১.
বাংলাদেশ কি চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে?
খুব সহজ একটি প্রশ্ন, তবে উত্তরটি কিন্তু খুব সহজ নয়। সচরাচর দুটো দলের লড়াইয়ে জয়ী হয় শক্তিমত্তার বিচারে এগিয়ে থাকা দলটিই। কিন্তু যে দলটির শক্তি কম, সে কি হাত-পা গুটিয়ে হেরে যাওয়ার জন্য বসে থাকবে? নিশ্চয়ই না।
শক্তিমত্তায় যখন এগিয়ে থাকা যায় না, তখন চেষ্টা করতে হয় কৌশলের মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ের। আর এই কৌশলের লড়াইয়ে জেতার জন্য দক্ষ হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দক্ষ হবার আগে দক্ষতা কী, সেটি সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা উচিত।
ইংরেজি শব্দ দিয়ে বোঝানো যাক। Ability মানে হচ্ছে সামর্থ্য আর Efficiency মানে হচ্ছে দক্ষতা। ধরা যাক, কোনো এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় ১০০ পাওয়ার সামর্থ্য আছে, কিন্তু পরীক্ষায় সে পেল ৮০। তার মানে এই শিক্ষার্থী ৮০% দক্ষ । আবার অন্য একজনের সামর্থ্য আছে ৭০ পাওয়ার, কিন্তু সে পেল ৬৫। তার মানে সে ৯৩% দক্ষ। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মনে রাখতে হবে যে, ভারতীয় দলের তুলনায় তাদের সামর্থ্য কিছুটা কম, কিন্তু এটা দক্ষতা দিয়ে তাদেরকে পূরণ করতে হবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে সামনে এসে পড়ছে বাংলাদেশের ফাইনালে ভেঙে পড়ার কিছু ইতিহাস। যদিও আজকের ম্যাচে দুই দলই সব কিছু পেছনে ফেলে নতুনভাবেই নামবে লড়াই করতে, তবুও বারবার হেরে যাওয়া দলটির মনে একটু হলেও বিষয়টি উঁকি দেবে। একই কারণে প্রতিপক্ষকে বিষয়টি উদ্দীপ্ত করবে যে, এরা ফাইনালে চোক করে।
২.
বাংলাদেশ কি ফাইনালে চোক করেছে?
বাংলাদেশের এই পর্যন্ত ৪টি ফাইনালের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ২০০৯
জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ঘরের মাঠের ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের কমপক্ষে ফাইনালে উঠার জন্য বাংলাদেশ ফেভারিটই ছিল। কিন্তু যে জিম্বাবুয়েকে টপকে তাদের ফাইনালে যাওয়া কথা, তাদের কাছেই প্রথম ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরে যায় ৩৮ রানের ব্যবধানে। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে সাকিব আল হাসানের ৬৯ বলে অপরাজিত ৯২ রানের সুবাদে রান রেটে জিম্বাবুয়েকে টপকে ফাইনালে যায় বাংলাদেশ।
ফাইনালে শ্রীলঙ্কাই ফেভারিট ছিল। কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশ যে মাত্র ১৫২ রানে অলআউট হয়ে যাবে, সেটিও কেউ আশা করেনি। হতাশ দর্শকরা যখন ম্যাড়ম্যাড়ে একটা ফাইনাল দেখার অপেক্ষায়, তখনই শ্রীলঙ্কার তারকা ব্যাটসম্যান সনাত জয়সুরিয়া প্রথম বলেই আউট হয়ে যান।
৫০ ওভারে ১৫৩ রানের লক্ষ্যমাত্রা সেই শ্রীলঙ্কার পক্ষে দুজন ব্যাটসম্যান কম নিয়ে খেললেও জিততে পারার কথা। আঘাতটা তাই সামান্য একটা উল্লাসের উপলক্ষ্য বাদে আর কিছু মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা দর্শক এবং শ্রীলঙ্কা দলকে বিস্ময় উপহার দিতে লাগল।
৮ ওভার শেষে যখন মাত্র ৬ রানে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট পড়ে গেল, তখন বাংলাদেশ জয়ের সুবাস পেতে শুরু করল। একটা পর্যায়ে স্কোর দাঁড়ালো ৫১ রানে ৬ উইকেটে। তারপর কিছুটা জুটি গড়ে উঠলেও ১১৪ রানে অষ্টম উইকেট পড়ার পর বাংলাদেশই সেই মুহূর্তের ফেভারিট ছিল। কিন্তু হুট করে বোলার মুরালিধরনের ১৬ বলে দুই ৬ আর চার ৪ এ অপরাজিত ৩৩ রানের একটা ক্যামিও বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিল।
হয়তো ভাগ্যের কাছেই হেরে গেল বাংলাদেশ।
এশিয়া কাপ ২০১২
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচটিতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ হারে ২১ রানে। কিন্তু এর পরের দুটো ম্যাচেই যথাক্রমে তারা ভারত আর শ্রীলঙ্কাকে হারায় রান তাড়া করে। এর মাঝে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে বাংলাদেশ তাড়া করেছিল ২৮৯ রান।
ফাইনালের সব কিছুই বাংলাদেশের মন মতোই হচ্ছিল। টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়া, ইনিংসের শেষ ওভারে ১৯ রান সত্ত্বেও পাকিস্তানকে মাত্র ২৩৬ রানে আটকে দেওয়া। পুরো ম্যাচটিতে একটি মূহুর্তেও মনে হয়নি যে বাংলাদেশ হারতে পারে, এমনকি শেষ ওভারে যখন ৯ রান প্রয়োজন হলো, তখনও মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ জিতবে। কারণ, ক্রিজে তখনও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উপস্থিত।
প্রথম বলে রিয়াদ ১ রান নেওয়ার পরের বলে লেগ বাই থেকে আসলো আরও এক রান। তৃতীয় বলে রিয়াদ রান নিতে পারেননি, এরপর করতে হতো ৩ বলে ৭ রান। চতুর্থ বলে ২ রান হয়, কিন্তু ওভার থ্রোর কারণে তিন রান হলো। বাকি রইল ২ বলে ৪ রান। কিন্তু ভুলটা হয়ে গেল রিয়াদ স্ট্রাইক হারিয়ে ফেলায়। পরের বলে যখন আবদুর রাজ্জাক বোল্ড হয়ে গেলেন, তখন আর রিয়াদের স্ট্রাইকে ফেরার উপায় নেই। শেষ বলে যখন ৪ রান প্রয়োজন এবং স্ট্রাইকে শাহাদাত হোসেন, সেই একটি মূহুর্তেই পাকিস্তানকে ম্যাচের ফেভারিট মনে হলো। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি বাংলাদেশ হারল মাত্র ২ রানে।
এশিয়া কাপ ২০১৬ (টি২০ ফরম্যাট)
ঘরের মাঠে হওয়া এই টুর্নামেন্টে পাকিস্তান, শ্রীলংকা আর আরব আমিরাতকে হারিয়েই বাংলাদেশ ফাইনালে উঠে এসেছিল। কিন্তু ফাইনালে ভারতই ফেভারিট ছিল, সেটা শুধু গ্রুপ পর্বে ৪৫ রানের ব্যবধানে ভারতের কাছে হারার কারণে নয়, বরং রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, শেখর ধাওয়ান, ধোনির সমন্বয়ে দলগত শক্তির দিক থেকেও ভারত যথেস্ট এগিয়ে ছিল। ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে ১৫ ওভারে ১২০ রানের মোটামুটি একটা স্কোর করে বাংলাদেশ। বিপরীতে ভারত সেটা টপকে যায় ১৩.৫ ওভারেই মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে।
ত্রিদেশীয় সিরিজ ২০১৮
জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশকে নিয়ে গড়া এই টুর্নামেন্টের ফেভারিট ছিল বাংলাদেশই। দুর্বল জিম্বাবুয়ে কিংবা অনভিজ্ঞ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের সামনে তেমন বাধা হয়ে উঠতে পারবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিল। প্রথম তিন ম্যাচে জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ তার ফেভারিট হওয়ার বিষয়টির যথার্থ প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছিল। ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হারটাকে তাই কেউ বড় করে দেখেনি। কিন্তু ফাইনালে আবার বাংলাদেশ হেরে গেল ৭৯ রানের বড় ব্যবধানে।
সামর্থ্যের কমতিটাকে দক্ষতা দিয়ে পূরণ করে দিল শ্রীলঙ্কা, আর বাংলাদেশকে উপহার দিল আরেকবার হতাশা।
৩.
এতক্ষণ বলা ফাইনালে হারের ইতিহাসগুলো যদি হতাশার ইতিহাস হয়, তাহলে এর বিপরীতে আশাজাগানিয়া কিছু বিষয়ও আছে। প্রথম বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ এর আগে যে ম্যাচগুলো হেরেছিল, সেগুলোর একটা ফাইনাল বাদে সবই ছিল একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ভারতের বিপক্ষে ফাইনালটি হবে অন্য ফরম্যাটে। ফরম্যাট যত ছোট হবে, তুলনামূলক দুর্বল দলের জেতার সম্ভাবনা ততটাই বেশি থাকে। ঠিক এই কারণেই টেস্ট ম্যাচের তুলনায় ওয়ানডে ম্যাচে অঘটনের পরিমাণ বেশি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ওয়ানডেতে বাংলাদেশ কেবলমাত্র ৩টি ফাইনাল হেরেছে। অতীতের অনেক দলই ওয়ানডেতে আরো বেশি ফাইনাল খেলার পর টুর্নামেন্ট জিতেছে। নিচের তালিকাটিতে একটু লক্ষ্য করা যাক।
৪.
ফাইনাল হারের রেকর্ডের সাথে সাথে আরেকটি অশুভ রেকর্ডও বাংলাদেশকে ম্যাচ শুরুর আগে খানিকটা পিছিয়ে দেবে। এখন পর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে সাতটি টি-২০ খেলা হলেও একটি ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা না চাইলেও সিন্দবাদের ভুতের মতো তাদের উপর চেপে থাকবে। তাছাড়া আইপিএল এর সৌজন্যে এই ফরম্যাটে বিশ্বের সবচেয়ে চৌকস দল বলে ফেলা যায় ভারতকেই।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলা, তাদের বিপক্ষে আগের কোনো ম্যাচই জিততে না পারা, আগের ফাইনালগুলোর ব্যর্থতার চাপ- এতগুলো নেতিবাচক বিষয়কে এড়িয়ে যদি বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে কিছুটা অস্বাভাবিকই বলা লাগবে। তবে বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত যা করেছে, সেটাতেই সমর্থকরা খুশি। টুর্নামেন্ট না জিততে পারলেও এর জন্য মন খারাপ হবে বলে মনে হয় না।
ফাইনালের মতো ম্যাচে না চাইলেও যেকোনো খেলোয়াড় চাপে থাকেন। তবে সেই চাপটা যেন প্রেশার কুকার হয়ে তার স্বাভাবিক খেলাটাকে নষ্ট করে না দেয়, সেদিকেই দৃষ্টি দেওয়া উচিত। ফাইনালে টাইগারদের উচিত চাপটা মাথা থেকে সরিয়ে ম্যাচটি উপভোগ করা। হার-জিত নিয়ে চিন্তা না করে ম্যাচে মনোনিবেশ করা।
গত ম্যাচে যে লড়াকু মনোভাবটা বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা দেখিয়েছেন, সেটুকু দেখিয়ে ম্যাচ হেরে গেলেও সমর্থকেরা খুব বেশি কষ্ট পাবে বলে মনে হয় না। আর যদি জিতে যায়, তাহলে সেটা বোনাস।
ফিচার ইমেজ: BCB