মার্চ, ১৯৬৬; মাত্র কয়েক মাস পরেই ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর, বিশ্বকাপ। সামনে বিশ্বকাপ উপলক্ষে ওয়েস্টমিনিস্টারের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হলে স্ট্যানলি গিবসন স্ট্যাম্পটেক্স স্ট্যাম্প প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ বিশ্বকাপ ট্রফি জুলে রিমে। স্বভাবতই চারদিকে কড়া পাহারা।
এমনিতেও লন্ডনের এই এলাকাটিতে প্রচুর পুলিশের আনাগোনা, কারণ কয়েকশ মিটার দূরেই সংসদ ভবন। সেন্ট্রাল হলের মধ্য দিয়ে হেটে যাচ্ছে পাতলা গড়নের এক মধ্যবয়সী, দশ জন থেকে আলাদা করার মতো কেউ নয়। ম্যাথিও পার্কার স্ট্রিটের গেট দিয়ে প্রবেশ করে হার্মার রুক স্ট্যাম্প স্ট্যান্ড হয়ে জুলে রিমের রাখা ক্যাবিনেটের পাশ ঘেঁষে বের হয়ে গেলো লোকটি। যতক্ষণে সবাই টের পেয়েছে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে বিশ্বকাপ আসরের সবচেয়ে মূল্যবান ও একমাত্র বস্তুটি; জুলে রিমে ট্রফি।
জুলে রিমে চুরি
সমর্থকদের অনুরোধে বিশ্বকাপের প্রাক্কালে ওয়েস্টমিনিস্টারে বিশ্বকাপ প্রদর্শনীর আয়োজন করে ইংল্যান্ড ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (FA)। ফিফার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্ট্যানলি রউসের তিনটি শর্ত পূরণ করে দর্শনার্থীদের জন্য জুলে রিমে ট্রফি প্রদর্শনীর সুযোগ করে দিয়েছিলো এফএ। শর্তগুলো ছিলো- খ্যাতিসম্পন্ন নিরাপত্তা ফার্মের মাধ্যমে ট্রফি স্থানান্তরিত করতে হবে, ট্রফিটি রাখতে হবে তালাবদ্ধ গ্লাসবক্সে, যা ২৪ ঘণ্টা পাহারায় থাকবে এবং ৩০,০০০ পাউন্ডের ইনস্যুরেন্স করতে হবে ট্রফিটির জন্য। সেই সময়ে ট্রফিটির মূল্য ছিলো উল্লেখিত অর্থের দশ ভাগের এক ভাগ, তাছাড়া ট্রফিটি যেসব স্ট্যাম্পের সাথে প্রদর্শিত হচ্ছিলো সেগুলোর মূল্য ছিল কম করে হলেও ৩ মিলিয়ন পাউন্ড।
ঠিক কিভাবে এত নিরাপত্তার মধ্য দিয়েও চোর ট্রফিটি নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো তা নিয়ে এখনো যথেষ্ট ধোঁয়াশা বিদ্যমান। তবে যতটুকু আন্দাজ করা হয়, তা হলো, ২০ মার্চ সকাল ১ টা থেকে দুপুর ১২:১০, এই সময়ের মধ্যে চুরি হয় বিশ্বকাপ ট্রফিটি। হয়তো নিরাপত্তারক্ষীরা আশেপাশে ছিলো না, যদিও শর্ত ছিলো ২৪ ঘণ্টা কড়া নজরদারিতে থাকবে এটি। ধারণা করা হয়, প্রদর্শনী শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই নিচের তলায় চার্চের একটি কার্যক্রম সংগঠিত হয়। ঠিক এই হ-য-ব-র-ল সময়ে ও নিরাপত্তার খুঁতের সুযোগে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে ট্রফি নিয়ে সবার নজর এড়িয়ে পালিয়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত (!) চোর। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আসরের বিখ্যাত জুলে রিমে ট্রফি চুরির ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ইংল্যান্ডের ফুটবল সংস্থা, একই সাথে একরকম নাক কাটা যায় নামকরা লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশেরও।
প্রদর্শনীতে ট্রফিটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলো আলসা-গার্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস, যাদের দাবি তারা সব সময়ই ট্রফিটির সাথেই ছিলো। কিন্তু, ঠিক কিভাবে কী ঘটেছে, সেই ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না। ফার্মটির একজন নিরাপত্তাকর্মী, যিনি ঐ কক্ষে দায়িত্বরত ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, “আমাদের নিরাপত্তায় কোনো ত্রুটিই ছিলো না, ট্রফিটি শুধু চুরি হয়ে গিয়েছে।”
যা-ই হোক, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করে ট্রফিটি। চুরি হয়ে যাওয়া জুলে রিমে খুঁজে দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো কিছু কোম্পানি। কয়েক মাস পরই ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ আয়োজন হতে যাচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে ট্রফি হারিয়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন বিব্রত ছিল গোটা ইংল্যান্ড, তেমনি ভীষণ বিরক্ত ছিল গোটা ফুটবল বিশ্ব।
আঁধারে আলোর সন্ধান
ট্রফি চুরি যাওয়ার একদিন পর এফএ চেয়ারম্যান জো মেয়ার্সের সাথে অস্থির চিত্তের জ্যাকসন ছদ্মনামে এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। মেয়ার্সের সাথে যোগাযোগের পর জ্যাকসন তাকে একটি পার্সেল পাঠায়, যেখানে ট্রফির একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং কিভাবে দাবিকৃত ১৫,০০০ পাউন্ড তাকে ট্রফির বিনিময়ে পৌঁছে দিতে হবে সেই নির্দেশনা দেওয়া ছিলো। গভীর অন্ধকারে কিছুটা আলোর সন্ধান পায় মেয়ার্স ও মেট্রোপলিটন পুলিশ। নির্দেশনায় বলা হয়, ২৫ মার্চ শুক্রবারে মেয়ার্স নির্ধারিত অর্থ পৌঁছে দিলে পরদিনই ফেরত দেওয়া হবে ট্রফি। চোর নিজ উদ্যোগে যোগাযোগের পরেও কোনো কুল কিনারা করতে পারছিলো না পুলিশ, অবশেষে দাবি অনুযায়ী ট্রফিটির ‘মুক্তিপণ’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
জ্যাকসনের কথা অনুযায়ী, দাবিকৃত অর্থ নিয়ে বেট্টেসি পার্কে যাওয়ার কথা মেয়ার্সের। কিন্তু অত্যধিক মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েন মেয়ার্স, জ্যাকসনের সাথে দেখা করার অবস্থায় তিনি আর তখন ছিলেন না। শেষপর্যন্ত পুলিশের গোয়েন্দা লেন বাগি মেয়ার্সের সহকারী পরিচয়ে নোটভর্তি সুটকেস নিয়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছান। যদিও সুটকেসে ১৫,০০০ পাউন্ড মোটেই ছিলো না, ছিলো মাত্র ৫০০ পাউন্ড এবং পুরো সুটকেস ভর্তি করা হয়েছিলো খবরের কাগজ দিয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্কে ছদ্মবেশে অনেক পুলিশ ব্যাক-আপ হিসেবে পৌঁছে গিয়েছিলো। বাগি সেখানে পৌঁছানোর পর পুলিশের চোখে ধরা পড়ে যায় জ্যাকসন, বুঝতে পেরে পালানোর চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় তাকে।
জ্যাকসনের আসল পরিচয় উন্মুক্ত হলেও যে বস্তুটির জন্য এত আয়োজন, তার কোনো হদিস বের করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। জ্যাকসনের আসল নাম ছিলো এডওয়ার্ড ব্যাচলি। অনেক চেষ্টা করেও সঠিক কোনো তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ, তবে ব্যাচলি জানায়, তাকে ‘দ্য পুল’ নামের কোনো এক ব্যক্তি ৫০০ পাউন্ড দিয়েছে এই কাজটির জন্য। ট্রফিটির ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই বলে জানায় পুলিশকে। আদালত ব্যাচলিকে দুই বছরের জন্য জেলে পাঠানোর শাস্তি ঘোষণা করলেও আসল চোরকে শনাক্ত করতে তখনো ব্যর্থ পুলিশ। মামলা চলাকালীন সময়ে অবশ্য ইংল্যান্ড দলের জন্য শুভকামনা করে নিজেকে সত্যিকার ফুটবলপ্রেমী হিসেবে প্রমাণ করতে ভুলেননি তিনি, “আমার শাস্তি যা-ই হোক না কেন, আশা করি ইংল্যান্ড যেন বিশ্বকাপ জেতে।”
করবেট ও তার পোষা কুকুর পিকলস
চুরির এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তখনো জুলে রিমে ট্রফির কোনো সন্ধান বের করতে পারেনি পুলিশ। ইতিমধ্যে পত্রিকায় এই ঘটনা নিয়ে ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ব্যর্থতার এই পর্যায়ে সব সমস্যার একমাত্র সমাধান হয়ে আসে একটি কুকুর ও তার মালিক। ২৮ মার্চ করবেট তার কুকুর পিকলসকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটছিলেন, করবেটের বাড়ির পাশের ঝোপের মধ্যে গন্ধ শুকতে শুরু করে কুকুরটি। পিকলসের দেখানো পথ ধরে ঝোপের মাঝে একটি খবরের কাগজে মোড়ানো প্যাকেট খুঁজে পান করবেট। বেশ বড় ও ভারী প্যাকেটটি হাতে তুলে নিয়ে ভিতরে ঠিক কী রয়েছে তা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি করবেট। বোম ভেবে ভয় পেলেও মোড়ানো খবরের কাগজ খোলার পর ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে ব্রাজিল, জার্মানি, উরুগুয়ের নাম। পুরোপুরি প্যাকেটটি খোলার পর চোখ কপালে উঠে যায় করবেটের, ভেতরে যে রয়েছে অমূল্য জুলে রিমে ট্রফি!
স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে হারানো ট্রফিটি পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেই বিপদে পড়েন করবেট। কারণ চুরির দায়ে পুলিশের সন্দেহের তীর তার দিকেই তাক করা হয়। অবশ্য ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় করবেটকে। এরপর রীতিমতো তারকাখ্যাতি লাভ করেন করবেট ও তার কুকুর পিকলস। ট্রফি খুঁজে পেতে মূল ভূমিকা পালন করা পিকলস জাতীয় নায়কে পরিণত হয়। বেশ কিছু টেলিভিশন অনুষ্ঠান, এক বছরের খাবার, নগদ অর্থ ও রৌপ্যপদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিলো কুকুরটিকে। বিশ্বকাপ জয়ের পর আয়োজিত ভোজসভায়ও আমন্ত্রিত হয়েছিলো করবেট ও পিকলস। পিকলসকে ‘দ্য স্পাই উইথ কোল্ড নোজ’ নামের একটি মুভিতেও দেখা গিয়েছিলো সেই সময়ে।
পিকলসের খ্যাতির আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো করবেটের অবদান, শেষপর্যন্ত তাকে পুরষ্কার স্বরূপ ৬,০০০ পাউন্ড দেওয়া হয়, যা ছিলো ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের পুরষ্কারের তুলনায় ঢের বেশি, যদিও শুরুতে মেয়ার্স করবেটের অবদান স্বীকার করতে রাজি ছিলো না। বিশ্বকাপজয়ী প্রতিটি খেলোয়াড়কে বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো ১,৩৬০ পাউন্ড। করবেট ও পিকলসের কল্যাণে ইংল্যান্ড ও তাদের ফুটবল সংস্থা কী বিশাল পরিমাণ মানহানির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো তা বলাই বাহুল্য, তবে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় খেলোয়াড়দের বোনাসের তুলনায় করবেটের পুরষ্কারের অর্থের পরিমাণ থেকে। ট্রফি চুরি যাওয়ায় বিশ্বকাপ শুরুর পূর্বেই ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হওয়া ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ পর্ব শেষ হয়েছিলো তাদের একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে অসাধারণভাবে।
আবারো ফিরে আসি ট্রফি চুরি যাওয়ার শুরুর সময়ে। ট্রফি চুরি যাওয়ার পর তৎকালীন ব্রাজিলিয়ান স্পোর্টস কনফেডারেশনের প্রধান আব্রেইন তেবেল বলেছিলেন, “এমনকি ব্রাজিলিয়ান চোরেরাও ফুটবল ভালোবাসে এবং তারা কখনোই এমন অপকর্ম করবে না। এরকম কিছু কখনোই ব্রাজিলে ঘটতো না।” ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবলপ্রীতির উপর ভরসা থেকে এত বড় মুখ করে বলা আব্রেইনের কথা ভুল প্রমাণিত হয় বেশ কয়েক বছর পরই। তিনটি বিশ্বকাপ জয় করায় চিরদিনের জন্য জুলে রিমে ট্রফিটি ১৯৭০ নিজেদের করে নিয়েছিলো ব্রাজিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি তারাও। ১৯৮৩ সালে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল সংস্থার সদর দপ্তর থেকে চুরি হয়ে যায় জুলে রিমে ট্রফিটি। কিভাবে হারিয়ে গেলো এবং এখন কোথায় রয়েছে জুলে রিমে ট্রফিটি? শেষপর্যন্ত কী ঘটেছে ট্রফিটির ভাগ্যে? সেই গল্প তুলে ধরা হবে পরবর্তী পর্বে।
ফিচার ইমেজ- FIFA