Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.
তখন আফগানিস্তানে বেঁধেছে যুদ্ধের দামামা। নারী-শিশু-বুড়ো-যুবক দলে দলে সবাই আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে। আফগান যুবকদের সেই দুঃস্বপ্নের সময়গুলো রঙ পেয়েছিল কেবল ক্রিকেট দিয়ে। হ্যাঁ, এ কথা সত্যি। আফগানিস্তানের ক্রিকেটের শিকড় মূলত পাকিস্তানে থাকাকালীন সময়ে শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে। আর আজ? পৌঁছে গেছে ক্রিকেট বিশ্বের সবখানে। সাফল্যের জয়গান ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। যার সর্বশেষ সংযোজন, বাংলাদেশের বিপক্ষে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়। আর এই জয়ের কাণ্ডারী হওয়ার পিছনে লুকিয়ে আছে একটি নাম- নওরোজ মঙ্গল।
ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে নওরোজ; Image Source: ICC Cricket
২০০৩ সালের কথা। শিবিরে তখন ক্রিকেট নিয়েই আলোচনা চলে। আফগানিস্তানের যুবকদের পাকিস্তানের সমর্থন চলে পুরোদমে। আর ধূসর চোখে স্বপ্ন দেখে নিজ দেশের হয়ে ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করার। পাকিস্তানের খেলা মানেই যতটা সম্ভব মাঠের গ্যালারিতে বসে দেখতে চাওয়া। পেশোয়ারে তেমনই এক ম্যাচে গ্যালারিতে বসেছিলেন নওরোজ মঙ্গল। সেদিনই ভেবেছিলেন, একদিন আফগানিস্তানও খেলবে এভাবেই। হাজার হাজার সমর্থক দেখবে তাদের ব্যাট-বলের লড়াই। নওরোজ মঙ্গল পেরেছিলেন। পেরেছিলেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় অধিনায়ক হতে, প্রধান নির্বাচক হতে…। আর এখন দেশের ব্যাটিং কোচ টি-টোয়েন্টির আক্রমণাত্মক আফগান দলকে আমূল বদলে দিচ্ছেন টেস্টের জন্য। মূলত তার হাত ধরেই টেস্টে নিজেদের ‘ইজারা’ নিয়েছে আফগানিস্তান ক্রিকেট দল। টি-টোয়েন্টির জবরদখলের যুগে, প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেটে।
চট্টগ্রামের সাগরিকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পাওয়াটা তাই নওরোজের জন্য একটু বেশিই ‘স্পেশাল’। বাংলাদেশের সাথে নওরোজের গল্পটা বেশ পুরনো। জড়িয়ে আছে অনেক কিছু। যেমন পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেই ম্যাচ দেখেই জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন, তেমনই ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটাও খেলেছেন এই বাংলাদেশের বিপক্ষেই। পুরনো দিনের সেই সব কথার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ৩৫ বছর বয়সী নওরোজ বললেন,
‘২০০৩ সালে পেশোয়ার টেস্টে আমি ছিলাম দর্শক। আর এখন আমরা সেই বাংলাদেশের বিপক্ষেই টেস্ট খেলছি, তাদেরকে এই ফরম্যাটে হারিয়েও দিচ্ছি। এটা আমাদের জন্য বিশাল অর্জন।’
একটি জয়ের উদযাপন, অধিনায়ক নওরোজের সাথে সতীর্থরা; Image Source: ESPN
শেষ এক যুগে আফগানিস্তানের ক্রিকেট যেভাবে উঠেছে, তার পুরোটাই দেখেছেন নওরোজ। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি ছিলেন দেশের ক্রিকেট রূপকথার একজন গল্পকার। বলেছেন,
‘বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে জয় পাওয়াটা অনেক বড় ব্যাপার। আপনি যখন কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে কষ্ট করছেন, সেই পর্যায়টাও আবার বেশ নিচের দিকে; তখন এমন ধরণের সাফল্য পাওয়া মানে নিজের স্বপ্নটা পূরণ হওয়া।’
যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশ আফগানিস্তান। সেখানেও শান্তির ফুল ফুটেছে কেবলই ক্রিকেটের হাত ধরে। শত সমালোচনা, অবহেলার মাঝে এই ক্রিকেটই তাদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এনে দিয়েছে শান্তি ও শুভেচ্ছার বারতা। সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ না জিতলেও তাদের পারফরম্যান্স, চেষ্টা প্রশংসিত হয়েছিল।
যে সাফল্য, যে অর্জন কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল হিসেবে যে অভ্যেসগুলো এখন আফগানিস্তান ক্রিকেট দল চালিয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে মূল যুদ্ধটা ছিল নওরোজদের। ২০০৯ সালে তার অধিনায়কত্বে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায় দক্ষিণ এশিয়ার এই দলটি। এগিয়ে যায় স্বপ্নের বাস্তুবায়নের পথে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে অধিনায়ক মিসবাহর সাথে নওরোজ মঙ্গল; Image Source: crickethighlight.com
সাবেক এই অধিনায়ক এ নিয়ে বলেছেন,
‘যখন আমরা শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের দেশে ক্রিকেটের ব্যাপারে মানুষ তেমন কিছু বুঝতোও না। তারা ভাবতো এটা আমাদের দেশের খেলা নয়। প্রথম দিকে আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা যখন ক্রিকেট খেলতাম, লোকে ভাবতো আমরা সময় নষ্ট করছি এসব করে। আমাদের কোনো খেলার মাঠ ছিল না। আমরা খুব ছোট জায়গায় খেলতাম। এখন আমরা সিরিজ খেলতে বিদেশে আসি, আমাদের ক্রিকেট বোর্ড ভালো অবস্থানে আছ। এখন দেশে আমরা ভালো মাঠ পাই, একাডেমি পাই।’
নওরোজ মঙ্গল মনে করেন, খুব অল্প বিরতিতে দুটি বড় অর্জন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে আফগানিস্তানকে সাহায্য করেছে। প্রথমটি হলো ২০০৯ সালে ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ করা এবং পরের বছরেই অর্থাৎ ২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করা।
‘এই দুটো ব্যাপার বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে অবশ্যই। যখন আমরা ২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে গেলাম, সেটা ছিল আমাদের জন্য বিশাল ব্যাপার। আমাদের জন্য সত্যি বলতে কল্পনাতীত। আমরা ক্রিকেট শুরু করার পর থেকেই ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে যখন অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশের মতো পূর্ণ সদস্যদের বিপক্ষে খেলা শুরু করলাম, তখন আমরা আসলেও ভালো করছিলাম।’
কোনো বিষয়ে সাফল্য আসলেই সে বিষয়ে অন্যান্যদের আগ্রহ বেড়ে যায়। যে দেশটি ক্রিকেটই বুঝতো না, সেই দেশের মানুষের মাঝে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা এসেছিল নওরোজ-শাপুর জারদানদের সাফল্য থেকেই। তাদের পরিশ্রম শুরুতে যেমন হেয় হয়েছিল, তেমনই তাদেরই সাফল্য দিনশেষে আফগানিস্তানকে ক্রিকেটখেলুড়ে দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
৫০টি ওয়ানডে ও ৩১ টি-টোয়েন্টি খেলা এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান বললেন,
‘সাফল্যের পেছনে রহস্য হিসেবে রয়েছে দেশের মানুষের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। তারা বুঝতে পারলো আমাদের রক্তে ক্রিকেটের মেধা রয়েছে। রশিদ, নবী, মুজিব; এরা বড় জায়গায় লিগ খেলছে ভালো উপার্জন করছে। এখন তাই বাচ্চাদের বাবা-মাও তাদের সন্তানদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হলে উৎসাহ দিচ্ছে।’
নিজে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে পারেননি। অবসর নেওয়ার আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি আফগানিস্তান। নওরোজ তাই শান্তি খুঁজে ফিরছেন বর্তমান দলকে টেস্টে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মিশন হাতে নিয়ে,
‘টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে খেলতে পারা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন ছিল। যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম তখন মনে হচ্ছিল স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমি টেস্ট খেলতে পারিনি।’
নওরোজ এখন দলের ব্যাটিং কোচ। টেস্টই মূলত তার লক্ষ্য। কীভাবে কী করলে সাদা পোশাকে আরও ভালো করা যায়, নিজে টেস্ট খেলতে না পারলেও জানা আছে তার। এই মুহূর্তে দলের ব্যাটিং নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট । তবে চ্যালেঞ্জ অন্যখানে। দীর্ঘদিন সংক্ষিপ্ত আসরের ক্রিকেট খেলা একটা দলকে পাঁচদিনের ম্যাচের জন্য ব্যাট হতে প্রস্তুত করাটা সহজ কথা নয়। কিন্তু নওরোজ মঙ্গলকে সেটাই করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর; Image Source: ICC cricket
বলেছেন,
‘আমাদের ব্যাটিং এখন বেশ ভালো অবস্থায় আছে। যেহেতু দলটি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বেশি খেলেছে তাই এখন তাদেরকে শেখাতে হচ্ছে কীভাবে বল ছেড়ে দিতে হয়। দলের সবাই মেধাবী, দ্রুত শিখছে। আমি বড় ক্রিকেটারদের থেকে শিখেছি। আপনি যে পর্যায়ে থাকবেন, সেই পর্যায়েই নিজেকে উপভোগ করাতে শিখতে পারতে হবে। আমি যখন খেলোয়াড় ছিলাম, তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। যখন অধিনায়ক হয়েছি, তখন আরেক রকম। যখন নির্বাচক হলাম… এখন আবার কোচ। আমি আমার প্রত্যেকটি পর্যায় উপভোগ করেছি এবং এখনও করছি।’