২৮ নভেম্বর, ২০১৬; দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় সারির ক্লাব টুর্নামেন্ট কোপা সুদামেরিকানার ফাইনাল ম্যাচ খেলতে কলম্বিয়া যাচ্ছিলো ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব শ্যাপেকোয়েন্স। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে চতুর্থ বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত হওয়া শ্যাপেকোয়েন্সের জন্য এই ফাইনালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোপা সুদামেরিকানার শিরোপাটা জিতে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে নতুন দ্বার উন্মোচন করা হবে- এমন স্বপ্নেই প্রতিটি খেলোয়াড় বিভোর ছিল। তবে আচমকা এক আঘাতে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়!
সেদিনের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় ৭৭ জন যাত্রীর মধ্যে ৭১ জনই নিহত হয়, যার মধ্যে শ্যাপেকোয়েন্সের খেলোয়াড় ছিল ১৯ জন! পুরো বিশ্ব সেই ঘটনার শোকে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলো, ক্লাবটিকে সাহায্য করতে অনেক প্রতিষ্ঠানই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
এ বছর সেই ভয়াল ঘটনার দু’বছর পূর্ণ হলো। সেদিনের দুর্ঘটনায় নিজেদের প্রায় সবগুলো খেলোয়াড়কে হারানো ক্লাবটি এই দুই বছরে ঠিক কেমন সময় পার করেছে? কতটা কঠিন ছিল তাদের লড়াই? তাদের বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কেমন?
আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এমন একটা বিশাল ক্ষতি সত্ত্বেও ২০১৭ মৌসুমের সিরি আ-তে শ্যাপেকোয়েন্সের সময়টা কিন্তু বেশ ভালোই কেটেছিলো! সেই মৌসুমেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠেছিলো দলটি! প্রচণ্ড শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার ফলেই হয়তো এমনটা সম্ভব হয়েছিলো। যদিও শীর্ষস্থানে তাদের সেই অবস্থানটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তবুও তাদের সেই মৌসুমের পারফরম্যান্স বেশ সন্তোষজনক ছিল। লিগে তাদের অবস্থান ছিল অষ্টম, এর আগে কখনোই এত ভালো অবস্থানে থেকে লিগ শেষ করতে পারেনি তারা।
এমন পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছিলো, শ্যাপেকোয়েন্স বুঝি ২০১৮ মৌসুমে আরো ভালো করবে। কিন্তু বিধি বাম! এই মৌসুমের শুরু থেকেই ক্লাবটির পারফরম্যান্সের গ্রাফ ভীষণ নিম্নমুখী ছিল। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে লিগের শেষ রাউন্ডে দলটি রেলিগেটেড হয়ে যায় কি না এমন আশঙ্কাও জেগে ওঠে। ২০১৩ সালে সিরি আ-তে উন্নীত হওয়ার পর এত খারাপ অবস্থায় কখনোই পড়তে হয়নি তাদের। অথচ এমনটা হওয়ার কথা কিন্তু ছিল না। ২০১৬ সালের বিশাল ক্ষতি সত্ত্বেও যে ক্লাবটি ২০১৭ সাল অষ্টম স্থানে থেকে লিগ শেষ করে, তাদের কেন এবারের মৌসুমে রেলিগেশন এড়ানোর জন্য লড়তে হলো?
প্রথমে যে কারণটির কথা উল্লেখ করতে হবে সেটি অবশ্যই ক্লাবটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিপূরণের জন্য শ্যাপেকোয়েন্সের বিরুদ্ধে ৫৪টি মামলা করেছে। যদিও সবার ক্ষতিপূরণ মেটানোর জন্য ক্লাবটি আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তাৎক্ষণিকভাবে সবার ক্ষতিপূরণ একসাথে দেওয়া সম্ভব না হলেও আগামী দশ বছরের মধ্যে যাতে সবাই তাদের প্রাপ্য অর্থ পেয়ে যায় সেই চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই মৌসুমে রেলিগেটেড হয়ে গেলে সেই চেষ্টায় বড় একটা ধাক্কা অবশ্যই লাগতো, কারণ সিরি আ-তে খেলার দরুণ যেখানে শ্যাপেকোয়েন্স প্রতি বছরে ৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড টেলিভিশন স্বত্ত্ব হিসেবে পাচ্ছে, সেখানে সিরি বি-তে অবনমিত গেলে সেই অর্থ নেমে দাঁড়াতো মাত্র ১.৪৩ মিলিয়ন পাউন্ডে! এ প্রসঙ্গে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডগলাস বলেন, “আমরা সবাই রেলিগেশন এড়ানোর ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমাদের একদম নতুন থেকে শুরু করতে হয়েছে। আমরা জানি, অনেকগুলো পরিবারের ভালোমন্দ এই ক্লাবের উপরেই নির্ভরশীল। সেই নির্ভরশীল মানুষগুলোর জন্য হলেও সিরি আ-তে আমাদের টিকে থাকতে হবে– এটাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য।”
ড্রেসিংরুমেও খেলোয়াড়েরা এসব অর্থনৈতিক ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত থাকতো এমন কথাও শোনা গেছে। তবে এমন খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যাটাই দায়ী এটা ভাবাটাও ভুল হবে। এই সমস্যা তো আগের মৌসুমেও ছিল, তবে সেই মৌসুমে পারফরম্যান্সের গ্রাফ কেন ভালো ছিল? সেই মৌসুমে দলটির অধিকাংশ খেলোয়াড়ই অন্য ক্লাব থেকে ধারে খেলতে এসেছিলো। তারা হয়তো এই শহরের কেউ ছিল না, আগের কোনো ঘটনায় তাদের প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগও ছিল না, তবুও তারা নিজেদের উজাড় করে খেলেছিলো। আর সেই কারণেই বেশ আনকোরা দল নিয়েও সেই মৌসুমে ভালো করেছিলো তারা।
সেই ভয়াল দুর্ঘটনায় যে ছয়জন মানুষ জীবিত ফিরে এসেছিলো, তাদেরই একজন জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার রাফায়েল হেঞ্জেল। প্রিয় ক্লাবের এমন দুর্দশার ব্যাপারে তিনি বলেন, “গত মৌসুমে শ্যাপেকোয়েন্স সেই ট্র্যাজেডি থেকে সবেমাত্র ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলো, যদিও তখন দলটির অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ধারে খেলতে এসেছিলো, কিন্তু প্রতিটি খেলোয়াড়ের মাঝে আলাদা একটা অনুপ্রেরণা কাজ করেছিলো। মৃত খেলোয়াড়দের স্মৃতির সম্মানার্থে কিছু একটা করার অভিপ্রায় প্রত্যেকের মাঝেই ছিল। কিন্তু এই মৌসুমে খেলোয়াড়দের মাঝে আমি তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
সাফল্যের আশায় বেশ চড়া দামে খেলোয়াড় কেনাও শুরু করেছিলো শ্যাপেকোয়েন্স। সেটাও ক্লাবের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে এনেছে বলে মনে করেন ক্লাবটির সাবেক কার্যনিবাহী সদস্য আন্দ্রেই কোপেত্তি। তিনি আরো বলেন, “আমরা যখন সারাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছিলাম তখন আমাদের সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত খেলোয়াড় ছিলেন ব্রুনো র্যাঙ্গেল (যিনি সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন), তার বেতন ছিল মাসে প্রায় ২৫ হাজার পাউন্ড। এখন আমরা কোনোকিছু চিন্তাভাবনা না করেই একজন খেলোয়াড়কে মাসে ৪০ হাজার পাউন্ড দিচ্ছি, যাদের কাছ থেকে আমার সেরকম পারফরম্যান্সও পাচ্ছি না।”
তাছাড়া মাঠের বাইরের বিতর্কও ক্লাবের অবস্থাকে আরো টালমাটাল করেছে। গিলসন ক্লেনিয়া, গুটো ফেরেইরা আর ক্লদিনেই অলিভিয়েরা– এক মৌসুমে এই তিনজন মানুষকে শ্যাপেকোয়েন্সের ডাগআউটে কোচ হিসেবে দেখা গেছে! এভাবে হুটহাট কোচবদল কোনো দলের জন্যই ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে না, শ্যাপের জন্যেও পারেনি। রুই কস্তা ও জোয়াও কার্লোসের মতো অসাধারণ পরিচালকদেরও হুট করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাথে ক্লাব প্রেসিডেন্ট পিনিও ডেভিডকে নিয়ে চলা বিতর্ক গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে যোগ হয়েছে।
এতকিছুর পরেও শ্যাপেকোয়েন্সের ভক্তরা তাদের সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে প্রিয় ক্লাবকে সমর্থন যুগিয়ে গিয়েছে। রেলিগেশন এড়ানোর জন্য সাও পাওলোর বিপক্ষে শেষ রাউন্ডের ম্যাচে তাদের জয় ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। শেষ রাউন্ডের সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে প্রিয় ক্লাবকে সমর্থন জানানোর জন্য ঘরের মাঠ অ্যারেনা কোন্ডায় রেকর্ড ১৯,৯৩২ জন দর্শক উপস্থিত হয়েছিলো, যেখানে শ্যাপেকোর মোট জনসংখ্যাই মাত্র সোয়া লাখ! এতগুলো মানুষের আগমন বৃথা যেতে পারে না। শেষপর্যন্ত তাই শেষরক্ষাটা হয়েছে। শেষ রাউন্ডে সাও পাওলোকে ১-০ গোলে হারিয়ে রেলিগেশন জোন থেকে ২ পয়েন্ট বেশি নিয়ে ১৪ তম স্থানে থেকে এবারের লিগ শেষ করেছে শ্যাপেকোয়েন্স।
রেফারি যখন ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজালেন, সাথে সাথে পুরো অ্যারেনা কোন্ডা বুনো উল্লাসে ফেটে পড়ে। প্রেস বক্সে থাকা হেঞ্জেলও নিজের আবেগকে আটকাতে পারেননি। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বারবার বলে গেছেন, “শ্যাপেকোয়েন্স কোনোদিন রেলিগেটেড হতে পারে না, কোনোদিন না।”
এমন লড়াকু একটি ক্লাব কখনোই নিচের স্তরে নেমে যেতে পারে না সেটা আমরাও বিশ্বাস করি। আর কারো জন্য না হোক, পরলোকগত সেই মানুষগুলোর জন্য হলেও শ্যাপেকোয়েন্সের টিকে থাকাটা যে বড্ড জরুরি। সব সমস্যা, বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে ক্লাবটি সাফল্যের পথ খুঁজে পেয়ে আবারো কোনো নতুন রূপকথা সৃষ্টি করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।