Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রসিস্কি: ইঞ্জুরির ছোবলে হারিয়ে যাওয়া লিটল মোজার্ট

ইউরোপীয় ফুটবলের ২০০৬-০৭ মৌসুমের শুরু তখন। সদ্যই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে এগিয়ে থেকেও হারল আর্সেনাল। মৌসুমের শেষে স্পেনে পাড়ি জমান দলের অন্যতম ভরসা রবার্ট পিরেস। তার স্থলে জার্মানি থেকে ওয়েঙ্গার উড়িয়ে আনলেন ‘কিউট’ এক চেককে। তাকে দেওয়া হলো পিরেসের জায়গা, পিরেসের শার্ট। প্রথম খেলতে নামেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ালিফায়ারে ডায়নামো জাগরেভের বিপক্ষে। আর্সেনালে এভাবেই শুরু হয় টমাস রসিস্কির।

চেক রিপাবলিকের প্রাগ শহরে থাকতেন স্পার্টা প্রাগ ও পরবর্তীতে বোহেমিয়ান সিকেডি প্রাগের ডিফেন্ডার জিরি ও তার তার স্ত্রী, টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ইভা। ক্রীড়ানুরাগী এই পরিবারের বড় ছেলেরও খুব আগ্রহ ছিল ফুটবল নিয়ে। ১৯৮০ সালের ৪ অক্টোবর জন্ম নেন সবার ছোট টমাস।

সিকেডি কমপ্রেসরিতে মাত্র ৬ বছর বয়সে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। বড় ভাই জিরির সাথে যোগ দেন স্পার্টা প্রাগের যুবদলে। জিরি সেখান থেকে চলে যান স্পেনে, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বি দলে। কিন্তু এবার আর রসিস্কি যাননি। তিনি থেকে যান। দু’বছর পরেই টমাসের অভিষেক হয় স্পার্টা প্রাগের সিনিয়র টিমে। বয়স তখন মাত্র ১৮। স্পার্টা সেই বছর লিগ জিতলেও রসিস্কি খেলেন মাত্র তিন ম্যাচ। কিন্তু পরের মৌসুমেই ৩৬ ম্যাচে ৭ গোল নিয়ে স্পার্টার লিগ জেতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেই সাথে জিতে নেন ঐ মৌসুমের ট্যালেন্ট অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার। ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় এখানেই।

স্পার্টার যুবদলে টমাস রসিস্কি; Image Credit: football players childhood pics

২০০০ সালেই তার অভিষেক হয়ে যায় জাতীয় দলে। ২০০২ বিশ্বকাপে চেক কোয়ালিফাই না করলেও সেখানে রসিস্কির ছিল ২ গোল। সেই সাথে ২০০৪ ইউরোতেও খেলেন দলের হয়ে। ২০০১ সালের জানুয়ারির শীতকালীন দলবদলে সবচেয়ে দামি চেক প্লেয়ার হিসেবে যোগ দেন বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। ডর্টমুন্ড সেই বছরই জিতে নেয় লিগ শিরোপা। এটিই ছিল ডর্টমুন্ডের সাড়ে পাঁচ বছরে জেতা রসিস্কির একমাত্র শিরোপা। উয়েফা কাপের ফাইনাল খেললেও সেখানে হার মানতে হয় ফেয়েনুর্দের কাছে। ডর্টমুন্ডের খারাপ সময় গেলেও রসিস্কির খারাপ সময় ছিল না। ২০০২ সালে চেক গোল্ডেন বল সহ ২০০১, ‘০২ ও ‘০৬ সালে জেতেন দেশসেরা ফুটবলারের খেতাব। জার্মানিতে পেয়ে যান আরেক ডাক নাম- ‘দ্য লিটল মোজার্ট’। একজন প্লেমেকার হয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে ১২ গোল করে নজরে আসেন সবার। আর সেই বছরের মার্চ মাসেই তাকে দেখা দেওয়া শুরু করে তার ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া থাই ইঞ্জুরি।

বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে রসিস্কি; Image Credit: The Bundesliga Fanatic

আর্সেন ওয়েঙ্গারের মত জুড়ির নজরেও পড়েন সেই সময়। আর্সেনাল তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি দল। দু’বছর আগেও তারা ছিল অজেয়। সেই সাথে ইউসিএল-এ রানারআপ তখন। দল পরিবর্তনে মোটেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননি রসিস্কি। মাত্র ৬.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে তাকে নিয়ে নেয় আর্সেনাল।  ২০০৬ বিশ্বকাপে চেক জেতে মাত্র একটি খেলায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে রসিস্কির ছিল দুই গোল। বিশ্বকাপের পরে অবসর নেন পাভেল নেদভেদ। তার জায়গায় দলের অধিনায়কত্ব দেওয়া হয় নাম্বার টেন রসিস্কিকে।

অনেক আশা নিয়ে আর্সেনালে আসলেও ঐ মৌসুমে আর্সেনাল শুরু করে অন্যতম বাজেভাবে। লিগে অবস্থা শোচনীয়। দলের হয়ে রসিস্কি প্রথম গোল পান হামবুর্গের বিরুদ্ধে ইউসিএল-এর গ্রুপ পর্বে। কিন্তু যার বদলি হয়ে দলে এসেছিলেন তার পারফর্মেন্সের ধারে-কাছেও যেতে পারছিলেন না। পিরেস যেখানে গড়ে তিন-চার ম্যাচ পর পর গোল পেতেন, সেখানে রসিস্কি তখন ভুগছেন গোলখরায়। কিন্তু তখন আর্সেনাল পুরো দলটাই ছিল বাজে ফর্মে। দেখা গেল, সিজনে পাওয়া ৬ গোলের মধ্যে পাঁচটিই ছিল দলের জয়সূচক। আর্সেনাল যেমন সংগ্রাম করে ঐ মৌসুমে, তেমনটা করেন রসিস্কিও। ইংলিশ কন্ডিশনে প্রথম মৌসুমে মানিয়ে নেওয়া, প্রত্যাশার চাপ- সব মিলিয়ে রসিস্কি ছিলেন খুব চাপে। তবে টিমমেটদের সহযোগীতাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। উইলিয়াম গালাস, থিয়েরি অঁরি ছাড়া আর কেউ মোটামুটি ফর্মেও ছিলেন না।

সমস্যগুলো প্রায় কাটিয়ে উঠেছিলেন পরবর্তী মৌসুমেই। ছয় গোল করেছিলেন ১৫ ম্যাচেই। কিন্তু ক্যারিয়ারের কালো অধ্যায়ের শুরু হয় এখানেই। নিউক্যাসলের সাথে এফএ কাপের ম্যাচে দশ মিনিটও হয়নি। উরুর টেন্ডন ছিড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রসিস্কি। ফলে একেবারে শেষ হয়ে যায় ঐ মৌসুমটি। এই ইঞ্জুরির জন্য জাতীয় দলের হয়ে মিস করেন ২০০৮ ইউরো ও ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার। তবে ইঞ্জুরিতে যে শুধু বসে ছিলেন তা নয়, গিটার শিখে এসময় হয়ে যান পার্ট টাইম গিটারিস্ট। পুরো দেড় বছর দর্শক হিসেবে কাটানোর পরে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে প্রাক-মৌসুমে একটি ম্যাচ খেলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক খেলায় ফেরা দীর্ঘায়িত হয় আবারও হ্যামস্ট্রিং ইঞ্জুরিতে ছয় সপ্তাহ  মাঠের বাইরে চলে যাওয়ায়।

খেলায় এরপর ফেরেন একেবারে সেপ্টেম্বরে। আর্সেনাল তাদের মিসিং পাজল অবশেষে পায়। আস্তে আস্তে ভাল হতে থাকে তাদের রেজাল্ট। লিগে শীর্ষ চারে স্থান নিশ্চিত করা সহ কাপ ম্যাচেও প্রভাব ফেলেন রসিস্কি। এই সিজনেই ট্যাকটিকাল কিছু পরিবর্তন আসে তার খেলায়। শুধুমাত্র একজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে না থেকে খাঁটি প্লেমেকার হিসেবে শুরু করেন। গোল করার চেয়ে করানোয় মনোযোগী হন বেশি। ওয়াইডে খেলানোর চেয়ে তাকে মাঝখানে নিয়ে আসেন ওয়েঙ্গার। একদম কেন্দ্রে থেকে দুই উইং এই বল সাপ্লাই দিতে থাকেন ভালভাবে। বলতে গেলে মাকড়সার জালের মতো লিংক আপ করেন বাকিদের সাথে। তার ট্রেড মার্ক আউটসাইড ফুট থ্রু পাসগুলো খুব ভাল কাজ করে এখানে। তবে দলের পারফর্মেন্স খুব একটা ভাল হয়নি তাতেও। বার্মিংহামের কাছে অসহায় পরাজয় বরণ করে আর্সেনাল লিগ কাপের ফাইনালে। এত কিছু ছাপিয়ে তার সেরা পারফর্মেন্সগুলো সব বরাদ্দ থাকত নর্থ লন্ডন ডার্বির জন্য।

টটেনহ্যামের বিরেদ্ধে স্মরণীয় গোলটির পর উদযাপন; Image Credit: Mirror

এ সময় দল নিয়ে বলেন, “চার বছর আগে এখানে যখন এসেছিলাম তখন থেকেই এটা আমার বাড়ির মতো, আর আমি বিশ্বাস করি এভাবেই আমরা স্পেশাল কিছু অর্জন করতে পারব।  

ক্যাপ্টেন হিসেবে ২০১২ সালের ইউরোতে প্রথম দুই ম্যচ খেলে আবার টেন্ডন ইঞ্জুরিতে চলে যান সাইডলাইনে। চেক রিপাবলিকের হয়ে সবচেয়ে কম এবং বেশি দুই বয়সেই ইউরোতে খেলার রেকর্ড তার। জাতীয় দলে হয়ে তার এই রেকর্ড অনেকদিন বহাল তবিয়তে থাকবে আশা করা যায়।

রসিস্কির নেতৃত্বে চেক প্রজাতন্ত্র; Image Credit: ESPN

১০ বছরের আর্সেনাল ক্যারিয়ারে প্রথম ট্রফিটা আসে ২০১৪ সালে। বদলি হিসেবে যদিও খেলেন মাত্র ১৩ মিনিট, কিন্তু তাতেই গলায় ঝুলিয়ে নেন এফএ কাপের মেডেল। বেশিদিন লাগেনি পরবর্তী ট্রফি পেতেও। ম্যানচেস্টার সিটিকে হারিয়ে আর্সেনাল জিতে নেয় কমিউনিটি শিল্ড। কিন্তু মেসুত ওজিল দলে ভেড়ায় জায়গা হারাতে শুরু করেন এবার রসিস্কি। ২০১৫-তে এফএ কাপের ফাইনালেও নামা হয়নি তার। সাইডলাইনে বসেই পেলেন আরেকটি শিরোপার স্বাদ। ছিলেন না কমিউনিটি শিল্ডের ম্যাচেও। ২০১৫-১৬-ই হয়ে যায় আর্সেনালের হয়ে তার শেষ মৌসুম। হাঁটুর ইঞ্জুরির কারণে নামতে পারেননি ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। জানুয়ারিতে এক ম্যাচ খেলেই আবার উরুর সমস্যা দেখা দেয়। ফলাফল, আর মাঠে দেখা যায় নি এই মিডফিল্ড মায়েস্ত্রোকে।

আর্সেনালে রসিস্কিকে বিদায় সংবর্ধনা; Image Credit: Arsenal Station

সবাই ভেবেছিল, মৌসুমের শেষ ম্যাচে তাকে দেখা যাবে মাঠে। কিন্তু ফিটনেসের সমস্যার জন্য খেলা হয়নি বিদায়ী এই ম্যাচটি। ৪-০ গোলে ম্যাচটি জিতে আর্সেনাল বিদায় দেয় ক্যাপ্টেন মিকেল আর্তেতা, ও লিজেন্ড টমাস রসিস্কি ও ম্যাথিউ ফ্লামিনিকে।

পরবর্তী মৌসুমে ফ্রিতে যোগ দেন শৈশবের ক্লাব স্পার্টা প্রাগে। কিন্তু ইঞ্জুরি তার পিছু ছাড়েনি এখানেও। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম ম্যাচে নামেন দলের হয়ে, ইঞ্জুরিতে পড়েন ঐ ম্যাচেই। ফেরা হয়নি আর ঐ মৌসুমে। আবার নামেন পরবর্তী বছরের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু ফিটনেস, ইঞ্জুরি, শারীরিক অবস্থা- সবকিছু বিবেচনায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অবসর নিতে বাধ্য হন। খেলা ছাড়লেও দল ছাড়েননি। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে স্পার্টার সহকারী কোচ ও পরবর্তীতে ঐ বছরের ডিসেম্বরে হন স্পোর্টিং ডিরেক্টর, যে পদে এখনও তিনি বহাল আছেন।

স্পার্টার নতুন স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবে রসিস্কি; Image Credit: AC Sparta Praha

তবে দিন শেষে মানুষের মনে থাকবে তার খেলার ধরনটাই। মিডফিল্ডে তার কারিশমা, নেতৃত্ব, গেম রিডিং, বলের উপর কন্ট্রোল- সবকিছু একজন ক্রীড়াপ্রেমিককে মুগ্ধ করবেই। রসিস্কির খেলা দেখুন, কোনোভাবেই বিরক্ত লাগবে না। তার খেলা বাধ্য করবে তার ভক্ত হতে। আর আর্সেন ওয়েঙ্গার নিজেই বলে গিয়েছেন, “তুমি যদি ফুটবলকে ভালবাসো, তুমি টমাস রসিস্কিকেও ভালবাসবে।

Related Articles