ফুটবল ইতিহাসে অনেক ক্লাবই খেলোয়াড়দের সম্মানে তার পরিহিত জার্সি নাম্বারকেই অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের ক্লাবের প্রতি আনুগত্য, ভালবাসা, ত্যাগের কারণেই ক্লাবের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি। আর সেজন্য অনেকবারই দেখা গিয়েছে, খেলোয়াড়ের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে সেই খেলোয়াড়ের বিদায়ের পর তার জার্সি নাম্বারটিও অবসরে পাঠিয়ে দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। পেলে, ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে অনেক খেলোয়াড়ের ভাগ্যেই জুটেছে এমন সম্মাননা। আজ আমরা দেখবো তেমনি কয়েকটি জার্সির অবসর কথন।
রাউল – শালকে (জার্সি নাম্বার ৭)
রিয়াল কিংবদন্তী রাউলের প্রস্থানে জার্মান ক্লাব শালকে ঘোষণা দেয়, তারা রাউলের সম্মানে চিরতরে ৭ নাম্বার জার্সিটি তুলে রাখবে। যদিও রাউল শালকের হয়ে খেলেছিলেন মাত্র ২টি মৌসুম।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১৫ মৌসুম খেলার পর ক্যারিয়ারের শেষ দিকে জার্মান ক্লাব শালকেতে পাড়ি জমান এই স্প্যানিশ স্ট্রাইকার। সেখানে মাত্র দুই বছর কাটালেও এই দুই মৌসুমে করেন ৪০ গোল। মাত্র দুই মৌসুম খেলার পরই শালকের এই সিদ্ধান্তে অনেকে বিস্মিতও হয়েছিলো। এমনকি শালকে ক্লাব কিংবদন্তীদের মধ্যে অনেকেই ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি। তবুও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তাই রাউল গঞ্জালেসের অবসরের পর থেকে শালকেতে ৭ নাম্বার জার্সি গায়ে এখনো পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড় দেখা যায়নি।
দিয়েগো ম্যারাডোনা – নাপোলি (জার্সি নাম্বার ১০)
ফুটবল কিংবদন্তী দিয়েগো ম্যারাডোনার কপালেও জুটেছিলো এই সম্মাননা। ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলির হয়ে অবিশ্বাস্য সব কীর্তি গড়ে নিজেকে উপাসনার যোগ্য করে তুলেছিলেন এই আর্জেন্টাইন গ্রেট।
নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনা মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ সাত বছর। ১৯৮৪থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত শুধু নাপোলিই নয়, ম্যারাডোনা জাদুতে আচ্ছন্ন ছিলো ইতালিসহ গোটা ইউরোপ। ম্যারাডোনার হাত ধরেই ১৯৮৬/৮৭ মৌসুমে প্রথমবারের মতো সিরি আ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সৌভাগ্য হয় নাপোলির।
ম্যারাডোনার সাত বছর সময়কালে নাপোলি জিতেছে ৫টি শিরোপা। সবগুলো শিরোপাই প্রায় এককভাবে জিতিয়েছেন দিয়েগো ম্যারাডোনা।
যদিও ম্যারাডোনাকে কলঙ্কিত হয়েই নাপোলি ছাড়তে হয়। ডোপ টেস্টে পজিটিভ প্রমাণ হয়ে ১৫ মাস নিষেধাজ্ঞা পেয়ে নাপোলি ছাড়েন ম্যারাডোনা। কিন্তু তাই বলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ ভুলে যায়নি ম্যারাডোনার অবদান। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চিরদিনের জন্য তুলে রাখা হয় মারাডোনা পরিহিত ১০ নাম্বার জার্সিটি।
পেলে – নিউ ইয়র্ক কসমস (জার্সি নাম্বার ১০)
সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাত পেলের জার্সিটিও সম্মানার্থে তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাব। নিজের ক্যারিয়ারের দুই যুগ ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসে কাটানোর পর পেলে পাড়ি জমান নিউ ইয়র্ক কসমস ক্লাবে। সেখানে কাটান নিজের ক্যারিয়ারের শেষ দুই বছর।
কালো মানিক খ্যাত পেলে কসমসের জার্সি গায়ে খেলেন ১০৭ ম্যাচ। নিজের ক্যারিয়ারের সায়াহ্নেও এই ১০৭ ম্যাচ খেলে গোল করেন ৬৪টি। তাই পেলের অবসরের পর এই কিংবদন্তী খেলোয়াড়ের সম্মানে তার পরিহিত ১০ নাম্বার জার্সিটি অবসরে পাঠায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
নিউ ইউর্ক কসমস ক্লাবটি ১৯৮৫ সালে ভেঙে গেলেও আবার নতুন করে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হাভিয়ের জানেত্তি – ইন্টার মিলান (জার্সি নাম্বার ৪)
গত দুই যুগের মধ্যে অন্যতম এক সম্মানিত খেলোয়াড় ছিলেন হাভিয়ের জানেত্তি। দুই যুগ ধরে ছিলেন ইন্টার মিলান দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
ক্যারিয়ারের ১৯টি বসন্ত কাটিয়েছেন সান সিরোতে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৪ সালে অবসরের আগপর্যন্ত ছিলেন নেরাজ্জুরিদের দলনেতা। এই সময় সমর্থক ও ভক্তরা জানেত্তিকে ডাকতেন ‘এল কাপিতানো’ নামে, যার অর্থ হচ্ছে ‘দ্য ক্যাপটেন’।
ইন্টার মিলানকে অনেক শিরোপা এনে দেওয়ার পাশাপাশি অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে ক্লাবের হয়ে জিতেছেন আরাধ্য ট্রেবল।
২০১৪ সালে জানেত্তির অবসরের আগে ইন্টার মিলান প্রেসিডেন্ট এরিক থোহির ঘোষণা দেন, জানেত্তির সম্মানে ক্লাব তার পরিহিত ৪ নাম্বার জার্সি চিরতরে তুলে রাখবে। পাশাপাশি অবসরের পরপরই এই আর্জেন্টাইন লেফট ব্যাক হবেন ক্লাবটির ভাইস প্রেসিডেন্ট।
ববি মুর – ওয়েস্ট হাম উইনাইটেড (জার্সি নাম্বার ৬)
পেলের মতে, সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারের খেতাব পাওয়া ববি মুর শুধুমাত্র একজন ডিফেন্ডারই ছিলেন না। ছিলেন একজন নেতাও। তার হাত ধরেই ইংল্যান্ড জিতেছিল ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ।
ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছিলেন ইস্ট লন্ডনের ক্লাব ওয়েস্ট হামে। ১৬ বছরের ওয়েস্ট হামে ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৫০০ এর উপর ম্যাচ। ববি মুরের ম্যাচ পড়ে ফেলার ক্ষমতাও ছিলো অসাধারণ। এই কিংবদন্তী ফুটবলারের অবসরের পর ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেড ঘোষণা দেয়, ববি মুরের ছয় নাম্বার জার্সিটিও তারা তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে চিরদিনের জন্য তুলে রাখবে।
রবার্তো ব্যাজ্জিও – ব্রেশিয়া (জার্সি নাম্বার ১০)
পনিটেইল করা রবার্তো ব্যাজ্জিও শুধু ইতালির নয়, বরং বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন।
ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, ফিওরেন্টিনার মতো ক্লাবে। কিন্তু এদের কোনোটিই নয়। বরং ব্যাজ্জিওর সম্মানে তার জার্সিটি অবসরে পাঠিয়েছে ব্রেশিয়া নামের একটি ক্লাব।
নিজের ক্যারিয়ারের শেষ কয়েকটি বছর এই ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড কাটিয়েছেন ব্রেশিয়াতে। ব্রেশিয়ার হয়ে ১০১ ম্যাচ খেলে করেছেন ৪৬টি গোল। বিশ্বের কয়েকজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকারের মধ্যে একজন রবার্তো ব্যাজ্জিওর অবসরের পর ব্রেশিয়া তার ১০ নাম্বার জার্সিটি চিরদিনের জন্য তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফেরেঙ্ক পুসকাস – বুদাপেস্ট হনভেড (জার্সি নাম্বার ১০)
হাঙ্গেরির ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ফেরেঙ্ক পুসকাস তার ক্যারিয়ার শুরু করেছেন বুদাপেস্ট ক্লাবের হয়ে। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বুদাপেস্টের হয়ে পুসকাস খেলেছেন ৩৪১টি ম্যাচ। এসব ম্যাচ মিলিয়ে পুসকাসের গোলসংখ্যা বরাবর ৩০০টি। বুদাপেস্টের হয়ে খেলার সময় টানা চার মৌসুম ধরে সর্বোচ্চ গোলদাতার স্বীকৃতি পান এই ফরোয়ার্ড। মাঝে ১৯৪৮ সালে জিতে নেন মৌসুমে ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতার স্বীকৃতি।
১৯৫৬ সালে পুসকাস বুদাপেস্ট ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান করেন। বুদাপেস্ট থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তার সম্মানার্থে ক্লাবটি পুসকাসের ১০ নাম্বার জার্সিটি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
বুদাপেস্ট থেকে রিয়াল মাদ্রিদে গিয়েও নিজের গোল করার ধারা অব্যাহত রাখেন পুসকাস। রিয়ালের হয়ে অনেক শিরোপা জেতার পাশপাশি নিজেকে কিংবদন্তীর কাতারে নিয়ে যান ফেরেঙ্ক পুসকাস।
ফ্রাঙ্কো বারেসি – এসি মিলান (জার্সি নাম্বার ৬)
গত দুই তিন যুগ ধরে এসি মিলানের কয়েকজন সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইতালিয়ান ডিফেন্ডার ফ্রাঙ্কো বারেসি। নিজের পুরো ক্যারিয়ারই বারেসি কাটিয়েছেন এসি মিলানে।
এসি মিলানের হয়ে বারেসি খেলেছিলেন ৭০০ এর উপর ম্যাচ। তরুণ পাওলো মালদিনির মেন্টরও ছিলেন এই ডিফেন্ডার। পরবর্তীতে মালদিনিও এসি মিলান কিংবদন্তীতে পরিণত হন। বারেসিকে ক্লাবের ১৯ শতকের সেরা খেলোয়াড় হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় এসি মিলান। শুধু এই স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং অবসরের পর বারেসির ছয় নাম্বার জার্সিটি তুলে রেখে তার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করে এসি মিলান।
পাওলো মালদিনি – এসি মিলান (জার্সি নাম্বার ৩)
বারেসির পদক্ষেপ অনুসরণ করে পাওলো মালদিনিও নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। এসি মিলানের আরেক কিংবদন্তী ডিফেন্ডার মালদিনি নিজের ক্যারিয়ারের পুরো সময়টাই কাটিয়েছেন রোজানেরিদের হয়ে।
২৫ বছরের ক্যারিয়ারে জিতেছেন বহু শিরোপা। পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা অর্জন। তাই বারেসির মতো ক্লাব কর্তৃপক্ষ মালদিনির জার্সিটিও তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মালদিনির কোনো ছেলে যদি ক্লাবের হয়ে খেলে তাহলে মালদিনির পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে নিজের জার্সিটি তার ছেলেকে পরার অনুমতি দেওয়ার।
ইয়োহান ক্রুয়েফ – আয়াক্স (জার্সি নাম্বার ১৪)
ক্রুয়েফ শুধুমাত্র ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় নন, বরং অবসরের পরও ফুটবলে তার অবদান অনস্বীকার্য। ফুটবল অনেকাংশেই ঋণী এই ডাচ কিংবদন্তীর কাছে।
মাত্র ১০ বছর বয়সে আয়াক্সের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন ক্রুয়েফ। খেলোয়াড় ও পরবর্তীতে কোচ হিসেবে আয়াক্সের হয়ে অসাধারণ কিছু সময় কাটান তিনি।
খেলোয়াড়ি জীবনে ক্রুয়েফ আয়াক্সকে ঘরোয়া লিগ জিতিয়েছেন মোট ৮ বার। এর পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ক্লাব জিতিয়েছেন ৩ বার। তবে এতেই শেষ নয়। খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার পর ক্রুয়েফ কোচ হিসেবে ফিরে আসেন আয়াক্সে। আশির দশকে এই ক্লাবটির কোচের দায়িত্ব পালন করেন ক্রুয়েফ। এই কিংবদন্তীর সম্মানে ২০০৭ সালে আয়াক্স সিদ্ধান্ত নেয় ক্রুয়েফের পরা ১৪ নাম্বার জার্সিটি চিরতরে তুলে রাখার।