সিড বার্নসকে চেনেন? না, কিংবদন্তি ইংরেজ বোলার সিডনি বার্নসের কথা বলছি না। বলছি অজি ব্যাটসম্যান সিড বার্নসের কথা। সত্যি বলতে, যে স্কুলের ফার্স্ট বয় ডন ব্র্যাডম্যান, সেখানকার সেকেন্ড বয়কে না চেনাটাই বরং স্বাভাবিক।
১৯৪৮ অ্যাশেজের ঘটনা। নটিংহ্যামের প্রথম টেস্টে ইংল্যাণ্ডকে হারানোর পথে শেষ দিকে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন বার্নস। শেষবেলায় আলোকস্বল্পতার মাঝে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনবদ্য ব্যাটিং করেন তিনি। দ্রুত রান দরকার ছিল, দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে ৯৮ রানের ৬৪ রানই করলেন তিনি। এক ক্যামেরাম্যান তো অবাক হয়ে বলেই ফেললেন, “এই অন্ধকারে বল দেখছেন কী করে? বিড়ালের চোখ নাকি?“
বার্নস ভাবলেন পত্রিকায় বেশ লেখালেখি হবে তাকে নিয়ে। কিন্তু পরদিন পত্রিকা খুলে দেখলেন সবাই ঘটা করে লিখেছে ব্র্যাডম্যানের ‘ডাক’ নিয়ে।
এভাবেই সবসময় ছিলেন ব্র্যাডম্যানের ছায়ায়।
তবু ব্র্যাডম্যানকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন বার্নস। মনে-প্রাণে তার মতো হতে চাইতেন। বলতেন,
আমাকে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করে যেতে হবে। তিনি একটা সেঞ্চুরি করে ক্ষান্ত হননি, আমিও হব না।
সিড বার্নস ছিলেন স্পষ্টভাষী। তার দর্শন ছিল ‘নাম শুনে কাউকে সমীহ করা যাবে না’।
১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড সফর শেষে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরেছে দল। তখনকার সময়ে বিলি ও’রাইলিকে ধরা হয় বিশ্বের সেরা বোলার। বার্নসের বয়স তখন সবে পনের। এক ম্যাচে ও’রাইলির বিরুদ্ধে বেশ ভালো ব্যাট করলেন। ও’রাইলি ড্রেসিংরুমে তাকে ডেকে নিয়ে পিঠ চাপড়ে বললেন, “ভালো খেলেছ।” বার্নস সাথে বললেন, “হ্যাঁ, বিকেলের দিকে আপনিও চমৎকার বোলিং করেছেন।“
১৯৩৮ সালের ইংল্যাণ্ড সফরে যান দুর্দান্ত ফর্মে থাকা অবস্থায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে চোটে পড়েন তিনি। চোট কাটিয়ে উঠতে উঠতে সফরে আন্তর্জাতিক ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট মিলিয়ে ব্র্যাডম্যান রান করে ফেলেছেন ১৫৯২। বার্নস ফেরার পর আরও ৮৩৭ রান করেছিলেন ব্র্যাডম্যান, কিন্তু বার্নস রান করলেন ১০৮০।
ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে অভূতপূর্ব সাফল্য পান বার্নস। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার স্কোরগুলো ছিল এরকম- ১৪৪, ১০৮, ১৩৩, ১৩১, ১৩২, ১৮৫ ও ৫১। তখন সেই ৫১ রানের ইনিংসকেই মনে হচ্ছিল ব্যর্থতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেল তার ক্যারিয়ার থেকে। কিন্তু যুদ্ধের পরও অসামান্য ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন। পর পর করলেন ২০০, ১৪৬, ১৫৪ ও ১০২।
১৯৪৬ অ্যাশেজের সিডনি টেস্টে প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড অলআউট হলো ২২৫ রানে। ব্র্যাডম্যানের কথায় ওপেনিং শুরু করেছেন বার্নস। মাটি কামড়ে উইকেটে পড়ে রয়েছেন। একের পর এক উইকেট যাচ্ছে। কিন্তু ব্র্যাডম্যান আসছেন না ব্যাটিংয়ে।
অবশেষে ছয় নাম্বারে ব্যাটিংয়ে আসলেন ব্র্যাডম্যান। এসে বললেন, পায়ের পেশির ব্যথা আর গ্যাস্ট্রিক- দুয়ে মিলিয়ে বেশ শোচনীয় অবস্থা। বার্নসকে বললেন, “উইকেটে থাকার দায়িত্বটা তোমাকেই নিতে হবে।“
অধিনায়কের নির্দেশ মেনে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় খেলতে থাকলেন বার্নস। এদিকে স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে চলেছিলেন ব্র্যাডম্যান।
শতকের পর বার্নসও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শুরু করলেন। ব্র্যাডম্যান করলেন দ্বি-শতক। ২৩৪ রান করে ফেরত যাওয়ার পথে ব্র্যাডম্যান সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অজি ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ রান করে ফেলেছেন। বার্নসের সাথে গড়েছেন পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৪০৫ রানের বিশ্বরেকর্ড।
দ্বিশতক করেন বার্নসও। ২৩৪-এ পৌঁছে নিরীহ গোছের একটা বলকে সোজা উঁচুতে তুলে দিলেন। বল তালুবন্দি করলেন ফিল্ডার। হাসতে হাসতে সাজঘরে ফেরত যান বার্নস, ব্র্যাডম্যানকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছাই যে ছিল না তার!
১৯৪৮ অ্যাশেজের অস্ট্রেলিয়া দলকে বলা হয় ‘দ্য ইনভিন্সিবলস’। সেই সফরে অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের কথা মতো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে গিয়ে পাঁজরে আঘাত পান বার্নস। আঘাত গুরুতর হলেও সেযাত্রায় বেঁচে যান তিনি।
সেই সিরিজে ব্র্যাডম্যান করলেন ৫০০, বার্নস করলেন ৩২৯। মনে রাখতে হবে, চোটের জন্য তিন ইনিংস খেলতে পারেননি বার্নস, একটা ইনিংস খেলেছেন চোট নিয়ে। সিরিজ শেষ করলেন ৮২.২৫ গড় নিয়ে, যা সেই সিরিজে স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়েও বেশি ছিল।
বার্নসের রেকর্ড ছিল ঈর্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে মিলিয়ে খেলেছেন ১৩ টেস্ট। ৬৩ গড়ে করেছিলেন ১০৭২ রান। ১১০ ম্যাচের প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারে রান করেছেন ৫৪ গড়ে।
১৯৪৮ এর অ্যাশেজের পর অজিদের হয়ে আর না খেলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে ১৯৫১-৫২ মৌসুমে দলে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কেননা বোর্ড তাকে বাদ দিয়েছিল ‘ক্রিকেটের বাইরের’ কোনো কারণে।
সহজাত স্পষ্টভাষিতার কারণে বোর্ডের সাথে প্রায়ই ঠোকাঠুকি হত বার্নসের। বার্নস তবু অবাক হলেন, কারণ তাকে ক্রিকেটের বাইরের কোনো কারণে বাদ দেয়া হবে এটা ভাবতে পারেননি তিনি। সেই সময়টা প্রচণ্ড কঠিন ছিল তার জন্য। কেন তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হলো, কিছুতেই ভেবে পান না। যে অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের নির্দেশ মেনে মরতে পর্যন্ত বসেছিলেন, সেই ব্র্যাডম্যানও কেন কিছু বলছেন না! অবশেষে মানহানি মামলা করলেন বার্নস।
মামলার শুনানিতে বোর্ড সভাপতি অব্রে অক্সলেড বলেন, “The accusations against Barnes are childish and not serious at all.” বোর্ডের কোনো কর্তাই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে পারেননি। ফলে সহজেই মামলা জিতে যান বার্নস।
কিন্তু জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। শরীরে বাসা বেঁধেছিল ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’ নামের কঠিন স্নায়বিক ব্যাধি। চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু হতাশার সাগরে ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলেন। বন্ধু হারাচ্ছিলেন, জনজীবন থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাত্র ৫৭ বছর বয়সে নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন বার্নস। তার বন্ধু ডেভিড ফ্রিথ তার ‘Silence of the Heart’ বইয়ে লিখেছেন,
একজন পুলিশ অফিসার বার্নসের মৃতদেহ দেখে আমাকে বলেছিল, ‘Hey Nugget, your mate’s just knocked himself off.
অসাধারণ ‘সেন্স অফ হিউমার’সম্পন্ন মানুষ সিড বার্নস এই কথা শুনলে হয়তো হো হো করে হেসে উঠতেন।