আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আদিযুগ থেকে আধুনিক যুগের পথচলায় পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। অনেকরকম নিয়মকানুন তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি অনেক কিছু রয়ে গেছে আগের মতোই। সেগুলো পরিবর্তন করলে ক্রিকেটের সৌন্দর্য, দর্শকপ্রিয়তা কমে যাবে। যেমন- টেস্ট ক্রিকেট পাঁচ দিন থেকে কমিয়ে চারদিন করলে টেস্ট ম্যাচ তার জৌলুশ হারাবে। টেস্ট ম্যাচে দুই দল দুবার করে ব্যাট করে, এটাও টেস্ট ম্যাচের একটা সৌন্দর্য। টেস্ট ক্রিকেটের পথচলা শুরু হওয়ার পর থেকে এই একটা নিয়মে কখনও পরিবর্তন আসেনি।
ক্রিকেট একটি দলগত খেলা। টেস্ট ক্রিকেট দুই ইনিংসের। এসব ছোট কথাগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অনেক সময় ভুলে যায়। টেস্টে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনতে হলে কিংবা ম্যাচ বাঁচাতে হলে ম্যাচের ১৫টি সেশনকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এক সেশনে খারাপ খেলে পিছিয়ে পড়লে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কষ্টসাধ্য। টেস্ট ম্যাচ যে দুই ইনিংসের সেটা ভুলে যাওয়ার কারণেই বিদেশের মাটিতে এখনও ছোট দল হিসেবেই গণ্য করা হয় বাংলাদেশকে। চলতি সিরিজসহ নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের শেষ দুই টেস্ট সিরিজে দুটি ম্যাচে এক ইনিংসে দুর্দান্ত পারফর্ম করার পরেও লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১৪টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। দেশের মাটিতে ছয়টি এবং কিউইদের মাটিতে আটটি। এই ১৪ ম্যাচে বাংলাদেশ ছয় ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। নেই কোনো জয়। সাফল্য বলতে দেশের মাটিতে তিনটে ড্র। নিউ জিল্যান্ডের মাঠে আটটি টেস্ট খেলে এখন পর্যন্ত এক ম্যাচেও হার এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। এরমধ্যে অন্তত দুই ম্যাচে বাংলাদেশের পরাজয় ছিল দলগতভাবে এবং ম্যাচের যেকোনো এক ইনিংসে ভালো খেলতে না পারার কারণে।
এক.
এই সিরিজের আগে নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ কখনও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ জেতেনি। এই ধারা অব্যাহত রেখে চলতি সফরে বাংলাদেশ তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের সবকটি ম্যাচে পরাজিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি একটি ম্যাচেও। টেস্ট সিরিজেও যে এর ব্যতিক্রম ঘটবে না, তা অনুমেয় ছিলো। সাকিব, মুশফিকহীন বাংলাদেশের মিডল-অর্ডার ছিলো নড়বড়ে। তা সামলানোর দায়িত্ব পড়েছে মিঠুন এবং সৌম্য সরকারের কাঁধে। রঙিন পোশাকের এই দুই ক্রিকেটারের সাদা পোশাকে নেই তেমন কোনো সাফল্য। সেই সাথে ওপেনিংয়ে সাদমান ইসলাম এর আগে মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন।
ওয়ান ডাউনে খেলা মুমিনুল হকের বিদেশের মাটিতে নাজেহাল অবস্থা। লিটন দাসের ফর্মের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। এই তো গেলো ব্যাটিং। বোলিং ডিপার্টমেন্টেও নেই কোনো অভিজ্ঞ বোলার। রাহী, এবাদত এবং খালেদ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনও শিশু। তাদেরকে আঙুল ধরে হাঁটতে শেখাবেন, এমন কেউও দলে ছিলেন না। স্পিনার হিসেবে খেলেছেন মিরাজ। গতবার এখানে খেলতে এসে প্রথম ইনিংসে ১১৬ রান খরচ করে ছিলেন উইকেটশূন্য।
স্বাগতিক নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। সবুজে ঢাকা মাঠ, নরসুন্দরদের মতো কাটা ঘাসের পিচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করার জন্য সবধরনের পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিলেন তারা। কিন্তু তামিমের ছিলো ভিন্ন পরিকল্পনা। বেশ সাবলীলভাবে ব্যাট করে অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ৩৭ বলে অর্ধশতক হাঁকিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, এখানে ব্যাটিং করা খুব সহজ। সাদমানের সাথে উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ৫৭ রান। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে মুমিনুল হকের সাথে যোগ করলেন ৬৪ রান। এই জুটিতে তামিম একাই করেছেন ৫২ রান। তামিমকে মাঠে রেখে মুমিনুল মধ্যাহ্ন বিরতিতে না গেলে জুটিটা আরও বড় হতে পারতো।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা আসা-যাওয়ার মিছিলে যোগদান করেন। তামিমের আশাজাগানিয়া ইনিংস শেষ ১২৬ এ। মাত্র ১২৮ বলে ২১টি চার এবং ১টি ছয়ের মারে এই রান করে জানান দেন, এখানে রান করা আর এমন কী! তামিমের দুর্দান্ত ইনিংসের পরেও বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস থামে ২৩৪ রানে। ওয়েগনারের শর্ট বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা অহেতুক শট খেলতে গিয়ে নিজেদের উইকেট খুইয়েছিলেন। সেডন পার্কের ব্যাটিং স্বর্গে ভুল করেননি নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে লাথাম এবং রাভাল যোগ করলেন ২৫৪ রান, যা বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের থেকে ২০ রান বেশি। তাদের জুটি রানের খাতা খোলার আগেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, যদি সৌম্য লাথামের সহজ ক্যাচ তালুবন্দী করতে পারতেন।
উদ্বোধনী উইকেট জুটিতেই বাংলাদেশকে টপকে গিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। তারপরেও তাদের ব্যাটসম্যানদের রানের ক্ষুধা মেটেনি। রাভালের ১৩২, লাথামের ১৬১ এবং কেন উইলিয়ামসনের অপরাজিত ২০০ রানের উপর ভর করে তারা প্রথম ইনিংসে ৭১৫ রান সংগ্রহ করেছিলো। বাংলাদেশের অনভিজ্ঞ বোলিং লাইনআপের ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৮১ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে আবারও দলকে শুভসূচনা এনে দেন তামিম এবং সাদমান। তামিম খেলেন ৭৪ রানের ইনিংস, সাদমান ঠিক তার অর্ধেক রান করেন। এই দুজনের সংগ্রাম ভেস্তে যায় মিঠুন শূন্য এবং মুমিনুল মাত্র ৮ রানে ফিরে গেলে।
উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ৮৮ রান তোলার পর ১২৬ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। তারপর জুটি বাঁধেন সৌম্য এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তারা দুর্দান্ত সব শট খেলে কিউই বোলারদের পাল্টা আক্রমণ করেন। সৌম্য তার ক্যারিয়ারের প্রথম শতক হাঁকিয়ে যখন সাজঘরে ফেরেন তখন তার নামের পাশে ১৪৯ রান এবং দলীয় ৩৬১ রান। মাত্র ১৭১ বলে ২১টি চার এবং ৫টি ছয়ের মারে তিনি এই ইনিংস খেলেছিলেন। রিয়াদ এবং সৌম্য ৫ম উইকেট জুটিতে ২৩৫ রান যোগ করার পরেও কিউইদের থেকে ১২০ রানে পিছিয়ে ছিলো বাংলাদেশ। সৌম্য ফিরে যাওয়ার পর আর কেউ প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। রিয়াদ আরও কয়েকটি দুর্দান্ত শট খেলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে করেছিলেন ১৪৬ রান। এই দুজনের অনবদ্য ব্যাটিংয়ের পরও বাংলাদেশ ইনিংস হার এড়াতে পারেনি। ৪২৯ রানে সবকটি উইকেট হারিয়ে ইনিংস ও ৫২ রানের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে কোনো দল চার শতাধিক রান করার পরেও ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে, এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র সাতবার। এই তালিকায় নিজেদেরও নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের প্রথম ইনিংসে পাঁচ শতাধিক রান করার পরেও ম্যাচ হারার ঘটনা ঘটেছে সাতবার, সেখানেও নাম রয়েছে বাংলাদেশের। প্রতিপক্ষ এই নিউ জিল্যান্ডই।
সেডন পার্কে তামিম ইকবাল দুই ইনিংসে করলেন বরাবর দুশো রান। রিয়াদ এবং সৌম্য দ্বিতীয় ইনিংসে যথাক্রমে ১৪৬ ও ১৪৯ রানের ইনিংস খেললেন। তার মানে এই তিনজন ম্যাচে এই চার ইনিংসে ৪৯৫ রান করলেন। তবুও শেষপর্যন্ত দল ইনিংস ব্যবধানে পরাজিত হলো। ক্রিকেট যে দলগত খেলা- এর সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে এই ম্যাচের স্কোরকার্ড ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া টেস্ট ম্যাচে ভালো করতে হলে সব সেশনকেই যে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে সেটার উদাহরণ দিতেও এই ম্যাচের স্কোর কার্ড বেশ কাজে আসবে।
দুই.
২০১৭ সালের ১২ই জানুয়ারি, ওয়েলিংটনে সিরিজের প্রথম টেস্টে নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এই ম্যাচেই সাকিব আল হাসান ২১৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, মুশফিক করেছিলেন ১৫৯ রান। এই দুজন ৫ম উইকেট জুটিতে ৩৫৯ রান যোগ করেছিলেন, যা যেকোনো উইকেট জুটিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেছিল ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান তোলার পর। বেশ নিরাপদ সংগ্রহ বলা চলে। এর আগে কোনো দল প্রথম ইনিংসে এত রান করে টেস্ট ম্যাচ হারেনি।
প্রথম ইনিংসে সাকিব, মুশফিকের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে রানের পাহাড় গড়ার পরেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে জয় তো দূরের কথা, ম্যাচও বাঁচাতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ ঐ একটাই, টেস্ট ম্যাচ ১৫ সেশনের। প্রত্যেক দল দুবার করে ব্যাট করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ ১১ সেশন পর্যন্ত ম্যাচে টিকে থাকলেও মাত্র দুই সেশনেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে। বলা যায়, ম্যাচের শেষদিনের প্রথম সেশনেই বাংলাদেশের সকল পরিশ্রম ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
ওয়েলিংটন টেস্টে বাংলাদেশের করা প্রথম ইনিংসে ৮ উইকেটে ৫৯৫ রানের জবাবে নিউ জিল্যান্ড নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৫৩৯ রান সংগ্রহ করেছিল। প্রথম ইনিংসে ৫৬ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসেও ঠিকঠাক ব্যাট করছিলেন তামিম এবং কায়েস। দলীয় ৪৬ রানের মাথায় কায়েস দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়েন। শেষ বিকালে কায়েস মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অন্যরাও ছন্দ হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ চতুর্থ দিন শেষ করেছিলো ৩ উইকেটে ৬৬ রান করে। প্রথম ইনিংসের লিডসহ বেশ ভালো অবস্থানেই ছিলো বাংলাদেশ। তবে শেষদিনের শুরুতেই প্রথম ইনিংসে দ্বিশতক হাঁকানো সাকিব শূন্য রানে ফিরে যান। ভাগ্যও বাংলাদেশের পক্ষে ছিলো না, কায়েসের পর মুশফিকও ১৩ রান করে ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়েন। কায়েস খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার ব্যাট করতে নামলেও মুশফিকের আর মাঠে নামা হয়নি।
ওয়েলিংটনের ব্যাটিং স্বর্গে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৬০ রানে থেমে গেলে নিউ জিল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন পড়ে ২১৭ রানের। হাতে সময় ছিলো দুই সেশনেরও কম। কিউই অধিনায়ক জানতেন, এই ব্যাটিং স্বর্গে কখনোই এত কম সময়ে তারা সবক’টি উইকেট হারাবেন না। তাই জয়ের জন্য ব্যাট করে মাত্র ৩৯.৪ ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। উইলিয়ামসন মাত্র ৯০ বলে ১০৪ রানের ইনিংস খেলে দলের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
টেস্ট ম্যাচ দুই ইনিংসের। কখনও প্রথম ইনিংসে, কখনও দ্বিতীয় ইনিংসে ভালো খেলে ফলাফল নিজেদের অনুকূলে আনা সম্ভব নয়। ওয়েলিংটনে যেমন সাকিব, সাব্বিররা দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে না আসলে ম্যাচের ফলাফল ভিন্ন হতে পারতো। তেমনি সেডন পার্কে প্রথম ইনিংসে তামিমের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাটসম্যানরাও রানের দেখা পেলে অন্তত বাংলাদেশকে ইনিংস ব্যবধানে হারতে হতো না।