সদ্যই শুরু হওয়া এশিয়া কাপকে অনেকে মিনি বিশ্বকাপও ডেকে থাকেন। পরাশক্তি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও আছে পরাশক্তি হওয়ার আভাস দেওয়া বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান ও হংকং। বড় দলগুলো ছাড়াও বাংলাদেশও পাখির চোখ করেছে এবারের এশিয়া কাপের ট্রফি। তবে ৩৪ বছরের ইতিহাসে মোট ১৩ বার অনুষ্ঠিত হওয়া এই টুর্নামেন্টে ছড়ি ঘুরিয়েছে মূলত ভারত ও শ্রীলঙ্কাই। ভারত ছয়বার ও শ্রীলঙ্কা জিতেছে পাঁচবার। অন্যদিকে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পেরে পাকিস্তান জিতেছে মোটে দুবার। বাংলাদেশের অর্জনের খাতা এখনো শূন্য।
ঠিক একইভাবে ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকালে ভারত ও শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়দের রানের ফুলঝুড়ি ছোটানোও চোখে পড়ার মতো। এশিয়া কাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকের তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রথম পাঁচটি স্থানই দখল করে রেখেছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানেরা। সেই তালিকায় আছেন কোন পাঁচজন ব্যাটসম্যান? চলুন তা দেখে আসা যাক।
৫. অর্জুনা রানাতুঙ্গা (শ্রীলঙ্কা)
১৯৯৬ বিশ্বকাপ জেতানো সাবেক শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা আছেন এই তালিকার পাঁচ নাম্বারে। ১৯৮৪-৯৭ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে রানাতুঙ্গা খেলেছেন ১৯টি এশিয়া কাপ ম্যাচ। ১৯ ম্যাচে রানাতুঙ্গার ব্যাট থেকে আসে মোট ৭৪১ রান। তবে তার ম্যাচপ্রতি গড় রান ছিলো অবিশ্বাস্য। প্রায় ৫৭ গড়ে এই রান সংগ্রহ করেন তিনি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এরকম গড় স্বাভাবিকভাবেই বিস্ময় জাগানিয়া। ১৯ ম্যাচের মধ্যে রানাতুঙ্গা একটি শতকের পাশাপাশি হাঁকিয়েছেন ৬টি অর্ধশতকও।
এই সময়ের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে দুবার এশিয়া সেরার মুকুট পরতে সাহায্য করেন তিনি। ১৯৮৬ ও ১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়া শ্রীলঙ্কা ফাইনালে হারায় যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতকে। দুই ফাইনাল ম্যাচেও জ্বলে ওঠে রানাতুঙ্গার ব্যাট। পাকিস্তানের সাথে ৫৭ রানের ইনিংসের পর ভারতের বিপক্ষেও ফাইনালে তার উইলো থেকে আসে মূল্যবান ৬২ রান।
৪. বিরাট কোহলি (ভারত)
সময়ের সেরা এই ব্যাটসম্যানকে এই এশিয়া কাপে বিশ্রাম দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। তা না হলে হয়তো এবারই সবাইকে টপকে এক নাম্বার জায়গাটি দখল করে নিতেন এই ব্যাটিং জিনিয়াস। ২০১০ এশিয়া কাপ খেলে এই টুর্নামেন্টে অভিষেক ঘটান কোহলি। সেই টুর্নামেন্ট সহ তিনি এখন পর্যন্ত খেলেছেন চারটি এশিয়া কাপ। বরাবরের মতোই প্রতি টুর্নামেন্টে কোহলির ব্যাট হয়ে উঠেছে তলোয়ার। মাত্র ১৪ ইনিংসে কোহলির সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭৬৬ রানে। সাথে ম্যাচ প্রতি গড় রানও কোহলিসুলভ। ৬৪ গড়ে এই রান তুলে নেন তিনি।
রান ও গড়ের মতো কোহলির স্ট্রাইক রেটও দারুণ। ৯৯.৬ স্ট্রাইক রেটে বলতে গেলে প্রতি ম্যাচেই সপাটে ব্যাট ঘুরিয়েছেন ভারতের বর্তমান অধিনায়ক। ২টি অর্ধশতকের সাথে কোহলি করেন তিনটি শতকও। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য ২০১২ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৮৩ রানের দানবীয় ইনিংস, যা কি না ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ম্যাচে কোহলির সর্বোচ্চ সংগ্রহ। তার ব্যাটে ভর করে সেই ম্যাচে ভারত টপকেছিলো পাকিস্তানের ৩২৯ রানের পাহাড়। চারবারের মধ্যে দুবারই এই ট্রফি জেতার সৌভাগ্য হয়েছিলো কোহলির। ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কা ও ২০১৬ সালের সর্বশেষ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে হারানো ভারত দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন কোহলি।
৩. শচীন টেন্ডুলকার (ভারত)
এই তালিকায় তিন নাম্বার স্থানটিতে আছেন কিংবদন্তী শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। শচীনের নাম ছাড়া তালিকাটিও পরিপূর্ণ হতো না। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এশিয়া কাপের টুর্নামেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করে টেন্ডুলকার খেলেছেন সর্বমোট ২১ ম্যাচ। ২১ ম্যাচে এই লিটল মাস্টারের উইলো থেকে আসে ৯৭১ রান। অল্পের জন্য ১০০০ রানের মাইলফলক ছুঁতে না পারলেও ২০১২ এশিয়া কাপেই টেন্ডুলকার ছুঁয়েছিলেন আন্তুর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১০০তম শতক। যদিও বাংলাদেশের সাথে তার করা ১০০তম শতকের পরও সেই ম্যাচ ভারত হেরে যায়। সেই ম্যাচের ১১৪ রানই টেন্ডুলকারের এশিয়া কাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এই শতক সহ মোট দুটি শতক হাঁকান তিনি। পাশাপাশি অর্ধশত রান করেন মোট সাত ইনিংসে।
ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৫০ এর নিচে গড় থাকলেও এশিয়া কাপে টেন্ডুলকারের গড় ছিলো ৫১। ২০১০ সালে এশিয়া কাপ জেতা ভারত দলের সাথে সেবার না থাকলেও ক্যারিয়ারে মোট দুবার এই ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছেন তিনি। ১৯৯০ ও ১৯৯৫ সালে এশিয়া কাপ জেতা ভারত দলের গূরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তরুণ টেন্ডুলকার।
২. কুমার সাঙ্গাকারা (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান জায়গা করে নিয়েছেন দুই নাম্বারে। বাইশ গজের আশেপাশে ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ মেনে দৃষ্টিনন্দন সব শটের পসরা সাজানো সাঙ্গাকারা তার ক্যারিশমাটিক ব্যাটিং দেখিয়েছেন এশিয়া কাপেও। ২০০৪ এশিয়া কাপ থেকে শুরু অবসর নেওয়ার আগপর্যন্ত সর্বশেষ ২০১৪ এশিয়া কাপে খেলেছেন এই ব্যাটিং কিংবদন্তী। এই দশ বছরে শ্রীলঙ্কার হয়ে সাঙ্গাকারা এশিয়া কাপে ব্যাটিং করেছেন ২৩ ইনিংসে। আর তাতেই করে ফেলেন ১০৭৫ রান। ঈর্ষণীয়ভাবে ম্যাচ প্রতি গড়ে ৪৯ রান তোলেন তিনি।
এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ১২১ রান করা সাঙ্গাকারা এশিয়া কাপে শত রান করেন মোট চার ইনিংসে। আর অর্ধশতক করেন আটবার। এশিয়া কাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অর্ধশতক করার রেকর্ডটিও তার দখলে। এই রেকর্ডের পাশাপাশি উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান হিসেবেও সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের মালিক তিনি। শ্রীলঙ্কার স্বর্ণযুগের স্থপতি সাঙ্গাকারা এশিয়া কাপ জিতেছেন তিনবার। সেটিও একজন খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ। যদিও আরো কিছু লঙ্কান খেলোয়াড় সর্বোচ্চ তিনবার এই ট্রফি ছুঁয়ে দেখেছেন। ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের এশিয়ান কাপ জয়ী লঙ্কান দলের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন সাঙ্গাকারা।
১. সনাথ জয়াসুরিয়া (শ্রীলঙ্কা)
এই তালিকার শীর্ষস্থানটি দখল করেছেন মাতারা হারিকেন খ্যাত সনাথ জয়াসুরিয়া। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা এই বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানকে ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে ধরা হয়। ক্যারিয়ারে রানের ফুলঝুড়ি ছোটানো জয়াসুরিয়া সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন এশিয়া কাপেও। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করে তিনি খেলেছেন ২৫টি ইনিংস। ২৫ ইনিংসে এই ভয়ঙ্কর ওপেনার করেছেন সর্বোচ্চ ১২২০ রান। তার গড়ও অবিশ্বাস্য। প্রায় ৫৩ গড়ে নিজের নামের পাশে এই রান যোগ করেন তিনি। তবে এর চেয়ে অবিশ্বাস্য তার স্ট্রাইক রেট। সেই সময়ে ১০২.৬ স্ট্রাইক রেটে এই রান করে নিজের মারকুটে ভাবেরই পরিচয় দেন জয়াসুরিয়া।
সর্বোচ্চ রানের পাশাপাশি আরেকটি রেকর্ডও আছে জয়াসুরিয়ার দখলে। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৬টি শতক হাঁকান তিনি। যদিও অর্ধশতক করেন মোটে তিনটি। এশিয়া কাপে এক ম্যাচে জয়াসুরিয়ার সর্বোচ্চ সংগ্রহ ১৩০ রান। শ্রীলঙ্কার হয়ে এই মারকুটে ওপেনার এশিয়া কাপ জেতেন সাঙ্গাকারার মতো সর্বোচ্চ তিনবার। ১৯৯৭, ২০০৪ ও ২০০৮ এশিয়া কাপজয়ী লঙ্কান দলের সদস্য ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে ৩৭৮ রান করে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান করার কৃতিত্ব গড়েন মাতারা হারিকেন।