মিশেল মার্শ। অস্ট্রেলিয়ার এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার গত কয়েক বছরে দলের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। ২০১১ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হলেও সেই সময়ে নিজেকে ঠিক নিয়মিত করতে পারেননি। ২০১৬ সালে শেষবার জাতীয় দলের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, কিন্তু ওয়ানডে আর টেস্টে নির্বাচকদের পছন্দের তালিকাতেই থাকছেন তিনি। মার্শ যখন দুবাইতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ব্যস্ত, সেখানে থাকতেই ক্রিকবাজের কাছে এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্যারিয়ার, দল ও কিভাবে স্রেফ ইয়োগা তাকে বদলে দিয়েছে, তা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দীর্ঘদিন স্পিন বলের সামনে তার যে একধরনের ‘অ্যালার্জি’ ছিল, সেটা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন তা নিয়েও বলেছেন অনেক কথা। সর্বোপরি, সাবেক কোচ ড্যারেন লেহম্যান ও বর্তমান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার দুজনের শক্তির দিক নিয়ে আলাপ করেছেন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য মার্শের সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
দুবাইতে প্রথম টেস্টে একেবারেই সুবিধা করতে পারেননি। দ্বিতীয় টেস্টকে সামনে রেখে কী পরিকল্পনা?
সবসময় যদি ব্যাটিংয়ে সুবিধা করতে না পারেন, তাহলে আপনাকে হতাশ তো হতেই হবে। কিন্তু ক্রিকেটে এগুলো হলেও খুব দ্রুত আপনাকে সামলে নিতে পারতে হবে। আমার জন্য প্রথম টেস্টে ভালো ব্যাপার হলো, দল ম্যাচ ড্র করেছে। তো এবার সিরিজ জেতানোর আরেকটা সুযোগ আমার সামনে থাকছে, দ্বিতীয় টেস্টটা আমি ঠিক এভাবেই দেখছি। যদি ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে বলি, আগের সপ্তাহটা শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন সামনের সপ্তাহটা ভালোভাবে পার করতে চাই, মনে রাখার মতো কিছু করতে চাই।
প্রথম টেস্টে আপনি চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, সাধারণত এই পজিশনেই ব্যাট করেন। কখনও কি মনে হয়েছে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নামলে নিজের সেরাটা বের করে আনতে পারতেন?
হ্যাঁ। আমি এখন চার নম্বরে ব্যাট করছি। টেস্টে চার নম্বর পজিশনে হয়তো অভিষিক্ত কাউকে আনা হতে পারে। আমি আসলে যেকোনো পজিশনে ব্যাট করতে পারি। কিন্তু ভালো করার জন্য একটা নির্দিষ্ট পজিশন প্রয়োজন, পছন্দের জায়গা হতে হয়। আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সব ফরম্যাটে দীর্ঘদিন চার নম্বরে ব্যাট করছি, আমি মনের আনন্দে এই পজিশনে খেলি। তো আমি চাইবো জায়গাটা এখানেও (জাতীয় দলে) ধরে রাখতে।
শেষ পর্যন্ত মিশেল মার্শের ক্যারিয়ার কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
আমি কখনোই এসব নিয়ে ভাবি না। দিনের পর দিন ক্রিকেট আমাকে শিখিয়েছে বর্তমানে থাকতে, আটকে থাকতে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আগের দিনের চেয়েও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকি, নিজের খেলাটাকে আরও ভালো অবস্থানে নেওয়ার চেষ্টা করি। ক্রিকেট থেকে পাওয়া আমার সেরা শিক্ষা এটাই, বর্তমানে বাস করা।
এই মুহূর্তে কি নিজেকে আরও বেশি প্রস্তুত, আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে করছেন?
একদম! আমি অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এই অবস্থায় এসেছি। দেড় বছর আগেও ক্রিকেট নিয়ে আমার মধ্যে এই ব্যাপারগুলো ছিল না। আমি মাঠের খেলার পাশাপাশি মানসিক খেলাটাতেও (প্রস্তুতি) অনেক উন্নতি করেছি। এখন পর্যন্ত আমি আমার ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি। এখন আমি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ধারাবাহিক, অনেক বেশি প্রস্তুত। এক্ষেত্রে কোনো ফরম্যাট গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের জন্য আপনাকে হয়তো অনেক বেশি শট খেলতে হবে, কিন্তু আপনার মানসিক প্রস্তুতিটা যদি ঠিক থাকে তাহলে কোনো সমস্যা হবে না।
আপনি নেটে অনুশীলন করেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই! নেটে আমার দিকে ধেয়ে আসা বলগুলোর দিকে যখন সব মনযোগ ঢেলে দেই, তখন মাছ ধরার কথা মনে আসে। নেট অনুশীলন এমন একটা ব্যাপার, যা সব কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। গ্রেগ চ্যাপেল থেকে শুরু করে জাস্টিন ল্যাঙ্গার, সবাই এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। তো সব মিলিয়েই ম্যাচে ভালো করার পথে এটা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি মাছ ধরার কথা উল্লেখ করলেন। এটা কি অনেক আরাম-আয়েশের?
হ্যাঁ, আমি তো বাড়িতে থাকতে অনেক মাছ শিকার করি। কোথাও সফরে গেলে গিটারটা আমার সাথে থাকে। আমি গান ভালোবাসি, বাড়িতে অনেক বেশি গিটার বাজাই। নতুন নতুন টিউন শিখতে পছন্দ করি। ইদানিং অবশ্য ইয়োগা অনুশীলন শুরু করেছি।
ইয়োগা?
আসলে আমি ক্যামেরন ব্যানক্রফটের সঙ্গে এটা শুরু করেছি। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে আমি ও ব্যানক্রফট প্রতিদিন ইয়োগার প্রশিক্ষণ নেই। সময় পেলেই এটা অনুশীলন করি। সত্যি বলতে, ইয়োগা আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমার করা কাজের মধ্যে এটা সেরা। ইয়োগা আমাকে ক্রিকেট জীবনে অনেক সাহায্য করেছে। মাঠে কীভাবে নিজেকে এগিয়ে নিতে হয়, তা শিখিয়েছে। আশা করছি, আমি আরও ভালো করতে পারবো।
স্পিন বলের বিপক্ষে শেষ দেড় বছরে কতটা উন্নতি করতে পেরেছেন?
স্কট মিউলেম্যান আমার শৈশবের ব্যাটিং কোচ। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবনে তার গুরুত্ব অনেক। আমরা এখন নেটে অনেক বেশি স্পিন বল অনুশীলন করি। অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু এই কাজটা সাধারণত খুব একটা করা হয় না। কারণ আমরা এমন ঝামেলাতে খুব একটা পড়িও না। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে স্পিন বল খুব একটা টার্ন করে না, সেদিক থেকে এখানে স্পিন বল খেলা অনেকটা সহজ।
সত্যি বলতে আমি স্পিন বলের বিপক্ষে অনেক কাজ করেছি, বিশেষ করে ফুটওয়ার্ক নিয়ে। আমি আশাবাদী, এই পরিশ্রমগুলো আমাকে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটেও সুবিধা করতে সাহায্য করবে। আমি জানি কোন কোন জায়গায় আমাকে উন্নতি করতে হবে, ভালো করতে হবে।
যদিও কোচ হিসেবে আপনাদের সঙ্গে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের কেবল শুরু; তারপরও ড্যারেন লেহম্যান ও ল্যাঙ্গারের মধ্যে কোচ হিসেবে কী ধরনের পার্থক্য দেখেন?
তারা দুজনে একেবারে আলাদা ঘরানার। বুফ (লেহম্যান) আমাদের নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করতেন। ক্রিকেটারদের সত্যিই খুব ভালোবাসতেন, আমাদের জন্য সবকিছু করতেন। ল্যাঙ্গারও আমাদের নিয়ে পরিকল্পনা করেন। পাশাপাশি তিনি তার খেলোয়াড়দের কাছ থেকে প্রতিটি সেশনে সেরা পারফরম্যান্সটা বের করে আনতে চান। তিনি চান, আমরা যেন প্রতি মুহূর্তে কঠোর পরিশ্রম করি এবং যেকোনো পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখি। তার মানে এই নয়, একই জিনিস লেহম্যানও চাইতেন না। আমার চোখে, লেহম্যান সর্বকালের সেরা কোচদের মধ্যে একজন। আমি অবশ্যই তাকে ভালোবাসি। আসলে দুই কোচ কাজের ধরনের কারণে আলাদা। জাস্টিন ল্যাঙ্গার এখনও অতটা সময় পাননি, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় সময়ই সব বলে দেবে।
আপনার বোলিংয়ের অবস্থা কেমন এখন?
একজন বোলারের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, আমি এখন অনেক ফিট। আশা করি, এই কন্ডিশন আমার বোলিং স্টাইলে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিন্তু আমাদেরকে যার যার কাজটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনশেষে আমি সেটাই শতভাগ সফল করার চেষ্টা করবো। সত্যি বলতে আমি একজন ‘জেনুইন’ অলরাউন্ডার হওয়ার চেষ্টা করছি, যে কি না দলের প্রয়োজনে টেস্টের প্রতিদিনে ২০ ওভার বল করতে পারবে।
শেন ওয়াটসন অস্ট্রেলিয়া দলের অন্যতম অলরাউন্ডার যিনি বারবার ইনজুরিতে ভুগেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের অনুশীলন পদ্ধতি বদলে ফেলেছেন। আপনার কি তেমন কিছু করতে হয়েছে?
আমার শারীরিক অবস্থানের দিক থেকে আমার শরীরে এখনও অনেকটা গ্রোথ বাকি আছে। আমি এখনও আরও ফিট হওয়ার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু ইয়োগা আমাকে ব্যক্তিগতভাগে অনেক বদলে দিয়েছে, আমার মানসিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
শেষ প্রশ্ন, আগামী এক বছর আপনার ও আপনার দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমরা দল হিসেবে কথা বলেছিলাম। আমরা প্রতিটা সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলি, যেটা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আপনি হয়তো সামনের ১ বছর নিয়ে কিছুই ভাবতে চাইবেন না। তারপরও খানিকটা রোমাঞ্চ আপনার মধ্যে থাকবেই, কারণ আসছে গ্রীষ্মে আপনি সেরা কিছু দলের বিপক্ষেই মাঠে নামছেন।