Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী: বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম টাইগার

শহীদ আব্দুল হালিম জুয়েল; ছবিসুত্র: bdlive24.com

২১ মে, ১৯৬৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আইয়ুব ট্রফিতে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট বনাম ঢাকার তিন দিনের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষিক্ত এক তরুণ সে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৩৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ রান করেন। দুই দলের মধ্যে সর্বাধিক ৩৮ রানের ইনিংসটি ছিল তাঁরই এবং ফলাফল  ম্যাচ ড্র।

৫ অক্টোবর, ১৯৬৬

হায়দ্রাবাদের নিয়াজ ষ্টেডিয়ামে কায়দ-ই-আজম ট্রফিতে কোয়েটার বিপক্ষে চার দিনের ম্যাচ। এবার ঐ তরুণ খেলেন ইষ্ট পাকিস্তান দলের হয়ে। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৪ রান করলেও  দ্বিতীয় ইনিংসে আর ভুল করেননি, খেলেন ২৯ রানের একটি ইনিংস।  ফলাফল ইষ্ট পাকিস্তান জয়ী হয় ৫ উইকেটে।

২২ আগষ্ট, ১৯৬৯

করাচি হোয়াইট-এর বিপক্ষে সেই তরুণ খেলেন করাচির ন্যাশনাল ষ্টেডিয়ামে। কায়দ-ই-আজম ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রান করেন, ম্যাচ ড্র। একই টুর্নামেন্টের পরবর্তী ম্যাচে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল খায়েরপুর। তিন দিনের ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১৫ রান করলেও পরের ইনিংসে ব্যাটিং এ নামারই সুযোগ পাননি। কারণ এ ম্যাচে ইষ্ট পাকিস্তান জিতে যায় ইনিংস ও ৫ রানে। সেই টুর্নামেন্টের আরেক ম্যাচে হায়দরাবাদ হোয়াইট-এর বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১২ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ রান করেন। ইষ্ট পাকিস্তান ১৩৫ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে।

১৫ জানুয়ারি, ১৯৭১

ঢাকা ষ্টেডিয়ামে বিসিসিপি ট্রফির তিন দিনের ম্যাচে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে সেই তরুণ খেলেন ইষ্ট পাকিস্তান হোয়াইট-এর হয়ে। প্রথম ইনিংসে অল্পের জন্য মিস করেন হাফ সেঞ্চুরি, আউট হন ৪৭ রানে। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে হাতছাড়া করেননি হাফ সেঞ্চুরি, খেলেন ৬৫ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। যা ছিল তাঁর জীবনের সেরা পারফরম্যান্স। তবে সে ম্যাচটি হয় ড্র। একই টুর্নামেন্টের অন্য ম্যাচে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪ রান ও দ্বিতীয় ইনিংসে ০ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।

২১ দশমিক ৫৮ গড়ে সাত ম্যাচে ২৫৯ রান করেন তিনি, যা কিনা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ক্রিকেটারদের পক্ষে প্রবলভাবে উল্লেখযোগ্য।

ছবিসুত্র: prothom-alo.com

বলছিলাম এক সাহসী ক্রিকেটারের গল্প। নাম তাঁর আব্দুল হালিম চৌধুরী, ডাক নাম জুয়েল, খেলেছেন আজাদ বয়েজ ও মোহামেডান ক্লাবের হয়ে। ফেবারিট শট ছিল স্লগ সুইপ। ব্যাটিংয়ে যখন নামতেন, তখন যেন তাঁর একমাত্র কাজই হয়ে যেত প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করা। যেন তিনি এক চিত্রকর, তুলির মতো ব্যাট চালাতেন আর বলকে বানাতেন রঙ। সমগ্র মাঠ হয়ে যেত তাঁর নিজের তৈরি এক ক্যানভাস। সে সময় তাঁর বিখ্যাত সব স্লগ সুইপগুলো দেখে পাকিস্তানের বিখ্যাত এক ক্রিকেটার বলেছিলেন- “এই ছেলে এখানে কেন, এর তো পাকিস্তানের হয়ে ওপেনিং করার কথা”। হ্যাঁ, তাঁরই ছিল সমগ্র পাকিস্তানের হয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করার কথা। কিন্তু সমস্যা একটাই, তিনি যে বাঙালি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা তিনি পাননি। সমগ্র পাকিস্তানের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান হয়েও হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক।

খেলার মাঠে (বাঁ থেকে) রাকিবুল হাসান, বাসিল ডি’অলিভেরা এবং শহীদ জুয়েল; ছবিসুত্র: cricketcountry.com

১৯৫০ সালের ১৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণ পাইকশা গ্রামে জন্ম নেন আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। বাবা আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী এবং মা ফিরোজা বেগমের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। রাজধানী ঢাকার টিকাটুলির ৬/১ কে এম দাস লেনে ছিল তাঁর বাবার বাড়ি, সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই তিনি আকৃষ্ট ছিলেন ক্রিকেট খেলার প্রতি। শহীদ জুয়েলের ক্রিকেট খেলায় হাতেখড়ি হয় আজাদ বয়েজের হয়ে যার প্রতিষ্ঠাতা ছিল তাঁরই বন্ধু শহীদ মুশতাক। শুধু জুয়েলই নয়, মুশতাকের আজাদ বয়েজ থেকে উঠে আসে উঠতি আরও অনেক ক্রিকেটার।

শহীদ জুয়েল এবং শহীদ মুশতাক। ছবিসুত্র: archive.samakal.net

সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক মতোই, কিন্তু বাঁধ সাধলো ২৫শে মার্চের কালরাত। সে রাতেই নিখোঁজ আজাদ বয়েজের প্রতিষ্ঠাতা বন্ধু মুশতাক। জুয়েলের কান পর্যন্ত আসতে খবরটা খুব বেশি সময় নেয়নি। দুদিন বাদে ২৭ মার্চ আতঙ্ক কিছুটা স্থিমিত হলে সৈয়দ আশরাফুল হককে সাথে নিয়ে বের হন বন্ধু মুশতাকের খোঁজে। জেলা ক্রীড়া পরিষদ ভবনের সামনে এসে হঠাৎ চোখে পড়ল প্রিয় বন্ধু মুশতাকের রক্ত মাখা নিথর দেহটা। যে বুকে অগনিতবার জুয়েলকে আলিঙ্গন করেছে বন্ধু মুশতাক, সে বুকটিকেই ব্রাশ ফায়ার করে ঝাঁঝরা করা দেয়া হয়েছে। যে লোকটি শুধুমাত্র দোয়া করবার জন্য যে কারো জানাজার নামাযে দাঁড়িয়ে পড়ত, শেষ পর্যন্ত হলো না তাঁর নিজেরই জানাজার নামায।

মাকে বড় বেশি ভালবাসতেন জুয়েল। তাই মায়ের এই স্নেহের বাঁধন ছিঁড়তে পারছিলেন না সহজে। অন্যদিকে বন্ধু মুশতাকের ক্ষতবিক্ষত লাশের সেই চিত্র প্রতিনিয়তই আঁচড় কাটছে বুকে। মা-ও টের পেয়েছিলেন। তাই খেয়াল রাখছিলেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু নিজের মায়ের মতো নিজ মাতৃভূমিকেও বড় বেশিই ভালবাসতেন জুয়েল। তাই শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলেন না ঘরে। বের হয়ে গেলেন পেছনের দরজা দিয়ে, আর মায়ের জন্য রেখে এলেন নিজের বাঁধাই করা একটা ছবি।

ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে যান জুয়েল। সেখানে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের তত্ত্বাবধানে ২ নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন। দেশে ফিরে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনে। এই ক্র্যাক প্লাটুনে আরও ছিলেন রুমি, বদিউজ্জামান, আলম, পুলু, সামাদ, আজাদের মতো সাহসী যোদ্ধারা। এদের কাছে এসে জুয়েলের সাহস যেন বেড়ে গেল আরও শতগুণ। হাতের স্টেনগান যেন কথা বলতে লাগলো ব্যাটের মতো করেই। শত্রু বাহিনীর একেকটা সদস্যকে ছয় মেরে মেরে বের করতে থাকলেন মাঠের বাইরে। ফার্মগেট, এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে চালালেন বেশ কয়েকটি হামলা এবং সফলও হলেন।

ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা; ছবিসুত্র: bdlive24.com

তবে এবার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশনের এক পর্যায় জুয়েলের ডান হাতের তিনটি আঙুল বেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন দেশে পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। চারিদিকে শত্রুরা কীটের মতো কিলবিল করছে। এ সময়ে হাসপাতালে যাওয়া আর বাঘের মুখে নিজেকে ঢেলে দেয়া একই কথা। তাই আড়ালেই চলতে থাকে হাতের চিকিৎসা। তবুও হাতের চাইতেও জুয়েলের মনের ব্যাথার পরিমাণই বেশি। কেননা এই হাত দিয়েই যে স্বাধীন বাংলাদেশের হয়ে ওপেনিং এ নামতে হবে তাঁর। নীরবে হাতের সেবা করতে থাকে বোন আর বোনের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি এই বলে যে, স্বাধীন বাংলার হয়ে আবার ব্যাট ধরতে পারবেন তো?

হাতে ব্যাথা নিয়েও থেমে থাকে না তাঁদের অপারেশন। অগাস্টের মাঝামাঝির দিকে আবারো ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর বিরুদ্ধে। এবার লক্ষ্য সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন। কিন্তু বিধিবাম, অপারেশন চলাকালীন হানাদারদের আক্রমণের মুখে গুরুতর আহত হন জুয়েল। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মগবাজারে, সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসায়। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী কীটেরা তা টের পেয়ে যায়। ২৯ অগাস্ট পাকি সেনাদের অতর্কিত হামলায় আহত অবস্থায় ধরা পড়েন জুয়েল।

তিনি ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান একজন ক্রিকেটার, অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা। আবার তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরাও পড়েছিলেন জীবিতাবস্থায়। তাই তাঁর অপর অত্যাচারের পাশাপাশি আসে নানান ধরনের প্রলভনও। এমনকি তাঁর মুখ খোলানোর জন্য তাঁকে দেয়া হয় পাকিস্তান টিমের হয়ে ওপেনিং খেলার মতো প্রস্তাব। কিন্তু যার বুকে বইছে বাঙালির রক্ত, সে তো আর পাকিস্তান টিমের হয়ে খেলতে পারে না। কারণ স্বপ্ন তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশ টিমের হয়ে ওপেনিং করার। এক পর্যায়ে তথ্য আদায়ে ব্যর্থ হয়ে শত্রু সেনারা জুয়েলের ডান হাতের আঙ্গুল কেটে দেয়, যাতে করে সে আর কোনোদিন স্বাধীন বাংলার হয়ে ব্যাট ধরতে না পারে।

এভাবে একের পর এক অসহনীয় অত্যাচার চলতেই থাকে। কিন্তু বের হয় না কোনো তথ্য, বের হয় না কোনো শব্দ। ধারণা করা হয়- কোনো তথ্য জানতে না পেরে ৩১ অগাস্ট রাতেই হত্যা করা হয় জুয়েলকে। আর এভাবেই স্বাধীন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল।

শহীদ জুয়েলের জার্সি হাতে মুশফিক, মাশরাফি এবং সাকিব; ছবিসুত্র: ntvbd.com

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শহীদ জুয়েলের এই আত্মত্যাগের কথা প্রচার করা হয় এবং তৎকালীন অস্থায়ী সরকার তাঁকে মরণোত্তোর সম্মাননা প্রদানের ঘোষণা দেয়। কথা দিয়ে তারা ভুলে যায় নি, শেষ পর্যন্ত কথা রেখেছে তৎকালীন সরকার। ১৯৭২ সালে শহীদ জুয়েলকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়।

শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একাংশ; ছবিসুত্র: mapio.net

শহীদ জুয়েলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকার মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের একাংশের নাম রাখা হয় শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড। প্রতি বছরের ডিসেম্বরে শহীদ জুয়েল-শহীদ মোশতাক প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।

আজকাল আমাদের সাকিব, তামিম, মুশফিক, মুস্তাফিজরা যখন ক্রিকেট বিশ্বকে নিজেদের জাত চেনান, তখন ওপর থেকে হয়তো মুচকি মুচকি হাসেন আমাদেরই শহীদ জুয়েল। কেননা বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকারের প্রথম টাইগার যে ছিলেন তিনিই।

তথ্যসূত্র

১) বলের বদলে গ্রেনেড

২) bit.ly/2uO052j

৩) bn.wikipedia.org/wiki/আবদুল_হালিম_চৌধুরী_জুয়েল

৪) khela-dhula.com/ফিচার/featured/981/শহীদ-জুয়েল:-বীর-ক্রিকেটার,-বীর-যোদ্ধা

Related Articles