আইসল্যান্ড মানে বরফ-গ্লেসিয়ার, আইসল্যান্ড মানে তিমির খেলাধুলা, আইসল্যান্ড মানে আগ্নেয়গিরি।
আইসল্যান্ড মানে মাইলের পর মাইল বরফ ঢাকা জনমানবহীন ধু ধু প্রান্তর। বিশাল এক দেশে মোট মানুষের সংখ্যা আমাদের যেকোনো একটা শহরের মতো কিংবা তার চেয়ে কম।
এমন দেশে অনেক কিছুই হতে পারে। আইস স্কেটিং, আইস হকি থেকে শুরু করে বরফের অনেক খেলাধুলাই হতে পারে। কিন্তু এমন দেশে কি ফুটবল হয়?
শুধু এই দেশে ফুটবল হয় না। এই দেশ থেকে উঠে এসেছে গত বছর পাঁচেক ধরে দুনিয়াকে একটার পর একটা চমক দিতে থাকা এক জাতীয় ফুটবল দল। কয়েক বছর আগেও যে দলটার ফুটবল ম্যাপে তেমন কোনো হদিস ছিলো না, সেই দলই এখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসিদের বলে কয়ে আটকে দেয়। সেই দলটাই এখন নেদারল্যান্ডকে ছিটকে দেয় ইউরো বাছাইপর্বে। সেই দলই এখন ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। সেই আইসল্যান্ড এখন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সাথে ড্র করে স্বপ্ন দেখে আরও কিছু ইতিহাস রচনার।
এই আইসল্যান্ডের ফুটবল আকাশ থেকে পড়া কোনো গল্প নয়। এই দেশটির ফুটবল একটু একটু করে উঠে আসা এবং দারুণ পরিকল্পনার ফলে তৈরি হওয়া এক রূপকথা। বাইরে থেকে যেমনটা শোনা যায়, সব অপেশাদার লোকেদের খেলা বুঝি এখানে ফুটবল, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আইসল্যান্ড জুড়ে এখন একটার পর একটা ফুটবল লিগ, আইসল্যান্ডের খেলোয়াড়রা এখন ছড়িয়ে আছে ইউরোপজুড়ে। আর দেশটির ভেতরে ভেতরে চলছে এক ফুটবল বিপ্লব।
এই ফুটবল রূপকথা ও বিপ্লবের গল্পই শোনা যাক এখন।
আইসল্যান্ডে ফুটবলের শুরু ১৯ শতকে। ১৮৯৯ সালে দেশটির প্রথম ফুটবল ক্লাব কেআর রেইকজাভিক যাত্রা শুরু করে। ১৯১২ সালে শুরু হয় দেশটির প্রথম ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। তিনটি ক্লাব নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই দেশটিতে এখন পাঁচ স্তরে ফুটবল লিগ অনুষ্ঠিত হয়। প্রিমিয়ার লিগে অংশ নেয় ১২টি ক্লাব। মোট প্রথম চার লিগে ৪৬টি ক্লাব অংশ নেয়। পঞ্চম স্তরের লিগটি অনুষ্ঠিত হয় চারটি প্রাদেশিক বিভাগে বিভক্ত হয়ে। এখানে অংশ নেয় ৩৩টি ক্লাব। সব মিলিয়ে এখন আইসল্যান্ডে ৭৯টি পেশাদার ফুটবল ক্লাব নিয়মিত ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এছাড়াও আছে আইসল্যান্ডিক কাপ, আইসল্যান্ডিক সুপার কাপ ও দেইলদাবিকর কাপ নামে তিনটি টুর্নামেন্ট।
৬ বছর আগেও আইসল্যান্ডের ফিফা র্যাংকিং ছিলো ১৩০ এর আশেপাশে। এই ছয় বছরে ফুটবল নিয়ে পরিশ্রম তাদের নিয়ে এসেছে সেরাদের কাতারে। এখন তারা ফিফা র্যাংকিংয়ের ২৪ নম্বরে অবস্থান করছে।
আইসল্যান্ডে প্রায় ২২ হাজার রেজিস্টার্ড ফুটবলার আছে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলের দল আছে, কলেজের ফুটবল দল আছে। তারা নিজেদের মধ্যে অংশ নেয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। দেশটির মোট জনসংখ্যা তিন লাখ ত্রিশ হাজার। মানে জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ ফুটবলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।
আইসল্যান্ডে সারা বছর বাইরে ফুটবল খেলার পরিবেশ নেই। তাপমাত্রা ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকে না। তাই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশটিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফুটবল হাউস’। এই ফুটবল ঘরগুলো হলো বিশাল বিশাল একেকটি ফুটবল কমপ্লেক্স। এগুলোর মধ্যে আছে পূর্ণাঙ্গ খেলার মাঠ, ড্রেসিংরুম, মেডিকেল সুবিধা, দর্শকের জন্য গ্যালারি ইত্যাদি। কোনো কোনো ফুটবল হাউসে দশ হাজার দর্শকেরও ধারণক্ষমতা আছে। বর্তমানে দেশটিতে ১৫টি ফুটবল হাউস আছে। সর্বশেষ ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা আঘাত হেনেছিলো আইসল্যান্ডেও। ফলে তখন বন্ধ রাখতে হয়েছিলো এই ঘরগুলোর নির্মাণ প্রক্রিয়া। এখন আবার দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ চলছে।
আইসল্যান্ডের কোচ হেইমির হ্যালগ্রিমসন। তিনি ছিলেন পেশায় একজন দন্তচিকিৎসক। বছর দুয়েক আগে অবধিও দেশটির এক ছোট্ট শহরে চেম্বার খুলে লোকেদের দাঁতের চিকিৎসা করতেন। কিন্তু সেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন ফুটবলের টানে। অবশ্য এই সবের মানে এই নয় যে, তিনি ফুটবলে অ্যামেচার মানুষ। ফুটবলেও দিব্যি ডিগ্রি আছে তার। রীতিমতো উয়েফা প্রো লাইসেন্স করে কাজ শুরু করেছেন।
আইসল্যান্ডের এই সাফল্যের রহস্য কী? অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এক বড় ব্যাপার। দেশটির স্কুলগুলোতে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে যে, কমপক্ষে একটি আর্টিফিশিয়াল টার্ফ বাচ্চাদের জন্য থাকতেই হবে। এমন নিয়মের কারণে বাচ্চাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে। তবে হ্যালগ্রিমসনকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, এই সাফল্যের মূল কারিগর দেশটির স্থানীয় কোচেরা, ”আপনি ভালো খেলোয়াড় ছাড়া সাফল্য পাবেন না, এটা ঠিক। কিন্তু এই দলের ভালো খেলোয়াড়দের তৈরি করা ও তাদের প্রস্তুত করার কৃতিত্ব স্থানীয় কোচদের। তারা গত ১০-১৫ বছর ধরে এই ছেলেদের নিয়ে পরিশ্রম করে তবে ইউরোপে খেলার যোগ্য করে তুলেছেন। কোচদেরও কৃতিত্ব প্রাপ্য। আমাদের দেশে ৭০ শতাংশ কোচের ইউয়েফা বি লাইসেন্স আছে। ২৩ শতাংশ কোচের এ লাইসেন্স আছে। তারাই খেলোয়াড়দের তৈরি করে। তারা বয়সভিত্তিক দলগুলোতে পরিশ্রম করে। আমাদের ওখানে ১৬ বছর বয়স অবধি মেয়েরাও ছেলেদের সাথে ট্রেনিং করে।”
মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এই বাড়তি গুরুত্ব দেওয়াও ইতিমধ্যে ফল এনে দিয়েছে আইসল্যান্ডকে। তাদের খুবই শক্তিশালী একটা নারী দল আছে। যদিও তারা এখনও বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি। কিন্তু তারা ইতিমধ্যে তিনটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে ফেলেছে। এর মধ্যে ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে তারা কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছে।
আইসল্যান্ড এবার বিশ্বকাপ খেলছে সবচেয়ে কম জনবহুল দেশ হিসেবে। এত কম লোকের কোনো দেশ এর আগে এত বড় আসরে খেলেনি। ইউরোতেও তারা ছিলো প্রথম এত কম লোকের দেশ হিসেবে অংশ নেওয়া দল। ইউরো ছিলো তাদের প্রথম মেজর ট্রফি। সেখানে পর্তুগাল ও হাঙ্গেরির সাথে ড্র এবং অস্ট্রিয়াকে হারানোর পর দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলেছিলো তারা। দ্বিতীয় রাউন্ডে সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিলো ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রের দলটি।
আইসল্যান্ডের বর্তমান দলের সব খেলোয়াড় ইউরোপের বিভিন্ন লিগে ফুটবল খেলে। তাদের এ অবধি ১৬ জন খেলোয়াড় ইংলিশ লিগে খেলে গেছেন। বর্তমান দলেরই ৬ জন খেলোয়াড় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন লিগে খেলছেন। আইসল্যান্ডের সাবেক খেলোয়াড় হারমান হেরিডারসন, যিনি ইপিএলে তিন শতাধিক ম্যাচ খেলেছেন, তিনি বলেছেন, দেশটিতে ইংলিশ ফুটবলের একটা দারুণ জনপ্রিয়তা আছে, ”আইসল্যান্ডে ইংলিশ ফুটবলের একটা শক্ত ভিত্তি আছে। আমরা একটা ফুটবল পাগল জাতি। আমরা আমাদের দলের জন্য সব করতে পারি। আমাদের সমাজের হৃদয়ই হলো ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা।“
আইসল্যান্ডের ৩৪ বছর বয়স্ক গোলরক্ষক হ্যাল্ডরসন ইতিমধ্যে দুনিয়াকে নিজেকে চিনিয়ে ফেলেছেন। ইউরোর প্রথম ম্যাচে রোনালদো ১১টি শট করেছিলেন; হ্যাল্ডরসনকে হারাতে পারেননি। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মেসি ১০টি শট করেছেন; হ্যাল্ডরসনকে হারাতে পারেননি। ইতিমধ্যে সর্বকালের দুই সেরা তারকাকে আটকে দিয়ে তিনি নিজেই তারকা হয়ে গেছেন। যদিও হ্যাল্ডরসন একজন পেশাদার ফুটবলার। কিন্তু মনে ও মননে তিনি একজন চিত্রনির্মাতা। ২০১২ সালে ইউরোভিশন গান প্রতিযোগিতায় আইসল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করা মিউজিক ভিডিওটির পরিচালক ছিলেন তিনিই। আইসল্যান্ডের ফিল্ম স্টুডিও সাগাফিল্মে তিনি অবসর নেওয়ার পর চাকরি ঠিক করে রেখেছেন।
Feature Image: Medium