১.
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের কলিন কাউড্রি। এরপর আরও ৬৬ জন ক্রিকেটার শতাধিক টেস্ট ম্যাচ খেললেও ১০০ টেস্ট খেলা প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে কলিন কাউড্রির নাম। ওডিআইতে রিচার্ড হ্যাডলি এবং টি-টোয়েন্টিতে শোয়েব মালিক প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ১০০ ম্যাচ খেলেছেন। এরপরে আরও অনেক ক্রিকেটার এই মাইলফলক অতিক্রম করলেও তাদের নামই সবার উপরে থাকবে। তেমনি নিউ জিল্যান্ডের রস টেইলরের নামও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ তিনি ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটে আলাদাভাবে ১০০টি করে ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেছেন।
রস টেইলরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল ২০০৬ সালের ১লা মার্চ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ওডিআই ক্রিকেট দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেছিলেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ২৩২টি ওডিআই খেলে ৪৮.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৮,৫৭৪ রান সংগ্রহ করেছেন। ২১টি শতক এবং ৫১টি অর্ধশতকের সাহায্যে তিনি এই রান সংগ্রহ করেছেন। ওডিআই ক্রিকেটে নিউ জিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮,০০৭ রান করেছেন স্টিফেন ফ্লেমিং। টেস্ট ক্রিকেটেও ব্ল্যাক ক্যাপসদের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তিনি। সম্প্রতি নিজের শততম টেস্ট খেলা টেইলর ১০১ টেস্টে ৪৬.৯০ ব্যাটিং গড়ে ১৯টি শতক ও ৩৩টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৭,২৩৮ রান করেছেন।
২.
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করা টেইলর অভিষেকের পর থেকেই নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছেন। বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মিডল-অর্ডারে যেকোনো দলের জন্য তার মতো ব্যাটসম্যান আশীর্বাদ স্বরূপ। তিনি তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের জানান দেন নিজের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেদিন ১৩৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এরপর থেকে প্রতি মৌসুমেই ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ২০১৪ সাল থেকে তিনি ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটানো শুরু করেন। এ সময়ে ১০৩ ম্যাচে ১৩টি শতক এবং ২৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬১.২৬ ব্যাটিং গড়ে ৪,৬৫৬ রান সংগ্রহ করেন তিনি।
সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তার নাম উচ্চারিত না হলেও তিনি ওয়ানডে ফরম্যাটে সেরাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং দলে তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন। যার উদাহরণ তার ব্যাটিং গড়। ২০১৪ সালের পর থেকে কমপক্ষে চার হাজার রান করেছে এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার ব্যাটিং গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ ৬৭.১৩ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন বিরাট কোহলি।
বর্তমানে ওডিআই ক্রিকেটে সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকা করলে উপরের দিকে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, বাবর আজম, কেন উইলিয়ামসন কিংবা রয়, ফিঞ্চদের নাম উল্লেখ থাকবে। কোনো এক অজানা কারণে সবার দৃষ্টিসীমানার একটু দূরেই অবস্থান করেন রস টেইলর, যার কারণে ধারাবাহিকভাবে রান করা সত্ত্বেও সেরাদের কাতারে তার নাম উচ্চারিত হয় না। তিনি ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্তও ওডিআই ক্রিকেটে সবচেয়ে ব্যাটিং গড়ের দিক দিয়ে কোহলির পরেই অবস্থান করছেন। ২০১৭ থেকে এখন পর্যন্ত ৫৬ ম্যাচে ৬৫.৪২ ব্যাটিং গড়ে ২,৭৪৮ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১৮১ রানের ইনিংসসহ শতক হাঁকিয়েছেন ৬টি এবং অর্ধশতক ১৯টি।
৩.
টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানরা ভালো সূচনা এনে দেওয়ার পর পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব হলো দলকে পথ হারাতে না দেওয়া। পথ খোঁজার দায়িত্বও মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিতে হয়। যখন টপ-অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা দ্রুত সাজঘরে ফিরে আসে, তখন দলকে লড়াকু সংগ্রহ এনে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের। এই ভূমিকায় রস টেইলর বিশ্ব সেরাদের একজন। ওডিআই ক্রিকেটে চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে তার চেয়ে বেশি রান ইতিহাসে আর কারো নেই। টপ-অর্ডার এবং মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের যোগসূত্র চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশন। তিনি এ জায়গায় ১৭৮ ইনিংস ব্যাট করে ১৯টি শতক এবং ৪৬টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫২.৪৪ ব্যাটিং গড়ে ৭,৬৫৭ রান সংগ্রহ করেছেন। এই পজিশনে দ্বিতীয় সর্বাধিক ৬,৯৪৭ রান করেছেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান মাহেলা জয়াবর্ধনে। তিনি এ রান করেছেন ২১৯ ইনিংস ব্যাট করে।
শতক হাঁকানোর দিক থেকেও তিনি অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন। চারে ব্যাট করে সবচেয়ে বেশি ১৯টি শতক হাঁকিয়েছেন রস টেইলর। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫টি শতক হাঁকিয়েছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। শুধুমাত্র ওডিআই ক্রিকেটে নন, টেস্ট ফরম্যাটেও চারে নিউ জিল্যান্ডের আস্থার প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। ভারতের হয়ে শচীন টেন্ডুলকার, শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়াবর্ধনে, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, ওয়েস ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা এবং পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ যে দায়িত্ব পালন করেছেন, নিউ জিল্যান্ডের হয়ে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন। টেস্ট ক্রিকেটে চার নাম্বারে সবচেয়ে বেশি রান তোলা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় এই পাঁচজনের পরেই অবস্থান করছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৪৮.৭৩ ব্যাটিং গড়ে ৬,৬৭৭ রান সংগ্রহ করেছেন।
৪.
ব্যাটসম্যানদের আসল পরীক্ষা দিতে হয় রান তাড়ায় ব্যাট করতে নামলে। রান তাড়ায়ও রস টেইলর নিউ জিল্যান্ডের অন্যতম সেরা। তিনি এখন পর্যন্ত সফল রান তাড়ায় ৫৫ ইনিংসে ছয়টি শতক এবং ১১টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৬২.৭১ ব্যাটিং গড়ে ২,১৯৫ রান করেছেন। রান তাড়ায় ব্যাট করে জয় পাওয়া ম্যাচে তার ছয়টি শতকের মধ্যে পাঁচটি এসেছে ২০১৪ সাল থেকে। এই সময়ে চার কিংবা এর নিচের ব্যাটিং পজিশনে তার চেয়ে বেশি শতক হাঁকাতে পারেননি আর কোনো ব্যাটসম্যান। সফল রান তাড়ায় এই পজিশনে ২০১৪ সাল থেকে আর কোনো ব্যাটসম্যান দুটির অধিক শতক হাঁকাতে পারেনি।
নিউ জিল্যান্ডের বড় লক্ষ্য তাড়া করে জয় পাওয়া ম্যাচগুলোতেও রস টেইলরের অবদান সবচেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ড ওডিআইতে ছয়বার তিন শতাধিক রান তাড়া করে ম্যাচ জিতেছে। যার মধ্যে টেইলর পাঁচ ম্যাচে একাদশে ছিলেন এবং চার ম্যাচেই তিনি শতক হাঁকিয়েছেন। নিউ জিল্যান্ড সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জিতেছে ভারতের বিপক্ষে। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের দেয়া ৩৪৮ রানের লক্ষ্য ১১ বল এবং চার উইকেট হাতে রেখেই টপকে যায় স্বাগতিক নিউ জিল্যান্ড। এই রান তাড়া করে দলকে জয় এনে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন রস টেইলর। দলীয় ১০৯ রানের মাথায় দ্বিতীয় উইকেটের পতনের পর ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৮৪ বলে ১০টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে অপরাজিত ১০৯ রানের ইনিংস খেলেন।
নিউ জিল্যান্ড দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জিতেছিল ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ৩৪৭ রান তাড়া করতে নেমে এক উইকেটের জয় পেয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। রস টেইলরের অবদান ছিল ১১ রান। এই একবারই দলের তিন শতাধিক রান তাড়া করে জয় পাওয়া ম্যাচে দলে থেকেও শতক হাঁকাতে পারেননি তিনি। একই সিরিজের আগের ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ৩৩৭ রানের লক্ষ্য অতিক্রম করে নিউ জিল্যান্ড। ঐ ম্যাচে রস টেইলর ১২৭ বলে ১১৭ রান করে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন। গ্লেন ম্যাকগ্রা, শন টেইট এবং নাথান ব্র্যাকেনদের মতো বোলারদের বিপক্ষে চাপের মুখে তিনি এই ইনিংস খেলেন।
রস টেইলর তার ক্যারিয়ার সেরা ওডিআই ইনিংস খেলেছিলেন ২০১৮ সালের ৭ মার্চ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রান তাড়া করতে নেমে তিনি অপরাজিত ১৮১ রানের ইনিংস খেলে দলকে পাঁচ উইকেটের জয় এনে দেন। প্রথমে ব্যাট করা ইংল্যান্ড ৯ উইকেটে ৩৩৫ রান করলে জয়ের জন্য নিউ জিল্যান্ডের প্রয়োজন পড়ে ৩৩৬ রানের। বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিউ জিল্যান্ডের দুই ওপেনারই শূন্য রানের ফিরে যান। তাদের বিদায়ের পর দলকে বিপদের মুখ থেকে টেনে তুলে জয়ের বন্দরে পৌঁছান টেইলর। তার ১৪৭ বলে ১৭টি চার এবং ৬টি ছয়ের মারে অপরাজিত ১৮১ রানের কল্যাণে তিন বল এবং পাঁচ উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নেয় নিউ জিল্যান্ড।
২০১৫ সালের ১৪ই জুন একই প্রতিপক্ষের দেয়া ৩০৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১২৩ বলে ১১০ রানের ইনিংস খেলেন রস টেইলর। ইংল্যান্ডের দেয়া ৩০৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মার্টিন গাপটিল ২ এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ১১ রান করে ফিরে গেলে জুটি বাঁধেন কেন উইলিয়ামসন ও রস টেইলর। তারা দুজন তৃতীয় উইকেট জুটিতে ২০৬ রান যোগ করেন, যার ফলে এক ওভার ও তিন উইকেট হাতে রেখে জয় পায় নিউ জিল্যান্ড। মিডল-অর্ডারে তার দুর্দান্ত সব ইনিংসের কল্যাণেই বড় রান তাড়া করে শেষ হাসি হাসতে পারছে নিউ জিল্যান্ড। তিনি টপ-অর্ডার এবং মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মাঝে সাঁকো হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
রস টেইলর ২০০৬ সালে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই তিন ফরম্যাটে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে খেলে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে টেস্ট ও ওডিআইতে তাদের সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। টি-টোয়েন্টিতেও দলের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। তিন ফরম্যাটে আলাদাভাবে ১০০টি করে ম্যাচও খেলে ফেলেছেন তিনি। ব্যাট হাতে তার অনেক কীর্তি সময়ের সাথে হাতবদল হবে ঠিকই, কিন্তু প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটে শতাধিক ম্যাচ খেলার রেকর্ডটি ইতিহাসের পাতায় তার নামের পাশেই লেখা থাকবে।