি (১৯৯০ বিশ্বকাপ)।

ইতিহাসে যে পাঁচজন খেলোয়াড় একই আসরে গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল জিতেছিলেন তাদের একজন এই পাওলো রসি; Image Source : paolorossiacademy.com

একই আসরে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট দুটি পুরস্কারই জয়ের নজির থাকলেও ভিন্ন দুই আসরে দুটি ব্যক্তিগত পুরস্কার জেতার নজির খুবই কম। এর কারণটাও স্পষ্ট। বিশ্বকাপ হয় ৪ বছর পরপর, একবার যে গোল্ডেন বল বা গোল্ডেন বুট পেয়েছেন, তিনি ৪ বছর পর আবারো বিশ্বকাপ খেলতে এসে সেই আগের ফর্মে থাকবেন এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ জন খেলোয়াড় দুটি ভিন্ন বিশ্বকাপে মানদন্ডের দিক থেকে সেরা পারফর্মেন্স উপহার দিয়েছেন। তারা হলেন ব্রাজিলের পেলে (১৯৫৮ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপ), রোনালদো (১৯৯৮ ও ২০০২ বিশ্বকাপ) এবং ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান (১৯৯৮ ও ২০০৬ বিশ্বকাপ)। এর মধ্যে পেলে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছর বয়সে অতিমানবীয় এক পারফর্মেন্স উপহার দিলেও গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো মিস করায় ব্যক্তিগত সেরার কোনো পুরস্কার পাননি। তবে ১৯৭০ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল ঠিকই জিতেছিলেন তিনি।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ খেললে এই তালিকায় হয়তো রোনালদোর সাথে পেলের নামটাও থাকতো; Image Source: Portland Monthly

অন্যদিকে ২০০৬ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বলজয়ী জিদান ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে জোড়া গোল করে দলকে জেতালেও কার্ডজনিত সমস্যার কারণে সেবার বেশ কিছু ম্যাচ মিস করে ব্যক্তিগত লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন। এই তালিকায় থাকা রোনালদোই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুটি বিশ্বকাপে সেরা পারফর্ম করার সাথে সাথে ভিন্ন দুই বিশ্বকাপে দুটি ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে জিতেছিলেন গোল্ডেন বল আর পরের আসর ২০০২ সালে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। আজ আমরা রোনালদোর এই অমর কীর্তির ব্যাপারেই জানবো, জানবো কিভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ভিন্ন দুই বিশ্বকাপে জিতেছিলেন দুটি ভিন্ন পুরস্কার।

১৯৯৮ বিশ্বকাপ: সেরা খেলোয়াড় হয়েও বিষাদের ছায়া

১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলে রোনালদো থাকলেও সেবার রোমারিও-বেবেতো জুটির দাপটে ১৮ বছর বয়সী রোনালদো কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তবে ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে ফিফার প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হওয়ায় ১৯৯৮ বিশ্বকাপ রোনালদো খেলতে এসেছিলেন সেসময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা হিসেবেই। শুধু টানা দুবারের বর্ষসেরা পুরস্কার জেতার কারণেই নয়, সেসময়ে রোনালদোর খেলার ধরনটাও তার এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার বড় একটি কারণ ছিল। বিশ্বকাপের ঠিক আগের ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে রোনালদো কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন তা বোঝার জন্য কুইন্টনের ফর্চুনের একটি উক্তিই যথেষ্ট।

সেই মৌসুমের রোনালদোর ব্যাপারে ফর্চুন বলেন “মেসি, ক্রিস্টিয়ানো, নেইমার, রোনালদিনহো – এরা প্রত্যেকে অসাধারণ খেলোয়াড়। কিন্তু এদের সবার প্রতিভা একত্রিত করলে তবেই হয়তো আপনি সেই মৌসুমের রোনালদোকে পাবেন!” সেসময় রোনালদোর এমন অতিমানবীয় খেলা দেখে সবাই ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, এই ছেলে বুঝি পেলের সব রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবেন। আর এসব কারণেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এর আগের আসরের সেরা খেলোয়াড় রোমারিও ইনজুরির কারণে ছিটকে পড়লেও ২২ বছরের রোনালদোর উপরে ভর করেই ব্রাজিলিয়ানরা টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিলো।

টানা দুবার ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা রোনালদোকে ঘিরেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিলো ব্রাজিলিয়ানরা; Image Source : goal.com

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ব্রাজিল, ২-১ গোলে স্কটিশদের বিপক্ষে ব্রাজিলের সেই জয়ে কোনো গোল না করলেও অসাধারণ খেলেছিলেন রোনালদো। বিশেষ করে রাইট উইং দিয়ে কাট ইন করে ৩ জন স্কটিশ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যে শটটা নিয়েছিলেন সেটা গোল না হলেও অসাধারণ একটা মুভ ছিল। দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য মরক্কোর বিপক্ষে গোল-অ্যাসিস্ট নিয়ে স্বমহিমায় হাজির রোনালদো। ম্যাচের ৯ মিনিটের মাথায় রিভালদোর অসাধারণ এক থ্রুতে বল পেয়ে ওয়ান টাচ শটে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন রোনালদো।

এরপর ৫২ মিনিটে আবারো রোনালদোর ঝলক। মরক্কোর ডিফেন্ডার সাবেরের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে লেফট উইং হালকা স্টেপওভার করে আরেকজন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা বেবেতোর দিকে রোনালদো যে বল বাড়িয়ে দেন তা থেকে গোল করতে ভুল করেননি বেবেতো। রোনালদোর গোল-অ্যাসিস্টে ৩-০ গোলে মরক্কোকে হারায় সেলেসাওরা। গ্রুপপর্বের শেষম্যাচে নরওয়ের কাছে ২-১ গোলে হেরে বসে ব্রাজিল! এ ম্যাচে কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট পাননি রোনালদো অবশ্য ম্যাচ হারলেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের রাউন্ডে যায় সেলেসাওরা।

মরক্কোর বিপক্ষে রোনালদো পান বিশ্বকাপে নিজের অভিষেক গোল; Image Source : Soccer Museum

রাউন্ড অব সিক্সটিনে চিলির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। সেই ম্যাচে সিজার সাম্পাইয়োর জোড়া গোলে ২৭ মিনিটের মাঝেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ে রোনালদোকে চিলিয়ান গোলকিপার তাপিয়া ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ব্রাজিল। পেনাল্টি থেকে বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন রোনালদো।

এরপর ৭২ মিনিটে ডেনিলসনের পাস থেকে দারুণ ফিনিশিং এ গোল করে ব্রাজিলের ৪-১ গোলের জয় নিশ্চিত করেন রোনালদো। কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্কের মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। সেই ম্যাচে মাত্র দুই মিনিটের মাথায় গোল খেয়ে ব্রাজিল পিছিয়ে পড়লেও ১০ মিনিটে রোনালদোর অসাধারণ থ্রু পাস থেকে গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান বেবেতো। ২৫ মিনিটে আবারো রোনালদোর অ্যাসিস্ট, এবার গোল করলেন রিভালদো। শেষপর্যন্ত ৩-২ গোলে ডেনিশদের হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ব্রাজিল।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে এভাবে অহরহ দুই-তিনজন ডিফেন্ডারকে নাজেহাল করে ছেড়েছিলেন রোনালদো; Source: FIFA

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও অসাধারণ খেলেন রোনালদো, ম্যাচের ৪৬ মিনিটে গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে নেন তিনি। এছাড়াও সেই ম্যাচে মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে অসাধারণ এক দৌড় শুরু করে তিনজন ডাচ ডিফেন্ডারকে কাবু করে আরেকটু হলেই গোল দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষমুহূর্তে ডাচ ডিফেন্ডার ট্যাকলের কারণে সেটি আর গোলে পরিণত হয়নি।

সেই ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে চলে যায় ব্রাজিল, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক ফ্রান্স। ফ্রান্স স্বাগতিক হলেও রোনালদোর ব্রাজিলকেই সেবার সবাই ফেভারিট মানছিলো। কিন্তু হায় সেলুকাস! ঠিক ফাইনালের আগেই রহস্যময় এক ইনজুরিতে পড়েন রোনালদো, চিকিৎসকরা রোনালদোকে মাঠে নামার জন্য ছাড়পত্র না দিলেও রোনালদো কোচকে অনুরোধ করে ফাইনালে মাঠে নামেন।

এত কাছে এসেও ভাগ্যের কাছে হেরে হতাশ রোনালদো; Source: Getty Images

কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। খেলতে নামার অনুপযোগী রোনালদো যেভাবে ফাইনালে নিষ্প্রভ ছিলেন, তার দল ব্রাজিলও ছিল তেমন অনুজ্জ্বল। জিনেদিন জিদানের জোড়া গোলে ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে হেরে ভেঙ্গে যায় রোনালদোর বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। এত কাছে এসেও শুধুমাত্র ভাগ্যের কাছে স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্টে ছটফট করতে থাকেন রোনালদো। অবশ্য ৪ গোল আর ৩ অ্যাসিস্টে সেই আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলটা রোনালদোর কাছেই আসে। কিন্তু সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েও বিশ্বজয় করতে না পারার কষ্ট কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না তিনি।

২০০২ বিশ্বকাপ: রূপকথাকেও হার মানায় যে প্রত্যাবর্তন

১৯৯৮ বিশ্বকাপটা রোনালদো শুরু করেছিলেন সাফল্যের একদম চূড়ায় থেকে। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপের আগে রোনালদো ছিলেন একদম বিপরীত মেরুতে! ২০০০ সালের এপ্রিলে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে রোনালদোর ক্যারিয়ারটাই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এই ইনজুরির কারণে ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সবগুলো ম্যাচ মিস করেন তিনি! শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপের আগে খেলার জন্য ফিট হলেও আগের সেই ধার অনেকখানি হারিয়ে ফেলেন। তাই দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকা রোনালদো ২০০২ বিশ্বকাপের মঞ্চে কেমন করবেন এ ব্যাপারে বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল। তাছাড়া তাকে ছাড়া বাছাইপর্বে ব্রাজিলের অবস্থাটাও ছিল বেশ নাজুক। এ কারণে সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ভালো করার সামর্থ্য নিয়েও সবাই প্রশ্ন তোলা শুরু করে।

ইনজুরিতে রোনালদোর ক্যারিয়ারই পড়ে হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিলো; Source: sportskeeda

তবে সব পাশার দান উল্টে যায় টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার সাথে সাথেই। ইনজুরির কারণে রোনালদোর আগের সেই ড্রিবলিং ও চিতার মতো ক্ষিপ্রগতি না থাকলেও গোল করার ক্ষমতাটা আগের মতোই ছিল। সেই বিশ্বকাপে তিনি নিজের গোল করার ক্ষমতার উপরেই জোর দিলেন। গ্রুপ সি তে নিজেদের প্রথম ম্যাচে তুরস্কের সাথে ১-০ গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করলেও দ্বিতীয়ার্ধে রিভালদোর লব থ্রু থেকে বল পেয়ে অসাধারণ এক ফিনিশিং এ গোল করে ব্রাজিলকে সমতায় ফেরান রোনালদো। ম্যাচটা পরে ব্রাজিল জেতে ২-১ গোলে।

পরের ম্যাচে চীনের বিপক্ষে ব্রাজিলের গোল উৎসবের শেষ গোলটি করেন রোনালদো। ব্রাজিল ম্যাচ জেতে ৪-০ গোলে। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে কোস্টারিকার মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। আর এই ম্যাচেই রোনালদো বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন, আগের মতো ক্ষিপ্রগতি না থাকলেও শুধুমাত্র ফিনিশিং অ্যাবিলিটি দিয়েও তিনি পারেন যেকোনো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে। কোস্টারিকার বিপক্ষে ১০ মিনিটে গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন তিনি। তবে দৃষ্টিনন্দন ছিল এর পরের গোলটি। রিভালদোর নেওয়া কর্নার কিক থেকে রোনালদো যখন বল পান, তখন তাকে কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন দুজন ডিফেন্ডার। কিন্তু দুজনকেই বোকা বানিয়ে গোলমুখে শট নিয়ে অসাধারণ এক গোল করেন রোনালদো।

সেই গোল দেখে ধারাভাষ্যকার বলে উঠে “How did he do that?! This was a piece of magic from Ronaldo”। তার এই জাদুকরী পারফর্মেন্সে ভর করে কোস্টারিকাকে ৫-২ গোলে বিধ্বস্ত করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের রাউন্ড নিশ্চিত করে ব্রাজিল।

কোস্টারিকার বিপক্ষে গোল করে উল্লসিত রোনালদো দ্য ফেনোমেনন; Source: goal.com

রাউন্ড অব সিক্সটিনে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল বেলজিয়াম। সেই ম্যাচে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো বেলজিয়ানরা। ৬৭ মিনিটে রিভালদোর অসাধারণ এক দূরপাল্লার গোলে ব্রাজিল এগিয়ে গেলেও বেলজিয়ামের একের পর আক্রমণে ঠিক স্বস্তিতে থাকতো পারছিলো না সেলেসাওরা। ব্রাজিলের জয় নিশ্চিত করেন রোনালদো। ৮৭ মিনিটে ক্লেবারসনের পাস থেকে গোল করে নিশ্চিত করেন ব্রাজিলের ২-০ গোলের জয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কড়া মার্কিংয়ে থাকায় রোনালদো গোল না পেলেও রোনালদিনহোর জাদুতে ২-১ গোলে ইংলিশদের হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ব্রাজিল।

সেমিফাইনালে সেই আসরের চমক তুরস্কের বিপক্ষে কিছুতেই গোল পাচ্ছিলো না ব্রাজিল। তুর্কিদের ইস্পাতসম ডিফেন্স দেখে মনে হচ্ছিলো, এই ডিফেন্স ভাংতে জাদুকরী কোনো পারফর্মেন্স দরকার। আর বড় মঞ্চে সেই জাদুই করে দেখালেন রোনালদো। খেলার ৪৯ মিনিটে গিলবার্তো সিলভা যখন লেফট উইং থেকে রোনালদোকে পাস দিলেন, তখন তুরস্কের দুজন খেলোয়াড় রোনালদোকে কড়া মার্কিংয়ে রেখেছিলেন। দুজনকেই বোকা বানিয়ে ডিবক্সে ঢুকে তৎক্ষণাৎ শটে রোনালদো অসাধারণ এক গোল করেন।

এমন অনিন্দ্য সুন্দর গোল দেখে ধারাভাষ্যকার বলে উঠলেন, “Every world cup needs a hero & Ronaldo is one here!”  যদিও তখনো বিশ্বকাপের ফাইনাল বাকি, তারপরও রোনালদোর পারফর্মেন্স দেখে মনে হচ্ছিলো এই আসরের নায়ক রোনালদো ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না। রোনালদোর এই অমায়িক গোলেই তুরস্ককে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা তৃতীয়বার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে ব্রাজিল।

সেমিফাইনালে তুর্কিদের বিপক্ষে ব্যবধানটা গড়ে দিয়েছিলেন রোনালদোই; Source: Youtube

৩০ জুন, ২০০২ সালে জাপানের ইয়োকোহামা স্টেডিয়ামে ফাইনালে জার্মানির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। জার্মানির সামনে লক্ষ্য ৪ বার বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলকে ছুঁয়ে ফেলা আর ব্রাজিলের সামনে সুযোগ প্রথম দল হিসেবে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের। এদিকে রোনালদোর সামনে সুযোগ ৪ বছর আগে প্যারিসের সেই ফাইনালের দুঃস্বপ্ন ভুলে নতুন করে ইতিহাস গড়ার। কিন্তু তার সেই ইতিহাস গড়ায় বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ান সেই টুর্নামেন্টের আরেক নায়ক, জার্মানির গোলরক্ষক অলিভার কান।

প্রথামার্ধে ব্রাজিল গোল করার সহজ কিছু সুযোগ পেলেও তা নস্যাৎ হয়ে যায় অলিভার কানের দৃঢ়তায়। এর মধ্যে রোনালদো নিজেই নষ্ট করেন সবচেয়ে সহজ দুটি সুযোগ। গোল মিসের মহড়া দেখে মনে হচ্ছিলো এবারো বুঝি ফাইনালের মঞ্চ থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হবে রোনালদোকে। কিন্তু ইনজুরি থেকে ফেরার পর রোনালদো যে বিশ্বজয়ের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ!

৬৭ মিনিটে জার্মান মিডফিল্ডার হ্যামানের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে রোনালদো তা বাড়িয়ে দেন রিভালদোর দিকে। রিভালদো তৎক্ষণাৎ একটি দুর্বল শট গোলমুখের দিকে মারেন, যেটা অলিভার কানের খুব সহজেই ধরতে পারার কথা। কিন্তু বিধি বাম! সারা টুর্নামেন্টে অবিশ্বাস্য সব সেভ করা অলিভার কান রিভালদোর সেই দুর্বল শটটাকে ঠিকমতো গ্রিপ করতে না পারলে বল চলে যায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোনালদোর কাছে। এবার আর রোনালদো কোনো ভুল করলেন না। ঠান্ডা মাথা বল জালে জড়িয়ে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেন দ্য ফেনোমেনন।

ফাইনালে গোল করে রোনালদোর সেই ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন; Source: goal.com

দ্বিতীয় গোলটি ছিল চমৎকার এক টিম প্লের ফসল। ডানপ্রান্ত থেকে ক্লেবারসন যখন ডিবক্সের দিকে বল বাড়িয়ে দিলেন তখন জার্মান ডিফেন্ডার লিঙ্কে রোনালদোকে মার্ক না করে রিভালদোকে মার্ক করতে তার দিকে এগিয়ে যান। রোনালদোকে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিভালদো বল রিসিভ না করে অসাধারণ এক ডামিতে বল পাঠিয়ে দেন রোনালদোর দিকে। আনমার্কড রোনালদো ঠান্ডা মাথায় গোল করে নিশ্চিত করেন ব্রাজিলের পেন্টাজয়

৪ বছর আগে রহস্যময় এক ইনজুরির জন্য যে খেলোয়াড় বিশ্বকাপ ফাইনালে নিজের ছায়া হয়েছিলেন, সেই খেলোয়াড়ই দুই বছর মাঠের বাইরে থেকেও পরের বিশ্বকাপে ফিরে এসে এমন অতিমানবীয় পারফর্ম করলে সেটাকে রূপকথা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়? সেই টুর্নামেন্টে মোট ৮ গোল করে আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন বুট জিতে নেন রোনালদো।

অবশেষে স্বপ্নের সেই ট্রফির ছোঁয়া পাওয়া; Source: FIFA

তবে এমন অসাধারণ পারফর্মেন্সের পরও রোনালদোকে গোল্ডেন বল না দিয়ে সেটা দেওয়া হয় অলিভার কানকে! এটা সত্যি, সেই বিশ্বকাপে অলিভার কানের অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের কারণেই জার্মানি ফাইনালে উঠতে পেরেছিলো। কিন্তু পুরো বিশ্বকাপে রোনালদো যেভাবে পারফর্ম করেছিলেন সেটাকে কোনোভাবেই কানের পারফর্মেন্সের চেয়ে পিছিয়ে রাখার উপায় নেই।

একটি তথ্য দিলেই সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ে রোনালদোর প্রভাব কতটা বেশি ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। এখন পর্যন্ত যতগুলো বিশ্বকাপ হয়েছে তাতে চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে সেমিফাইনাল ও ফাইনালের সবগুলো গোল একজন খেলোয়াড়ই করেছেন এই ঘটনা মাত্র একবারই ঘটেছে আর সেটা ঘটিয়েছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপের রোনালদো। তবে গোল্ডেন বল না পেলেও এই আসরে গোল্ডেন বুট জিতেই রোনালদো হয়ে যান ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি এক আসরে গোল্ডেন বল জয়ের পর অন্য আরেকটি আসরে জিতে নেন গোল্ডেন বুট, যে রেকর্ডে আজও কেউ ভাগ বসাতে পারেনি।

তবে এই বিশ্বকাপে ৩ জন খেলোয়াড়ের সামনে সুযোগ থাকবে রোনালদোর এই অনন্য রেকর্ডে ভাগ বসানোর। তারা হচ্ছেন থমাস মুলার, লিওনেল মেসি ও হামেস রড্রিগেজ। মুলার ২০১০ আসরে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট, হামেস জিতেছিলেন ২০১৪ সালে আর মেসি জিতেছিলেন ২০১৪ সালের গোল্ডেন বলের পুরস্কার। এর মধ্যে মুলার ২০১৪ সালে এই রেকর্ড ছোঁয়ার খুব কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিলভার বল জেতায় সেবার আর এই রেকর্ডের ভাগীদার তিনি হতে পারেননি।

এখন দেখার বিষয়, এই তিনজনের মধ্যে কেউ কি রোনালদোর রেকর্ড ছুঁতে পারবেন নাকি ব্যতিক্রমী এক চূড়ায় রোনালদো একাই দাঁড়িয়ে থাকবেন সগৌরবে!

 ফিচার ইমেজ : FIFA

Related Articles