বিশ্বকাপ আসরের অনেক ম্যাচের ফলাফল হয়তো দুই দলের শক্তি ও ইতিহাসের বিচারে আগে থেকেই ধারণা করা যায়। স্বাভাবিক ফলাফলের ম্যাচে তাই অসাধারণ কিছু না ঘটলে তা বিশ্বকাপের আর বাকি দশটা ম্যাচের মতো ঢাকা পড়ে যায় স্মৃতির আড়ালে। কিছু ম্যাচে দেখা যায় প্রত্যাশিত কিংবা অপ্রত্যাশিত চমক দেখিয়ে এগিয়ে যায় কোনো দল, প্রতিপক্ষের হয়তো সেখানে আর আশা থাকে না ম্যাচে ফেরার।
এমন পরিস্থিতিতেও হাল ছাড়ে না অনেকেই। হাল না ছাড়া অদম্য মানসিকতার দরুণ তৈরি হয় পিছিয়ে পড়েও ম্যাচে ফেরার বিস্ময়কর আখ্যান। সেই সাথে জন্ম নেয় প্রত্যাবর্তনের কিছু রোমাঞ্চকর ইতিহাস ও রুদ্ধশ্বাস কিংবদন্তি, যা মানুষের মনে গেঁথে যায় রূপকথার মতো। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের তেমনি অন্যতম কিছু প্রত্যাবর্তনের নিদর্শন নিয়ে আজকের আয়োজন।
১৯৫৪, পশ্চিম জার্মানি ৩-২ হাঙ্গেরি
১৯৫০-৫৪ সাল; এই চার বছরে একটি ম্যাচও হারেনি দলটি, ৩০টি ম্যাচের মাঝে জিতেছে ২৬টি ম্যাচই এবং বাকি ৪টি ড্র। বলছিলাম মাইটি ম্যাগিয়ার্স নামে খ্যাত হাঙ্গেরির কিংবদন্তি দলটির কথা। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে দলটি ছিল এককথায় অপ্রতিরোধ্য, এই বিশ্বকাপে নিজেদের মাত্র চার ম্যাচ দলটি গোল করেছে ২৫টি। গোলের পরিসংখ্যানে দলটির শক্তিমত্তা বিচার করতে আপত্তি থাকলে জেনে রাখুন, কোয়ার্টার ফাইনালে তারা বিগত বিশ্বকাপের রানার্স আপ ও শক্তিশালী ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে এবং সেমিফাইনালে চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকেও পরাজিত করেছিল একই ব্যবধানে।
মাইটি ম্যাগিয়ার্সের বিপক্ষে সুইজারল্যান্ড ‘৫৪ বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয়ে জেতার সামর্থ্য কোনো দলের ছিল কি? ফাইনালে এই দলটির প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি, যাদেরকে ম্যাগিয়ার্সরা ৮-৩ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে এসেছে সেই গ্রুপপর্বেই।
ফাইনালে হাঙ্গেরির প্রতিপক্ষ এমন একটি দল, যাদের অস্তিত্ব চার বছর পূর্বেও ছিল না এবং সবাই মোটামুটি একরকম নিশ্চিত ছিল যে গ্রুপপর্বের মতোই ফাইনালেও পাত্তা পাবে না পশ্চিম জার্মানি। ফুটবল বিশ্বকাপ আসরের চেয়ে নিষ্ঠুর কিছু থাকতে পারে এমনটা হয়তো অনেক ফুটবল ভক্ত বিশ্বাস করবেন না, এই বিশ্বাসের উপলক্ষ অনেকগুলো হতে পারে এবং সেখানে হাঙ্গেরির নির্মম পরিণতি অন্যতম।
আসরে হাঙ্গেরি তাদের শেষ তিনটি ম্যাচ খেলেছিল তাদের সেরা তারকা পুসকাসকে ছাড়াই, ফাইনালের একাদশে দলে যোগ হয় পুসকাসের নামও। ম্যাচের ৬ মিনিটে পুসকাস ও মাত্র ২ মিনিট পরেই জিবর গোল করলে ২-০ গোলে যখন হাঙ্গেরি এগিয়ে, তখন তেমন একটা অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। অনেকেই তখন ভাবছিল, হয়ত আরেকটি ৮-৩ ফলাফলের ম্যাচের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে।
সব কিছু ভুল প্রমাণিত হতে বেশি সময় অবশ্য লাগেনি, কারণ ম্যাচের ১০ মিনিটে মার্লক গোল করে ব্যবধান কমিয়ে আনার মাত্র ৮ মিনিটের মধ্যেই হেলমুটের গোলে সমতায় ফেরে জার্মানি। বৃষ্টির কারণে ভেজা মাঠে নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে অনেকটা ব্যর্থ হলেও পশ্চিম জার্মানির রক্ষণে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাঙ্গেরির আক্রমণভাগ। জার্মান গোলরক্ষক টনির সেভের পর সেভ, নান্দোর হিরাকুটির শট গোলপোস্টে ও কচিসের শটে বল গোলবারে আঘাত করে ফিরে আসলে ভাগ্যও যেন আঘাত হানে হাঙ্গেরির বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার অল্প কয়েক মিনিট আগে।
ম্যাচের মাত্র ছয় মিনিট বাকি, একটি ক্রস থেকে আসা বল হাঙ্গেরির বক্সে এসে পড়লে কাছাকাছি থাকা হেলমুট তা গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে জালে জড়াতে সামান্যতম ভুল করেননি। অপ্রত্যাশিত এই জয়ে ফুটবল ইতিহাসে রচিত হয় ‘মিরাকল অব বার্ন’, শেষ হয়ে যায় মাইটি ম্যাগিয়ার্সের সোনালি সময় এবং ফুটবল বিশ্বে আবির্ভাব হয় অন্যতম এক পরাশক্তির।
১৯৬৬, পর্তুগাল ৫-৩ উত্তর কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার বিশ্বকাপে প্রথম বিশ্বকাপ স্মরণীয় হওয়ার কারণ মাত্র দুটি ম্যাচ, যদিও তাদের শুরুটা আহামরি কিছু ছিল না। প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা দল হিসেবে তারা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়, কেউ অবাক হয়নি। দলটি সকলের মনোযোগ ধীরে ধীরে নিজেদের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয় দ্বিতীয় ম্যাচে চিলির সাথে ড্র করার পর। গ্রুপপর্বের তৃতীয় ম্যাচে তখনকার দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে পরাজিত করে ইতালিকে পেছনে ফেলে সবাইকে অবাক করে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার এই রূপকথার মতো যাত্রার পরবর্তী প্রতিপক্ষ ছিল পর্তুগাল, ফুটবল বিশ্বকাপে তাদের প্রতিপক্ষের মতো তারাও এই প্রথম অংশগ্রহণ করছে।
দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে পূর্বে ফেভারিট তকমাটা ছিল পর্তুগালের, কারণ গ্রুপপর্বের তিনটি ম্যাচেই তারা জয়লাভ করেছে এবং শেষ ম্যাচটিতে তাদের সাথে পরাজিত হয়ে আসর থেকে বিদায় নিয়েছে পেলের ব্রাজিল। ব্রাজিলের বিপক্ষে পর্তুগালের খেলা ছিল সুন্দর ফুটবলের সাথে শারীরিক ফুটবলের বেশ ভালো সংমিশ্রণ। তাছাড়া পর্তুগাল দলে ছিল কালো চিতা খ্যাত ইউসেবিও, যিনি ছিলেন পর্তুগালের সবচেয়ে বড় ভরসা।
কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইতালিকে হারিয়ে বাড়তি মনোবলের উত্তর কোরিয়ার শুরুটা যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিল, তাদের শুরুটা হয়েছিল তার চেয়েও অনেক বেশি দুর্দান্ত। ম্যাচের প্রথম মিনিটেই পাক সিউং জিন গোল করলে পর্তুগালকে বিহ্বল করে দেয় দলটি। বিস্ময়ের রেশ কাঁটাতে প্রতিপক্ষকে সম্ভবত এক মুহূর্ত সময় দিতেও রাজি ছিল না কোরিয়ানরা। তাই ম্যাচের ২২ মিনিটে ডং কুক ব্যবধান দ্বিগুণ করলেও থেমে থাকেনি তারা। ৩ মিনিটের ব্যবধানেই কোরিয়ার হয়ে তৃতীয় গোলটি করেন ইয়াং কুক। ম্যাচের মাত্র ২৫ মিনিটে পর্তুগালের বিপক্ষে ৩-০ গোলে লিড নিয়ে উত্তর কোরিয়া থমকে দিয়েছিল গোটা স্টেডিয়াম।
উত্তর কোরিয়ার গোল উৎসব শেষে মঞ্চে আবির্ভূত হন ইউসেবিও, বাকিটা সময় ছিল শুধু ইউসেবিওময় এবং তার কিংবদন্তিতুল্য পারফর্মেন্সের দরুন ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ায় পর্তুগাল। ২৭ মিনিটে পর্তুগালের হয়ে প্রথম গোলটি করার পর প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মিনিট আগে পেনাল্টি থেকে দ্বিতীয় গোল করে ব্যবধান কমিয়ে আনেন এই কিংবদন্তি। দ্বিতীয়ার্ধে কোরিয়ানরা রক্ষণ সামাল দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে গেলেও ইউসেবিও হয়তো পণ করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার রূপকথার শেষ থেকেই তিনি শুরু করবেন পর্তুগালের রূপকথার নতুন অধ্যায়ের। শেষপর্যন্ত তিনি করেছিলেনও।
অসাধারণ নৈপুণ্যে দ্বিতীয়ার্ধের নয় মিনিটের মাথায় হ্যাটট্রিক সম্পূর্ণ করেন কালো চিতা এবং দলকে ৩-০ থেকে টেনে নিয়ে আসেন ৩-৩ গোলে চোখ ধাঁধানো ফলাফলে। সমতায় ফেরানোর তিন মিনিট পর প্রায় মাঝমাঠ থেকে অপ্রতিরোধ্য ইউসেবিও প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকে পড়লে ফাউলের শিকার হন এবং আদায় করে নেন পেনাল্টি। পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে জয়ের পথে এক ধাপ এগিয়ে নেন তিনি এবং তৈরি হয় অবিস্মরণীয় এক ইতিহাসের। এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি উত্তর কোরিয়া, ম্যাচ শেষ হওয়ার ১০ মিনিট পূর্বে পর্তুগালের হয়ে পঞ্চম গোলটি করে ৫-৩ গোলে জয় নিশ্চিত করেন হোসে আগুস্তু। ফুটবল বিশ্বকাপের অসাধারণ প্রত্যাবর্তনগুলোর মধ্যে এই ম্যাচটি আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে, কেননা ৩-০ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর কোনো দল জিততে পারেনি আজও, যা ইউসেবিওর পর্তুগাল করে দেখিয়েছে অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় আগে।
১৯৭০, পশ্চিম জার্মানি ৩-২ ইংল্যান্ড
মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড অংশগ্রহণ করেছিল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, কিন্তু তাদের দুঃস্বপ্নের শেষটা শুরু হয় কোয়ার্টার ফাইনালেই, যখন তারা পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয়। ১৯৬৬ সালের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড দলের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না এই আসরের দলটিও, অনেকে এই দলটিকে চ্যাম্পিয়ন দলটির চেয়েও ভালো মনে করে। ফুটবল বিশ্বকাপ কখনোই চমক দিতে কার্পণ্য করেনি এবং ব্যাপারটা আরও জমে ওঠে যখন প্রতিপক্ষ জার্মানি।
ইংল্যান্ড দল ম্যাচের ৪৯ মিনিটের মধ্যেই অ্যালান ও পিটারের গোলের সুবাদে ২-০ গোলের দুর্দান্ত সূচনা করে। ম্যাচের এই অবস্থা থেকেও যে ববি মুর ও ববি চার্লটনদের ইংল্যান্ড ম্যাচটি হারতে পারে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। বিশ্বকাপ আসরে ইতিহাস তৈরি করেন কিংবদন্তিরা কিংবা ইতিহাস সৃষ্টি করে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন অনেকে। তেমনি জার্মানির হয়ে শুরুতে এগিয়ে আসেন কিংবদন্তি বেকেনবাওয়ার, দ্বিতীয়ার্ধের ৬৮ মিনিটে এই কিংবদন্তির শট ইংল্যান্ড গোলরক্ষক পিটার বনেত্তিকে ফাঁকি দিয়ে জালে জড়ালে শুরু হয় জার্মানির হার না মানা আগ্রাসনের নতুন অধ্যায়।
ইংল্যান্ড কোচ চার্লটনকে ম্যাচের ৬৯ মিনিটে তুলে নিয়ে মিডফিল্ডার কলিন বেলকে মাঠে নামান। মনে করা হয়, ম্যাচটিতে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দিয়েছিল কোচদের খেলোয়াড় বদলি করার কৌশল এবং এক্ষেত্রে অবশ্যই কৌশলগত দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন জার্মান কোচ হেলমুট। অন্যদিকে চার্লটনকে তুলে নেওয়ার পর থেকেই ম্যাচে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডের প্রভাব কমতে শুরু করেছিল।
৮২ মিনিটে জার্মানির অধিনায়ক জিলার হেডে সমতাসূচক গোলটি করলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ইংল্যান্ড কোচ রামজে মনে করেন, বেকেনবাওয়ারের শট ও জিলারের হেড আটকানো উচিত ছিল গোলরক্ষক বনেত্তির। যা-ই হোক, অতিরিক্ত সময়ের ১০৮ মিনিটে গার্ড ম্যুলার জয়সূচক গোলটি করলে ইংল্যান্ডের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় এবং বাকি সময়ের তারা আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি। এই ম্যাচ শেষে পিটার বনেত্তিকে নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা করা হয় এবং শেষপর্যন্ত তার মা অনুরোধ করেন এতটা নির্মম না হওয়ার জন্য। অবধারিতভাবে ইংল্যান্ডের হয়ে বনেত্তির এটিই ছিল শেষ ম্যাচ।
১৯৭০, ইতালি ৪-৩ পশ্চিম জার্মানি
‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’ খ্যাত ম্যাচটিতে মেক্সিকো ‘৭০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল রক্ষণাত্মক ফুটবলের জন্য বিখ্যাত ইতালি এবং আক্রমণাত্মক পশ্চিম জার্মানি, যারা ম্যাচের শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত হাল ছাড়ে না। ম্যাচটি নিয়ে আলোচনা করার মতো তেমন কিছু থাকতো না যদি ম্যাচের মাত্র ৮ মিনিটে রবার্তো বনিসেইনার গোলে লিড নিয়ে ইতালি ম্যাচ শেষ করতে পারতো। ম্যাচের প্রায় শেষ মুহূর্তে, ঠিক ৯০ মিনিটে জার্মানির লেফট ব্যাক কার্ল হেইঞ্জ স্লেইলিনার গোলে সমতায় ফেরে জার্মানি এবং ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
ম্যাচটিকে কেন ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলা হয়ে থাকে সব উত্তর এই অতিরিক্ত সময়ের ৩০ মিনিটে নিহিত রয়েছে। অতিরিক্ত সময়ে গোল হয়েছে মোট ৫টি এবং এক গোলের ব্যবধানে হলেও এগিয়ে থাকার সুবিধার রদ-বদল হয়েছে তিনবার। কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালি মেক্সিকোর বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকলেও শেষপর্যন্ত ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে সেমিতে পা রাখে দেশটি এবং পশ্চিম জার্মানিও ফুটবল বিশ্বকাপের আরেকটি ক্লাসিক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে ঘুরে দাঁড়ানোর অসাধারণ নজির স্থাপন করে। অতিরিক্ত সময়ের ৯৪ মিনিটে জার্ড ম্যুলার গোল করলে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি এবং মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানেই তারচিসিওর গোলে সমতায় ফিরে ইতালি।
১০৪ মিনিটে জিজি রিভার গোলে এগিয়ে যাওয়া ইতালিকে আবারও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন ১১০ মিনিটে জার্ড ম্যুলার তার দ্বিতীয় গোলটি করেন। ম্যাচটি যদি ৩-৩ গোলের সমতায় শেষ হতো তাহলে ফুটবল বিশ্বকে দেখতে হতো কয়েন টসের মাধ্যমে বিজয়ী নির্ধারণের এক হাস্যকর প্রথা, কিন্তু সেজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য ইতালির মাঝমাঠের খেলোয়াড় জিয়ান্নি রিভেরার। ম্যুলারের গোলের মাত্র এক মিনিটের মধ্যেই ইতালির চতুর্থ ও জয়সূচক গোলটি করেন তিনি এবং শেষপর্যন্ত রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে ৪-৩ গোলের জয় পায় ইতালি। তাদের অসাধারণ এই জয়ের আনন্দের সলিল সমাধি ঘটে ফাইনালে, যখন তারা ব্রাজিলের বিপক্ষে ৪-১ গোলে পরাজিত হয়ে শিরোপা বঞ্চিত হয়েছিল।
ম্যাচটি শেষে জার্মানির স্ট্রাইকার উবে জিলার বলেছিলেন, “ইংল্যান্ড ও ইতালির সাথে আমাদের অতিরিক্ত সময়ের ম্যাচগুলোর পর যদি ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলতে হতো, তাহলে আমরা ৫ গোলে পরাজিত হতাম।”
২০১৮, বেলজিয়াম ৩-২ জাপান
ফুটবল বিশ্বকাপে ১৯৭০ সালের পর বিগত ৪৮ বছরে এই প্রথম কোনো দল নক আউট পর্বে ২-০ গোলে পিছিয়ে পরার পরও ম্যাচটি জিতেছে এবং অসাধারণ এই কৃতিত্ব চলতি রাশিয়া ‘১৮ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট দল বেলজিয়ামের।
গ্রুপপর্বে শক্তিশালী বেলজিয়াম তেমন একটা কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়নি। রাউন্ড ষোলোতে বেলজিয়ামের প্রতিপক্ষ যখন জাপান, তখনও কেউ হয়তো ভাবেনি ফুটবল বিশ্ব দেখতে যাচ্ছে অসাধারণ একটি ম্যাচ। ম্যাচের প্রথমার্ধে গোল করতে পারেনি কোনো দলই এবং খেলার চমক শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। বিরতির তিন মিনিট পর হারাগুচির দারুণ শটে কর্ত্যুয়া পরাস্ত হলে লিড নেয় জাপান। প্রথম গোলের মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বক্সের বাইরে থেকে দুর্দান্ত গতির শটে এবার গোল করেন জাপানের ইনুই। ম্যাচে তখনও বেলজিয়ামের বলার মতো প্রভাব বা আধিপত্য ছিল না। ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও রক্ষণাত্মক ফুটবল না খেলে বরাবরের মতো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে গিয়েছে জাপান, শেষপর্যন্ত এর মাশুল গুনতে হয়েছে তাদের। ম্যাচে ফিরতে মরিয়া বেলজিয়াম আক্রমণ জোরালো করলে অবশেষে তারা গোলের দেখা পায় ম্যাচের ৬৯ মিনিটে।
ভার্তোগেনের হেডে করা গোলটি বেলজিয়ামের ডুবতে থাকা তরীতে কিছুটা ভরসা যোগায়। বদলি হিসেবে নামা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার ফেলাইনি হেড থেকে সমতাসূচক গোলটি করেন প্রথম গোলের পাঁচ মিনিট পরেই। ম্যাচটির ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল মার্তিনেজের দুই বদলি খেলোয়াড়ই। ম্যাচের নির্ধারিত সময় শেষ হলে যোগ হয় অতিরিক্ত চার মিনিট। যোগ হওয়া চার মিনিটও প্রায় শেষের দিকে, বেলজিয়ামের অর্ধে কর্নার পাওয়া জাপান নিজেদের রক্ষণ পূর্ণ সুরক্ষিত না রেখেই অংশ নিয়েছিল কর্নার কিকে। শেষ মিনিটেরও প্রায় শেষ সেকেন্ডে জাপানের কর্নার থেকে প্রতি-আক্রমণের সুযোগ পায় বেলজিয়াম, দুর্দান্ত এই আক্রমণ থেকে জয়সূচক গোলটি করেন বেলজিয়ামের আরেক বদলি খেলোয়াড় চাদলি। এই গোলেই শেষ হয়ে যায় জাপানের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার স্বপ্ন এবং বেলজিয়াম রচনা করে নতুন এক প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস।
ফিচার ইমেজ- foxsports.com.au