Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাকিব আল হাসান: একজন অধিনায়ক ও এক আহত বাঘের গল্প

মুস্তাফিজুর রহমানকে ২ বলে ২টি বাউন্সার দিলেন ইসুরু উদানা। তাও যেন-তেন বাউন্সার নয়, একেবারে মাথার পাশ দিয়ে। দ্বিতীয়টিতে রান আউটের শিকার ‘দ্য ফিজ’। বিষয় সেটা নয়, ২ বাউন্সারের কারণে নো বল দিয়েও যে ফিরিয়ে নিয়েছেন আম্পায়াররা! উইকেটে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ততক্ষণে আম্পায়ারদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন। ম্যাচে নখ কামড়ানো উত্তেজনা। নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ৪ বলে প্রয়োজন ১২ রান। এমন সময় আম্পায়ারদের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি বাউন্ডারির বাইরে থাকা অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও। সেখানে ম্যাচ রেফারিকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ওদিকে মাঠের মধ্যে চলছে আরেক কথার লড়াই।

এমতাবস্থায় সাকিব হুট করে ডাক দিলেন মাঠের দুই ব্যাটসম্যানকে! অর্থাৎ, ম্যাচ বয়কটের ইঙ্গিত! সবাইকে বের হয়ে আসতে বলে নিজেও উঠে গেলেন ড্রেসিংরুমের সিঁড়িতে। পরক্ষণেই অবশ্য বাংলাদেশ দলের কোচ কোর্টনি ওয়ালশ ও ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনের হস্তক্ষেপে এসব ঝামেলা মিটলো। কিন্তু সাকিবের অমন আক্রমণাত্বক নেতৃত্ব যেন আরও ‘বুস্ট আপ’ করেছিল রিয়াদকে। জয়ের ক্ষুধা যেন খুব করে জেঁকে বসেছিল মাথার  মধ্যে। আবারও  খেলতে নেমে নিশ্চিত ওয়াইড বলকে ৪ মেরে বসলেন, ছক্কা হাঁকিয়ে সেই ম্যাচ জিতলন আরও একটি বল হাতে রেখেই!

উদযাপনে জয়ের নায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ; Source: AP

ব্যাট হাতে ১৮ বলে ৪৩ রান করে ম্যাচ জেতানোর নায়ক অবশ্যই রিয়াদ। কিন্তু ইনজুরির শঙ্কা মাথায় নিয়েও নিদাহাস ট্রফিতে যোগ দিয়ে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেভাবে সাকিব অধিনায়কত্ব করলেন তা সমর্থক এমনকি তার শত্রুরাও মনে রাখবে অনেকদিন।

শেষ মুহূর্তে কী হয়েছিল? সাকিবের ভাগ্যে কী জুটলো?

সংবাদ সম্মেলনে জয়ের ব্যাপারগুলো যেমন আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল, তেমনই শেষ ওভারে সাকিবদের কথার লড়াই,  মাঠ থেকে বের হয়ে আসতে বলার মতো ঘটনাও খুব আলোচিত হয়েছিল। অবশ্য সাকিব এ প্রসঙ্গে উত্তর দিয়েছেন কৌশলে। হাত নেড়ে ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্যে যা-ই বলুন না কেন, সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘ওই  ইঙ্গিত আসলে দুটিই হতে পারে। ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিতও হতে পারে, বের হয়ে আসারও ইঙ্গিত হতে পারে।’

কিন্তু সত্যিই যদি বের হয়ে আসার  মতো কিছু ঘটতো, তাহলে নিষেধাজ্ঞার শিকার হতেন সাকিব। ভাগ্য বাঁচিয়েছে, সেটা হতে হয়নি। তবে শাস্তি পেয়েছেন তিনি। রাতের মধ্যেই ম্যাচ রেফারি তার ম্যাচ ফি’র ২৫ শতাংশ কেটে নিয়েছেন ও একটি ডিমেরিট পয়েন্ট সাকিবের নামের পাশে লিখে রেখেছেন। অবশ্য মূল একাদশে না খেলেও মাঠের মধ্যে উদযাপনের সময় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার কুশল মেন্ডিস ও অধিনায়ক থিসারা পেরেরার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে ডিমেরিট পয়েন্ট পেয়েছেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান।

থিসারা পেরেরার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় নুরুল হাসান সোহান; Source: AFP

শুক্রবার রাতে সাকিবকে যেভাবে পাওয়া গেছে, তা বোধ হয় খুব কম সময়েই পাওয়া গেছে। হতে পারে সেটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার  মতো অবস্থার কারণে। তাই নিজেকে সামলে নিচ্ছেন তিনি। ভুল শিকার করছেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য। এ প্রসঙ্গে সাকিব বলেছেন,

আপনি কখনোই টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এর চেয়ে বেশি ভালো আশা করতে পারবেন না। অনেক বেশি আবেগ, রোমাঞ্চ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই শ্রীলঙ্কা দলের প্রতি। শুরুতে ওরা ৫ উইকেট হারিয়েছিল। পরে কুশল পেরেরা ও থিসারা পেরেরার ব্যাটে ভালো স্কোর উঠেছে। শেষ দিকে কেউ আমরা নার্ভাসনেস ধরে রাখতে পারিনি। মাঠে সবসময় একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকে, বাইরে আমরা সবাই বন্ধু। অধিনায়ক  হিসেবে আমাকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। ভবিষ্যতে আমি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবো।”

ম্যাচে সাকিবের অধিনায়কত্ব

অধিনায়ক হিসেবে সাকিব তার ‘চালবাজি’ শুরু করেছেন দলে নিজের জায়গা করে নেওয়ার মধ্যে থেকেই। দলের অধিনায়ক ও ‘কি’ খেলোয়াড় হিসেবে তার ইনজুরির অবস্থায় চোখ ছিল শ্রীলঙ্কার টিম ম্যানেজমেন্টেরও। তারই ধারাবাহিকতায়, চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে ১২ মার্চ জানানো হয়, কেবল খেলাধুলা করার মতো অবস্থাতে আসতেই আরও ৯-১০ দিন সময় লাগবে সাকিবের। এরপর ম্যাচ ফিটনেস পেতে আরও সপ্তাহখানেক। এরপর তিনি খেলবেন কিনা তা নির্ভর করছে সাকিব ও নির্বাচকদের উপর।

এমন সব খবরে লঙ্কান শিবিরে চাপ নয়, বরং জয়ের পথে মানসিকভাবেই এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু ম্যাচের ঠিক দু’দিন আগে হুট করে সাকিব উড়ে গেলেন শ্রীলঙ্কায়! ডাক্তারি নির্দেশ আর বিপদের শঙ্কাকে পিছনে ফেলে ম্যাচের জন্য প্রস্তুতি  শুরু করলেন। বলা যায়, যুদ্ধের প্রস্ততি। তার প্রথম তোপেই খানিকটা যেন ঘাবড়ে গেলেন লঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। সাকিবকে নিয়ে কোনো রকমের প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগই সাকিব দেননি তাকে। তাতে হাথুরুসিংহে হাঁটলেন উল্টো পথে। বললেন-

‘বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো সাকিবকে এই ম্যাচে তারা পাচ্ছে।’

অবশ্য সাকিবকে ছাড়াই শ্রীলঙ্কাকে প্রথম ম্যাচে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সাকিবকে পেয়ে দলের অবস্থা যেন আরও অন্যরকম হয়ে গেল। ফাইনালের টিকিটের জন্য প্রয়োজন কেবল একটি জয়। তাতেই বদলে যাবে সবকিছু।

মাঠে ফিরেই উইকেট শিকার, অতঃপর উদযাপন; Source: AP

সেটাই হলো। কিন্তু সাকিব দলকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সবকিছু এলোমেলো করে ফেললেন। কখন কি করছেন, কিছুই বুঝে ওঠার সুযোগ দেননি শ্রীলঙ্কাকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি দলের প্রতিটি ক্রিকেটারের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা থাকে প্রতিপক্ষ দলের। কে কখন নামছে, কে কখন বল করছে সেসবের উপর ভিত্তি করেই এসব পরিকল্পন করা হয়। কিন্তু সাকিব যেন গোলক ধাঁধায় ফেলে দিলেন হাথুরুসিংহেদের। ১৬০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিয়মিত ব্যাটিং অর্ডার বদলে দিলেন মুড়ি মাখানোর মতো করে।

নিজের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা দুই নম্বরে ব্যাট করালেন সাব্বির রহমানকে! নিজে নামলেন ৭ নম্বরে। ওপেন করালেন লিটন কুমার দাসকে দিয়ে। কিন্তু সৌম্য সরকারকে ব্যাট করতে দিলেন ৫ নম্বরে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, শুরুর ধাক্কা যেন শেষের দিকে প্রভাব ফেলতে না পারে, সেই প্রতিষেধকটা আগেই নিয়ে রাখলেন সাকিব। সেটা মোটামুটি কাজেও দিয়েছিল। তবে এখানে মূল অবদান তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। তাদের ব্যাটেই সর্বোচ্চ (তামিম ৫০, রিয়াদ ৪৩) রান পেয়েছে দল। শুধু তা-ই নয়, তারা দুজন যেন মনপ্রাণ দিয়ে খেলেছেন।

সাকিবের শঙ্কা ছিল ব্যাটিং করা নিয়ে। সেই ব্যাটিংয়ে ৭ রান করেই আকিলা ধনজঞ্জয়ার বলে ক্যাচ আউট হয়েছেন। গতানুগতিক কিছু কাজ করেছেন। টস জিতে আগে ফিল্ডিং করতে নেমে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে বাঁহাতি স্পিনার দেওয়া যাবে না, সেই আদ্যিকালের প্রবাদ যেন সাকিবও মনে রাখেন। তা না হলে ৪১ রানে ৫ জন লঙ্কান ব্যাটসম্যানকে ফেরানোর পর এমন করে কেন জেগে উঠবে শ্রীলঙ্কা?

নিজে ২ ওভার বল  করে ৯ রান খরচ করেছিলেন। কিন্তু কুশল-থিসারা দুজনেই বাঁহাতি হওয়ার কারণে আর বোলিংই করেননি তিনি! একইভাবে বাঁহাতি হওয়ায় স্পিনার নাজমুল অপুকে একটি ওভারও বল করাননি। তাতে লাভ হয়নি। তবে বাঁহাতি পেসারের হাতে বল তুলে দিয়েছেন তিনি। মুস্তাফিজের পর সৌম্য সরকারকে দিয়েও ২ ওভার  বল করিয়েছেন। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। সৌম্য ২ ওভারে ২১ রান খরচ করেছেন। ডানহাতি ফাস্ট বোলারা রুবেল ৪ ওভারে দিয়েছেন ৪১ রান। এছাড়া বাংলাদেশের ‘টাইট ফিল্ডিং’ ছিল দেখার মতো। টি-টোয়েন্টির রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা পরতে পরতে টের পাইয়েছেন সাকিব।

ইনজুরি ও শেষ কথা

এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ইনজুরিতে পড়েছিলেন সাকিব। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল ম্যাচে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েন তিনি। ওই ম্যাচে আর ফেরা হয়নি তার। এরপর থেকেই মাঠের বাইরে বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউণ্ডার।

সেই ইনজুরি; Source: AP

নতুন দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মাশরাফি বিন মুর্তজা অবসর নেওয়ায় টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব, মুশফিককে সরিয়ে দেওয়ায় বিসিবি তাকে টেস্টেও দায়িত্ব দেয়। জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্ট ও দুই টি-টোয়েন্টি খেলে বাংলাদেশ। যথারীতি মাঠের বাইরে সাকিব। কিন্তু নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি তিনি। প্রথম টেস্টে চট্টগ্রামে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন খেলা দেখতে। ঢাকায়ও এসেছিলেন। নিজের বাইরে থাকাটা যেন মানতে পারছিলেন না। ফেরার লড়াই ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। লঙ্কা সিরিজ না পেলেও, লঙ্কা মুল্লুকে ত্রিদেশীয় ভারত ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফি খেলছেন তা নিশ্চিত ছিল। পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়। বোলিং ও ফিল্ডিং করছিলেন পুরোদমে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ব্যাটিং নিয়ে। আহত আঙ্গুলের কারণে ব্যাট ‘গ্রিপ’ করতে পারছিলেন না সাকিব।

চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে টেস্ট ম্যাচ দেখছেন সাকিব। পাশে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। Source: BCB

তারপরও আশা ছাড়েননি তিনি, আশা ছাড়েনি তার টিম ম্যানেজমেন্ট। তাকে নিয়েই ১৬ সদস্যর দল গড়ে বাংলাদেশ। একই দিনে এটাও জানানো হয়, প্রথম দুয়েকটি ম্যাচে থাকতে পারবেন না সাকিব। কারণ সেই ব্যাট করতে না পারা। তারপরও দলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় সফর করলেন। সেখান থেকে আঙ্গুলের চিকিৎসার জন্য উড়ে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক গ্রেগ হয়ের দেওয়া ব্যাথানাশক ইঞ্জেকশন তথা ‘দাওয়াই’ কাজ করেছিল সঠিকভাবেই। তারপরের গল্পটা তো সবারই জানা।

মাশরাফির মতো সাকিব একজনই। একেকজন নিজের জগতে আলাদা। যার নেই কোনো শাখা, নেই কোনো বিকল্প। সাকিবের শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, মাশরাফি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের যে একজন আক্রমণাত্বক অধিনায়কহীনতায় ভুগতে পারতো, সেটার অভাব হয়তো বুঝতে দেবেন না এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার।

ফিচার ইমেজ- Indian Express

Related Articles