ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে জিম্বাবুয়ে এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বড় ব্যবধানের জয় পেয়ে দুই ম্যাচ হাতে রেখেই ফাইনাল নিশ্চিত করেছিলো স্বাগতিক বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে জয়ের ধারা বজায় রাখার জন্য মাঠে নামেন মাশরাফি বাহিনী। শেষ পর্যন্ত সাকিব-তামিমের নৈপুণ্যে টানা তৃতীয় ম্যাচে বোনাস পয়েন্ট সহ জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। এই জয়ের মধ্য দিয়ে হাবিবুল বাশারকে টপকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ওডিআই অধিনায়ক হিসাবে নিজের নাম লেখালেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৩০টি ওডিআইতে জয় পেয়েছে।
ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের মধ্যকার দ্বিতীয় ম্যাচের সব ফোকাস নিজের দিকে নিয়ে আসেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তামিম ইকবাল। সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮৪* রানের অপরাজিত ইনিংস খেলার পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও ৮৪ রান করেন তামিম। সিরিজে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ১০৫ বলে ৭৬ রানের ইনিংস খেলার পথে দুটি কীর্তি গড়েন তিনি। ব্যক্তিগত ৪২ রানের মাথায় সনাৎ জয়াসুরিয়াকে টপকে নির্দিষ্ট একটি ভেন্যুতে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের তালিকায় সবার উপরে উঠে আসেন তামিম। এবং ৬৬ রান পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি এবং বিশ্ব ক্রিকেটের ৫৫তম ব্যাটসম্যান হিসাবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছয় হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
তামিম ইকবাল শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ৭৪টি ওডিআইতে ৩৫.৯০ ব্যাটিং গড়ে ২,৫৪৯ রান করেছেন। শতক হাঁকিয়েছেন পাঁচটি এবং অর্ধশতক ১৬টি। নির্দিষ্ট একটি ভেন্যুতে এর আগে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহক ছিলেন সনাৎ জয়াসুরিয়া। তিনি কলোম্বোর আর প্রেমদাস স্টেডিয়ামে ৭১টি ওডিআইতে ৩৮.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৫১৪ রান করেন।
ওডিআইতে নির্দিষ্ট একটি ভেন্যুতে সর্বাধিক রান সংগ্রাহক (শীর্ষ পাঁচ)
তামিম ইকবাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের ৪১তম অর্ধশতক হাঁকানোর পথে ছয় হাজার ওডিআই রান পূর্ণ করেন। তিনি ১১ বছরের ওডিআই ক্যারিয়ারে ১৭৭ ম্যাচে ৩৫.৩৫ ব্যাটিং গড়ে নয়টি শতক এবং ৪১টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬,০১০ রান করেন।
শূন্য থেকে এক হাজার: তামিম ইকবালের পথচলা
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তামিম ইকবালের। অভিষেক ম্যাচে আট বলে পাঁচ রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। তামিম ইকবাল প্রথম আলোচনায় আসেন ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ৫৩ বলে সাতটি চার এবং দুটি ছয়ের মারে ৫১ রানের ইনিংস খেলার মধ্য দিয়ে। পোর্ট অফ স্পেনে জহির খানদের বিপক্ষে তার ভয়ডরহীন ইনিংসের কল্যাণেই বাংলাদেশ দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে।
ভারতের বিপক্ষে অর্ধশতকের পর বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলোতে তামিম নিষ্প্রভ ছিলেন। আট ম্যাচে ১৫.১২ ব্যাটিং গড়ে মাত্র ১২১ রান করেছিলেন। তামিম ইকবাল সেসময়ে লেগ সাইডে কিছুটা দুর্বল ছিলেন। পায়ের বলগুলো খেলতে সমস্যায় পড়তে হতো। অভিষেকের এক বছর পর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম ওডিআই শতক হাঁকান তামিম ইকবাল। তিনি ১৩৬ বলে ১৫টি চার এবং একটি ছয়ের মারে ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন। ২৮শে জুন ২০০৮ সালে করাচিতে ভারতের বিপক্ষে ৫৫ রানের ইনিংস খেলার পথে ওডিআই ক্রিকেটে এক হাজার রান পূর্ণ করেন তামিম ইকবাল। এক হাজার রান করতে তার ৩৭ ইনিংস প্রয়োজন হয়।
এক হাজার থেকে দুই হাজার: জেমি সিডন্সের তত্ত্বাবধায়নে
নতুন কোচ জেমি সিডন্স দায়িত্ব পাওয়ার পর তামিমকে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করতে লাগলেন। লেগ সাইডে দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা, অহেতুক আক্রমণ না করে কীভাবে বল ছেড়ে খেলতে হয় এবং বড় ইনিংস খেলার কৌশল শেখান তামিম ইকবালকে। তামিম একটু বেশিই সময় নিয়ে নিলেন। টানা ছয়টি সিরিজে তিনি শতকের দেখা পাননি।
শেষপর্যন্ত ২০০৯ সালে ১৬ই আগস্ট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়েতে ১৩৮ বলে সাতটি চার এবং ছয়টি ছয়ের মারে ১৫৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন, যা এখন পর্যন্ত ওডিআইতে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস। তার শতকের উপর ভর করে জিম্বাবুয়ের করা ৩১৩ রান অতিক্রম করে বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল ২০১০ সালের ১১ই জানুয়ারি দুই হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। এবারও প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নেন ভারতকে। ৩১ বলে ১৭ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে তিনি দুই হাজার রান পূর্ণ করেন। ৭০ ম্যাচ খেলে তিনি এই কীর্তি গড়েন। এক হাজার থেকে দুই হাজারে পৌঁছুতেও মাত্র একটি শতক হাঁকান তামিম ইকবাল।
দুই হাজার থেকে তিন হাজার: আক্রমণাত্মক রূপ
২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত তামিম ইকবাল ওডিআইতে সহস্রাধিক রান করেন। শুধুমাত্র ওডিআইতে নন, টেস্ট ক্রিকেটেও দুর্দান্ত পারফর্ম করেন তিনি। ৮৯৫ রান করেছিলেন ৫৫.৯৩ ব্যাটিং গড়ে। ভারত এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে শতক হাঁকান এই সময়ে। সেসময় সহ-অধিনায়কের দায়িত্বও পান তিনি।
তামিম ইকবাল শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর চড়াও হয়ে ব্যাটিং করতেন। পাওয়ার প্লে কাজে লাগিয়ে প্রায় ম্যাচেই বাংলাদেশকে উড়ন্ত সূচনা এনে দিতেন তিনি। তখনও তামিমে ইনিংস বড় করতে না পারার সমস্যা থেকে গেছে। দুই হাজার থেকে তিন হাজার রান করতেও মাত্র একটি শতক হাঁকিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২০ বলে ১৩টি চার এবং তিনটি ছয়ের মারে ১২৫ রানের ইনিংসটিই তার একমাত্র শতরানের ইনিংস। তামিম ১০২টি ওডিআইতে তিন হাজার রান পূর্ণ করেন। ২০১১ সালের ১৯শে আগস্ট বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫৩ বলে নয়টি চারের মারে ৬১ রানের ইনিংস খেলার পথে তিন হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছান।
তিন হাজার থেকে চার হাজার: নিষ্প্রভ
তামিম ইকবালের প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় লাগে তিন হাজার থেকে চার হাজার রানে পৌঁছাতে। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে সিরিজে ভরাডুবির পর সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব থেকেও তাকে অব্যাহতি থেকে দেওয়া হয়। ২০১২ সালের এশিয়া কাপে তামিমকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিলো। এশিয়া কাপের পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজে যথাক্রমে শূন্য, চার এবং শূন্য রানে সাজঘরে ফেরেন। শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তামিমকে মূল একাদশে রাখা হয়। সুযোগ পেয়ে চার ম্যাচে চারটি অর্ধশতক হাঁকান তামিম। এশিয়া কাপে একাধারে চারটি অর্ধশতক হাঁকানোর পর ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত তামিম ইকবালের পারফরমেন্স ছিলো বেশ হতাশাজনক। কোনো ফরম্যাটেই আশানুরূপ রানের দেখা পাননি। তামিম সেসময় নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। কয়েক ম্যাচে ভালো শুরু করলেও নিজের উইকেট প্রতিপক্ষকে উপহার দিয়ে আসতেন।
২০১৫ সালের ৫ই মার্চ; বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের ছুঁড়ে দেওয়া ৩১৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন তামিম। তার ১০০ বলে ৯৫ রানের ইনিংসের উপর ভর করে বাংলাদেশ জয় তুলে নেয়। ৯৫ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে তামিম চার হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের ক্লাবে যোগদান করেন। তিন হাজার থেকে চার হাজার রানে পৌঁছাতে ৩৬ ম্যাচ খেলেন তিনি। নয়টি অর্ধশতকের বিপরীতে মাত্র একটি শতক হাঁকিয়েছিলেন।
চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার: বদলে যাওয়া তামিম
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে সম্পূর্ণ বদলে যান তামিম ইকবাল। স্বাস্থ্য কমানোর পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও দায়িত্বশীল মনোভাব দেখা যায়। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে ১৩২ ও ১১৬* রানের ইনিংস খেলেন। শেষ ওডিআইতেও তার ব্যাট থেকে আসে ৬৪ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বাংলাদেশী ওপেনার হিসাবে দ্বিশতক হাঁকান তিনি।
১২ই অক্টোবর ২০১৬ সাল; চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৫ রানের ইনিংস খেলার পথে প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান হিসাবে পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন তামিম। চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার রান পূর্ণ করতে তামিম মাত্র ২১ ম্যাচ সময় নেন। এই ২১ ম্যাচে তিনটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতক হাঁকান। তিনি ১৫৯ ম্যাচে ৩২.০৭ ব্যাটিং গড়ে ৫,০০৭ রান করেন।
পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার: তামিমের বিশ্বরেকর্ড
ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তামিম ইকবাল বাংলাদেশের শততম টেস্টে শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলার পর তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওডিআইতে ১২৭ রান করেন তিনি।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চার ম্যাচে একটি শতক এবং একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ২৯৩ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় উপরের দিকেই ছিলেন তামিম। এই সময়ে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ জয়েও অবদান রাখেন তিনি। তিনি পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার রান করতে মাত্র ১৭ ইনিংস ব্যাট করেন। এর আগে রোহিত শর্মার ২০ ইনিংসে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার রানে পৌঁছানোটা বিশ্বরেকর্ড ছিলো। শেষ দশটি ওডিআইতে ছয়টি অর্ধশতক এবং একটি শতক হাঁকানো তামিম ইকবাল বিশ্বরেকর্ড গড়েই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ছয় হাজার রান পূর্ণ করেন।