একজনের সাম্রাজ্যের সূর্যটা এখন মধ্যগগণে, আরেকজনের রাজত্বে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার — যদিও দু’জনেই এই মুহূর্তে নিজ নিজ দেশের ব্যাটিং লাইনের সবচেয়ে বড় নাম। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পাকিস্তানের বাবর আজম আর গত আড়াই বছর ধরে শতকের দেখা না পাওয়া ভারতের বিরাট কোহলির মধ্যে তুলনা হওয়ার পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে আজকের তুলনাটা তাদের অতীত পরিসংখ্যান বা রেকর্ড নিয়ে নয়, আজকের তুলনাটা শুধুই দু’জনের কভার ড্রাইভের আদ্যোপান্ত নিয়ে। তাহলে চলুন, বাবর-কোহলির কভার ড্রাইভের টেকনিক্যাল ব্যবচ্ছেদটা দেখে আসা যাক।
সৌন্দর্য্যের বিষয়টা দর্শকের ওপরই নির্ভর করে, তবে টেকনিকের দিক থেকে দু’জনের কভার ড্রাইভে পার্থক্য আছে। প্রথমেই বাবরের দিকে তাকানো যাক। বাবরের কভার ড্রাইভকে সরলীকরণ করলে দেখা যায়, পেছনের পায়ে দারুণ শক্তিশালী হওয়ায় কভার ড্রাইভ খেলতে সামনের পা’কে বেশি ব্যবহার করেন না বাবর। সামনের পা অফ স্ট্যাম্পের বাইরে যায় না সাধারণত, আর বোলার বল ছোঁড়ার আগ পর্যন্ত সামনের পা স্ট্যাম্পের মধ্যেই থাকে। বোলার বল ছোঁড়ার সময়ে একই সাথে সামনের পা মুভ করেন এবং ব্যাকলিফট করেন। এরপর অপেক্ষা করেন বল মাথার নিচে আসা পর্যন্ত। চোখের নিচে বল আর ব্যাটের সংযোগ ঘটান, শট খেলার পর ফলো-থ্রুতে বাঁ কনুই মাথা বরাবর উঠে যায়, ব্যাটও অনেক উপরে ওঠে। সব মিলিয়ে ‘ফ্রি-ফ্লোয়িং’ কভার ড্রাইভ খেলতে দেখা যায় বাবর আজমকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০২২ সালে প্রথম ওয়ানডেতে যেমনটা দেখা গেছে, মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নেওয়া বাবর বোলার বল ছোঁড়ার আগ মুহূর্তে পেছনের পা একটু পেছনে সরিয়ে নিয়েছেন, সামনের পা’কে লেগ স্ট্যাম্প থেকে এনেছেন অফ আর মিডল স্ট্যাম্পের মাঝে। এরপর চোখ বরাবর অফ স্ট্যাম্পের বাইরে থেকে খেলেছেন কভার ড্রাইভ, আর শট খেলার পর বাঁ কনুই আর ব্যাট দুটোই উঠে গেছে মাথার ওপর।
কোহলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা। কোহলি ঠিক ‘ফ্রি-ফ্লোয়িং’ কভার ড্রাইভ খেলেন না, খেলেন ‘চেক শট’। বোলার বল ছোঁড়ার আগেই কোহলি পায়ের ব্যবহার করেন, পেছনের পা’কে একটু পেছনে নিয়ে যান। এরপর শট খেলার সময়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে সামনের পা নিয়ে যান, এরপর চোখের নিচে ব্যাট বলের সংযোগ ঘটান। এরপর শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ব্যাটটাকে ঐ অবস্থানেই স্থির রাখেন।
গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে যেমনটা দেখা গেছে, বাঁহাতি পেসার মোহাম্মদ আমিরের বিপক্ষে মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নিয়েছেন কোহলি, সামনের পা রেখেছেন লেগ স্ট্যাম্পের একটু বাইরের লাইনে। বোলার বল ছোঁড়ার মুহূর্তে পেছনের পা’কে এনেছেন অফ-মিডলে, সামনের পা অফ স্ট্যাম্পের লাইনে। এরপর কভার ড্রাইভ, বলও বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেছে সবুজ ঘাসের বুক চিরে।
এবার দু’জনের লফটেড কভার ড্রাইভের দিকে তাকানো যাক। লফটেড কভার ড্রাইভ বলতে এক্সট্রা কভার অঞ্চল দিয়ে ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে মারা কভার ড্রাইভকেই বোঝায়। ছবিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাবরকে দেখা যাচ্ছে মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নিতে, এরপর বোলার বল ছোঁড়ার মুহূর্তে তিনি সরে এসেছেন লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে, এরপর জায়গা করে নিয়ে সামনে এগিয়ে এসে তুলে মেরেছেন কভার দিয়ে; ফলাফল – বাউন্ডারি।
তবে লফটেড ড্রাইভ খেলতে হলে টাইমিংয়ের পাশাপাশি পাওয়ার হিটিংয়ের সক্ষমতাও প্রয়োজন, যে ক্ষেত্রে বাবরের ঘাটতি আছে। এ কারণেই ভালো টাইমিং হওয়া সত্ত্বেও অ্যাডাম জাম্পাকে তুলে মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেন তিনি।
কোহলির ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, লফটেড কভার ড্রাইভ খেলার জন্য কোহলি অতটা জায়গা করে নেননি। বরং সামনের পা’কে মিডল স্ট্যাম্পের লাইনে এনে তুলে মেরেছেন কভার দিয়ে। এক্ষেত্রে শট খেলার মুহূর্তে বাবরের তুলনায় কোহলির শরীর অনেক বেশি ঝুঁকেছে। তবে সময়ে সময়ে কোহলিকে জায়গা করে নিয়েও লফটেড কভার ড্রাইভ খেলতে দেখা যায়; আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিপ এক্সট্রা কাভার আর লং অফের মাঝামাঝি জায়গাটাকে লক্ষ্য বানানোয় দারুণ টাইমিং আর প্লেসমেন্টই যথেষ্ট বাউন্ডারি আদায় করার জন্য।
এবার একটু কভার ড্রাইভে দু’জনের দুর্বলতার ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করা যাক। হাত আর চোখের দুর্দান্ত সমন্বয়ের ফলে কভার ড্রাইভে বাবরের দুর্বলতা ইদানিং অতটা দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে ২০১৯ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে তার দুর্বলতা খুঁজে বের করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পেসাররা। প্রথম টেস্টে অষ্টম বা নবম স্ট্যাম্পের বলকে কভার ড্রাইভ করতে গিয়ে আউটসাইড এজ হয়ে ধরা পড়েন বাবর।
এরপর দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে তার টেকনিকে সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়, মিডল স্ট্যাম্পের বদলে তিনি গার্ড নেন মিডল-লেগে, ফলে দৃশ্যমান থাকে দুটো স্ট্যাম্প। এই টেকনিকে প্রথমে সফল হতে দেখা যায় তাকে, বোলার বল ছোঁড়ার পর একটু শাফল করে এসে কভার ড্রাইভে বাউন্ডারি আদায় করেন তিনি।
তবে ঐদিন অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়লেও পরের দিন সকালেই তার এই টেকনিকের ফাঁক খুঁজে বের করেন মিচেল স্টার্ক। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে আউটসাইড এজ হয়ে আউট হয়ে যান বাবর আজম।
ঐ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও কভারে বল ঠেলতে গিয়েই ব্যাটের বাইরের কানায় বল লাগে বাবরের। এক্ষেত্রে অবশ্য বলটা ফুল লেন্থের বদলে গুড লেন্থে পিচ করে, আর মিডল-লেগে গার্ড নেওয়া বাবর চেষ্টা করেছিলেন ব্যাকফুটে গিয়ে চেষ্টা করেছিলেন বলটা সামলানোর।
তবে বাবর তার এই সমস্যাটা নিয়ে কাজ করেছেন, আর এর উদাহরণ হলো পাকিস্তানের সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সিরিজ, যেখানে পুরো সিরিজে একবারও অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মেরে আউট হননি বাবর আজম। অবশ্য তাতে বাবরের নিজের মুন্সিয়ানার পাশাপাশি রাওয়ালপিন্ডি, করাচি আর লাহোরের ‘হাইওয়ে’ পিচের যে অবদান আছে, সেটা বোধ হয় না বললেও চলছে। তবে দুর্দান্ত হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশনের কারণে বাবরের জন্য কভার ড্রাইভটা যেমন সহজ আর রানপ্রসবা শট, দর্শকের জন্যও তা দৃষ্টিসুখকর।
এবার আসি কোহলির দুর্বলতায়। কভার ড্রাইভ বরাবরই কোহলির অন্যতম সেরা শট। দীর্ঘদিন এই কভার ড্রাইভ দিয়েই অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে রাজত্ব করেছেন তিনি। তবে গত বছরের ইংল্যান্ড সফর থেকেই কোহলিকে এই কভার ড্রাইভ খেলতে গিয়ে ভুগতে দেখা গেছে। সফরের দ্বিতীয় টেস্টে তিনি লেগ স্ট্যাম্পে গার্ড নিয়েছিলেন, এরপর বোলার বল ছোঁড়ার সময়ে শাফল করে সামনের পাকে অফ স্ট্যাম্পের লাইনে নিয়ে এসে খেলতে গিয়ে আউটসাইড এজ হয়ে কিপারের হাতে ক্যাচ দেন।
তৃতীয় টেস্টে কোহলির ব্যাটিং টেকনিকে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন, লেগ স্ট্যাম্পের বদলে কোহলি গার্ড নিয়েছিলেন মিডল স্ট্যাম্পে; ফলে দৃশ্যমান ছিল ‘দেড়’টা স্ট্যাম্প। এরপর বোলার বল ছোঁড়ার আগমুহূর্তে শাফল করে চলে এসেছিলেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরে। আর উপরের ছবিতে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, জেমস অ্যান্ডারসনের এই আউটসুইঙ্গারটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন কোহলি।
তবে ঐ ইনিংসেই, কিছুক্ষণ পরে কোহলিকে গার্ড পরিবর্তন করতে দেখা যায়, মিডল স্ট্যাম্পের বদলে কোহলি গার্ড নেন মিডল-লেগ স্ট্যাম্পে। বাকিটা আগের মতোই। বোলার বল ছোঁড়ার আগমুহূর্তে শাফল করে অফ স্ট্যাম্পের লাইনে চলে আসা, এরপর ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে উইকেটকিপারের হাতে ধরা পড়া।
তৃতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে কোহলিকে আবারও মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নিতে দেখা যায়। শাফল করে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে এসে অ্যান্ডারসনকে দুটো বাউন্ডারিও মারেন তিনি।
তবে ঐ দিনের খেলা শেষ হতেই কোহলির গার্ডও বদলে যায়। পরের দিন সকালে কোহলিকে আবারও দেখা যায় মিডল-লেগ স্ট্যাম্পে গার্ড নিতে। এই পরিবর্তনটার ফলাফল ভালো হয়নি, শাফল করে অফ স্ট্যাম্পের লাইনে সামনের পা এনে ড্রাইভ করতে গিয়ে আউটসাইড এজ হয়ে কিপারের গ্লাভসে ধরা পড়েন কোহলি।
গত বছরের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও কোহলিকে দেখা যায় মিডল-লেগ স্ট্যাম্পে গার্ড নিতে। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে কাগিসো রাবাদাকে কভার ড্রাইভে বাউন্ডারিও হাঁকিয়েছিলেন।
তবে ঐ ইনিংসেই লুঙ্গি এনগিডির অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালাতে গিয়ে আউট হয়ে যান কোহলি। রাবাদার বলে বাউন্ডারির সাথে এই বলে আউট হওয়ার ক্ষেত্রে একটাই পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, নিজের শরীর থেকে বলের দূরত্ব। এনগিডির বলটা অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে পড়ে আউটসুইং করে আরও বেরিয়ে যাচ্ছিল; কোহলি সেই ফাঁদে পা দিয়ে আউট হয়ে যান।
ঐ সফরেই মার্কো ইয়ানসেনের বলেও ভুগতে দেখা যায় কোহলিকে। ইয়ানসেন বাঁহাতি পেসার বলে কোহলি মিডল-লেগে গার্ড নিলেও সামনের পা রেখেছিলেন লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে, বল ছোঁড়ার মুহূর্তে ঐ পা নিয়ে আসেন অফ স্ট্যাম্পের লাইনে। তবুও কভার ড্রাইভে বাউন্ডারি আদায় করতে পারেননি, ব্যাটের বাইরের কানায় লাগিয়ে সাজঘরের পথে পা বাড়িয়েছেন।
সদ্যসমাপ্ত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও (আইপিএল) ভুগতে দেখা গেছে কোহলিকে। লেগ স্ট্যাম্প বা লেগ মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নিয়ে চেনা ভঙ্গিতে শাফল করে সামনের পা’কে আরেকটু সামনে এনে কভার ড্রাইভ বা কাভারে পুশ করার ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিখুঁত হতে পারেননি কোহলি, আউটসাইড এজ হয়ে আউট হয়েছেন কয়েকবার।
আপাতত দুঃসময় চললেও, এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে কোহলি নিজের সাময়িক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনো গার্ড পরিবর্তন করে, কখনো শট খেলার ধরন পাল্টে তিনি ফিরতে চাচ্ছেন চেনা রূপে। অপরদিকে বাবর আজমের আপাতত তেমন কোনো সমস্যা নেই, সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বর্তমান সেরা ব্যাটার আলো ছড়াচ্ছেন নিজের মতো করেই। সাধারণ ক্রিকেটভক্তরা তাই কোহলিকে খুব দ্রুতই চেনা দুর্দান্ত ফর্মে ফিরতে দেখতে চাইবেন; উপমহাদেশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের দুই সেরা ব্যাটার ‘আগুনে’ ফর্মে না থাকলে বিষয়টা ঠিক জমছে না!